"ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন যখন আপনার স্বামী বৈদ্যনাথ ১৩ মাসের জন্য জেলে আটক ছিলেন তখন আপনার বেজায় কষ্ট হয়েছিল, তাই না? এত বড়ো একটা একান্নবর্তী পারিবার সামলানো তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়... আর তাছাড়া…" পুরুলিয়ার ভবানী মাহাতোকে প্রশ্ন করেছিলাম আমি।

“ফিরে আসার পর বরং ঝামেলা বাড়ল! ফিরে আসার মানে দাঁড়ালো যখন তখন স্যাঙ্যাৎদের নিয়ে আসবে, আমাকে তাদের আহারের ব্যবস্থা দেখতে হবে, আর নইলে তারা এসে রাঁধা খাবারদাবার তুলে নিয়ে যাবে। সময়ে অসময়ে পাঁচ, দশ বা কুড়ি অথবা তারও বেশি লোক এসে হাজির হত! একটা মিনিট যে একটু দম নেব, তার জো ছিল না,” ঠাণ্ডা গলায় তাঁর সদৃঢ় জবাব।

“কিন্তু, মানে বলছিলাম যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সঙ্গে আপনার যে যোগ…”

“ওইসব ব্যাপারস্যাপারের সঙ্গে আমার আবার কীসের যোগসাজশ?” তাঁর সপাট প্রশ্ন। “ওই আন্দোলনের সঙ্গে আমার কোনও লেনদেন নেই, সে ছিল বটে আমার স্বামী বৈদ্যনাথ মাহাতোর। আমার থোড়াই ওসবের সময় ছিল। এই এত্ত বিরাট সংসারের সবার দেখাশোনা, একগাদা লোকজন, তাদের সবার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি রান্না করতে হত না, বলুন দেখি! দিন কে দিন কাজ বেড়েই যেত! আর মনে রাখবেন এতসবের উপর ছিল চাষবাসের যাবতীয় কাজ,” বলে উঠলেন ভবানী দিদা।

এমনতর কথা শুনে আমরা তো হতবাক। হাবেভাবেই বোঝা যাচ্ছিল আমরা যারপরনাই নিরাশ। কতখানি পথ পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই প্রত্যন্ত এলাকায় আমরা এসেছি এখনও বেঁচে থাকা প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খোঁজে। আর এই মানবাজার ১ ব্লকের চেপুয়া গ্রামে আমাদের সামনে বিরাজমান আছেন যিনি, যাঁকে সব অর্থেই সেই মহান ভূমিকা পালনকারী এক আদর্শ চরিত্র বলে মনে হচ্ছিল, তিনিই কিনা ভারতের স্বাধীনতার সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামে তাঁর নিজের অবদানকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসে জল ঢেলে দিলেন!

কি অসাধারণ স্বচ্ছতা এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভবানী দিদা কথা বলছিলেন – ভেবে দেখার মতো ব্যাপার যে তিনি এমন এক মানুষ যাঁর বয়স কিনা ১০১ থেকে ১০৪ বছরের মধ্যে। প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলের আম মানুষের বয়স নির্ধারণ করা আজকের দিনেও তো কম বিড়ম্বনার ব্যাপার নয়। আর এক শতাব্দী পূর্বে ভবানী মাহাতোর ভূমিষ্ঠ হওয়ার কালে জন্ম সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজের কোনও বালাই ছিল না। প্রয়াত স্বামীর নথিপত্র, মধ্য ৭০-এর তাঁর ছেলে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বয়স এবং পুরুলিয়ার এই এলাকার অন্য আর পাঁচটা গ্রামে তাঁর চেয়ে বয়সে খানিক ছোটো অথচ সমসাময়িক মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা - ইত্যাদি নানান অনুষঙ্গের মাধ্যমে তাঁর মোটামুটি সঠিক একটা বয়স আমরা ঠাহর করতে পেরেছিলাম।

বয়স নির্ধারণের এই পদ্ধতি, যা হোক একটা বয়স লিখে পাট চুকিয়ে দেওয়া আধার কার্ড নামক গেরোর চেয়ে ঢের বেশি ভরসাযোগ্য। আধার কার্ডের নিরিখে ভবানী মাহাতোর জন্মের সাল ১৯২৫, সেই হিসেবে তাঁর বয়স এখন মোটে ৯৭।

অথচ পরিবারের মানুষজন বলছেন তাঁর বয়স অন্তত ১০৪।

Bhabani’s age is somewhere between 101 and 104. Here she is with her son Shyam Sundar Mahato who is in his 70s
PHOTO • P. Sainath

ভবানী মাহাতোর বয়স ১০১ থেকে ১০৪ বছরের মধ্যে। ছবিতে ভবানী মাহাতোর সঙ্গে রয়েছেন তাঁর পুত্র শ্যাম সুন্দর মাহাতো। তাঁর বয়স ৭০-এর কোঠায়

"আমাদের সংসারখানা ছিল বিশাল, আর তার দায়দায়িত্ব সব আমার ঘাড়ে। যাবতীয় কাজকর্ম আমিই সামলাতাম। সবকিছুর বন্দোবস্ত করা, সংসারের খুঁটিনাটির খেয়াল রাখা – কাজের সে লম্বা ফিরিস্তি। ১৯৪২-৪৩ সালে যখন এই সমস্ত ঘটনা ঘটছিল তখন আমার কাজ ছিল সব্বার দেখাশোনা করা।” ভবানী দিদা অবশ্য সেসব ‘ঘটনার’ কথা ভেঙে না বললেও, বলাই বাহুল্য যে তার মধ্যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনও সামিল ছিল। আর ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একযোগে ১৯৪২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ১২টি থানা ঘেরাও করে তেরঙ্গা উত্তোলনের সেই অধ্যায় যা এই পুরুলিয়ার ইতিহাসের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ  মুহূর্ত – এই এলাকা সেদিনও শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়নে সর্বাধিক জর্জরিত অঞ্চলগুলির একটা ছিল।

পুরুলিয়া এমন এক জেলা যেখানে আজও, মোট পরিবার-সংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। স্বাধীনতা উত্তর সময়েও দারিদ্র্য সূচকের নিরিখে এই জেলার স্থান পশ্চিমবঙ্গে সবার উপরে । ভবানী মাহাতোর একান্নবর্তী পরিবারের হাতে বেশ কয়েক একর জমি ছিল, বর্তমানেও তা বজায় আছে বলেই তাঁদের অবস্থা অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো।

তাঁর স্বামী তথা অঞ্চলের নেতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব বৈদ্যনাথ মাহাতো ব্রিটিশ সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। পুরুলিয়ায় পিঁড়রা গ্রামে বসবাসকারী এখনও বর্তমান অপর দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী ঠেলু মাহাতো এবং লক্ষ্মী মাহাতো আমাদের বলেছিলেন তাঁদের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে কোনও খবর এসে পৌঁছতে অনেক দিন গড়িয়ে যেত। ঠেলু মাহাতোর কথায়, "আমাদের এখানে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক এসে পৌঁছেছিল মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রায় একমাস পরে।"

আর তাই এখানে থানা ঘেরাও করার অপারেশনটি ১৯৪২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর সংঘটিত হয়। ১৯৪২ সালের ৪ঠা অগস্ট মুম্বইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দান থেকে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে মহাত্মা গান্ধীর 'ভারত ছাড়ো' ডাক দেওয়ার পাক্কা ৫৩ দিন পরে। বৈদ্যনাথকে এই ঘটনা পরবর্তী ধরপাকড়ে গ্রেপ্তার করা হয়, তিনি ইংরেজ সরকারের দমনের শিকার হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি শিক্ষকের কাজে ব্রতী হন। সেইসময়ে শিক্ষকেরা মানুষকে রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে সংগঠিত করার কাজে সমাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। আর এই ভূমিকায় তাঁরা স্বাধীন ভারতে বেশ কয়েক দশক ধরে বহাল ছিলেন।

*****

Bhabani ran the family’s farm for decades right from preparing the soil for sowing, to supervising the labour and the harvesting. She even transported the produce back home herself
PHOTO • P. Sainath

বহু দশক জুড়ে তিনি পারিবারিক জমিজিরেত পরিচালনা করেছেন। জমি তৈরি করা থেকে শুরু করে বীজ বোনা, মুনিশদের তদারকি, আগাছা নিড়ানো, ফসল কাটা সবই করতেন তিনি। আর ছিল খেত থেকে সেই ফসল বাড়ি অবধি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা

পুলিশ চৌকি দখল করে পতাকা উত্তোলনের এই কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল নানান গোষ্ঠী। চূড়ান্ত শোষণমূলক ব্রিটিশ শাসনে নাজেহাল জনগণও ছিল চরম ক্ষুব্ধ আর বিরক্ত। বিবিধ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষজনের মধ্যে থেকে গড়ে উঠেছিল সমবেত প্রতিরোধ। তাঁদের মধ্যে বামপন্থী বিপ্লবীরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন গান্ধীবাদী ভাবনায় উদ্বুদ্ধ মানুষজন। ছিলেন ঠেলু এবং লক্ষ্মী মাহাতোর মতো অনন্য মানুষেরা যাঁরা আদর্শগত অবস্থানে ছিলেন বামপন্থী, আর যাপনে, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে গান্ধীবাদী।

রাজনীতি, আবেগ তাঁদের সম্পৃক্ত ছিল বাম আদর্শের সঙ্গেই। নৈতিক চরিত্র এবং জীবনযাপনের রীতিতে তাঁরা ছিলেন গান্ধীর অনুসারী। এই দুই পথের নিয়ত টানাপোড়েন তাঁদের আচ্ছন্ন করত। অহিংসায় তাঁদের আস্থা থাকলেও সময় বিশেষে ব্রিটিশদের অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধের পথেও হাঁটতেন। তাঁদের বক্তব্য: “দেখুন, ওরা আমাদের উপর গোলাগুলি চালাত। এখন লোকে নিজের চোখের সামনে বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন বা কমরেডদের পুলিশের গুলি খেতে দেখলে, তারা হাত গুটিয়ে থোড়াই বসে থাকবে! প্রতিশোধ তো নেবেই।” ঠেলু এবং লক্ষ্মী মাহাতো উভয়েই কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষ।

ভবানী দিদার পরিবারও এই কুড়মি সম্প্রদায়ভুক্ত, এটি পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল অঞ্চলের বৃহত্তম সম্প্রদায়।

ব্রিটিশ সরকার ১৯১৩ সালে কুড়মি সমাজকে তফসিলি জনজাতি হিসাবে চিহ্নিত করে। ১৯৩১ সালের আদমশুমারিতে তাঁদের তফসিলি জনজাতির আওতার বাইরে রাখা হয়। মজার ব্যাপার এই যে ১৯৫০ সালে ভারতে তাঁদের ওবিসির তকমা জোটে। তফসিলি জনজাতির পরিচিতি ফিরে পাওয়া এই রাজ্যের কুড়মি সমাজের অন্যতম প্রধান একটি দাবি।

স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোভাগে ছিলেন এখানকার কুড়মিরা। ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দুই দিন জুড়ে ১২টি পুলিশ থানার দখল নেওয়ার যে পরিকল্পনাটি হয়েছিল তাতে কুড়মি সমাজের অসংখ্য মানুষ অংশ্রগ্রহণ করেছিলেন।

Baidyanath Mahato was jailed 13 months for his role in the Quit India stir
PHOTO • Courtesy: the Mahato family

ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন বৈদ্যনাথ মাহাতোর ১৩ মাসের জেল হয়

৭০-এর কোঠায় পৌঁছানো বৈদ্যনাথের ছেলে শ্যাম সুন্দর মাহাতো আমাদের বলছিলেন, "বাবা এর পরে ১৩ মাস জেলে আটক ছিলেন, তাঁকে ভাগলপুর ক্যাম্প জেলে রাখা হয়েছিল৷” বৈদ্যনাথের কারাবাসের প্রসঙ্গেই আমরা জানতে চেয়েছিলাম স্বামী হাজতে থাকাকালীন ভবানী দিদাকে কতই না যাতনা সইতে হয়েছিল। আর তখনই তিনি আমাদের সেই মোক্ষম জবাবখানি দিয়েছিলেন – হাজতবাস শেষে বাড়ি ফিরে আসার পর জ্বালা বরং আরোই বেড়ে গিয়েছিল!

“ওঁনার ফিরে আসার পর বাড়িতে লোকের আনাগোনা লেগে থাকত। এতোগুলো বাড়তি লোকের যত্নআত্তির, আহারের ব্যবস্থাও তো করতে হত। আমি কান্নাকাটি করতাম, রেগে যেতাম যে এইসব বড়ো বড়ো ব্যাপার আমার উপর এত এত দায়িত্ব আরোপ করত, পরিবারের উপরেও তো এর প্রভাব পড়ত। উনি ফিরে এলে আমার কাজের আর অন্ত থাকত না।"

স্বামীর কথা সরিয়ে আমরা ভবানী দিদার প্রতি আমাদের যাবতীয় মনোসংযোগ ফিরিয়ে আনা সমীচীন বোধ করলাম। আমরা জানতে চাইলাম, মহাত্মা গান্ধী কি তাঁর ভাবনাচিন্তায় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন? সত্যাগ্রহ এবং অহিংসা – এই দুই নৈতিক অবস্থান সম্বন্ধে তাঁর মতামতই বা কি?

শান্ত, সপ্রতিভ এবং স্পষ্টবাক ভবানী মাহাতো আমাদের দিকে স্নিগ্ধ চাউনি ভরা চোখে তাকিয়ে যেন বা বলতে চাইলেন এই যে এতক্ষণ ধরে লাগাতার তিনি কত কিছু ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, এই অর্বাচীন গণ্ডমূর্খ দুটোর মাথায় কি তার বিন্দুবিসর্গও ঢোকেনি!!

"গান্ধী... আপনাদের বক্তব্যটা ঠিক কি বাবা? কি বলতে চাইছেন? আপনারা বুঝি ভাবছেন আমার বসে বসে এইসব চিন্তাভাবনা করার অঢেল সময় ছিল? বলছি তো দিনে দিনে লোকের সংখ্যা বেড়েই চলত… সবার দেখাশোনা থেকে শুরু করে রাঁধা-বাড়া আর খেতে দেওয়া সবই তো আমি করতাম,” হাত নেড়ে নিজের বক্তব্য জোরের সঙ্গে তুলে ধরলেন ভবানী দিদা।

“একটা কথা বোঝার চেষ্টা করুন - বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। তখন বুঝি আমার এতো বড়ো বড়ো বিষয় নিয়ে ভাবার অবস্থা ছিল? তারপর কয়েক দশক ধরে আমি একা হাতে এই বিরাট পরিবারের দায়দায়িত্ব সামলে গিয়েছি। আর এটাও জানবেন যে এইসব ছাড়াও চাষবাসের কাজের যাবতীয় ব্যাপারস্যাপার আমিই দেখতাম। জমি তৈরি করা থেকে শুরু করে বীজ বোনা, মুনিশদের (শ্রমিক) তদারকি, আগাছা নিড়ানো, ফসল কাটা সবই তো করতে হত ..." তাতেও যদি নিস্তার মেলে! তারপর তিনি মুনিশদের আহারের ব্যবস্থাও নিজেই করতেন।

আর হ্যাঁ, তাঁর চাষের কাজের মধ্যে বনজঙ্গল লাগোয়া নিজেদের খেত থেকে ফসল ঘর অবধি নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করার গুরু দায়িত্বটিও ছিল কিন্তু।

আর একথাও স্মরণে রাখা দরকার সে যুগে এই সমস্ত কাজ করার জন্য কোনও প্রকৌশলগত যান্ত্রিক বিকল্প ছিল না – বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতির তো কোনও প্রশ্নই উঠছে না। অর্থাৎ, খেতে চাষের কাজে তাঁর যে হাড়ভাঙা খাটনি তা সেই মান্ধাতার যুগের সাজসরঞ্জাম নির্ভর ছিল – আজও এই অবস্থা বর্তমান – চাষের কাজে ব্যবহৃত যাবতীয় সরঞ্জামই পুরুষের বড়ো পাঞ্জা আর হাতের নিরিখেই নির্মিত৷ আর তার উপর এই এক খরা-প্রবণ অঞ্চলটি আর্থিক বৈষম্য এবং ক্ষুধায় জর্জরিত।

বৈদ্যনাথের সঙ্গে বিয়ের প্রায় তিন দশক পরে, তাঁর স্বামী আরও একবার বিয়ে করেন। দ্বিতীয়বারে যাঁর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হল তিনি আর কেউ নন, ভবানীর চেয়ে বয়সে  ২০ বছরের ছোটো, তাঁর বোন উর্মিলা। আত্মীয়রা জানালেন যে একটি জটিল পারিবারিক সংকটের কারণে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। দুই বোনই তিনটি করে সন্তানের জন্ম দেন।

PHOTO • P. Sainath
PHOTO • P. Sainath

পুরুলিয়া জেলার চেপুয়া গ্রামে নিজের ভিটে-বাড়িতে ভবানী মাহাতো

ক্রমশ আমাদের মগজে স্পষ্ট হচ্ছিল ভবানী দিদার শ্রমের দুনিয়াটি – ফসল ফলানো, শস্য কাটা, বাড়ি অবধি তা বয়ে আনা আর অবশেষে সেই শস্য পরিবার-পরিজনের জন্য নিজের হাতে রাঁধা – এইসবটাই তো তিনিই করতেন একা হাতে। ১৯২০ এর দশকের শেষ থেকে শুরু করে ১৯৩০ আর ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত অবিরাম তিনি এতকিছু সামাল দিয়েছেন।

ঠিক কত একর জমির চাষাবাদের কাজ তাঁর জিম্মায় ছিল তা একটু আবছা হয়ে এসেছে এতদিন পরে। যে জমিতে পরিবার কৃষিকাজ করত, তা আদতে ছিল তখনকার জমিদারি ব্যবস্থার অধীন। ফলত সেসময়ে জমির মালিকানার পাট্টা বা দলিলের কোনও প্রশ্নই ছিল না। সবই নির্ধারিত হত জমিদারের খেয়ালখুশি মাফিক। ২০ জনেরও অধিক সদস্য সম্বলিত ভবানী দিদার পরিবারটি নির্ভরশীল ছিল তাঁর নিজের মা-বাবা এবং স্বামীর পরিবার মিলিয়ে মোট ৩০ একর জমির উপর।

কাজের নির্মম বোঝার চাপে দিনের প্রায় প্রতিটি ঘণ্টা উপচে উঠত, যতক্ষণ জেগে থাকতেন কাজ আর পিছু ছাড়ত না। সত্যি কথা বলতে, জেগে থাকার ঘণ্টাগুলোর বাইরে দিনের আর বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট থাকত না।

ভোরে কটায় উঠতেন তাহলে? ৪টে বাজলেই? আমাদের হিসেব উড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, "তারও ঢের আগে, অনেকটা আগে।" তার মানে দাঁড়াচ্ছে রাত ২টোতেই তিনি উঠে পড়তেন। “আর রাত ১০টার আগে ঘুমানোরও তো জো ছিল না। বরং তারও অনেকটা পরেই ঘুমাতাম।”

ভবানী দিদার প্রথম সন্তানটি আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। “গ্রামের কবিরাজ মশাইয়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। মোটে একবছর বয়স ছিল তার।”

আরও একবার গান্ধী এবং সংগ্রাম-আন্দোলনের কথা তোলার চেষ্টা করতে তিনি বলে উঠলেন "মা হওয়ার পর, আমি আর চরকা কাটার বা অন্য যা কিছু করতাম সেসবের সময়ই পাইনি।” আবারও একবার মনে করিয়ে দিলেন, "৯ বছর বয়সে তো আমার বিয়েই হয়ে গেল!”

কিন্তু তারপরে, যে ঘটনাবহুল সময়গুলির মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল, যেসব পর্বত-প্রমাণ সমস্যা তিনি পার করছিলেন, তাতে করে ভবানী দিদা নিশ্চয়ই মানুষকে বিহ্বল করে তোলে এমন খানতিনেক তৎকালীন অভিজ্ঞতার কথা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেই পারেন, তাই না?

“আরে বাবা, আমি  তো প্রতি মুহূর্তেই বিহ্বল হয়ে থাকতাম! আমার জীবনটা যে ঠিক কোন খাতে বইছিল, তা যদি আপনারা একটু দয়া করে বোঝার চেষ্টা করেন। বাছা, আপনাদের বুঝি মনে হয় আমার বসে বসে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ ছিল? সারাক্ষণ মাথায় একটাই চিন্তা পাক খেত - কেমন করে সব সামলাব, কেমন করে এই বিরাট সংসার ঠেলব। বৈদ্যনাথ এবং তাঁর মতো আরও অন্যান্যরা সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। আমার কাজ ছিল সবাইকে খেতে দেওয়া।"

যখন এত ভার দুঃসহ হয়ে উঠত, এত কিছু সামলাতে গিয়ে শরীর মন যখন জেরবার হয়ে উঠত, কী করতেন তখন তিনি? “মায়ের কাছে বসে বসে কাঁদতাম। আর হ্যাঁ আমার স্বামী যখন সঙ্গে করে লোকজন নিয়ে আসতেন আর তাদের সবার জন্য আমাকে রান্নাবান্না করতে হত, আমি তখন মোটেও বিরক্ত হতাম না। আমার শুধু বড্ডো কান্না পেত।"

কথাগুলি তিনি আবারও উচ্চারণ করলেন, তাঁর ভেতরে যেন বা এই আকুতি কাজ করছিল যে আমরা তাঁর পরিস্থিতিটুকু যেন মরমে অনুভব করতে পারি - "আমি মোটেই বিরক্ত হতাম না, আমার বড্ডো কান্না পেত।"

*****

স্মরণে রাখা দরকার ১৯৪০-এর দশকে যখন তিনি একা হাতে সব সামাল দিচ্ছিলেন, সেটা ছিল বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়। বলাই বাহুল্য, তাঁর জন্য এটা ছিল কল্পনাতীত কষ্টের সময়

ভিডিও দেখুন: ভবানী মাহাতো: পুরুলিয়ার অনভিলাষী স্বাধীনতা সংগ্রামী

বিদায় নেব বলে চেয়ার ছেড়ে আমরা উঠে দাঁড়াতেই, তাঁর নাতি পার্থ সারথি মাহাতো, যিনি নিজেও বৈদ্যনাথের মতোই একজন শিক্ষক, আমাদের বসতে বললেন। কয়েকটি মাত্র শব্দই সেই অমোঘ মুহূর্তে পার্থদা আমাদের বলেছিলেন।

অকস্মাৎ ধোঁয়াশার সব পরত সরে গেল।

এই একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য বাদে আর যাঁদের জন্য তিনি রান্না করতেন সেই মানুষগুলো ঠিক কারা? সেই যে মাঝে মাঝেই বৈদ্যনাথ যে পাঁচ-দশ-বিশ জন লোকের আহার প্রস্তুত রাখতে বলতেন স্ত্রী ভবানী মাহাতোকে?

“আসলে ঠাকুমা খাবারদাবার রান্না করতেন বিপ্লবীদের জন্য, ব্রিটিশবিরোধী আন্ডারগ্রাউন্ড প্রতিরোধে সামিল সেসব মানুষেরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতেন, বনে-জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে থাকতেন।"

পার্থদার কথা শুনে আমরা নির্বাক বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত বসে রইলাম। সম্মুখে উপবিষ্ট এই প্রবীণার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগে আমরা তখন অভিভূত। নয় বছর বয়স থেকে যে দায়ভার বহন করেছেন সারাটা জীবন, তার একটা মুহূর্তও তাঁর নিজের জন্য ছিল না।

১৯৩০ এবং ৪০-এর দশকে তিনি যা কিছু করেছিলেন তা যদি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ বলে পরিগণিত না হয়, জানি না তাহলে সেই অবদানের স্বরূপ কী।

তাঁর পুত্র এবং অন্যান্য সদস্যরা আমাদের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকালেন - আমরা যে এতক্ষণ এই কথাটা বুঝতেই পারিনি এতে তাঁরা বেজায় অবাক হয়েছেন। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে আমরা এই বিষয়ে অবহিত, সজাগ।

আচ্ছা, ভবানী দিদা নিজে জানতেন তিনি ঠিক কি করছেন এবং কাদের জন্য?

বিলক্ষণ জানতেন! তবে হ্যাঁ, তিনি তাঁদের নাম জানতেন না, আর হয়তো ব্যক্তি হিসাবে তাঁদের চিনতেনও না। বৈদ্যনাথ এবং তাঁর সহযোদ্ধা বিপ্লবীরা গ্রামের মহিলাদের রান্না করা খাবারদাবার ওইসব পলাতক ছুপা রুস্তমদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত এমনভাবেই করতেন যাতে উভয় পক্ষেরই নিরাপত্তা যতটা সম্ভব বজায় থাকে।

তৎকালীন পুরুলিয়ার পরিস্থিতি বিষয়ে উৎসাহী গবেষক পার্থদা পরে আমাদের বুঝিয়ে বলেছিলেন: “গ্রামে শুধুমাত্র হাতেগোনা কতিপয় অপেক্ষাকৃত ভদ্রস্থ আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন পরিবারই সময়ে সময়ে অল্প বা বহুসংখ্যক আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবীদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা করত। তাঁদের ক্ষুধানিবৃত্তির কাজে নিযুক্ত মহিলাদের উপর নির্দেশ থাকত রাঁধা খাবারদাবার যেন রান্নাঘরেই রেখে দেওয়া হয়।"

“কাদের জন্য রান্না করছেন, অথবা কে এসে খাবার নিয়ে গেল এসব কথা ঠাকুমারা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না। প্রতিরোধে সামিল বিপ্লবীরা পারত পক্ষে গ্রামের সাধারণ মানুষদের খাবার বহনকারীর ভূমিকায় ব্যবহার করতেন না। আসলে গ্রামে গ্রামে ইংরেজদের খোচর ছিল। ঔপনিবেশিক শাসকের দোসর সামন্তপ্রভু বা জমিদাররাও গুপ্তচর পুষতেন। এইসব চরেরা তো খুব সহজেই খাবারদাবার বহনকারী স্থানীয় বাসিন্দাদের চিনে নিতে পারবে। এর ফলে এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত মহিলারা ও গা ঢাকা দেওয়া বিপ্লবীরা – উভয়পক্ষের নিরাপত্তাই বিপন্ন হবে। আর রাতবিরেতে যাঁরা এসে খাবার নিয়ে যেতেন, তাঁদেরও যাতে সনাক্ত না করা যায় সেটাও মাথায় রাখতে হত। কে যে কখন এসে রসদ তুলে নিয়ে গেল, তা মহিলারা চর্মচক্ষে দেখতে পেতেন না।”

“এইসবই ছিল উভয়পক্ষকে বিপদ থেকে দূরে রাখার কৌশল। তবে হ্যাঁ, ঠিক কি ঘটছে তা মেয়েরা আলবাত জানতেন। তাঁদের অধিকাংশই রোজ গ্রামের পুকুর অথবা দীঘিতে স্নানের সময়ে সমবেত হতেন। পরস্পরের মধ্যে খবর বিনিময় চলত। সাধারণভাবে তাঁরা জানতেন বটে ঠিক কি করছেন এবং কেনই বা করছেন – কিন্তু নির্দিষ্ট ঘটনার খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁরা অবহিত ছিলেন না।”

*****

PHOTO • P. Sainath

ছবিতে পরিবারের ১৩ জন সদস্যের সঙ্গে ভবানী মাহাতো এবং (নিচে ডানদিকে) তাঁর নাতি পার্থ সারথী মাহাতো। পরিবারের সব সদস্য অবশ্য ছবিটি তোলার সময়ে উপস্থিত ছিলেন না

এই 'মহিলা'দের মধ্যে কিশোরীরাও ছিল। মনে রাখা দরকার কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এইসকল কাজকর্ম। ভবানী দিদার বাড়ি পুলিশ এসে হানা দিলে কী হবে? তাঁর নিজের এবং তাঁর ভরসায় থাকা সংসারটিরই বা কি গতি হবে যার যাবতীয় দায়দায়িত্বই তাঁর ছিল? এইসব দিক বিচার করলে দেখা যায়, মোটের উপর আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী পরিসরের নিজস্ব নিয়মবিধি বেশ কার্যকরী ছিল।

স্বদেশী আদর্শ, চরকা এবং ব্রিটিশবিরোধী প্রতিরোধের অন্যান্য প্রতীকগুলিকে যেসব পরিবারগুলি বরণ করে নিয়েছিল তাদের উপর সর্বদা নজরদারি চলত। কাজেই বিপদের আশংকা মোটেই অমূলক ছিল না।

গা ঢাকা দেওয়া বিপ্লবীদের জন্য ভবানী দিদা কী রাঁধতেন? আমাদের সঙ্গে মোলাকাতের পর পার্থদা তাঁর ঠাকুমার হয়ে আমাদের নানান কথা বুঝিয়ে বলেন। জনার (ভুট্টা), কোদো (বাজরা, মিলেট বিশেষ), মাড়োয়া (রাগি, মিলেট বিশেষ) এবং মহিলারা যেসব সবজি সংগ্রহ করতে সক্ষম হতেন। ফলে একটা কথা স্পষ্ট, ভবানী দিদা এবং তাঁর মতো মহিলাদের দৌলতে আমাদের বিপ্লবীরা নিজেদের রোজকার জীবনের নিয়মিত খাদ্যই পেতেন।

আর সময়ে অসময়ে পেট ভরানোর জন্য চিঁড়ে, মুড়ি সম্বল ছিল। মহিলারা মাঝেমধ্যে ফলও পাঠাতেন। সঙ্গে বনকুল জাতীয় বুনো ফলমূল তো ছিলই। এছাড়া ক্যাঁদ (তিরিল) ফলটির কথা সমাজের প্রবীণ সদস্যরা প্রায়শই বলেন। একাধিক আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষায় তিরিলের অর্থ বনের ফল।

পার্থদা বলছিলেন যে তাঁর জোয়ান ঠাকুরদা হঠাৎ হঠাৎ এসে হাজিও হতেন আর দিদাকে নানান আদেশ দিতেন। জঙ্গলে গা ঢাকা দেওয়া কমরেডদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ মানে ছিল বহু সংখ্যক মানুষের জন্য রান্নার বন্দোবস্ত।

তবে কিনা ব্রিটিশরাই একমাত্র আপদ ছিল না। স্মরণে রাখা দরকার ১৯৪০-এর দশকে যখন তিনি একা হাতে সব সামাল দিচ্ছিলেন, সেটা ছিল বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়। বলাই বাহুল্য, তাঁর জন্য এটা কল্পনাতীত কষ্টের সময় ছিল।

স্বাধীনতার পরও তাঁর দুঃসাহসিক সব কর্মকাণ্ড জারি ছিল। ১৯৫০-এর দশকে, এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে চেপুয়া গ্রামে তাঁদের পুরো পাড়াটিই ভস্মীভূত হয়ে যায়। পাড়াপড়শিদের ঘরে মজুত করে রাখা রসদ, শস্য সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভবানী দিদা জনড়া গ্রাম থেকে তাঁর নিজের পরিবারের জমিতে উৎপন্ন শস্য আনার ব্যবস্থা করেন। পরের খেপের ফসল না ওঠা অবধি এই রসদই গ্রামের কত না পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিল।

১৯৬৪ সালে বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) জামশেদপুর অঞ্চলে একটি বড়ো মাপের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমশ এর আঁচ এসে পোঁছায় পুরুলিয়ায়, তার জেরে বেশ কয়েকটি গ্রামে আগুন জ্বলে। ভবানী দিদা এই কঠিন সময়ে তাঁর গ্রামের বহু মুসলমান পড়শিকে নিজের বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

এই ঘটনার দুই দশক পরে, যখন ভবানী দিদার বেশ বয়স হয়েছে, সেই সময়ে এক খাটাসের উৎপাতে গ্রামের নাজেহাল মানুষ হন্যে হয়ে জানোয়ারটিকে ধরার অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হন। পার্থদা আমাদের জানিয়েছিলেন কেমন করে একটা চ্যালাকাঠের টুকরো দিয়ে তাঁর ঠাকুমা সেটাকে নিকেশ করেন।

*****

PHOTO • Courtesy: the Mahato family

১৯৮০-এর দশকের একটি ছবিতে স্বামী বৈদ্যনাথ মাহাতো এবং বোন উর্মিলা মাহাতোর সঙ্গে ভবানী মাহাতো (মাঝখানে)। পূর্ববর্তী সময়ের কোনও পারিবারিক ছবি পরিবারের সংগ্রহে ছিল না

ভবানী মাহাতোর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা নিরন্তর বাড়ছিল। মনে পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী গণপতি যাদবকে নিয়ে লেখা সেই গল্পটা। সাতারার আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী বাহিনীর জন্য তিনি বার্তাবাহকের কাজ তো করতেনই, সেই সঙ্গে জঙ্গলের গোপন ডেরায় লুকিয়ে থাকা বিপ্লবীদের জন্য খাবারও সরবরাহ করতেন। এই ৯৮ বছর বয়সী প্রবীণের সঙ্গে দেখা করার সময়েও তিনি দৈনিক ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতেন। বিস্ময়কর এই মানুষটির কথা লিখতে পারা যারপরনাই আনন্দের ব্যাপার ছিল। এত ঝুঁকি নিয়ে তিনি খাবারদাবার বয়ে নিয়ে যেতেন বিপ্লবীদের জন্য, কিন্তু তাঁকে আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি তাঁর স্ত্রীর কথা যিনি কিনা নিজের হাতে এইসব খাবার রান্না করতেন।

গণপতি যাদবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম যখন, সেইসময়ে তাঁর স্ত্রী কোনও এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন।

গণপতি যাদব মারা গেছেন, কিন্তু ভবানী মাহাতোর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকার আমাদের ভাবনাচিন্তাকে প্রসারিত করেছে, একটা নতুন উপলব্ধি আমাদের মননকে প্রভাবিত করেছে। বৎসলা গণপতি যাদবের কাছে ফিরে যেতে হবে… তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁর কাছে শোনা বাকি আছে তাঁর নিজের গল্প, তা শুনতে তাঁর কাছে যেতে হবে।

ভবানী মাহাতো আমাকে লক্ষ্মী পাণ্ডার সেই জোরালো কথাগুলি স্মরণ করিয়ে দিলেন। ওড়িশার এই স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সদস্য ছিলেন। বর্মা (অধুনা মায়ানমার) এবং সিঙ্গাপুরের জঙ্গলে আইএনএ-এর শিবিরগুলিতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন।

“যেহেতু আমি কখনও জেলে যাইনি, রাইফেল চালনায় প্রশিক্ষিত হয়েও কাউকে লক্ষ্য করে গুলি চালাইনি, তার মানে কি তাহলে আমি স্বাধীনতা সংগ্রামী নই? অথচ আমি আইএনএর জঙ্গল ক্যাম্পে কাজ করেছি, এই ক্যাম্পগুলিতে ব্রিটিশরা ঘনঘন বোমা ফেলে হামলা করত। তার মানে কি তাহলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমার কোনও অবদানই নেই? যারা বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করছিল, তাদের জন্য আমি যে সেই ১৩ বছর বয়স থেকেই ক্যাম্পের পাকশালায় রান্না করছিলাম, তাহলে কি আমি সেই যুদ্ধে শরিক ছিলাম না?"

লক্ষ্মী পাণ্ডা, সালিহান, হৌসাবাই পাটিল এবং বৎসলা যাদবদের মতোই ভবানী মাহাতোও নিজের প্রাপ্য সম্মান এবং স্বীকৃতি পাননি। তাঁরা সকলেই ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে শরিক ছিলেন এবং অন্য সবার মতোই সসম্মানে নিজের নিজের ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা যে নারী। সংস্কারজাত নানান বেড়াজাল এবং বাঁধাধরা ছাঁদের মধ্যেই নারীকে দেখতে অভ্যস্ত যে সমাজ , সে এই মহিলাদের মহতী ভূমিকার মূল্য দিতে স্বভাবতই অপারগ।

তবে এসবে ভবানী দিদার কিছু যায়আসে বলে তো মনে হয় না। এমনটাও সম্ভব যে তিনি নিজেও সমাজের সেই মূল্যবোধগুলিকে আত্মস্থ করেছেন। আর সম্ভবত এই কারণেই তিনি তাঁর নিজের অনন্য অবদানকে তেমন গুরুত্বই দেন না।

বিদায়বেলায় তিনি কয়েকটি কথা বলেছিলেন: “দেখুন, এইসবই আমার নিজের হাতে গড়া - এই বিরাট সংসার, এতগুলো প্রজন্ম, আমাদের জমিজিরেত সবকিছু। কিন্তু এই যে নতুন প্রজন্ম..." দেখলাম ভবানী দিদার বেশ কয়েকজন নাতবৌ আমাদের চারপাশে পরম নিষ্ঠা ভরে নিজ নিজ কাজ করছিলেন। যতটা নিখুঁতভাবে সম্ভব তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। অথচ, এতসব কিছু তাঁর নিজের সময়ে তিনি একাহাতে সামাল দিচ্ছিলেন।

একথা মনে করলে মস্ত ভুল হবে যে তিনি বুঝি কমবয়সীদের অথবা অন্যদের উপর দোষারোপ করছেন। তাঁর একটাই দুঃখ যেন একা হাতে কাউকে 'সবকিছু' করে উঠতে না হয়।


এই গল্পে নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রেক্ষিত যুগিয়ে সাহায্য করার জন্য স্মিতা খাটোরকে আমার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ভবানী মাহাতোর সঙ্গে কথাবার্তার সময়ে তৎক্ষণাৎ তাঁর বক্তব্যকে তিনি নিখুঁত দক্ষতায় অনুবাদ করেছেন। ধন্যবাদ জানাতে চাই জশুয়া বোধিনেত্রকে - জরুরি তথ্য  দিয়ে তিনি সাহায্য করেছেন। তাঁরা প্রাথমিকভাবে গ্রামে গিয়ে পুরো বিষয়টি জরিপ তথা পর্যবেক্ষণ করেন, এর ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে সাক্ষাৎকার এবং ইন্টারভিউগুলি নেওয়া সম্ভব হয়। স্মিতা এবং জশুয়াকে ছাড়া এই কাহিনি দিনের আলো দেখত না।

অনুবাদ: স্মিতা খাটোর

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Translator : Smita Khator

Smita Khator is the Chief Translations Editor, PARIBhasha, the Indian languages programme of People's Archive of Rural India, (PARI). Translation, language and archives have been her areas of work. She writes on women's issues and labour.

Other stories by Smita Khator