সেই সকাল ৬.৩০ থেকে খেটে চলেছেন তুফানি ও তাঁর দলের তিনজন তাঁতি। দিনে ১২ ইঞ্চি করে বুনন এগোচ্ছে, এভাবে চললে ২৩ বাই ৬ হাতের গালিচাটা বানাতে ৪০ দিন তো লাগবেই।

বেলা ১২.৩০টা নাগাদ কাঠের বেঞ্চিতে বসে দু’দণ্ড না জিরিয়ে আর থাকতে পারলেন না তুফানি বিন্দ। তাঁর ঠিক পিছনেই একটা টিনের চালাঘর, কাঠের কাঠামো থেকে সাদা সাদা সুতির সুতো ঝুলছে — এটাই তুফানি বাবুর কর্মশালা। গাঁয়ের নাম পুর্জাগির মুজেহারা, রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। এটাই এখানকার গালিচা বুনন শিল্পের প্রাণকেন্দ্র, মির্জাপুরে যার গোড়াপত্তন করেছিল মুঘলরা, তারপর ব্রিটিশ আমলে সেটা পরিণত হয় শিল্পে। ২০২০ সালের সর্বভারতীয় হস্তচালিত তাঁত সুমারি বলছে: পাটি, পাপোষ ও গালিচা বুননে উত্তরপ্রদেশের একচেটিয়া দখল — মোট জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে প্রায় অর্ধেক (৪৭ শতাংশ)।

মির্জাপুর শহরের প্রধান সড়ক ছেড়ে পুর্জাগির মুজেহারা গাঁয়ের পথ ধরলেই দেখবেন রাস্তাটা ক্রমে সরু হয়ে আসছে। দুধারের ঘরবাড়ি প্রধানত একতলা — অধিকাংশই পাকা দালান, তবে খড়ে ছাওয়া খানকতক কাঁচাবাড়িও চোখে পড়বে; বাতাসে পাক খেয়ে উঠছে ঘুঁটেপোড়া ধোঁয়া। দিনেরবেলায় পুরুষরা সচরাচর বাড়ির বাইরে পা রাখে না, তবে মেয়েবৌদের ঘরকন্নার কাজ সামলাতে দেখতে পাবেন — কেউ টেপাকলের পানিতে কাপড় কাচছেন, কেউ বা শাকসব্জি তথা প্রসাধনী সামগ্রী বেচতে আসা স্থানীয় ফেরিওয়ালাদের সঙ্গে দরাদরিতে ব্যস্ত।

এটা যে বুনকরদের মহল্লা, সেটা চট্ করে ধরতে পারবেন না। কারও বাড়ির বাইরে গালিচা-টালিচা কিছু ঝোলানো বা ডাঁই করা নেই। যদিও প্রতিটা গেরস্থালিতেই গালিচা বোনার জন্য হয় একটা করে আলাদা কামরা বা খানিক জায়গা ছাড়া আছে, তবে গালিচা তৈরি হলেই ফড়ের দল সেগুলো কাচা-ধোওয়ার জন্য নিয়ে চলে যায়।

বিশ্রামরত তুফানি বিন্দ পারিকে জানালেন, “এটা [গিঁট দিয়ে দিয়ে বোনার কায়দা] আমি আমার বাপের থেকে শিখেছি, ১২-১৩ বছর বয়স থেকে এটাই করে চলেছি। তাঁর পরিবারটি বিন্দ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত (রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহের তালিকায় নিবন্ধিত)। উপরোক্ত সেনসাসের তথ্য মোতাবেক ইউপির সিংহভাগ বুনকরই ওবিসি।

PHOTO • Akanksha Kumar

পুর্জাগির মুজেহারা গাঁয়ের বুনকর তুফানি বিন্দ, তাঁতের সামনে একখান পাটা বা কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছেন

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: গালিচার ওয়ার্কশপ, কামরার দুদিকে খোঁড়া পরিখার উপর বসানো আছে তাঁতযন্ত্র। ডানদিকে: পুর্জাগির গ্রামের ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত গড়পড়তা একটি কর্মশালা

এখানকার কর্মশালাগুলি খুবই ঘিঞ্জি, মাটির মেঝে, একটিমাত্র জানলা আর দরজা দিয়ে আলোবাতাস ঢোকে, বেশিরভাগ জায়গাটাই তাঁতযন্ত্রের দখলে। তুফানি বাবুদের মতো কয়েকটা ওয়ার্কশপ আবার লম্বাটে সরু, যাতে একাধিক তাঁতি একত্রে মিলে লোহার তাঁতযন্ত্র চালাতে পারেন। অন্যান্য কর্মশালাগুলি ঘরের মধ্যেই অবস্থিত, তাদের তাঁতগুলো অপেক্ষাকৃত ছোটো এবং কাঠ কিংবা লোহার ডান্ডায় আঁটা। বুননকার্যে পরিবারের সকল সদস্যই হাত লাগান।

সুতির জালিকায় পশম দিয়ে গেরো বেঁধে বেঁধে বুনে চলেছেন তুফানি বিন্দ, এই কৌশলটির নাম টপকা বুনন — গালিচার প্রতি বর্গইঞ্চিতে ক’খানা করে গেরো বসছে, টপকা নামটি তারই ইঙ্গিতবাহী। অন্যান্য ঘরানার বয়নের চাইতে টপকা অনেকটাই বেশি শ্রমসাধ্য, কারণ কারিগরকে হাতে করে গিঁট মারতে হয়। কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর উঠে পরে একখান দাম্ভ (বাঁশের ডান্ডা) দিয়ে সুৎ বা সুতির জালিকা-কাঠামোটা খাপ খাওয়াতে হয় তাঁকে। এভাবে বারংবার ওঠবসের ছাপ শরীরে পড়তে বাধ্য।

গালিচাশিল্পে গেরো-বুননের (নটেড্ উইভিং) চেয়ে গোছ-বুননের (টাফ্ট উইভিং) ধারা অপেক্ষাকৃত নতুন, এতে হাতে ধরা একটা যন্ত্রের সাহায্য নকশা তোলা হয়ে থাকে। গেরো-বুননের পদ্ধতি যেমন জটিল, মজুরিও স্বল্প, তাই গত কয়েক দশকে অসংখ্য কারিগর গেরো-বুনন ছেড়ে গোছ-বুনন আরম্ভ করেছেন। অনেকে তো সবসুদ্ধ বয়নকর্মই ছেড়ে দিয়েছেন, দৈনিক ২০০-৩৫০ টাকা মজুরি দিয়ে পেট চালানো যে সত্যিই না-মুমকিন। মে ২০২৪ সালে আংশিক-দক্ষ মজদুরদের দিনমজুরি ৪৫১ টাকায় বেঁধে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের শ্রম বিভাগ, অথচ এই তল্লাটের বুনকরদের পারিশ্রমিক তার ধারেকাছেও নয়।

উপরন্তু পুর্জাগির বুনকরদের টেক্কা দেওয়ারও লোক রয়েছে, মির্জাপুরের শিল্প বিভাগের উপ-কমিশনার অশোক কুমার জানাচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর, ভাদোহি এবং পানিপত জেলাতেও গালিচা বোনা হয়। “চাহিদায় ঘাটতি এসেছে, যার প্রভাব গিয়ে পড়েছে উৎপাদনে,” তিনি বললেন।

এছাড়া অন্যান্য সমস্যাও আছে। ২১ শতকের প্রথম দশকের গোড়ার দিকে শিশুশ্রমের অভিযোগে কলুষিত হয়েছিল গালিচাশিল্পের ভাবমূর্তি। মির্জাপুরের এক গালিচা রপ্তানিকারক সিদ্ধ নাথ সিং বললেন যে তুরস্কের সস্তা যন্ত্রে-বোনা গালিচায় ইউরোপীয় বাজার ছেয়ে গেছে, ফলে ধীরে ধীরে ইউরোপও হাতছাড়া হয়ে গেছে আজ। উপরন্তু আগে যেখানে রাজ্য সরকার ১০-২০ শতাংশ ভর্তুকি দিত, সেটা কমতে কমতে মোটে ৩-৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে, এটাও জানালেন তিনি।

“দিনে ১০-১২টা ঘণ্টা খেটে ৩৫০ [টাকা] কামানোর চেয়ে শহরে এসে ৫৫০ টাকার দিনমজুরি করা ঢের ভালো,” সিদ্ধ নাথ সিং বললেন। তিনি এককালে গালিচা রপ্তানি প্রচার পরিষদের (সিইপিসি) সভাপতি ছিলেন।

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

তাঁতের লোহার পাইপে (বাঁদিকে) আঁটা সুতোর তন্তু। সুতোর জালিকা-কাঠামো সরাসরি করার জন্য তাঁতযন্ত্রের দেহে বসানো একটি বাঁশের ডান্ডা

এককালে তুফানি বাবু একযোগে ৫-১০টা রঙিন সুতো বোনার কৌশল রপ্ত করেছিলেন। তবে মজুরির ভাঁটা এসে তাঁর উৎসাহে জল দিয়ে গেছে। “কাজের বরাত ওনারাই [ফড়ে] দেন। আমরা দিনরাত খেটে মরি, অথচ আমাদের চাইতে ওনাদের আয়-ইনকাম বেশি,” হতাশ হয়ে বললেন তিনি।

কতটা বুনতে পারলেন, সেই অনুসারে দিনে ১০-১২ ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে ৩৫০ টাকা পান তুফানি বিন্দ, তবে গোটা মাসের মজুরিটা একসঙ্গে পান মাসের শেষে। তবে তাঁর মতে এই নকশাটা বদলাতেই হবে, কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টার চলতে থাকা মেহনতের দাম তিনি পান না। তুফানি বাবুর মতে এ হেন দক্ষ কারিগরির বিনিময়ে অন্তত ৭০০ টাকা দিনমজুরি বাবদ তো পাওয়াই উচিত।

কাজের বরাত নিয়ে আসা ফড়েরা গজ-পিছু (৩৬ ইঞ্চি সমান ১ গজ) রোজগার করে থাকেন। গড়পড়তা ৪-৫ গজ লম্বা একেকটা গালিচা বুনে তাঁতিরা যেখানে ১,২০০ টাকা পান, সেখানে ঠিকেদারের আয় হয় ২,২০০। তবে হ্যাঁ, কাটি (পশম) ও সুতের (সুতো) মতন কাঁচামালের দাম কিন্তু ঠিকেদাররাই মেটান।

তুফানি বাবুর চার ছেলে ও এক মেয়ের প্রত্যেকেই স্কুলে পড়ে, সন্তানরা তাঁর পদানুসরণ করুক এটা তিনি এক্কেবারে চান না। “ওদের বাপ-দাদা যে পেশায় গোটা জিন্দেগি খরচ করে ফেলেছে, ওরা কোন দুঃখে সেটা করবে বলুন? ওদের বুঝি লেখাপড়া করে আরও ভালো কিছু করাটা উচিত না?”

*****

দিনে ১২ ঘণ্টা খেটে এক বছরে ১০-১২ গালিচা বানান তুফানি বিন্দ ও তাঁর দলের বুনকররা। এই দলের রাজেন্দ্র মৌর্য ও লালজি বিন্দ দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। এঁরা যে কামরাটায় কাজ করেন সেখানে হাওয়ার চলাচলের একমাত্র রাস্তা একটি করে দরজা ও জানলা। কষ্টটা তুঙ্গে ওঠে গরমকালে। পারদের মাত্রা চড়চড়িয়ে উঠলে ঘরটা যেন উনুন হয়ে যায়, আধা-পাকা কাঠামোর মাথায় অ্যাসবেস্টসের ছাউনিটা থাকায় সেটা গরম থেকে কোনও রেহাই দিতে পারে না।

তুফানি বাবুর কথায়: “গালিচা বোনার পয়লা ধাপ তানা কিংবা তানান্না।” তাঁতের উপর সুতো-জালিকার কাঠামো বসানোটাই হল তানা।

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: পশমের সুতো ঠিকমতন সোজা করে বসাচ্ছেন তুফানি বাবুর সহকর্মী রাজেন্দ্র মৌর্য। ডানদিকে: আরেক সহকর্মী লালজি বিন্দ জানাচ্ছেন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বয়নকর্মের ফলে তাঁর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: তাঁতের লোহার কড়িতে লাগানো এই আঁকশিটির জন্য সুতোর কাঠামোটা পিছলে যেতে পারে না। ডানদিকে: গিঁটগুলি ঠিক করে বসাতে একখান পাঞ্জা (লোহার চিরুনি) ইস্তেমাল করেন তাঁতিরা

২৫ বাই ১১ হাত মাপের আয়তক্ষেত্রাকার ঘর, লৌহনির্মিত তাঁতযন্ত্রের দুদিকে পরিখা কাটা, তাঁতের একদিকে দড়ি দিয়ে গালিচার কাঠামো খাটানো। ৫-৬ বছর আগে ধারদেনা করে এটা কিনেছিলেন তুফানি বিন্দ, মাসে মাসে শোধ করে ৭০,০০০ চুকিয়েছেন। “বাবার আমলে পাথরের খাম্বায় কাঠের তাঁত বসানো হত,” জানালেন তিনি।

প্রতিটি গেরোয় একটি করে চার্রি (রৈখিক সেলাই) থাকে, যেটা উল দিয়ে করে থাকেন বুনকররা। সেটা যাতে বেঁকে-টেঁকে না যায়, সেজন্য সুতো দিয়ে একখান লাচ্চি (পশম ঘিরে সুতোর ফাঁস) বানিয়ে নেন তুফানি বিন্দ। পশমের যে খিটা আলগা, লাচ্চিটা তার সামনে এনে চুরা নামক একধরনের ছোটো কাঁচি দিয়ে কেটে দেন, তারপর পাঞ্জা (লোহার চিরুনি) দিয়ে সেলাইয়ের পুরো সারিটা ঠোকার পালা। “কাটনা আউর ঠোকনা [কাটাকাটি আর ঠোকাঠুকি], এটাই গেরো-বুনন,” বুঝিয়ে বললেন তুফানি বাবু।

বয়নশিল্প তার ছাপ ফেলে যায় বুনকরের শরীরস্বাস্থ্যে। “বছরের পর বছর বুনতে বুনতে আমার দুচোখের দৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে,” এ পেশায় ৩৫ বছর কাটানো লালজি বিন্দ জানাচ্ছেন। কাজের সময় চশমা আঁটতে বাধ্য হন তিনি। অন্যান্য তাঁতিদের গলায় শোনা গেল পিঠে ব্যথা আর সায়াটিকা বা কোমরে বেদনার কথা। তাঁদের একটাই কথা মনে হয়, এ পেশা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না হাতে। “আমাদের সামনে খুব একটা বেশি রাস্তা ছিল না,” তুফানি বিন্দ জানালেন। সর্বভারতীয় হস্তচালিত তাঁত সুমারি অনুযায়ী গ্রামীণ ইউপির প্রায় ৭৫ শতাংশ বুনকরই মুসলিম।

“বছর ১৫ আগে ৮০০টা পরিবারের লোক গেরো-বুনন করে খেত,” মনে করে বললেন অরবিন্দ কুমার বিন্দ, পেশায় ইনিও তাঁতি, থাকেন পুর্জাগির গ্রামে, “সংখ্যাটা আজ কমে ১০০ হয়েছে।” অর্থাৎ পুর্জাগির মুজেহারার মোট জনসংখ্যার (জনগণনা ২০১১ অনুসারে ১,১০৭) একের তিন।

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: সুতো ও উলের সাহায্যে গেরো-বুনন পদ্ধতিতে গালিচা বোনা চলছে, পাশেই কামরার দৈর্ঘ্য বরাবর পাতা আছে নকশার খসড়া। ডানদিকে: চার্রি বা লাইন স্টিচের জন্য পশম ব্যবহার করেন বুনকররা

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: লাচ্চি বা ফাঁসের জন্য ইস্তেমাল হয় সুতির সুতো। চুরা বা ছুরি দিয়ে আলগা পশম কাটা হয়, তাতে গালিচাটা বেশ লোমশ দেখায়

কাছেই আরেকটা কর্মশালায় বালজি বিন্দ ও তাঁর স্ত্রী তারা দেবী মিলে চুপচাপ একাগ্রচিত্তে একখান সৌমক, অর্থাৎ গেরো-বুননের গালিচা বানিয়ে চলেছেন। শব্দ বলতে থেকে থেকে কাঁচি দিয়ে সুতো কাটার আওয়াজ। একরঙা একনকশি গালিচার নাম সৌমক। যেসব বুনকরের ছোটো তাঁতযন্ত্র আছে, মূলত তাঁরাই এই বিশেষ গালিচাগুলো বানিয়ে থাকেন। “একমাসের ভিতর খতম করতে পারলে এটার জন্য ৮,০০০ টাকা পাব,” বালজি বাবু জানাচ্ছেন।

পুর্জাগির ও বাগ কুঞ্জলগির — বুনকরদের দুটি জনপদেই পুরুষদের পাশাপাশি তারা দেবীর মতো নারীরাও কাজ করেন। আদতে, তাঁতিদের এক-তৃতীয়াংশই মহিলা, অথচ কেউই তাঁদের মেহনতের স্বীকৃতি দেয় না। উপরন্তু স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে আর গ্রীষ্মের ছুটিতে বাচ্চারাও বড়োদের কাজে হাত লাগায়, নইলে কামকাজ আরও ঢিমেতালে এগোত।

স্ত্রী শ্যাম দুলারির সঙ্গে বাঁধা সময়ের মধ্যে একখান গালিচা বোনার চেষ্টা করছেন হাজারি বিন্দ। দুই ছেলের অভাব আজ বড্ড বিঁধছে তাঁকে, মজুরির টানে তারা সুরাটে পাড়ি দেওয়ার আগে বয়নকার্যে মা-বাবার সঙ্গে থাকত। “বাচ্চোঁ নে হমসে বোলা কি হম লোগ ইসমে নহি ফসেঙ্গে, পাপা [ছেলেরা আমায় বল্লো যে পাপা, আমরা এই ফাঁদে পড়তে চাই না।]”

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: স্ত্রী তারা দেবীর সঙ্গে সৌমক নামে গেরো-বুনন পদ্ধতিতে একপ্রকারের গালিচা বুনছেন বালজি বিন্দ। এগুলো একনকশি ও একরঙা হয়। ডানদিকে: অব্যবহারে জং ধরে যাওয়া একজোড়া টাফ্টেড গান বা গোছ-বাঁধার বন্দুক বার করে দেখাচ্ছেন শাহ-এ-আলম

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: ঘরে একখানা ছোট্ট তাঁতযন্ত্রে সৌমক বোনেন হাজারি বিন্দ। ডানদিকে: সুতোর পাশে বসে আছেন হাজারি বাবুর স্ত্রী শ্যাম দুলারি। সব বুনকর মহল্লাতেই মরদদের পাশাপাশি খেটে মরে মেয়েরা, অথচ কেউই তাঁদের মেহনতের স্বীকৃতি দেয় না

হাড়ভাঙা মেহনত আর পড়তে থাকা মজুরির জেরে নতুন প্রজন্ম তো বটেই, ৩৯ বছরের শাহ-এ-আলমের মতো কর্মীরাও এই কারিগরি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। বছরখানেক হল তিনি বয়নশিল্প ছেড়ে ই-রিক্সা চালাচ্ছেন। পুর্জাগির থেকে ৮ কিলোমিটার দূর নাটওয়ায় বাড়ি, ১৫ বছর বয়সে গালিচা বয়ন আরম্ভ করেন শাহ-এ-আলম। পরবর্তী ১২ বছরে তিনি ধীরে ধীরে গেরো-বুনন ছেড়ে গোছ-বুননে ফড়ের ভূমিকায় কাজ ধরেন। তারপর, তিনবছর আগে বাধ্য হন নিজের তাঁতটা বেচে দিতে।

“পোসা নহি রহা থা [পোষাচ্ছিল না],” তাঁর সদ্য নির্মিত দু-কামরার ভিটেয় বসে বলছিলেন শাহ-এ-আলম। ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দুবাইয়ের একটি টালি-নির্মাণ সংস্থায় মজুরি খেটেছেন, মাস গেলে ২২ হাজার টাকা মাইনে পেতেন। টালি-মোড়া মেঝের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “আর কিছু না হোক অন্তত এই বাসাটা বানাতে পেরেছি। তাঁতি হয়ে যেখানে দৈনিক ১৫০ টাকা মোটে রোজগার করতাম, আজ ড্রাইভার হয়ে অন্তত ২৫০-৩০০ টাকা পকেটে আসছে রোজ।”

রাজ্য সরকারের ‘এক জেলা এক পণ্য’ যোজনায় গালিচা-বুনকরদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, ওদিকে কেন্দ্রের মুদ্রা যোজনার খাতে তাঁরা রেয়াতি হারে ঋণ নিতে সক্ষম। ব্লকস্তরে এসব নিয়ে সচেতনতা অভিযান চললেও শাহ-এ-আলমের মতন তাঁতিরা আজও অবগত নন।

পুর্জাগির মুজেহারা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে বাগ কুঞ্জলগির মহল্লা, সেখানে গিয়ে দেখলাম জাহিরুদ্দিন সাহেব গুলতরাশ, অর্থাৎ গোছ-বুনন গালিচা নিখুঁত করে তোলায় ব্যস্ত। ৮০ বছরের এই প্রবীণ কারিগর মুখ্যমন্ত্রী হস্তশিল্প ভাতা যোজনার খাতায় নাম লিখিয়েছেন। ২০১৮ সালে চালু এই প্রকল্পে ষাটোর্ধ্ব কারিগরদের মাসিক ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। অথচ তিনমাস টাকা পাওয়ার পর আপনা-আপনিই তা বন্ধ হয়ে যায় বলে জানালেন জাহিরুদ্দিন সাহেব।

তবে হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনায় (পিএমজিকেএওয়াই) পাওয়া রেশন নিয়ে তিনি খুশি। এমনকি পুর্জাগির গাঁয়ের বুনকররাও “মোদী কা গাল্লা” [প্রধানমন্ত্রী মোদীর যোজনায় প্রাপ্ত খাদ্যশস্য] পাওয়ার কথা জানালেন পারিকে।

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: বাগ কুঞ্জলগিরের কারিগর জাহিরুদ্দিন গুলতরাশে ওস্তাদ — এটি গোছ-বুনন গালিচার নকশা নিখুঁত করার (বাঁদিকে) একটি প্রক্রিয়া বিশেষ। পাপোষের আকারের একটি তৈয়ার হওয়া গোছ-বুনন গালিচা তুলে ধরছেন তিনি

PHOTO • Akanksha Kumar
PHOTO • Akanksha Kumar

বাঁদিকে: প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে তাঁর একটি যুগ্ম ফটো দেখাচ্ছেন পদ্মশ্রী-বিজয়ী খলিল আহমেদ। ডানদিকে: ইরান, ব্রাজিল ও স্কটল্যান্ডের মতো বিভিন্ন দেশে ঘোরার পর এই নকশাগুলি তৈরি করেছেন খলিল সাহেব

লোহার চরকা ঘুরিয়ে এক কেজি সুতির তন্তু টানটান করলে ৭ টাকা করে পান শামশুন্নিসা (৬৫)। দিন গেলে শ-দুয়েক টাকা হয়। প্রয়াত শোহর হাসরুদ্দিন আনসারি এককালে গেরো-বুনন পদ্ধতিতে গালিচা বানাতেন, তবে বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে গেরো-বুনন ছেড়ে গোছ-বুনন শুরু করেছে এই পরিবারটি। এমনকি শামশুন্নিসার ছেলে সিরাজ আনসারি তো ভবিষ্যতে গালিচা বোনা থেকে পুরোপুরি হাত ধুয়ে ফেলতে মরিয়া, কারণ গোছ-বুনন গালিচারও বাজারও পড়ে গেছে।

জাহিরুদ্দিন সাহেবের পাড়াতেই সপরিবারে বসত খলিল আহমেদের। ২০২৪ সালে এই ৭৫ বছরের ওস্তাদ কারিগর দরিশিল্পে তাঁর অবদানের জন্য পদ্মশ্রী খেতাব পেয়েছেন। খলিল সাহেব তাঁর নকশার মহাফেজখানা হাতড়ে হাতড়ে উর্দুতে লেখা একটা পংক্তি দেখিয়ে পড়ে শোনালেন, “ইস্ পর যো বৈঠেগা, উওহ্ কিসমতওয়ালা হোগা [এ গালিচায় যে বসবে, সে নসীবওয়ালা হবে]।”

অথচ গালিচা যাঁরা বুনে চলেছেন, খুশ নসীব তাঁদের অধরাই থেকে যাচ্ছে।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Akanksha Kumar

Akanksha Kumar is a Delhi-based multimedia journalist with interests in rural affairs, human rights, minority related issues, gender and impact of government schemes. She received the Human Rights and Religious Freedom Journalism Award in 2022.

Other stories by Akanksha Kumar
Editor : Priti David

Priti David is the Executive Editor of PARI. She writes on forests, Adivasis and livelihoods. Priti also leads the Education section of PARI and works with schools and colleges to bring rural issues into the classroom and curriculum.

Other stories by Priti David
Editor : Sarbajaya Bhattacharya

Sarbajaya Bhattacharya is a Senior Assistant Editor at PARI. She is an experienced Bangla translator. Based in Kolkata, she is interested in the history of the city and travel literature.

Other stories by Sarbajaya Bhattacharya
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra