“জুন মাসে একদিন এসডিএম [সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট] এসে বললেন, ‘এই নাও উচ্ছেদের নোটিস’।”
গাহডারা গ্রামে ঢোকার মুখে বিশালাকৃতি বটগাছটির দিকে নির্দেশ করেন বাবুলাল আদিবাসী – এই গাছের ছায়াতেই গ্রামের সব গোষ্ঠীগত আলাপ-আলোচনা ঘটে থাকে, আর এই গাছের ছায়াতেই এক লহমায় বদলে গিয়েছে তাঁর জনজাতির ভবিষ্যৎ।
মধ্যপ্রদেশের পান্না ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভিতরে ও আশপাশে অবস্থিত ২২টি গ্রামের সহস্রাধিক বাসিন্দাকে নিজেদের জমি-বাড়ি ছেড়ে উঠে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাঁধ আর নদী সংযোগ প্রকল্পের জন্য। পরিবেশ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত ছাড়পত্র এসে গিয়েছে ২০১৭ সালে, জাতীয় উদ্যানের ভিতরে গাছ কাটাও শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু উচ্ছেদের শঙ্কা দানা বেঁধেছে সম্প্রতিই।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আটকে থাকা এই প্রকল্পের কেন্দ্রে আছে ২১৮ কিলোমিটার লম্বা একটি খালের মাধ্যমে কেন ও বেতোয়া নদীকে সংযুক্ত করার ৪৪,৬০৫ কোটি অর্থমূল্যের ( পর্যায় ১ ) বিরাট পরিকল্পনা।
প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে এই প্রকল্প। “এই প্রকল্পের কোনও প্রয়োজন নেই, জলবিজ্ঞানগত সার্থকতাও নেই,” বলছেন ৩৫ বছর ধরে জল নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানী হিমাংশু ঠক্কর। “প্রথমত, কেন নদীতে উদ্বৃত্ত জল নেই। এই বিষয়ে কোনও বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষা বা নিরপেক্ষ গবেষণা করা হয়নি, স্রেফ পূর্বনির্ধারিত কিছু ধারণার বশে এগোনো হচ্ছে,” যোগ করলেন তিনি।
ঠক্কর সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপল সংগঠনের একজন কো-অর্ডিনেটর। ২০০৪ সালে জলসম্পদ (অধুনা জল শক্তি) মন্ত্রকের অধীনে নদী সংযোগ বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর কথায় এই প্রকল্পের গোড়াতেই আছে গলদ: “নদী সংযোগের কারণে জঙ্গল, নদী এবং জীববৈচিত্র্যের উপর পরিবেশগত প্রভাব পড়বে বিপুল, যার সামাজিক পরিণাম হিসেবে এখানে তো বটেই বুন্দেলখণ্ড এলাকা এবং তারও দূরের মানুষজন দারিদ্র্যের কবলে পড়বেন।”
বাঁধের ৭৭ মিটার উঁচু জলাধার ডুবিয়ে দেবে ১৪টি গ্রাম। এছাড়াও ডুববে গভীর অরণ্যে বাঘের বাসস্থান এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণী-যাতায়াতের করিডর, আর তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাবুলালের গ্রামের মতো আরও আটটি গ্রাম বনদপ্তরকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে অরণ্যভূমি হিসেবে।
এর কোনওটাই অস্বাভাবিক নয়। চিতা, বাঘ , পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, বাঁধ, খনি ইত্যাদি নানান অজুহাতে এ দেশে নিয়মিত লক্ষ লক্ষ গ্রামবাসী, বিশেষ করে আদিবাসীরা উৎখাত হয়ে থাকেন।
মোট ৩৬৮২ টি
http://efaidnbmnnnibpcajpcglclefindmkaj/https:/ntca.gov.in/assets/uploads/Reports/AITM/status_of_tiger-copredators-2022.pdf
(২০২২ ব্যাঘ্রসুমারি) বাঘ নিয়ে বর্তমানে ৫১তম বছরে ভারতের চূড়ান্ত সফল প্রোজেক্ট টাইগার-এর সাফল্য এসেছে ভারতের আদিবাসী ও অরণ্যবাসী জনজাতিদের চরম ক্ষতির মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবেই, এই জনজাতিগুলির অধিকাংশই দেশের সর্বাধিক বঞ্চিত জনগোষ্ঠীও বটে।
১৯৭৩ সালে ভারতে নয়টি ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প ছিল, আজ আছে ৫৩টি। ১৯৭২ সাল থেকে প্রতিটি নতুন বাঘের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে উৎখাত হয়েছেন গড়ে ১৫০ জন অরণ্যবাসী। এই হিসেবটাও অনেকটা কম করে ধরা।
আর এর কোনও শেষ নেই – ১৯ জুন ২০২৪ তারিখে জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের (এনটিসিএ) একটি চিঠিতে আরও লক্ষাধিক মানুষকে উৎখাত করার আবেদন জানানো হয়েছে – সারা দেশের ৫৯১টি গ্রামকে জরুরি ভিত্তিতে সরানোর আবেদন।
পান্না ব্যাঘ্র প্রকল্পে মোট ৭৯টি বাঘ আছে, এবং বাঁধ ওঠার পর তাদের বিচরণভূমি গভীর অরণ্যের একটা বড়ো অংশ জলের তলায় ডুবে যাবে, যে কারণে সেই জমির ক্ষতিপূরণ হিসেবে আরও জমি প্রয়োজন। গাহডারায় বাবুলালের বাড়ি ও গ্রাম তাই জায়গা করে দেবে বাঘেদের বিচরণের জন্য।
পরিষ্কার করে বললে: ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়া হচ্ছে বনদপ্তরকে, আজন্মের ভিটেমাটি ছাড়া হতে বসা গ্রামবাসীদের নয়।
“ওখানে পুনর্বনায়ন হবে,” বলছেন পান্না রেঞ্জের ডেপুটি ফরেস্ট অফিসার অঞ্জনা তিরকি। “আমাদের কাজ হল এই জমিকে ঘাসজমিতে রূপান্তরিত করা এবং বন্যপ্রাণ নিয়ন্ত্রণ করা,” যোগ করলেন তিনি। প্রকল্পের কৃষি বা বাস্তুতন্ত্রগত প্রভাব বিষয়ে মন্তব্য করতে তিনি নারাজ।
কিন্তু নাম না করার শর্তে একাধিক আধিকারিক স্বীকার করে নিচ্ছেন, ওই ৬০ বর্গকিলোমিটার ঘন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এলাকা জলে ডুবে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে খুব বেশি হলে কিছু বীথিকা লাগানো সম্ভব। এটা হচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে পান্নাকে বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্প নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত করার মাত্র দুই বছরের মাথায়। প্রকৃতিগত অরণ্য থেকে প্রায় ৪৬ লক্ষ গাছ কাটা পড়ার (২০১৭ সালের অরণ্য উপদেষ্টা কমিটি মিটিং-এ প্রদত্ত অনুমান অনুসারে) জলস্তরগত প্রভাব কী হতে পারে তা খতিয়েই দেখা হয়নি।
শুধু বাঘেরাই বিপন্ন বন্যপ্রাণ নয়। প্রস্তাবিত বাঁধের মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত ভারতের তিনটি ঘড়িয়াল অভয়ারণ্যের মধ্যে একটি। এই এলাকা আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় থাকা অতিবিপন্ন পাখি ভারতীয় শকুনের বাসস্থান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও বাসস্থান খোয়াবে বহু বড়ো আকৃতির মাংসাশী ও তৃণভোজী প্রাণী।
বাবুলাল ছোটো চাষি, কয়েক বিঘা জমি আছে, তা থেকে পরিবারের অন্ন সংস্থান হয়। “উঠে যাওয়ার কোনও তারিখ দেওয়া হয়নি, তো আমরা ভাবলাম কিছু ভুট্টা চাষ করে নিই, নিজেদের খাওয়ার জন্য।” তিনি এবং গ্রামের আরও শতাধিক চাষি যখন জমি প্রস্তুত করছেন, তখনই ফরেস্ট রেঞ্জাররা এসে হাজির। “আমাদের বলল বন্ধ করতে হবে। বলল, ‘কথা না শুনলে আমরা ট্র্যাক্টর নিয়ে এসে জমি নষ্ট করে দিয়ে যাব’।”
এখন তাঁর পোড়ো জমিখানি আমাদের দেখিয়ে বাবুলাল বলছেন, “আমাদের পুরো ক্ষতিপূরণও দেয়নি যে আমরা অন্য কোথাও উঠে যাব, এখানে থাকতে, চাষ করতেও দিচ্ছে না। সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন – যতদিন গ্রামটা এখানে আছে অন্তত ততদিন চাষবাস করতে দিন… নইলে খাব কী?”
বংশানুক্রমিক বাসস্থান হারানো আরও একটা বড়ো ধাক্কা। দৃশ্যতই বিধ্বস্ত স্বামী প্রসাদ পরোহর জানালেন, তাঁর পরিবার গাহডারায় ৩০০ বছর ধরে আছে। “আমাদের চাষের আমদানি [আয়] ছিল, নয়তো মহুয়া, তেন্দু ইত্যাদি বনজ সম্পদের … এখন কোথায় যাব? কোথায় গিয়ে মরব? কোথায় গিয়ে ডুবব… কে জানে?” অশীতিপর বৃদ্ধের আশঙ্কা, পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে জঙ্গলের আর কোনও সম্পর্কই থাকবে না।
*****
‘উন্নয়ন’-এর নামে সরকারের তরফে জমি কেড়ে নেওয়ার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ এই নদী সংযোগ প্রকল্প।
২০২৩ সালে যখন কেন-বেতোয়া নদী সংযোগ প্রকল্পের চূড়ান্ত ছাড়পত্র আসে, তৎকালীন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান মহা আড়ম্বরে তাকে স্বাগত জানান। দিনটাকে “পিছিয়ে পড়া বুন্দেলখণ্ডের মানুষের জন্য সৌভাগ্যজনক” বলে ঘোষণা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর রাজ্যের যে বহু সহস্র কৃষক, পশুপালক, অরণ্যবাসী পরিবার এর ফলে ঘরছাড়া হবেন তাঁদের কথা সেদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেননি। তিনি এটাও লক্ষ করেননি যে বনদপ্তরের সেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল পান্না ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাইরে শক্তি উৎপাদন হবে এই শর্তে, কিন্তু প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপে সেটা পান্নার ভিতরে চলে আসছে।
উদ্বৃত্ত জলবাহী নদীর সঙ্গে কম জলবাহী নদী অববাহিকা সংযুক্ত করার ধারণার জন্ম বিগত শতকের সাতের দশকে, তখন একাজের জন্য জাতীয় জল উন্নয়ন নিগম গঠন করা হয়েছিল। সারা দেশে ৩০টি নদী-সংযোগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে শুরু করে এই সংস্থা – পরস্পর-সংযুক্ত জলপথের ‘বিশালাকৃতি মালা’ হিসেবে বর্ণনা করা হত।
কেন নদীর উৎস মধ্যভারতের কৈমুর পর্বতমালায় এবং তা গঙ্গা অববাহিকার অংশ – উত্তর প্রদেশের বান্দা জেলায় যমুনা নদীতে গিয়ে মিশছে। ৪২৭ কিলোমিটারের দীর্ঘ যাত্রাপথে পান্না ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভিতর দিয়ে যায় কেন। প্রকল্পের ভিতরে ধোদান গ্রাম হল প্রস্তাবিত বাঁধের জায়গা।
কেনের বেশ খানিকটা পশ্চিমে বইছে বেতোয়া নদী। নদী-সংযোগ প্রকল্পের লক্ষ্য হল ‘উদ্বৃত্ত’ কেন থেকে জল নিয়ে চড়াইয়ের দিকে ‘ঘাটতি’ বেতোয়া নদীতে জল পৌঁছানো। এই দুই নদীর সংযোগের ফলে আর্থিকভাবে অনগ্রসর কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাংক বুন্দেলখণ্ড এলাকার ৩৪৩,০০০ হেক্টর খরা জমিতে সেচের সুবিধা পৌঁছে যাবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পের জেরে আসলে বুন্দেলখণ্ড থেকে জল বেরিয়ে এলাকার বাইরে থাকা উচ্চ বেতোয়া অববাহিকায় পৌঁছে যাবে।
কেনের জল যে উদ্বৃত্ত, এই ধারণাটাকেই প্রশ্ন করা প্রয়োজন, বলছেন ড. নচিকেত কেলকর। কেনের উপরে আগে থেকে যে বাঁধগুলি আছে – বারিয়ারপুর ব্যারাজ, গাঙ্গৌ বাঁধ এবং পওয়াই-এর বাঁধগুলি থেকেই জলসেচ হওয়ার কথা। “কয়েক বছর আগে কেনের তীরবর্তী বান্দা এবং আশপাশের এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে প্রায়ই কানে আসত যে সেচের জল আসছে না,” জানালেন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত এই পরিবেশবিদ।
২০১৭ সালে সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপল সংগঠনের গবেষকরা কেনের পুরো গতিপথ ধরে হেঁটে এসে একটি রিপোর্টে লিখেছিলেন, “... কেন এখন আর সর্বত্র বারমাসি নদী নেই… নদীর বৃহত্তর অংশ এখন জল এবং স্রোতবিহীন।”
কেন নদীর নিজের এলাকাতেই সেচের জলের ঘাটতি আছে, কাজেই সেখান থেকে আবার বেতোয়ায় জল পাঠালে কেনের নিজের অববাহিকা বিপন্ন হবে। সারা জীবন পান্নায় কাটানো নীলেশ তিওয়ারি এই বিষয়টাকেই তুলছেন। তাঁর মতে, বাঁধ নিয়ে এলাকায় প্রবল অসন্তোষ, কারণ এতে করে মধ্যপ্রদেশের মানুষ চিরতরে অসুবিধায় পড়বেন, ওদিকে লাভ হবে উত্তরপ্রদেশের।
“বাঁধের জলে লক্ষ লক্ষ গাছ, হাজার হাজার প্রাণী ডুবে যাবে। [অরণ্যবাসী] মানুষ স্বাধীনতা হারাবেন, বেঘর [ঘরছাড়া] হয়ে যাবেন। মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে, কিন্তু রাজ্যের খেয়াল নেই,” বলছেন তিওয়ারি।
“কোথাও জাতীয় অরণ্য করে দিল, কোথাও এই নদী সেই নদীতে বাঁধ দিয়ে দিল… আর দলে দলে মানুষ আবার উচ্ছেদ হবে, উৎখাত হবে…” বলছেন জনকা বাই, ২০১৫ সালে পান্না ব্যঘ্র প্রকল্প সম্প্রসারণের সময় উমরাওয়ান গ্রামে তাঁর বাড়ি আত্মসাৎ হয়েছিল।
গোণ্ড আদিবাসীদের গ্রাম উমরাওয়ানের বাসিন্দা পঞ্চাশের কোঠার জনকা বাই, এক দশক ধরে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের জন্য লড়ে যাচ্ছেন। “আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজ্যের মাথাব্যথা নেই। আমাদের বোকা বানিয়েছে,” যোগ করছেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে জানালেন, বাঘের নাম করে তাঁর জমি নেওয়া হয়েছিল, এখন সেখানে রিসর্ট হচ্ছে। “দেখুন এই যে জমি ওরা সার্ভে করে গেছিল, এখান থেকে আমাদের বার করে দিয়ে এখন পর্যটকদের থাকার জায়গা করেছে।”
*****
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এক তথাকথিত জনশুনানির মাধ্যমে কেন-বেতোয়া নদী সংযোগ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়।
স্থানীয় অধিবাসীরা কিন্তু জোর দিয়ে বলছেন, এমন কোনও জনশুনানি হয়নি, শুধু উচ্ছেদের নোটিস আর মৌখিক প্রতিশ্রুতি এসেছে। এখানে জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পুনরুদ্ধারে স্বচ্ছতা ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণের অধিকার আইন , ২০১৩ সরাসরি লঙ্ঘিত হয়েছে। আইনে বলা আছে: “জমি অধিগ্রহণ বিষয়ক তথ্য সরকারি গেজেট, স্থানীয় সংবাদপত্র, স্থানীয় ভাষায় এবং সংশ্লিষ্ট সমস্ত সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।” আদেশনামা দেওয়া হলে পর এই বিষয়ের জন্য আলাদা করে বৈঠক ডেকে গ্রাম সভাকে এত্তেলা দিতে হবে।
“আইনে বলা কোনও পথের মাধ্যমেই সরকার এ বিষয়ে মানুষকে জানায়নি। আমরা বহুবার জানতে চেয়েছি, ‘আমাদের বলুন আইনের কোন ধারায় আপনারা এটা করছেন’,” বলছেন সমাজ কর্মী অমিত ভাটনগর। চলতি বছরের জুন মাসে জেলা কালেক্টরের দপ্তরের সামনে গ্রামসভার সই করা অনুমতিপত্র দেখতে চেয়ে বিক্ষোভ আয়োজন করেছিলেন তিনি। তাঁদের উপর লাঠিচার্জ করা হয়।
“আগে বলুন আপনারা [সরকার] কোন গ্রামসভা বৈঠকটা করেছেন, কারণ আদতে আপনারা কিছুই করেননি,” বলছেন আম আদমি পার্টির সদস্য ভাটনগর। “দ্বিতীয়ত, এই যোজনায় জনগণের সম্মতি থাকা আবশ্যক, যা নেওয়াই হয়নি। আর তৃতীয়ত, ওঁদের যদি উঠে যেতে বলা হয়, তাহলে পাঠানো হচ্ছে কোথায়? সে বিষয়ে তো কোনও কথা, কোনও তথ্য, কোনও আদেশনামা আসেনি।”
শুধু যে জমি অধিগ্রহণ আইনের লঙ্ঘন হয়েছে তাই নয়, সরকারি আধিকারিকরা প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন প্রচুর। ধোদানের বাসিন্দা গুরুদেব মিশ্র বলছেন, সবার মনে হচ্ছে তাদের ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। “অফিসাররা বলেছিল, ‘তোমাদের জমির বদলে জমি দেব, বাড়ির বদলে পাকা বাড়ি দেব, চাকরি পাবে। তোমাদের বাড়ির আদরের মেয়ের মতো বিদায় দেওয়া হবে’।”
ঘরোয়া এক গ্রামসভা জমায়েতে বসে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন এই প্রাক্তন সরপঞ্চ। “সরকার যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, [ছত্তরপুরের] জেলা কালেক্টর, মুখ্যমন্ত্রী, প্রকল্পের অফিসাররা এখানে এসে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমরা শুধু সেটাই চাইছি,” বলছেন তিনি। “কিন্তু তার একটাও পূরণ করা হয়নি।”
পান্না ব্যাঘ্র প্রকল্পের পূর্ব দিকে গাহডারায় পরিস্থিতি একইরকম। “[পান্নার] কালেক্টর বলেছিলেন, তোমরা যেমন আছো ঠিক তেমন করেই পুনর্বাসন দিয়ে দেব। তোমাদের কোনও অসুবিধা হবে না। নতুন করে এই গ্রাম গড়ে দেব,” বলছেন অশীতিপর পারোহর। “সেসব কিছুই হয়নি, আর আমাদের এখন উঠে যেতে বলছে।”
ক্ষতিপূরণের অংকটা পর্যন্ত স্পষ্ট নয়, হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রকমের তথ্য – ১৮ বছরের বেশি বয়সি পুরুষদের জন্য ১২ থেকে ২০ লক্ষ টাকা। মানুষের প্রশ্ন: “এটা কি মাথাপিছু, নাকি পরিবারপিছু? যেসব পরিবার মেয়েরা চালান তাদের কী হবে? জমির জন্য কি আলাদা করে ক্ষতিপূরণ দেবে? আমাদের গবাদি পশুগুলোর কী হবে? আমাদের কিছু স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না।”
সরকারি কার্যকলাপের এই অস্বচ্ছতার কারণে পারি-র ঘোরা প্রতিটি গ্রামেই দেখা গেছে যে মানুষ কবে এবং কোথায় উঠে যাবেন, বাড়ি, জমি, গবাদি পশু আর গাছের জন্য ক্ষতিপূরণের সঠিক পরিমাণ/হার, এসব কিছুই কেউ জানেন না। ২২টি গ্রামের মানুষ যেন আশঙ্কায় দমবন্ধ করে প্রহর গুনছেন।
ধোদানে বাঁধের জলে চাপা পড়তে চলা বাড়ির সামনে বসে উদ্বিগ্ন মুখে জমি মালিকানার প্রমাণস্বরূপ পুরোনো চালান ও সরকারি কাগজপত্র ঘাঁটছেন কৈলাশ আদিবাসী। “ওরা বলছে আমার নাকি পাট্টা নেই। কিন্তু আমার এই চালানগুলো আছে। আমার বাবা, তাঁর বাবা, তাঁর বাবা… সবাই এই জমিতে থেকেছেন। আমার কাছে সব চালান আছে।”
২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইন অনুসারে আদিবাসী তথা অরণ্যবাসী জনজাতির মানুষদের “যে কোনও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা রাজ্য সরকার প্রদত্ত পাট্টা বা লিজ বা অনুদানকৃত অরণ্যভূমির পরিবর্ত হিসেবে অন্য জমি” প্রাপ্তির অধিকার আছে।
কিন্তু কৈলাশকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে না এই বলে যে তাঁর কাগজপত্র নাকি ‘যথেষ্ট নয়।’ তাঁর কথায়, “আমরা এখন বুঝতে পারছি না যে এই জমি-বাড়িতে আমাদের কোনও অধিকার আছে কিনা। ক্ষতিপূরণ পাব কিনা তাও বলা হচ্ছে না। ওরা শুধু আমাদের তাড়িয়ে দিতে চায়। কেউ কোনও কথা শুনছে না।”
বাঁধের জলাধার ডুবিয়ে দেবে ১৪টি। আরও আটটি গ্রাম সরকার বন দপ্তরকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে
পাশের গ্রাম পালকোহায় যুগল আদিবাসী ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে চাইলেন।
“পাটোয়ারি বলে দিয়েছে আমাদের কাছে তোমার পাট্টার কোনও রেকর্ড নেই,” গ্রামের কেন্দ্রীয় চত্বর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন তিনি। “অর্ধেক লোক কিছুটা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, বাকিরা কিছু পায়নি।” তাঁর ভয়, এখন যদি প্রতি বছরের মতো দেশান্তরে চলে যান, তবে আর কোনও ক্ষতিপূরণই পাবেন না, আর তাঁর সাত সন্তানের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে।
“যখন ছোটো ছিলাম, জমিতে কাজ করতাম, জঙ্গলে যেতাম,” মনে পড়ে তাঁর। কিন্তু গত ২৫ বছরে ব্যাঘ্র প্রকল্প হয়ে যাওয়া জঙ্গলে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা পড়েছে তাঁর মতো আদিবাসীদের উপর, কাজেই দিনমজুরির কাজ নিয়ে দেশান্তরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকছে না তাঁদের।
হকের পাওনা ছাড়তে নারাজ উচ্ছেদ-হতে-বসা গ্রামের মেয়েরাও। “[প্রধানমন্ত্রী] মোদী সারাক্ষণ বলছেন ‘মহিলাদের জন্য এই যোজনা… মহিলাদের জন্য ওই যোজনা।’ আমাদের ওসব লাগবে না। আমাদের হকের পাওনা চাই,” বলছেন (দলিত) রবিদাস সম্প্রদায়ভুক্ত পালকোহা গ্রামের কৃষক সুন্নি বাই।
“শুধু পুরুষরাই কেন [ক্ষতিপূরণ] প্যাকেজ পাচ্ছে, মেয়েরা কিছু পাচ্ছে না? কিসের ভিত্তিতে সরকার এই আইন করেছে?” সওয়াল তুলছেন এক মেয়ে ও দুই ছেলের জননী। “ধরুন স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীয়ের বনিবনা হল না, তো স্ত্রী কীভাবে নিজের ও ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ করবেন? আইনে তো এই জিনিসগুলো ভাবা দরকার… ওই স্ত্রীও তো ভোটার।”
*****
“জল, জীবন, জঙ্গল অউর জানোয়ার – এই সবের জন্যই লড়ে যাচ্ছি,” জানাচ্ছেন স্থানীয় মানুষজন।
ধোদানে তাঁর বাড়ির ছড়ানো উঠোনখানা দেখিয়ে গুলাব বাই জানালেন, বাড়ির জন্য ক্ষতিপূরণের হিসেবে উঠোন আর রান্নাঘর বাদ দেওয়া হয়েছে, কারণ সেগুলি ‘থাকার জায়গা’র বাইরে অবস্থিত। পিছু হটতে রাজি নন ৬০ বছরের গুলাব বাই। “[আমার মতো] আদিবাসীরা শাসনের [প্রশাসন] থেকে কিচ্ছু পায়নি। আমি এখান থেকে ভোপাল [রাজ্যের রাজধানী] পর্যন্ত লড়ে যাব। আমার সে শক্তি আছে। আমি ওখানে গিয়েওছি। আমি আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত।”
নদী-সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছোটো আকারে প্রতিরোধ শুরু হয় ২০১৭ সালে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামসভার মধ্য দিয়ে। আন্দোলন গতি পায় ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি তারিখে যখন ছত্তরপুর জেলা কালেক্টোরেটে ৩০০-রও বেশি মানুষ জমা হন জমি অধিগ্রহণ আইন লঙ্ঘনের প্রতিবাদে। ২০২৩ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে এই বিক্ষোভ আন্দোলনের তিনটি জল সত্যাগ্রহের প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয়; তাতে পান্না ব্যাঘ্র প্রকল্পর ১৪টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছিলেন নিজের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে।
স্থানীয় অধিবাসীরা দাবি করছেন, বিক্ষোভের আঁচ প্রধানমন্ত্রীর কানেও পৌঁছেছিল, এবং সেই কারণেই গত বছর ধোদানে বাঁধের উদ্বোধন করতে আসার কথা থাকলেও আসেননি তিনি। এই প্রতিবেদক আলাদা করে এই তথ্য যাচাই করতে পারেননি।
প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক এবং বৈরিতার পরিবেশ ছাপ ফেলে ২০২৩ সালের অগস্টে শুরু হওয়া টেন্ডার বা দরপত্র সংক্রান্ত প্রক্রিয়াতেও। কোনও সংস্থা এই কাজে এগিয়ে আসেনি। কাজেই সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়।
সরকারি কার্যকলাপের এই অস্বচ্ছতার কারণে আমাদের ঘোরা প্রতিটি গ্রামেই দেখা গেছে যে মানুষ কবে এবং কোথায় উঠে যাবেন, বাড়ি, জমি, গবাদি পশু আর গাছের জন্য ক্ষতিপূরণের সঠিক পরিমাণ/হার, এসব কিছুই কেউ জানেন না
*****
“মধ্যভারতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশেষ কেউ কথা বলে না, কিন্তু এখানেই আমরা এখন ঘন ঘন তীব্র খরা আর তীব্র বৃষ্টিপাতের ঘটনা দেখছি, যার দুটিই জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী,” বলছেন পরিবেশবিদ কেলকর। “মধ্যভারতের বেশিরভাগ নদীতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্রোত বেড়েছে, কিন্তু এই বৃদ্ধি বেশিদিন থাকবে না। এখন হয়তো এই স্রোতের পরিমাণ দেখে জল উদ্বৃত্ত আছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের যে ভবিষ্যৎ রূপরেখা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা থেকে স্পষ্ট যে এই পরিবর্তনটা নেহাতই ক্ষণস্থায়ী।”
তাঁর সতর্কবাণী, এই ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে যদি নদী সংযোগ করা হয়, তবে এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ খরা পরিস্থিতির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
ঠক্কর আবার বলছেন, বিপুল আকারের প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংসের জলস্তরগত পরিণাম ভয়াবহ, এবং এটা একটা বিরাট মাপের ভুল পদক্ষেপ। “সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্টে এই কথা তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু শীর্ষ আদালত সেই রিপোর্টখানা বিবেচনাই করেনি।”
২০২৩ সালে নেচার কমিউনিকেশন পত্রিকায় প্রকাশিত নদী সংযোগ বিষয়ে আইআইটি মুম্বইয়ের একটি গবেষণাপত্রেও ধ্বনিত হয়েছে সাবধানবাণী: “অপসারিত জলের কারণে বর্ধিত জলসেচের পরিণামস্বরূপ সেপ্টেম্বর মাসে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২% পর্যন্ত কমে এসেছে ভারতের এই আগে থেকেই জলকষ্ট-অধ্যুষিত এলাকায়… সেপ্টেম্বরের হ্রাসমান বৃষ্টিপাত বর্ষা-পরবর্তীকালে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ইন্ধন হতে পারে, যা সারা দেশে জলকষ্টের পরিমাণ বাড়াবে এবং নদী সংযোগের উদ্দেশ্য বিফলে যাবে।”
জাতীয় জল উন্নয়ন নিগম তাদের এই প্রকল্পের ভিত্তি হিসেবে কী তথ্য ব্যবহার করছে তা বিজ্ঞানীদের জানানো হচ্ছে না জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে, জানালেন হিমাংশু ঠক্কর।
২০১৫ সালে যখন বাঁধের প্রস্তাব ক্রমশই বাস্তবায়নের দিকে এগোতে শুরু করে, ঠক্কর এবং সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপল সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা পরিবেশ বিবেচনা কমিটির কাছে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ‘ত্রুটিপূর্ণ কেন-বেতোয়া পরিবেশ-পরিণাম সমীক্ষা এবং জনশুনানির নিয়ম লঙ্ঘন’ শীর্ষক এমনই একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, “এই প্রকল্পের পরিবেশ-পরিণাম সমীক্ষা বা ইআইএ মূলগতভাবেই ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ, এবং এর জনশুনানি প্রক্রিয়ায় বহু নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে। এহেন অসম্পূর্ণ সমীক্ষার ভিত্তিতে দেওয়া এই প্রকল্পের যে কোনওরকম ছাড়পত্র শুধু অন্যায্যই নয়, বেআইনিও বটে।”
ইতিমধ্যেই অবশ্য প্রায় ১৫-২০ লক্ষ গাছ কাটা হয়ে গিয়েছে। ক্ষতিপূরণের কোনও দিশা নেই, কিন্তু উচ্ছেদের খাঁড়া সর্বক্ষণ মাথায় ঝুলছে। চাষবাস বন্ধ। দিনমজুরির খোঁজে দেশান্তরি হলে ক্ষতিপূরণের নামে কোনওরকম অনুদান থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
অবস্থার সংক্ষিপ্তসার করে দিলেন সুন্নি বাই: “আমরা সব হারাতে বসেছি। ওরা সব নিয়ে নিচ্ছে। আমাদের সাহায্য করার কথা ওদের। তার বদলে বলছে, ‘এই দেখ প্যাকেজ, এই ফর্মে সই কর, টাকা নাও আর যাও’।”
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী