“স্যার, খদ্দের এসেছে। একটু দেখে আসব? কানে ইয়ার ফোন আছে, স্যার, আপনার কথা শুনতে পাব।” নিজেকে আন-মিউট করে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে মুজাফ্‌ফর তার মাস্টার মশাইয়ের অনুমতি চেয়ে নিল। কয়েকজন খদ্দের দাঁড়িয়ে আছেন বটে তার ঠ্যালাগাড়ির সামনে। সবজি কিনতে এসেছেন তাঁরা। “টাটকা, তাজা সবজি… সবজি…” বলে আরও একবার হেঁকে নিয়ে সে আবার নিজের স্মার্টফোনে চলতে থাকা বিজ্ঞানের ক্লাসঘরে ঢুকে পড়ল।

আজ ১৫ই জুন মুজাফ্‌ফর শেখের অনলাইন ক্লাসের প্রথম দিন। “সারাক্ষণই গাড়ির আওয়াজ, খদ্দেরদের দরাদরি শুনতে পাচ্ছি পেছনে। বুঝতে পারছি না কোনটায় মন দেব, - ক্লাসে, নাকি সবজি বেচায়,” বলল ১৪ বছর বয়সী, ক্লাস এইটের ছাত্র মুজাফ্‌ফর। তার ঠ্যালাগাড়িতে সাজানো বেগুন, বিট, শসা, বাঁধাকপি, আর আরও কিছু তরকারি। উত্তর মুম্বইয়ের মালাডের মালওয়ানি চত্বরে সে সকাল ১০টা থেকে বসে সবজি নিয়ে, এবং সেই সঙ্গে সে অনলাইনে ক্লাসেও ‘পড়ে'।

মুজাফ্‌ফর এক বন্ধুর কাছ থেকে রোজ কয়েক ঘণ্টার জন্যে তার ফোন ধার চেয়ে নিয়ে ক্লাস করে। তার নিজের স্মার্টফোন নেই। “এই একই সময়ে, আমার দাদা মুবারকেরও ক্লাস চলছে। সে তার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ক্লাস করে। বাবা কাজে গেছে। আমি তো আর দোকান বন্ধ করে দিতে পারি না। তিন মাস পরে এই সবে ১০ তারিখ থেকে কাজ শুরু করতে পেরেছি।”

ইসলাম, ছেলেটির বাবা, আরেকটি ঠ্যালাগাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন জানুয়ারি মাসে। পরিবারের খরচা বেড়েই যাচ্ছিল, তাই রোজগারের আরেকটা উপায় না হলে আর চলছিল না। ইসলামের বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়। তিনি ট্রাক ড্রাইভারের খালাসি হিসাবে কাজ করতেন কিন্তু চাকরিটা ছেড়ে দিলেন কারণ রোজগার বড়ই কম ছিল (এই জুন মাসে অবশ্য আবার সেই চাকরিতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে)। ছেলেটির মা, ৩৫ বছর বয়সী মোমিনা, চুলের ক্লিপ বানান আর সেই সঙ্গে টুকটাক ম্যাক্সি সেলাই করেন। সাতজনের এই পরিবারে আছে ২ বছরের হাসনাইন, ও দুই মেয়ে, ক্লাস সেভেনের ছাত্রী ১৩ বছরের ফারজানা এবং ১২ বছরের আফসানা, ক্লাস সিক্সের ছাত্রী।

কিন্তু এই ঠ্যালা কেনার পরে সবে দুই মাস হয়েছে কি হয়নি, মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে লকডাউন শুরু হয়ে গেল। সদ্য শুরু হওয়া ব্যবসার পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হল। “আব্বাই তো ঠ্যালাটা নিয়ে বাজারে যেত।” সে আর তার ১৭ বছরের দাদা মুবারক সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা অবধি স্কুলে থাকত। স্কুল থেকে ফিরে দাদা আর ভাইয়ে মিলে বাবাকে সাহায্য করত সবজির দোকানে।

Mubarak Sheikh and his brother Muzzafar (in white) have been trying to juggle attending online classes and selling vegetables on a handcart
PHOTO • Jyoti Shinoli
Mubarak Sheikh and his brother Muzzafar (in white) have been trying to juggle attending online classes and selling vegetables on a handcart
PHOTO • Jyoti Shinoli

অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সবজি বিক্রি করে পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টা করে চলেছে মুবারক শেখ আর তার ভাই মুজাফ্‌ফর (সাদা শার্টে)

মোমিনা বলছিলেন, “গতবছরের আগেও আমাদের পরিবারের রোজগার মাসে ৫০০০ টাকার বেশি হত না। অনেক দিনই তখন আমাদের পাড়া-পড়শি  বা আত্মীয়দের সাহায্য নিতে হয়েছে।” পাড়ার এক পরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে মোমিনা একটা  সেলাই মেশিন পেলেন, তখনই তিনি ম্যাক্সি সেলাইয়ের কাজ ধরলেন। চুলের ক্লিপের কাজটার পাশাপাশি এর থেকেও অল্প কিছু রোজগার আসতে শুরু করল - মাসে মোটামুটি হাজার টাকা। কিন্তু লকডাউন শুরু হলে সেই রোজগারও বন্ধ হয়ে গেল। “মুদির দোকানের খরচ, বিজলির বিল, জলের খরচ, স্কুলের মাইনে, সবকিছু টানতে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাই সবজির ঠ্যালা দিলাম। কিন্তু সেটাও এই লকডাউনে ধ্বংস করে দিল।”

এই শেখদের মতো, ভারতবর্ষের অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে দৈনিক মজুরির উপর টিকে আছে। লকডাউনের ফলে সেই রোজগারটুকুও বন্ধ হয়ে যায়। “ছোটো ছোটো ব্যবসাদার, হকার ও দিনমজুররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এপ্রিল মাসের এই লকডাউনে। যে ১২ কোটি ১৫ লক্ষ মানুষের চাকরি গেছিল এপ্রিল মাসে, তাঁদের মধ্যে ৯ কোটি ১২ লক্ষ মানুষ এই শ্রেণির,” লিখেছিল সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (CMIE) তাদের ২০২০ সালের অগস্ট মাসের এক প্রকাশনায়।

লকডাউনের সময় শেখরা দেখলেন যে তাঁদের মতো অনেকেই গ্রামে ফিরে গেল। তাঁরাও ফিরে যাবেন বলেই ঠিক করেছিলেন। কাজের খোঁজে উত্তরপ্রদেশের বাহরাইচ জেলার বালাপুর গ্রাম থেকে মুম্বই এসেছিলেন তাঁরা ১৯৯৯ সালে। পেশায় তাঁরা ছিলেন খেতমজুর। নিজেদের কোনও জমি নেই। মোমিনা বলছিলেন, “আমরাও ভেবেছিলাম ফিরে যাব, কিন্তু কোনও ট্রেন বা বাসের টিকিট পাচ্ছিলাম না। তারপর খবর আসতে লাগল অ্যাক্সিডেন্টের। যারা পায়ে হেঁটে ফিরছিল, যারা টেম্পোতে করে ফিরছিল, তারা অনেকেই পথ দুর্ঘটনায় পড়ছিল। আমরা সেই ঝুঁকি নিতে চাইনি, তাই ভাবলাম থেকেই যাই। আস্তে আস্তে যদি অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে যায়, তাহলে হয়তো আমরা আবার কাজ পাব।”

বাবা মা দুজনেই কাজে বেরিয়ে যান বলে মুজাফ্‌ফর আর মুবারক সবজির ব্যবসাটা সামলানোর চেষ্টা করে। এপ্রিল মাসে, কারফিউ আর লকডাউনের ফাঁকে ফাঁকে দুজনে সবজি বিক্রি করেছে। মুজাফ্‌ফর জানালো, “আমাদের পাড়ার বাজারে ভিড় সামলানোর সময়ে হাবিলদারের লাঠির ঘা পড়েছিল একবার মুবারকের কনুইয়ে। তারপরের একটা মাস আমরা অন্য আরেকজনের সবজির ঠ্যালায় কাজ করি। মে মাসটা এই কাজ করে আমরা দিনমজুরি বাবদ পেতাম মাথা পিছু ৫০ টাকা করে।”

জুন মাসে, যখন লকডাউন কিছুটা শিথিল হল, তারা আবার ঠ্যালা ভাড়া করে সবজি বিক্রি করতে শুরু করল। ঠ্যালা আর টেম্পোর ভাড়া মেটানোর পরে তাদের দুজনের মিলিয়ে মাসে ৩০০০ -৪০০০ টাকা রোজগার থাকে।

'We have one simple mobile. So we borrowed khala’s mobile', says Mubarak, here with his mother Momina (who stitches gowns and makes hairclips for an income) and sister Afsana
PHOTO • Jyoti Shinoli
'We have one simple mobile. So we borrowed khala’s mobile', says Mubarak, here with his mother Momina (who stitches gowns and makes hairclips for an income) and sister Afsana
PHOTO • Jyoti Shinoli

আমাদের শুধু একটাই খুবই সাদামাটা মোবাইল আছে আমরা তাই খালার মোবাইলটা ধার নিই ,’ বল ল মুবারক ছবিতে সে , তার বোন আফসানা আর তা দে র মা মোমিনার ( যিনি ম্যাক্সি সেলাই করে আর চুলের ক্লিপ বানিয়ে কিছু রোজগার করেন ) সঙ্গে বসে আছে

ততদিনে ইসলাম ট্রাক ড্রাইভারের খালাসি হিসাবে কাজটা শুরু করতে পেরেছেন আবার। আগের মতোই তিনি এখন মাসে ৪০০০ টাকা মাইনে পাচ্ছেন। মোমিনার কথায়, “ও ৯ -১০টা খেপ করে, একেকটা খেপ ২-৩ দিনের হয়। আর খেপের ফাঁকে ফাঁকে সে বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নেয়, আবার রওনা দিয়ে দেয় পরের ট্রিপে। দিন নেই রাত নেই করে কাজ করে ও।”

মোমিনাও এই একই সময়ে কাজ শুরু করতে পেরেছেন আবার, তবে মাসে কম দিন কাজ পাচ্ছেন এখন। “জুলাই থেকে আবার কাজ পেতে শুরু করেছি, কিন্তু এখন মাসে মাত্র ১০ দিনের কাজ পাই। লকডাউনের আগে মাসে প্রায় ২০ দিনের কাজ পেতাম আমি,” বললেন মোমিনা “সাপ্লায়ার বললেন বেশ কয়েকটা ফ্যাক্টরি লকডাউনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই বায়না এখন অনেক কম।”

কিন্তু এই প্রথম কয়দিন, যখন আস্তে আস্তে রোজগারপাতি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছিল, মুজাফ্‌ফর আর মুবারকের স্কুল বন্ধ ছিল। ওরা দুজনে যথাক্রমে গুরুকুল ইংলিশ হাইস্কুল ও জুনিয়র কলেজে পড়ে। বাড়ি থেকে ১ কিলোমিটার দূরে এইটি স্কুল চালায় এক এনজিও। ৯২৮ জন পড়ুয়াকে নিয়ে কেজি ক্লাস থেকে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি পড়ানো হয় এখানে। স্কুলে ক্লাস আবার শুরু হল জুন মাস থেকে, আর এবার তো অনলাইন ক্লাস।

“আমাদের শুধু একটাই খুবই সাদামাটা মোবাইল আছে। আমরা তাই খালার কাছ থেকে তাঁর মোবাইলটা ধার করে আনি।” কিন্তু একটা ধার করা মোবাইলে কি আর চার ভাইবোনের কুলোয়! বিশেষ করে যখন তাঁদের সবার ক্লাস একসঙ্গেই চলতে শুরু করে। ছোটো দুই বোন ফারজানা আর আফসানা বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দুরে আম্বুজওয়াড়ির ম্যুনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের এম.এচ.বি. উর্দু স্কুলে পড়াশোনা করে। তারা অনলাইন ক্লাস করার জন্যে এক বন্ধুর বাসায় চলে যায়।

মুজাফ্‌ফর আর মুবারক পালা করে সবজির দোকান সামলায় আর ধার করা মোবাইলটিতে অনলাইন ক্লাস করে। ওই প্রথম দিনের অনলাইন ক্লাসের সময়ের অভিজ্ঞতা এড়াতে তারা এখন তাদের আম্বুজওয়াড়ি বস্তির এক-কামরার ঘরে বসেই ক্লাস করে। অবশ্য তাতেও ক্লাসে মনোনিবেশ করা অসুবিধাজনক। দিনে তিন ঘণ্টা ক্লাস, আর ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা কাজ (শুধু শনিবারটা কাজ থেকে ছুটি মেলে)।

দুই ভাই সবজি কিনতে যাওয়ার ব্যাপারটাও পালা করে সামাল দেয়। আম্বুজওয়াড়ি থেকে নবি মুম্বইয়ের ভাসিতে এপিএমসি মাণ্ডি যেতে হয় টেম্পো ভাগাভাগি করে অন্যান্য বিক্রেতাদের সঙ্গে। আসা যাওয়া মিলিয়ে ৪০ কিলোমিটার রাস্তা। যখন তাদের আব্বা ইসলাম প্রথম ঠ্যালাগাড়ি ভাড়া নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন, তখন থেকেই তারা আসত আব্বার সঙ্গে। “রাত বারোটা নাগাদ আমরা রওনা দিই। আর ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় ফিরে আসি সবজি নিয়ে। বেশিরভাগ দিন আমিই যাই,” বলে মুজাফ্‌ফর। “মুবারক মোটেই দরাদরি করতে পারে না। তারপর সবজি ধুয়ে, ঠ্যালাগাড়িতে তাজা তরি-তরকারি সাজিয়ে আমরা সাড়ে সাতটার মধ্যে এক্কেবারে তৈরি।”
PHOTO • Jyoti Shinoli

আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমার ঠিক কি করা উচিত। ক্লাসের পড়ায় মন দেব , নাকি সবজি বিক্রি করব ,’ জুন মাসে নিজের প্রথম অনলাইন ক্লাসের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে বলে মুজাফ্‌ফর

সারা রাত্রি পাইকারি বাজারে কাটিয়ে, আবার সকাল বা দুপুরে অনলাইন ক্লাস করা যথেষ্ট কঠিন ব্যাপার। চোখ খোলা রেখে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। “চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। তখন তাড়াতাড়ি গিয়ে চোখে জল দিয়ে আসি, অথবা মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করি,” বলে মুবারক।

“ওই ভারী ঠ্যালাটা ঠেলে ঠেলে বাজারে ঘোরাও তো কঠিন। তার ওপর তাতে ১৫-২০ কিলো সবজিও থাকে। আমার তো কাঁধ টনটন করে, হাতের তালুতে জ্বালা করে। লেখার সময় ব্যথা লাগে,” মালওয়ানির সরু সরু রাস্তা দিয়ে ঠ্যালাটা ঠেলতে ঠেলতে বলে মুজাফ্‌ফর। “আমরা পালা করে করি কাজটা। আজকে মুবারকের সকালে ক্লাস। তাই আমি কাজে এসেছি। আমার ক্লাস দুপুর দেড়টা থেকে।”

ওদের স্কুলের বহু পড়ুয়াকেই এই একইরকম অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয়েছে। গুরুকুল ইংলিশ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সিপাল ফরিদ শেখ বললেন, “আমাদের প্রায় ৫০ জন পড়ুয়া স্থানীয় হোটেলে, ইমারতির কাজে বা সবজি বাজারে কাজ করে। তারা প্রায়শই বলে ক্লাসের মধ্যে তাদের ঘুম পাচ্ছে, বা ক্লান্ত লাগছে। পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।”

“মালওয়ানি, ধারাভি, মানখুর্দ ও গোভান্ডির বস্তি থেকে আসা অনেক বাচ্চাকেই লকডাউনের মধ্যে কাজ শুরু করতে হয়েছে। তাদের এখনও কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হল ঠিকঠাক ফোন না থাকায় অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে না পারা, বা বাবা-মায়ের বেকারত্ব,” জানালেন মুম্বইয়ের ‘প্রথম’ নামে যে এনজিও বস্তির বাচ্চাদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে, তার প্রধান নবনাথ কাম্বলে।

এই পড়ুয়াদের মধ্যে একজন ১৭-বছরের রোশনি খান। আম্বুজোয়াড়িতেই শেখদের বাড়ি থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে থাকে রোশনি, সে-ও গুরুকুল স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। স্থানীয় একটি কেকের দোকানে রোশনি কাজ নেয় লকডাউনের মধ্যে। এই রোজগার দিয়ে সে কিনেছে একটা হাত ফেরতা সেকেন্ড-হ্যান্ড মোবাইল ফোন, যাতে সে অনলাইন ক্লাস করতে পারে। তার বাবা সাবির ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি ও মা রুকসানা অন্যের বাড়িতে গৃহশ্রমিকের কাজ করেন। বিহারের মাধেপুরা জেলার কালোতাহা গ্রাম থেকে ১৯৭০-এর দশকে কাজের খোঁজে তার বাবা-মা এসেছিলেন মুম্বইয়ে।

Along with online school, Roshni Khan continues to work at a cake shop to support her family, including her mother Ruksana and sister Sumaira (right)
PHOTO • Jyoti Shinoli
Along with online school, Roshni Khan continues to work at a cake shop to support her family, including her mother Ruksana and sister Sumaira (right)
PHOTO • Jyoti Shinoli

অনলাইন স্কুলের সঙ্গে সঙ্গে রোশনি খান একটা কেকের দোকানে কাজ নিয়েছে কিছু রোজগার করে পরিবারকে সাহায্য করার জন্য। (ডানদিকে) মা রুকসানা আর বোন সুমায়রার সঙ্গে রোশনি

রোশনি বলছিল, “বাবার একটা খুবই সাধারণ মোবাইল ছিল। কিন্তু মার্চে সব কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে নতুন মোবাইল (স্মার্টফোন) কেনা সম্ভব ছিল না।” যে দোকানে সে কাজ করে, কেক সাজানো, প্যাকেটে ভরা আর বিক্রি করার কাজটি, সেটা আম্বুজওয়াড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলমিটার দূরে। “আমার বন্ধু আমাকে এই কাজের কথা জানিয়েছিল মার্চ মাসে,” কাছাকাছি অটোরিকশা স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রোশনি জানালো। অফিস পৌঁছতেই তার রোজ ২০ টাকা খরচ হয়ে যায়।

তার ৫০০০ টাকা মাস-মাইনে থেকে রোশনি ২৫০০ টাকা দিয়ে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড মোবাইল কেনে মে মাসের মাঝামাঝি। কাজ সে তারপরেও চালিয়ে যায়, সংসার চালাতে বাবা-মাকে খানিক সাহায্য করার মরিয়া তাগিদ থেকে।

কিন্তু এই সকাল ১১টা থেকে সন্ধে ৬টা অবধি কাজের সময়টা তার স্কুলের অনলাইন ক্লাস করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার কথায়, “সপ্তাহে ২-৩ দিন আমি দুপুরের ক্লাস মিস করি। সেই ক্লাসের পড়া আমি নিজে নিজেই করার চেষ্টা করি। যা বুঝতে পারিনা, তা টিচারের কাছ থেকে পরে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি ফোন করে।”

সাত ঘণ্টা দুইপায়ের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করার পরে রোশনি স্বাভাবিকভাবেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। সে বলছিল, “খুব ক্লান্ত লাগে, হোমওয়ার্ক শেষ করে উঠতে পারি না। একেক দিন রাতের খাবার খাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। মনে হয়, আমি তো চাকরি করছিই, তাহলে কেন আমাকে আবার পড়াশোনাও করতে হবে?”

এনজিও প্রথম-এর কর্মকর্তা নবনাথ কাম্বলে জানালেন যে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এই ধরনের মনোভাব দেখা দিচ্ছে বহু পড়ুয়ার মধ্যেই। “বস্তিবাসী যে সমস্ত পড়ুয়ারা কোনও কাজে ঢুকেছে, তাদের পড়াশোনায় আগ্রহ অনেক সময়েই কমে যায়। কিন্তু শিক্ষা থেকে দূরে থাকলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই যাবে।”

রোশনির আরও তিন ভাইবোন আছে - রিহানা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, সুমায়রা পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে, আর রিজোয়ান পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। সকলেই ম্যুনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের এমএচবি উর্দু স্কুলে পড়ে। “আমি যেহেতু মোবাইল নিয়ে কাজে চলে যাই, সবাই নিজের নিজের বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনা করে,” জানালো রোশনি।

'I feel so tired, I cannot finish homework', says Roshni. 'Sometimes I feel I already [have a job and] earn, so why do I need to study?'
PHOTO • Jyoti Shinoli
'I feel so tired, I cannot finish homework', says Roshni. 'Sometimes I feel I already [have a job and] earn, so why do I need to study?'
PHOTO • Jyoti Shinoli

‘খুব ক্লান্ত লাগে, হোমওয়ার্ক শেষ করে উঠতে পারি না। একেক দিন রাতের খাবার খাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। মনে হয়, আমি তো চাকরি করছিই, তাহলে কেন আমাকে আবার পড়াশোনাও করতে হবে?’

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ওদের বাবা-মা আবার কাজে ফিরতে পেরেছেন। তবে মাইনে এখন আগের থেকে কম। “আগে চারটে বাড়িতে কাজ করতাম, কিন্তু এখন একটাই বাড়িতে কাজ করি। অন্য বাড়িগুলোর মালকিনরা আমাকে এখনও ডেকে পাঠায়নি।” অর্থাৎ মার্চ মাসের আগে রুকসানা মাসে যে ৪০০০ টাকা আয় করতেন, সেটা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মোটে ১০০০ টাকায়।

“রোশনির বাবাও এখন মাসে মোটে ১৫ দিনের কাজ পাচ্ছেন। দিনে মেলে ৪০০ টাকা করে। কিন্তু আগে তিনি যখন মালওয়ানির শ্রমিক নাকায় যেতেন, তখন মাসে অন্তত ২৫ দিন কাজ মিলত,” রুকসানা জানালেন। এই কাজ কমে যাওয়ার ফলে, রোশনির বাড়তি রোজগার সত্ত্বেও, পরিবারের মোট আয় এখন মাসে ১৪,০০০ টাকা থেকে কমে ১২,০০০ টাকা হয়েছে।

রুকসানার কথায়, “আমাদের রোজগার বাড়েনি, কিন্তু খরচা বেড়েছে।” মুদির দোকানের জিনিসের দাম, স্কুলের মাইনে, ইলেকট্রিসিটি বিল, গ্যাসের দাম, চাল-আটার দাম সব কিছুই বেড়েছে। (পরিবারটির রেশন কার্ডও নেই। আবেদনপত্র জমা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।)

মেয়ের উপরে এই রোজগারের দায়িত্ব এসে পড়াতে রুকসানা খানিক চিন্তিত। “আমার মেয়েটা তো খুবই ছোটো, তাই চিন্তা হয়। বড্ডো বেশি দায়িত্ব পড়ে যাচ্ছে ওর উপর।”

এদিকে রোশনি প্রাণপাত পরিশ্রম করে চাকরি আর ক্লাস সামলানোর চেষ্টা করে চলেছে। যেমনটা করে চলেছে মুজাফ্‌ফর আর মুবারকও। আপাতত ৩১শে ডিসেম্বর (অন্তত) অবধি শহরের স্কুলগুলি বন্ধ থাকবে বলে নির্দেশিকা জারি করেছে বৃহন্মুম্বই ম্যুনিসিপাল কর্পোরেশন।

আরও একটা অনলাইন ক্লাসে হাজিরা দিতে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মুজাফ্‌ফর বলে, “পড়াশোনা আর রোজগার, দুটো একসঙ্গে চালাতে আপত্তি নেই আমাদের। তা সে যত সময়ই লাগুক না কেন। আর তাছাড়া এখন ক্লান্ত হয়ে পড়লেও বই নিয়ে পড়তে বসাটা একরকম অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে, তাই আগামীদিনেও ঠিকই ম্যানেজ করে নিতে পারব।”

অনুবাদ: শিপ্রা মুখার্জী

Jyoti Shinoli

ज्योति शिनोली, पीपल्स आर्काइव ऑफ़ रूरल इंडिया की एक रिपोर्टर हैं; वह पहले ‘मी मराठी’ और ‘महाराष्ट्र1’ जैसे न्यूज़ चैनलों के साथ काम कर चुकी हैं.

की अन्य स्टोरी ज्योति शिनोली
Translator : Sipra Mukherjee

Sipra Mukherjee ([email protected]) teaches at West Bengal State University.

की अन्य स्टोरी Sipra Mukherjee