শ্রদ্ধেয় প্রধান বিচারপতি মহাশয়,

"মিডিয়ার ক্যানভাস থেকে দিনকে দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে তদন্তমূলক সাংবাদিকতা... তাবড় তাবড় সব কেচ্ছার কথা ফাঁস হচ্ছে খবরের কাগজের পাতায় পাতায়, সেসবের জন্য তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকতাম ছোটবেলায়। নাহ্, নিরাশ করাটা খবরের কাগজের ধাতে ছিল না তখন।" – এমন একটা প্রাসঙ্গিক সত্য তুলে ধরার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

সংবাদমাধ্যমের ব্যাপারে এমন ঠোঁটকাটা কথা আর কেউই তেমন বলে না আজকাল। ক'দিনের জন্য হলেও একদা যেটা আপনার কর্মক্ষেত্র ছিল, তার কথা মনে রাখার জন্য বেশুমার ধন্যবাদ আপনাকে। ১৯৭৯ সালে আপনি ঈনাডু-তে যোগ দেওয়ার মাসকয়েকের মধ্যেই সাংবাদিকতার জগতে পা রেখেছিলাম আমি।

সম্প্রতি একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ কথাটা আপনি স্মরণে এনেছিলেন – টালমাটাল সেই দিনগুলোয়, যখন ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই "তাবড় তাবড় সব কেচ্ছার কথা ফাঁস হচ্ছে খবরের কাগজের পাতায় পাতায়, সেসবের জন্য তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকতাম।" আজকাল ঘুম ভাঙলে কী দেখি জানেন সাহেব? সেসব কেচ্ছার কথা ফাঁস করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা ফেঁসে গেছেন নিজেরাই, এমনকি বেআইনি কার্যকলাপ নিবারণ অ্যাক্ট (ইউএপিএ) মার্কা একুশে আইনের আওতায় জেলে পোরা হয়েছে তাঁদের। কিংবা সাম্প্রতিককালে কড়া ভাষায় যেটার নিন্দা করেছিলেন আপনি, সেই অর্থ তছরুপ প্রতিরোধক আইনের (পিএমএলএ) নির্লজ্জ অপব্যবহারের কথা।

বক্তৃতায় বেশ দক্ষভাবেই তুলে ধরেছিলেন বটে: "অতীতে আমরা দেখেছি কেমন করে কেলেঙ্কারির কথা খবরের কাগজে ফাঁস হওয়ার পর আলোড়ন পড়ে যেত চারিদিকে, পরিণতির গুরুভার আটকানো যেত না।" হায় রে, পরিণতির সে গুরুভার আজ বইতে হয় সেই সাংবাদিকদেরই যাঁদের কলমে ফাঁস হয় সে-সকল খবর। সোজাসাপ্টা ভাষায় লিখতে গেলেও হাল হয় একই। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে হওয়া ওই বীভৎস ঘটনাটা মনে আছে সাহেব? গণধর্ষণের শিকার সেই মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন সিদ্দিক কাপ্পান। যাওয়ার পথে গ্রেফতার তো হলেনই , আজ অবধি জামানত জুটলো না তাঁর কপালে। গোটা একটা বছর পেরিয়ে গেছে, মামলাটা এ আদালত থেকে সে আদালতে চরকিপাক খেয়ে মরছে, ওদিকে দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে কাপ্পানের স্বাস্থ্য।

সে তদন্তমূলক হোক অন্য কিছু, এমনতর উদাহরণ উঠে আসে যে দেশে, সেথায় সাংবাদিকতার সিংহভাগটাই যে অচিরে ভ্যানিশ হয়ে যাবে এ কথা বলাই বাহুল্য।

ধর্মাবতার রামানা, হক কথাই বলেছেন আপনি, একদা যেখানে একের পর এক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যেত, সেখানে "আজকাল এমন কোনও বড়সড় খবর চোখেই পড়ে না। এ দেশের বাগিচা যেন শুধুই সুবাসিত গোলাপের কেয়ারি। বলাই বাহুল্য, আপনারা নিজের নিজের মতো করে উপসংহারে উপনীত হবেন।"

একে তো আইনকানুন তথা মিডিয়া ঘিরে সুগভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী আপনি, তার উপর ভারতীয় সমাজ বাঁধা পড়ে গেছে আপনার তীক্ষ্ণ দর্শনে – সাহেব, আপনি যদি আরেক পা এগিয়ে এটাও বলে দিতেন যে ঠিক কী কী কারণে আজ ভারতীয় সাংবাদিকতার ষোল আনাই (সে তদন্তমূলক হোক বা অন্য কিছু) ডুবতে বসেছে, বড্ডো খুশি হতাম। ওই যে বললেন না নিজেই নিজের মতো উপসংহার সাজিয়ে নিতে, তাহলে খান তিনেক কারণ গেঁথে পসরা সাজিয়ে দিই আপনার জন্য? কী বলেন?

প্রথমত, কাঠামোগতভাবে মিডিয়ার মালিকানা আজ মুষ্টিমেয় কর্পোরেট পরিবারের পকেটে বন্দি, যাদের মগজে মুনাফা ছাড়া আর কিস্যুটি ঢোকে না।

দ্বিতীয়ত, স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার উপর যে হারে আজ রাষ্ট্রীয় অবদমন নেমে এসেছে, এমনটা এর আগে কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।

তৃতীয়ত, নীতিবোধের অবক্ষয়, যে কারণে আজ প্রবীণ থেকে প্রবীণতর সাংবাদিকের দলও ক্ষমতার কলমচি হতে উঠে পড়ে লেগেছে।

হলফ করে বলছি সাহেব, এ পেশায় শিক্ষকতা করি তো আমি, পড়ুয়াদের একটা কথাই বারবার করে বলি তাই: আমাদের কর্মক্ষেত্রে আজ মোটে দুটি মতবাদই পড়ে আছে – হয় সত্যান্বেষী কিংবা ক্ষমতার কলমচি, এর মধ্যে কোনটা হতে চাও তোমরা?

৩০টা বছর ধরে একটা কথা ঘ্যানঘ্যান করে গেছি সাহেব, রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হলেও ভারতীয় মিডিয়া মুনাফার মায়াজালে বন্দি। আজ মুনাফার সে বন্দিদশা তো ঘোচেইনি, উপরন্তু গুটিকয় যে স্বাধীন কণ্ঠ পড়েছিল আমাদের মধ্যে, একে একে তাঁরা রাজনৈতিক বন্দিদশায় আটকা পড়েছেন।

এই যে মিডিয়া-স্বাধীনতা নামক বস্তুটি আজ হিক্কা তুলছে ক্রমাগত, এটা নিয়ে খোদ মিডিয়ার অন্দরমহলেই কারও তেমন গা নেই – সাহেব, এটা তো সত্যিই একটা মারাত্মক জিনিস, তাই না? একে একে খুন করা হয়েছে স্বনামধন্য তথা গণমানসে গভীর প্রভাব বিস্তারকারী চার বুদ্ধিজীবীকে, যাঁদের প্রত্যেকেই যুক্ত ছিলেন সংবাদ জগতের সঙ্গে। এঁদের মধ্যে পেশাগতভাবে বরিষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন গৌরি লংকেশ । (বন্দুকধারী আততায়ীদের হাতে শহীদ হয়েছেন রাইজিং কাশ্মীরের সম্পাদক শুজাৎ বুখারিও)। তবে বাকি তিনজনও নিয়মিত লেখালেখি করতেন খবরের কাগজে। যুক্তিবাদী একটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন নরেন্দ্র দাভোলকর , শুধু কলমের জোরেই প্রায় ২৫ বছর ধরে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তিনি। সত্যের পক্ষে অক্লান্ত কলম চালাতেন গোভিন্দ পানসারে এবং এম.এম. কালবুর্গি

একটা ব্যাপারে মিল ছিল এই চারজনের: একাধারে যুক্তিবাদী এবং সাংবাদিক ছিলেন প্রত্যেকেই, লেখালেখি করতেন ভারতীয় ভাষায় – ফলত অচিরেই খুনিদের পথের কাঁটা হয়ে ওঠেন তাঁরা। নাহ্, রাষ্ট্র তাঁদের সরাসরি খুন করেনি ঠিকই, তবে হত্যাকারীদের মাথার উপর বকলমে ছাতা ধরতেও পিছপা হয়নি কিন্তু। 'বেসরকারি' এই ভাড়াটে খুনিদের 'হিটলিস্টে' এই চারজন ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক রয়েছেন

বাস্তবটা কী জানেন সাহেব? স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এমনভাবে তলানিতে ঠেকেনি এর আগে কখনও। তবে আমাদের বিচারব্যবস্থা যদি চোখ থেকে ঠুলি সরিয়ে এ বাস্তবের মুখোমুখি হয়, তবে অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হতে পারে বৈকি। আশা করি পেগাসাসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে অন্তত এটুকু বুঝেছেন যে আধুনিক প্রযুক্তিতে বলীয়ান একটা রাষ্ট্র চাইলে যতটা অত্যাচার করতে সক্ষম, তার কাছে জরুরি-অবস্থাকালীন সেই ভয়াবহ দিনগুলোও নিতান্তই নস্যি।

২০২০ সালে ফ্রান্স-কেন্দ্রিক সীমান্তহীন সাংবাদিকেরা (রিপোর্টারস্ উইদাউট বর্ডার্স) স্বাধীনতার নিরিখে বিশ্ব সংবাদমাধ্যম ঘিরে একটি ক্রম-তালিকা (ডাব্লিউপিএফআই) বার করে, সেখানে একলাফে ১৪২ নম্বরে তলিয়ে গেছে ভারতবর্ষ।

এখনকার সরকার যে ঠিক কী কায়দায় প্রেসের স্বাধীনতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে সে বিষয়ে সরাসরি কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার, এবার না হয় সেগুলোই বলি। ১৪২তম স্থান দখল করাতে সরকার বাবাজি তো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, খোদ কেন্দ্র সরকারি মন্ত্রিসভার সচিবের থেকে হুকুম আসে যেন অবিলম্বে একটি ক্রম পর্যবেক্ষণ কমিটি (ইনডেক্স মনিটরিং কমিটি) বানিয়ে ভারতের প্রেস-স্বাধীনতার বর্তমান স্বর্ণযুগের কথা বিশ্বমাজারে তুলে ধরা হয়। নাহ্, ডাব্লিউপিএফআইয়ের সঙ্গে একহাত নেওয়ার জন্য নয়, বরং এ দেশের প্রেস-স্বাধীনতার হাল-হকিকত তুলে ধরাটাই একমাত্র লক্ষ্য – এই প্রতিশ্রুতিটা না দিলে মরে গেলেও এ কমিটির সদস্য হতে রাজি হতাম না আমি।

১৩ জনের এই কমিটির ১১ জনই হয় আমলা কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গবেষক। কাজটা প্রেস-স্বাধীনতা নিয়ে, অথচ কমিটিতে সাংবাদিকের সংখ্যা মেরেকেটে ২! আমি ছাড়া দ্বিতীয় যে সাংবাদিক ছিলেন তিনি খানদুয়েক মিটিংয়ে পায়ের ধুলো দিয়েছিলেন বটে, তবে টুঁ শব্দটিও করেননি। বহাল তবিয়তে চলেছিল মিটিংগুলো, আমি বাদে গলা তুলে প্রশ্ন-টশ্ন আর কেউই করেনি। এরপর সে এক আজব 'রিপোর্টের খসড়া' তৈয়ারি করা হয় যেখানে 'খসড়া' শব্দটা লেখাই ছিল না। মিটিংগুলোয় তাও বা যে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-টিষয় উঠে এসেছিল, তার একটিও সে খসড়াহীন 'খসড়া' অবধি গিয়ে পৌঁছয়নি। ফলত আমি বাধ্য হই একটি প্রতিবাদমূলক টিপ্পনি জুড়ে দিতে সেই রিপোর্টটির সঙ্গে।

ব্যাস! সেই রিপোর্ট, কমিটি, এক লহমায় সব হাওয়া হয়ে উবে গেল। দেশের সর্বোচ্চ আমলা যাঁরা, যাঁদের একমাত্র কাজই এ দেশের সর্বশক্তিমান দুই যুগপুরুষের খিদমত – খোদ তেনাদের হুকুমে জন্ম নেওয়া কমিটি নাকি টুকুস করে ভ্যানিশ হয়ে গেল! ভাবুন দেখি একবার, প্রেস-স্বাধীনতার উপর বানানো রিপোর্ট হাজারটা আরটিআই ঠোকা সত্ত্বেও দিনের আলো দেখল না। তবে সে 'খসড়ার' একখান প্রতিলিপি কিন্তু আমার কাছে আছে। তদন্তমূলক সাংবাদিকতা তো দূর কি বাত হ্যায়, এই সার্কাসটির মূল লক্ষ্য ছিল ভারতীয় সাংবাদিকতার উপরেই তদন্ত চালানো। ফলত একটা ফোঁটাও বিরোধিতা সইল না বেচারার পেটে, দুম করে হাপিস হয়ে গেল।

সাহেব, আপনি ঠিক যে ধরনের তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করছিলেন না, তেমনটা করতে আগ্রহী অনেকেই আছেন এ দেশে। উঁচুস্য উঁচু অট্টালিকা, বিশেষ করে সরকারি সাতমহলার ফেরেব্বাজি ও ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে তদন্তে নামতে ইচ্ছুক তাঁরা। তবে আজকে এ কাজে হাত দিতে গেলে প্রথমেই কোপ নামাবে তাঁদের কর্পোরেট প্রভুরা। আসলে সে সরকারি চুক্তিই বলুন, কিংবা পূর্বোক্ত সাতমহলায় বসত করা বাবুবিবিরা, তেনাদের সঙ্গে যে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছেন সেসব মনিবের দল।

এই দেবতুল্য মনিবেরা মুনাফাদার খবর ছেপেই কোটিপতি হয়ে যান। এছাড়াও রয়েছে জনসাধারণের সম্পদ নয়ছয় করার লাইসেন্স কিংবা সরকার দ্বারা হাজার হাজার কোটি টাকার জাতীয় সম্পত্তি বেসরকারিকরণের মেহফিল। ক্ষমতাসীন দল যাতে মসনদ দখল করে রাখতে পারে, তার জন্য ভোটের বাজারে তুড়ি মেরে লাখ কোটি টাকা খরচা করে ফেলেন এই মালিকেরা – সুতরাং ক্ষমতার লাস্যে তেনাদের জুড়িদার যারা, সেই সরকারের বিরুদ্ধে তেনাদেরই অধীনে থাকা সাংবাদিকের কলম কি উঠতে দেওয়া যায় আদৌ? ভারতের বুকে এককালে যে পেশাটির সঙ্গে জুড়ে ছিল গর্ব, আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুনাফার গোমুখ, ফলত চতুর্থ স্তম্ভ কেবলই স্তম্ভিত এক দালালির হলফনামা। যে সাংবাদিকতা রাজাকে উলঙ্গ বলার ক্ষমতা রাখে সে যে এ দেশে নেহাতই অনাথ।

অতিমারির আগে ভারতের জনজীবনে সংবাদমাধ্যম তথা সাংবাদিকের ভূমিকা এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি কখনও – আশা করি এই কথাটা আপনার মনে ধরবে সাহেব। কিন্তু এ হেন মাহেন্দ্রক্ষণে মিডিয়া দুনিয়ার রাঘব-বোয়ালের ঠিক কোন কোন পদক্ষেপ নিয়েছিল শুনি? ঘ্যাচাং করে তেনারা বেকারত্বের কোপ নামিয়ে এনেছিল ২,০০০-২,৫০০ সাংবাদিক এবং তার চেয়েও বেশি সংখ্যক অসাংবাদিক মিডিয়াকর্মীর উপর।

PHOTO • Courtesy: TMMK
PHOTO • Shraddha Agarwal

কোভিড-১৯ সামলাতে গিয়ে সরকার বাহাদুর যে কতটা ল্যাজেগোবরে হয়েছিল তা আজ বকলমে ভুলে মেরে দিয়েছে ধামাধরা মিডিয়া। তেনারা বরং সরকারের সেই ফাটা রেকর্ডটা চালাতেই ব্যস্ত যেখানে গাঁথা রয়েছে অতিমারির মোকাবিলায় ভারত সরকারের অসাধারণ ভূমিকা তথা বিশ্ব মাঝে ভারতের কাল্পনিক অগ্রণী ভূমিকার জয়গান

জনগণের সেবা, এই ধারণাটাই হাপিস হয়ে গেছে আজ। ২০২০ সালে মুখ থুবড়ে পড়ে আমাদের অর্থনীতি, ফলত সরকারি বিজ্ঞাপন ছাড়া সংবাদমাধ্যমের টিকে থাকাটা এক কথায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কোভিড-১৯ সামলাতে গিয়ে সরকার বাহাদুর যে কতটা ল্যাজেগোবরে হয়েছিল তা নিয়ে গোড়ার দিকে (গুটিকয়) খবর ছাপলেও আজ সেটা বকলমে ভুলে মেরে দিয়েছে ধামাধরা মিডিয়া। তেনারা বরং সরকারের সেই ফাটা রেকর্ডটা চালাতেই ব্যস্ত যেখানে গাঁথা রয়েছে অতিমারির মোকাবিলায় ভারত সরকারের মহতী ভূমিকা তথা বিশ্বমাঝে ভারতের কাল্পনিক অগ্রণী ভূমিকার জয়গান।

এই সময়টা সাক্ষী থেকেছে ঝামা-ইটের মতো স্বচ্ছ 'পিএম কেয়ারস্ ফান্ড'-এর। শিরোনামে 'প্রধানমন্ত্রী' কথাটা জ্বলজ্বল করছে বা ওয়েবসাইটে প্রধান সেবকের চাঁদবদন শোভা পাচ্ছে তো কী হয়েছে? এটি যেমন সরকারি কর্তৃপক্ষের আওতায় পড়ছে না, তেমনই এটি আরটিআইয়েরও নাগালের বাইরে । এমনকি এটি "ভারত সরকারের নিজস্ব কোনও তহবিলই নয়।" সুতরাং সরকারি কোনও বিভাগের তরফ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক খতিয়ানের আওতায় একে ফেলাটা নিতান্তই অসম্ভব।

সাহেব, এটা কেমনতর যুগ জানেন? স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচাইতে ক্ষতিকারক শ্রম আইনগুলি পাশ করানোর যুগ এটা। এসব আইনকানুন প্রথমে অধ্যাদেশ হিসেবে পাশ করে রাজ্য সরকারগুলো, তার সেটা 'কোড' হিসেবে রূপান্তরিত করে কেন্দ্রীয় সরকার । এক ধাক্কায় একশো বছর পিছিয়ে গেছে এ দেশের শ্রম অধিকার , দিনে আট ঘণ্টার বেশি না খাটার যে স্বর্ণসম অধিকারটি ছিল মজুরদের, সেটা আজ আষাঢ়ে গপ্পো হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার হাজার কর্মী সংবাদমাধ্যমে কাজ করলেও এসব নিয়ে তদন্তে নামা সম্ভব নয় কারণ মিডিয়ার পুরোটাই আজ কর্পোরেটের ট্যাঁকে গোঁজা। তা সত্ত্বেও এ অসাধ্য সাধন করতে যাঁরা এগিয়ে আসতেন – আজ তাঁরা কর্মহীন। মালিকেরা খোলামকুচির মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তাঁদের।

সে সরকারি ভ্রষ্টাচার হোক, গণহারে সাংবাদিক ছাঁটাই হোক, শ্রম অধিকারের মুণ্ডপাত হোক, বা সব ধরনের স্বচ্ছ খতিয়ানের ঘেরাটোপের বাইরে 'প্রধানমন্ত্রী' নামক পদটির আর্থিক স্বেচ্ছাচারিতা – এই তাণ্ডবনৃত্যে বাধ সাধতে কুটোটাও নাড়তে চাইছে না বিচারব্যবস্থা। এইটা যে বড্ডো দুশ্চিন্তার বিষয় হে সাহেব! হ্যাঁ, সংবাদমাধ্যমের সর্ষে বরাবরই ভুতের আস্তানা ছিল ঠিকই, নয়তো সাংবাদিকতা আজ এমন ফেলো-কড়ি-মাখো-তেলে গিয়ে ঠেকত না। তবে সাচ্চা-দিল যে কয়েকজন সাংবাদিক আছেন, তাঁদের বেঁচে থাকার সহায় কি আমাদের বিচারব্যবস্থা একেবারেই হতে পারত না চাইলে?

স্বতন্ত্র মিডিয়ার অফিসে অফিসে সরকারি হামলা, তাদের মালিক তথা সাংবাদিকদের পদে পদে শাসানো, ধমকানো বা 'টাকাকড়ি তছরুপের' কাদা ছোঁড়া, এসব হুহু করে বাড়তে থেকেছে দিনকে দিন। হ্যাঁ, মহামান্য আদালতে এসব ভুয়ো মামলা দু সেকেন্ডও টিকবে না ঠিকই – যেসব দফতরগুলি সরকারের হয়ে শাসিয়ে বেড়াচ্ছে তারা সেটা হাড়ে হাড়ে জানেও। কথাটা আসলে সেটা নয়। 'পদ্ধতি যেথা নিজেই সাজা': এ গুরুমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই রণাঙ্গনে নেমেছে তারা। মামলা মিটতে মিটতে কেটে যাবে বছরের পর বছর, উকিলের পিছনে বয়ে যাবে লাখ লাখ টাকা, ফলত চতুর্থ স্তম্ভের শেষ ক'টি সৎ খিলানও ভেঙে পড়বে দেউলিয়া হয়ে। এমনকি 'দৈনিক ভাস্কর', অর্থাৎ বৃহৎ মিডিয়ার কোলাহলে একমাত্র স্বতন্ত্র স্বাধীন স্বর – রেহাই পায়নি সেটিও, মাফিয়ার আড্ডাখানা ভেবে হামলা চালায় সরকার । স্বাভাবিকভাবেই বৃহৎ মিডিয়ার বাকি সদস্যরা কোনও উচ্চবাচ্য করেনি এটা নিয়ে।

সাহেব, এই যে সজ্ঞানে আমাদের আইনকানুনের গুষ্টির গোটাকলাই করা হচ্ছে, এটা আটকানো কি সত্যিই মহামান্য আদালতের ক্ষমতার বাইরে?

PHOTO • Shraddha Agarwal
PHOTO • Parth M.N.

যে দু'জন কর্পোরেট সম্রাটের কথা স্লোগানে স্লোগানে তুলেছিলেন চাষিরা, তাদের সম্পত্তি এক জায়গায় জড়ো করলে পঞ্জাব বা হরিয়ানার গ্রস স্টেট ডমেস্টিক প্রোডাক্টের পুরোটাই ছাপিয়ে যাবে অনায়াসে – এই কথাটা কি 'মূলধারার' মিডিয়া একটিবারের জন্য হলেও জানিয়েছিল তেনাদের পাঠক তথা দর্শকদের?

মানুষখেকো কৃষি-আইনগুলো রদ হয়েছে বটে, তবে সে ব্যাপারে মাননীয় বিচারব্যবস্থার ভূমিকা তেমন কিছু নজরকাড়া ছিল না। না, আইনকানুন নিয়ে আমি সত্যিই পড়াশোনা করিনি, তবে এটুকু জানি যে এরকম কোনও বিতর্কিত আইনের সাংবিধানিক বৈধতা কতটুকু, সেটা খতিয়ে দেখার দ্বায়িত্ব সাংবিধানিক রূপে সর্বোচ্চ আদালতের উপরেই বর্তায়। তার বদলে মহামতি আদালত একটি কমিটি গঠন করে তাদের হুকুম দিলেন কৃষি-সমস্যার সমাধান বার করতে। সে কমিটি আর তার রিপোর্ট – দুইয়েরই গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে আজ।

ফাঁসি-টাসি ওসব সেকেলে জিনিস, তার বদলে এই 'কমিটি-দ্বারা-মৃত্যু' অনেক পয়া, কমিটি নিজেই কী সুন্দর টেঁসে যায়!

নয়া কৃষি-আইনের এই ডামাডোলের বাজারে বেশ স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে 'মূলধারার' মিডিয়া ও তার স্বার্থের সংঘাত। এই আইন তিনটে থেকে যে পুঁজিপতি সবচাইতে বেশি মুনাফা লুটতো , দেশের ১২ আনা মিডিয়ার মালিক সে নিজেই। বাকি ৪ আনা সরাসরি তেনার পকেটে না থাকলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তেনার বিজ্ঞাপনই বাঁচিয়ে রেখেছে সে সকল সংবাদমাধ্যমকে। সুতরাং মোসাহেব মিডিয়া যে উক্ত কৃষি-আইনের পক্ষে সরাসরি দালালিতে নেমেছিল তাদের সম্পাদকীয়ের পাতায় পাতায়, এ আর এমন আশ্চর্যের কী?

যে দু'জন কর্পোরেট সম্রাটের কথা স্লোগানে স্লোগানে তুলেছিলেন চাষিরা, তাদের সম্পত্তি এক জায়গায় জড়ো করলে পঞ্জাব বা হরিয়ানার গ্রস স্টেট ডমেস্টিক প্রোডাক্টকেও (জিএসডিপি) ছাপিয়ে যাবে অনায়াসে – এই কথাটা কি 'মূলধারার' মিডিয়া একটিবারের জন্য হলেও জানিয়েছিল তেনাদের পাঠক তথা দর্শকদের? ফোর্বস্ পত্রিকার মতে এদের একেকজনের পুঁজি গোটা পঞ্জাবের জিএসডিপিকে টেক্কা দিতে পারে, এটা জানানো কি খুবই কঠিন ছিল? এ সকল তথ্য হাতের নাগালে থাকলে গোটা পরিস্থিতিটা খতিয়ে দেখা তো বেশ সহজ হয়ে উঠত পাঠকদের জন্য, তাই না?

সাহেব, ভাষণে যে তদন্তমূলক সাংবাদিকতা নিয়ে মন খারাপ করছিলেন, তেমনটা করতে পারে এমন সাংবাদিকের সংখ্যা মুষ্টিমেয় আজ, অনুরূপ সংবাদসংস্থার কথা তো ছেড়েই দিলাম না হয়। উপরন্তু আমজনতার হাল-হকিকত (অর্থাৎ এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি তুলে ধরা) নিয়ে যাঁরা তদন্ত করছেন, তাঁদের খুঁজতে বেরোলে অতলে তলিয়ে যাবে পরিসংখ্যানটি। আজ ৪১ বছর হতে চলল, ওই দ্বিতীয় ঘরানাতেই সংসার পেতেছি আমি।

তবে আমজনতার হাল-হকিকত নিয়ে তদন্ত করা বা তাঁদের জীবনযাপনের উন্নতির নিমিত্তে ঘাম ঝরানো – এই কাজে বহু অ-সাংবাদিকেরাও রয়েছেন বটে। ঠিক এই জাতীয় অলাভজনক তথা নাগরিক সংগঠনদেরকেই বেছে বেছে তাদের উপর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার বাহাদুর। বাতিল হয়ে গেছে এফসিআরএ , অফিসে অফিসে নেমে এসেছে হামলা, ঠোকা হয়েছে পয়সাকড়ি তছরুপের ভুয়ো মামলা – যতক্ষণ না তাদের দুয়ারে লালবাতি জ্বলছে ততক্ষণ সাম-দান-দণ্ড-ভেদ সবকিছু প্রয়োগ করে গেছে আমাদের প্রভুরা। বিশেষ করে যে দলগুলি জলবায়ু পরিবর্তন, শিশুশ্রম, চাষবাস এবং মানবাধিকার নিয়ে লড়ছে, তারাই পড়েছে রাষ্ট্রের রোষানলে।

তাহলে এই কথাটাই রইল শেষমেশ – একদিকে মিডিয়ার বেহাল দশা, ওদিকে সে হাল সামলানোর দ্বায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানের, তারা হাতের উপর হাত চাপিয়ে বসে আছে চুপটি করে। সাহেব, ছোট ছোট কয়েকটা মর্মভেদী মন্তব্য ছিল আপনার বক্তৃতায়, সে কারণেই এ খোলা-চিঠিটা না লিখে পারলাম না। নিঃসন্দেহে আদাজল খেয়ে কাজে লেগে পড়তে হবে মিডিয়াকে, তবে যদি ফুট কাটি যে এটার দায় বিচারব্যবস্থার উপরেও বর্তায়, তাহলে রাগ করবেন না তো সাহেব? একটা কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি জানেন তো? যতদিন এ দেশের সিদ্দিক কাপ্পানেরা জেলে পচে মরবে ন, ততদিন বেশি বেশি করে কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হবে আমাকে, আপনাকে, আমাদের সব্বাইকে... না মিডিয়া, না বিচারব্যবস্থা, রেহাই পাবে না কেউই।

ভবদীয়,
পি. সাইনাথ

চিত্রণ: পারিপ্লব চক্রবর্তী, ঋণ স্বীকার: দ্য ওয়্যার

এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য ওয়্যারে

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra