“একটা ছোট্ট ভুল, আর কোয়টা না হয়ে সত্তুর হয়ে যাবে!” কাস্তে আর কসাইয়ের ছুরির মধ্যে তফাতটা ভালোই বোঝেন রাজেশ চাফেকর। মহারাষ্ট্রের আক্তান গ্রামের কামারশালায় বসে এখনও পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি লোহার সরঞ্জাম বানিয়েছেন অভিজ্ঞ এই কামার।

৫২ বছরের রাজেশ দাদা কাজ শিখেছেন বাবা দত্তাত্রেয় চাফেকরের কাছে। তাঁরা পাঞ্চাল লোহার সম্প্রদায়ের মানুষ, মহারাষ্ট্রের বহু চাষি চাষের সরঞ্জাম নেন এই সম্প্রদায়ের লোহার বা কামারদের থেকেই। “লোকে বলে, ‘আক্তান সে হি হাতিয়ার লেকে আও’ [সরঞ্জাম আক্তান থেকেই এনো],” বলছেন ভাসাই তালুকের এই সাত প্রজন্মের কামার। ২৫টিরও বেশি ধরনের আলাদা আলাদা চাষের সরঞ্জাম বানানোর বিদ্যা তাঁর করায়াত্ত।

৯০ কিলোমিটার দূরের নবি মুম্বইয়ের উরান থেকেও ক্রেতা আসত এককালে, নৌকা বানানোর সরঞ্জাম তাসনি পাইকারি হারে অর্ডার দিতে। গিরহাইক-রা [গ্রাহকরা] দিন চারেক আমাদের বাড়িতেই থাকত, শুরু থেকে শেষ অবধি সরঞ্জাম তৈরি দেখে যেত,” স্মৃতিচারণ করছেন রাজেশ দাদা।

আক্তান গ্রামের সরু সরু গলিগুলো বরাবর জাতকর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত থেকেছে: সোনার (স্বর্ণকার), লোহার (কামার), সুতার (ছুতোর), চাম্ভার (চর্মকার), এবং কুম্ভর (কুমোর)। গ্রামের মানুষ জানালেন তাঁরা বরাবর কারিগরির দেবতা বিশ্বকর্মার ভক্ত। ২০০৮ সাল থেকে পাঞ্চাল লোহারদের ‘যাযাবর জনজাতি’ তালিকায় রাখা হয়; তার আগে তাঁরা ওবিসি (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিবর্গ) তালিকায় ছিলেন।

রাজেশ দাদা জানালেন, ১৯ বছর বয়সে কামারের পারিবারিক পেশায় যোগ দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। একটা ইলেকট্রনিকস্‌-এর দোকানে কাজ সামলানোর চাকরি নিয়েছিলেন, মাসে ১২০০ টাকা মাইনে ছিল। কিন্তু বৃহত্তর যৌথ পরিবারে বচসার দরুণ কাজ চলে যায় তাঁর বাবার, আর বড়ো ছেলে হিসেবে তাঁর উপরেই দায়িত্ব এসে পড়ে পারিবারিক পেশা এগিয়ে নিয়ে চলার।

Rajesh Chaphekar, a blacksmith in Vasai taluka's Actan village with a sickle (left) made by him.
PHOTO • Ritu Sharma
He learnt the craft from his father Dattatrey Chaphekar, whose photo he is holding (right)
PHOTO • Ritu Sharma

নিজের তৈরি কাস্তে (বাঁদিকে) হাতে নিয়ে ভাসাই তালুকভুক্ত আক্তান গ্রামের কামার রাজেশ চাফেকর। বাবা দত্তাত্রেয় চাফেকরের কাছে কাজ শিখেছেন তিনি, যাঁর ফোটো হাতে ধরে আছেন (ডানদিকে)

Rajesh's workshop (left) is close to the popular Actan cross (right), which leads to the lane where only lohars once lived
PHOTO • Ritu Sharma
Rajesh's workshop (left) is close to the popular Actan cross (right), which leads to the lane where only lohars once lived
PHOTO • Ritu Sharma

রাজেশের কামারশালা (বাঁদিকে) জনবহুল আক্তান মোড়ের (ডানদিকে) কাছেই অবস্থিত। এই মোড় থেকে বেরিয়েছে যে রাস্তা তাতে এককালে শুধু কামার সম্প্রদায়ের মানুষজনই বাস করতেন

আজ তিন দশক পরে তিনি এলাকার ওস্তাদ কামার। রোজ সকাল ৭টায় কাজ শুরু, ১২ ঘণ্টা চলবে, মাঝে মধ্যে চায়ের বিরতি ছাড়া। একদিনে তিনটে সরঞ্জাম আগাগোড়া বানিয়ে ফেলতে পারেন। তাঁর নিয়মিত খদ্দেরদের মধ্যে আছেন বেনাপাট্টির আদিবাসীরা, যাঁরা মূলত ভাসাইয়ের ভুইগাঁও আর মুম্বইয়ের গোরাই গ্রামে থাকেন।

সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় যেসব সরঞ্জাম তার মধ্যে কোয়টা (ছোটো কাস্তে), মোরলি (সবজি ও মাংস কাটার ছুরি) আউট (লাঙল), তাসনি (বাটালি), কাটি (আঁশবঁটি), চিমটে, আর সাত্তুর (কসাইয়ের ছুরি) অন্যতম।

ক্রেতার প্রয়োজনমতো বিশেষ সরঞ্জামও বানিয়ে দেন রাজেশ দাদা, কারণ “প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব প্রয়োজন আছে, নকশা আছে। তাড়ি নামান যাঁরা তাঁদের কোয়টার [ছোটো কাস্তে] হাতলে বাড়তি জোর দরকার হয়, যাতে গাছে চড়ার সময়ে শক্ত করে ধরতে পারেন।” কলা আর নারকোল চাষিরা সারা বছরই সরঞ্জাম পাঠান শান দেওয়া আর মেরামতির কাজে।

“কাজের প্রতিদানে প্রচুর উফার পাই,” কাস্তে ধার দিয়ে দেওয়ার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ স্থানীয় এক নারকোল চাষির দিয়ে যাওয়া তাজা নারকোল দেখিয়ে জানালেন রাজেশ দাদা। “আঁশবঁটি মেরামত করে দিলে মাঝে মাঝে কোলি ভাইরা দিনে দিনে ধরা তাজা মাছ দিয়ে যান,” আরও যোগ করলেন তিনি।

সুদূর পুণের ওয়াঘোলি থেকেও প্রচুর বায়না আসে, যেহেতু ওই এলাকায় কামার খুব বেশি নেই। “ত্যানচে সাত্তুর আস্তাত, বকরে কাপায়লা [কসাইয়ের ছুরির অর্ডার আসে, বকরি কাটার জন্য]।”

উদ্ভাবনের নেশায় একটা বিশেষ ধরনের কাস্তে বানিয়েছেন রাজেশ দাদা, যা দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া শক্ত নারকোল কাটা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। “আমি পরীক্ষা চালিয়ে যাই। কিন্তু আপনাকে দেখাব না। আমার পেটেন্ট!” হেসে বললেন রাজেশ দাদা। ছবিও তুলতে দেননি।

Rajesh can make more than 25 different types of tools (left), many of which he innovates for his customers (right) after understanding their requirements
PHOTO • Ritu Sharma
Rajesh can make more than 25 different types of tools (left), many of which he innovates for his customers (right) after understanding their requirements
PHOTO • Ritu Sharma

২৫-এরও বেশি রকমের সরঞ্জাম বানাতে পারেন রাজেশ দাদা (বাঁদিকে), যার অনেকগুলিই ক্রেতার প্রয়োজন বুঝে সেইমতো বানানো হয় (ডানদিকে)

Sonali Chaphekar, Rajesh's wife holds a traditional morli used to cut vegetables and fruits (left).
PHOTO • Ritu Sharma
For elderly women who can't sit on the floor, Rajesh has designed a compact morli that be attached to the kitchen platform (right)
PHOTO • Ritu Sharma

ফল-সবজি কাটার সাবেক মোরলি হাতে রাজেশের স্ত্রী সোনালি চাফেকর (বাঁদিকে)। মাটিতে বসতে পারেন না যে বয়স্ক মহিলারা, তাঁদের জন্য বিশেষ এক ধরনের ছোট মোরলি বানিয়েছেন রাজেশ দাদা যা রান্নাঘরের টেবিলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়

সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সরঞ্জামের মধ্যে অন্যতম ছোটো আকারের মোরলি, ফল-সবজি কাটার একধরনের সরঞ্জাম যা রান্নাঘরের টেবিলে জুড়ে দেওয়া যায়। সাবেকি মোরলি অনেক বড়ো, মাটিতে রাখা হয়। তাই বয়স্ক মানুষজন যাঁরা মাটিতে বসতে পারেন না, তাঁদের জন্য এই ছোটো মোরলি অনেক বেশি সুবিধাজনক।

বর্ষার সময়ে চাষিরা শহরে চলে যান দিনমজুরির সন্ধানে, ফলে তখন তাঁর বিক্রিবাটাও পড়ে যায়। “মাঝে মাঝে দিনে ১০০ টাকা আসে, মাঝে মাঝে মাত্র ১০ টাকা। কোনওদিন হয়তো ৩,০০০ বা ৫,০০০ পেয়ে গেলাম, পরের দিন একদম ফাঁকা। কিছু বলা যায় না,” উপার্জনের কথা বলতে গিয়ে জানালেন রাজেশ দাদা। “গিরহাইক আনি মারান কাঢি ইয়েতিল কাই সাংতা ইয়েতা কা? [খদ্দের আর মরণ, এরা কখন এসে কড়া নাড়বে সে কী আর আগে থেকে বলা যায়?]”

*****

প্রতিদিন ঠিক সকাল ৯টায় ভাটিতে আগুন দেন রাজেশ দাদা, রবিবারেও অন্যথা নেই এই নিয়মের।

পারি যেদিন তাঁর কামারশালায় যায়, রাজেশ দাদা ভাটি গরম হওয়ার অপেক্ষা করতে করতেই স্থানীয় এক ব্যক্তি একটা আলু নিয়ে এসে হাজির। কেউ কোনও কথা বলেন না। রাজেশ দাদা আলুটা নিয়ে ভাটির এক প্রান্তে পুঁতে দেন। “কয়লা-পোড়া আলু খেতে ভালোবাসে খুব, ঘণ্টাখানেক পর এসে নিয়ে যাবে,” জানালেন রাজেশ দাদা।

অল্পক্ষণের মধ্যেই দিনের প্রথম খদ্দের উপস্থিত। রাজেশ দাদাকে চারটে কাস্তে ধরিয়ে দেন শান দেওয়ার জন্য। একটু থেমে রাজেশ দাদা জিজ্ঞেশ করে নেন, “খুব তাড়া নেই তো?” খদ্দের তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, কয়েক দিন পর এসে নিয়ে যাবেন।

“কী করব, জিজ্ঞেস করতেই হয়। আমার সঙ্গে তো আর কেউ নেই,” বলছেন রাজেশ দাদা।

দিনের বায়না আসা শুরু হয় পর পর, রাজেশ দাদা নিজের কাঁচামাল গোছাতে লেগে পড়েন। এই কাজটা আগে করে রাখা জরুরি, কারণ ভাটি পুরোপুরি গরম হয়ে গেলে সবকিছু প্রস্তুত থাকা দরকার। একটা বড়ো পাত্রে ৬ থেকে ৮ কেজি কয়লা নিয়ে হাতে করে সেগুলো বাছতে আরম্ভ করেন তিনি। “ছোটো পাথর থাকলে কয়লা ধীরে জ্বলে,” জানালেন তিনি, তাই ভাটিতে দেওয়ার আগে ছোটো পাথরগুলো বেছে ফেলে দেওয়া দরকার।

Rajesh removing small stones from the coal (left).
PHOTO • Ritu Sharma
He adds small strands of wood shavings (right) to ignite the forge
PHOTO • Ritu Sharma

কয়লা থেকে ছোটো পাথর বেছে বার করছেন রাজেশ দাদা (বাঁদিকে)। পাতলা পাতলা কাঠের টুকরো (ডানদিকে) মিশিয়ে দেন যাতে আগুন ঠিক করে ধরে

The raw metal (left) is hammered and shaped on the airan (metal block). It is periodically placed inside the forge for ease of shaping
PHOTO • Ritu Sharma
The raw metal (left) is hammered and shaped on the airan (metal block). It is periodically placed inside the forge for ease of shaping
PHOTO • Ritu Sharma

কাঁচা ধাতুর তাল (বাঁদিকে) আইরান-এ (নেহাই বা ধাতব পাটাতন) রেখে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আকার দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর পর একবার করে ভাটিতে ঢুকিয়ে নেওয়া হয় নরম করার জন্য

অভিজ্ঞ কামার এরপর দ্রুত হাতে কয়লার উপরে একগোছা পাতলা কাঠের পাত রেখে দেন যাতে ভাটিতে আগুন দ্রুত লাগে। ভাটির ভিতর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে কাজে লাগে ভাটা নামে এক সরঞ্জাম (হাপর), আগেকার দিনে এটাকে ধামনি বলা হত। ভাটির ভিতরে হাওয়ার গতিও নিয়ন্ত্রণ করে এই হাপর, আর দরকার মতো ভাটিতে হাওয়া ঢুকিয়ে দেয় যাতে আঁচ গনগনে থাকে।

সব সরঞ্জামের মূল উপাদান যে কাঁচা ধাতু সেটাকে প্রথমে পাঁচ-সাত মিনিট ভাটিতে ঢুকিয়ে রাখা হয় গরম করার জন্য। তারপর সেই গনগনে গরম ধাতুর তাল রাখা হয় বিরাট আইরানের (নেহাই) উপর। কয়েক সেকেন্ড ধাতুর তালটাকে উলটো করে রেখেই দ্রুত হাতে পর পর ঘান বা হাতুড়ির বাড়ি মারেন তাতে। “ধাতু ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই এটা করে নিতে হবে, নইলে আকার বিগড়ে যেতে পারে,” ব্যাখ্যা করেন রাজেশ দাদা।

রাজেশ দাদা ছোটো একটা হাতুড়ি নিয়েছেন, তাঁর ছেলে ওম নিয়েছেন বড়ো হাতুড়িটা। দু’জনে মিলে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দফায় দফায় ধাতুর তালটাকে গরম করা আর হাতুড়ি মারার কঠিন প্রক্রিয়াটা চালালেন যতক্ষণ না সেটা তাঁদের পছন্দমতো আকার নিচ্ছে। আকার ঠিক হলে তারপর গোলাকৃতি স্টিলের মণ্ডল দিয়ে কাঠের নিম্নাংশের সঙ্গে সেটাকে জোড়া হবে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ হল কাঁচা ধাতুকে সমান করা। রাজেশ দাদা একটা ৮০ বছরের পুরনো শান পাথর ব্যবহার করেন সরঞ্জামে ধার দেওয়ার জন্য। শেষে বাবার দেওয়া ফাইল করার মোগরি দিয়ে হাতে-গড়া সরঞ্জামটায় ‘ফিনিশিং টাচ’ দেন তিনি।

কামারশালা সারাক্ষণই ধোঁয়ায় ভরে থাকে, তবে তাতে রাজেশের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। “আঁচের গরমটা আমি পছন্দ করি। মজ্জা আতা হ্যায় মেরেকো [আমার বেশ লাগে]।” ভাটির সামনে বসে থাকা ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠলে খালি দুই পায়ে জল ছিটিয়ে নেন।

Left: Rajesh shaping his tools using a small hammer.
PHOTO • Ritu Sharma
Right: His son Om helps out in the workshop
PHOTO • Ritu Sharma

বাঁদিকে: ছোটো হাতুড়ি দিয়ে সরঞ্জামে আকার দিচ্ছেন রাজেশ দাদা। ডানদিকে: ছেলে ওম কামারশালায় হাত লাগান

The veteran blacksmith is almost done shaping the sickle (left).
PHOTO • Ritu Sharma
The last step is to attach the maandal (steel circular ring) and wooden base to it (right)
PHOTO • Ritu Sharma

কাস্তের আকার দেওয়ার কাজ প্রায় সেরে এনেছেন অভিজ্ঞ কামার (বাঁদিকে)। শেষ ধাপ হল সেটায় মণ্ডল (স্টিলের গোলাকৃতি রিং) আর কাঠের তলদেশটা জোড়া (ডানদিকে)

স্থানীয় এক ইউটিউবারের তোলা তাঁর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর প্রবাসী ভারতীয়দের থেকেও অর্ডার পেতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু এই সরঞ্জামগুলো হাতিয়ার হিসেবে ধরা হয় বলে বিদেশে পোস্ট করতে পারেননি। এখন অস্ট্রেলিয়া থেকে খদ্দেররা নিজে ভারতে এসে মাংস কাটার ছুরি নিয়ে যান তাঁর থেকে।

তাঁর অনুরাগী খদ্দের অনেকেই আছেন, কিন্তু তাঁর সমস্যা হল অর্ডার শেষ করা – তাঁর লোকবল নেই। “খদ্দেরকে তো আর বলতে পারি না যে কাল এস,” বলছেন রাজেশ দাদা।

তাঁর সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন মুম্বই আর থানের কাছাকাছি বাসা নিয়েছেন; রেলওয়ের চাকরি, ছোটোখাটো ব্যবসা ইত্যাদিতে কাজের সুযোগ বেশি সেখানে: “কী আর করব, চাষের জমিই তো আর নেই।” ৩০ বছর আগে তাঁর গলিতেই ১০-১২টা কামারশালা ছিল, স্মৃতিচারণ করছেন রাজেশ দাদা। “আটা দোনাচ রাহিলে! [এখন মাত্র দুটো আছে!]” রাজেশ দাদা ছাড়া তাঁর সম্প্রদায়ের আর একজনই কামার আছেন, তিনি তাঁরই তুতো ভাই। রাজেশের স্ত্রী সোনালি পেশায় শিক্ষিকা, স্বামী যে কামারের পেশায় রয়ে গেছেন তাতে তিনি গর্বিত। “আজকাল সবাই ফোকটে পয়সা কামায়। ভাটিতে বসে ঘান [হাতুড়ি] পেটাতে আর কে চায়?” বলছেন তিনি।

তাঁদের ২০ বছরের ছেলে ওম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। “আমি ওকে সবসময় বলি শনি-রবিবার আমার সঙ্গে হাত লাগাতে। এটা আমাদের কাজ; এই কারগরি হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়।” রাজেশ দাদা আরও চান যে তিনি চলে গেলে ছেলে যেন তাঁর সরঞ্জামগুলো বাঁচিয়ে রাখে। “আমার কাছে এখনও বাপ-ঠাকুরদার সরঞ্জাম আছে। হাতুড়ি কীভাবে পড়েছে সেটা দেখে বোঝা যায় কে বানিয়েছে। সবার হাতুড়ি পেটানোর ধরন আলাদা আলাদা।”

The lohar adds final touches to the sickle (left) and puts it inside the forge (right)
PHOTO • Ritu Sharma
The lohar adds final touches to the sickle (left) and puts it inside the forge (right)
PHOTO • Ritu Sharma

কাস্তেয় ফিনিশিং টাচ দিয়ে (বাঁদিকে) ভাটির ভিতরে ঢোকাচ্ছেন (ডানদিকে) অভিজ্ঞ কামার

Rajesh sharpens (left) and then files (right) the newly crafted tools before they are handed over to the customer
PHOTO • Ritu Sharma
Rajesh sharpens (left) and then files (right) the newly crafted tools before they are handed over to the customer
PHOTO • Ritu Sharma

সদ্য তৈরি সরঞ্জামে প্রথমে ধার দিয়ে (বাঁদিকে), তারপর শান দিয়ে (ডানদিকে) তবেই খদ্দেরের হাতে দেন রাজেশ দাদা

ভাটি চালানোর জন্য রান্না-ব্যতীত অন্য কাজের কয়লা জোগাড় করা ক্রমেই আরও খরচসাপেক্ষ হয়ে উঠছে: ২০২৩ সালে উচ্চমানের কয়লার দাম ৮ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে কোল ইন্ডিয়া। “আমি যখন কাজে নামি [৩২ বছর আগে], তখন কয়লার দাম ছিল ৩ টাকা প্রতি কিলো। এখন সেটা ৫৮ টাকা কিলোপ্রতি হয়ে গেছে,” জানালেন তিনি।

প্রতিদিনের কয়লার খরচ পুষিয়ে ওঠা তাঁর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। একটা কাস্তে ৭৫০ টাকায় বেচেন তিনি। এই কাস্তে বানাতে তাঁর ধাতুর তাল লাগে ২-৩ কিলো, ১২০-১৪০ টাকায় পাওয়া যায়। সেই ধাতুকে আকার দিতে কয়লা পোড়ে অন্তত ছয় কিলো। সরঞ্জামের কাঠের তলদেশের দাম পাইকারি হারে কিনলে ১৫ টাকা প্রতি পিস, খুচরো কিনলে ৬০ টাকা অবধিও দাম উঠতে পারে।

“হিসেবটা কষে বলুন দেখি আমার হাতে কত রইল?”

কয়লার ক্রমবর্ধমান দামের সঙ্গে যোগ হয়েছে এই পেশার সহযোগী অন্যান্য পেশা-সম্প্রদায়ের মানুষজনের চলে যাওয়া। এককালে ছুতোর আর কামাররা পরস্পরকে সাহায্য করতেন দাম কম রাখার জন্য। “আগে খয়ের কাঠ ব্যবহার করতাম, এখন যে বাবুল কাঠ পাই তার চেয়ে বেশি দামি। কিন্তু ছুতোররা জঙ্গলে গেলে আমাদের জন্য খয়ের কাঠ নিয়ে আসত। প্রতিদানে আমরা ওদের গরুর গাড়ির চাকার ধাতব ব্যান্ড আর বক্সিং বানিয়ে দিতাম। এভাবে আমরা পরস্পরকে সাহায্য করতাম।”

Left: The blacksmiths would help carpenters by making the circular bands that hold the wheels of the bullock cart together.
PHOTO • Ritu Sharma
Right: Rajesh holding the finishing sickle made by him
PHOTO • Ritu Sharma

বাঁদিকে: গরুর গাড়ির চাকার ধাতব গোলাকার ব্যান্ডগুলো বানিয়ে দিয়ে ছুতোরদের সাহায্য করতেন কামাররা। ডানদিকে: নিজের বানানো কাস্তে হাতে রাজেশ দাদা

আগুন আর ধাতু নিয়ে কাজে চোট-আঘাতের ঝুঁকি আছেই। বাজারে নিরাপত্তা সরঞ্জাম পাওয়া যায়, কিন্তু রাজেশ দাদা বলছেন ওইসব পরলে গরম ভাটিতে তাঁর শ্বাসকষ্ট হয়। স্ত্রী সোনালি কাটাপোড়ার ঝুঁকি নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তায় থাকেন; জানালেন, “কাজ করতে করতে বহুবার হাত কেটেছেন। একবার তো পাও কেটে গেছিল।”

কিন্তু রাজেশ দাদা থামবেন না। “বসে থাকলে তো আর কাজ জুটবে না। বসতে হলে ভাটিতে গিয়েই বসব। কোয়লা জালানা হ্যায় মেরেকো [আমায় তো কয়লা জ্বালাতে হবেই]।”

বহু দশকের কামারের কাজ ছাড়তে কোনওমতেই রাজি নন রাজেশ দাদা। বললেন, “চলতা হ্যায় ঘর [সংসার তো চলে যাচ্ছে]।”

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Ritu Sharma

Ritu Sharma is Content Editor, Endangered Languages at PARI. She holds an MA in Linguistics and wants to work towards preserving and revitalising the spoken languages of India.

Other stories by Ritu Sharma
Jenis J Rumao

Jenis J Rumao is a linguistics enthusiast with an interest in culture and language through hands-on research.

Other stories by Jenis J Rumao
Editor : Sanviti Iyer

Sanviti Iyer is Assistant Editor at the People's Archive of Rural India. She also works with students to help them document and report issues on rural India.

Other stories by Sanviti Iyer
Editor : Priti David

Priti David is the Executive Editor of PARI. She writes on forests, Adivasis and livelihoods. Priti also leads the Education section of PARI and works with schools and colleges to bring rural issues into the classroom and curriculum.

Other stories by Priti David
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

Other stories by Dyuti Mukherjee