২০২০ সাল, করোনা ভাইরাস আটকাতে সবে লকডাউন ঘোষণা হয়েছে, হঠাৎই একদিন গ্রাম থেকে খবর এল যে আমার দাদা (ঠাকুরদা) পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছেন। গ্রামে একটা কম্যুনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে বটে, কিন্তু সেখানে ডাক্তারের টিকি দেখা যায় না, আর কাছেপিঠের বেসরকারি ডাক্তারখানাগুলো সবই বন্ধ করোনার জন্য। না জানি কীভাবে আমার বাড়ির লোকজন ভাঙা পায়ে নিজেরাই জোগাড়যন্তর করে প্লাস্টার লাগিয়ে সেবা-শুশ্রুষা শুরু করে দিল। তবে থেকে থেকে ধুম জ্বর আসতে লাগল দাদার, থেকে থেকেই চিৎকার করে ককিয়ে উঠতেন যন্ত্রণায়। দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেলেন মানুষটা। শেষে ওই বছরই মে মাসে ছেড়ে চলে গেলেন সব্বাইকে।

এসব যখন ঘটছে তখন আমি মুম্বইয়ে। হঠাৎ করে সবকিছু থমকে গেছে, যেন মার-মার শব্দে ছুটে আসা ঘুর্ণিঝড়। একদিকে বেড়ে চলা অতিমারির ভয়, অন্যদিকে মুষলধারে নেমে আসা পুলিশের ডান্ডা। মুখ থুবড়ে পড়েছিল রুজিরুটি, অভিবাসী মজুরের দল একে একে রওনা দিল নিজেদের দেশগাঁয়ের পথে। আমি অবশ্য মুম্বই ছেড়ে যাইনি, কারণ সবজি বেচি তো, আর আমাদের কামকাজে ছাড় দিয়েছিল। কিন্তু দাদার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আর স্থির থাকতে পারলাম না, ইচ্ছে করছিল তক্ষুনি সব ছেড়েছুড়ে আমার গ্রাম, অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর জেলায় পাড়ি দিই। তাছাড়াও দ্বায়িত্ববান মানুষ বলতে বাড়িতে একা আমার মা-ই ছিলেন।

সময়টা বড্ডো কষ্টের ছিল তখন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উড়ে আসা খবরগুলো যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল ভিতরটা। বাড়ি ফেরার পথে রেললাইনেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন জনাকয় শ্রমিক, এতটাই ক্লান্ত ছিলেন, ঘুমের মধ্যে ছুটে আসে ট্রেন, এক লহমায় নিদ্রাটা পরিণত হয় চিরনিদ্রায়। একদানা খাবার নেই, নেই একফোঁটা জল, দুধের শিশু কোলে করে বাড়ি ফিরছেন এক মা। দাদা মারা যাওয়ার পর বাগপত্তর সব গুছিয়ে সবচেয়ে কাছে যে স্টেশনটা আছে, সেই আন্ধেরিতে গিয়ে খোঁজ লাগালাম বাড়ি ফেরার ট্রেনের। খবর এল যে বারাণসীতে নাকি রেলগাড়ির ভিতর দুটো লাশ পাওয়া গেছে। ওদিকটা ইউপি-গামী একটা ট্রেন নাকি ওড়িশা রওনা দিয়েছে। এমনিতেও গাঁয়ে ফিরতে হলে এলাহাবাদ (অধুনা প্রয়াগরাজ) ছাড়িয়ে ৭০ কিলোমিটার হাঁটতে হত আমায়। মনমেজাজ নেতিয়ে পড়েছিল, উপরন্তু এসব অলুক্ষুণে ঘটনার ঘনঘটায় ইচ্ছেশক্তি আর বাকি রইল না। হ্যাঁ, ট্যাক্সি ধরে যাওয়াই যায়, তবে ৪০,০০০-৫০,০০০ টাকা লাগবে। ট্যাঁকের অত জোর নেই, যাইহোক বাড়ি যাওয়া শিকেয় উঠল আমার। অন্য কোনও উপায়ও তো ছিল না আর আমার হাতে।

Mithun Kumar (facing the camera) in a BEST bus, on his way to the vegetable market
PHOTO • Sumer Singh Rathore
Inspecting lemons at the mandi in Dadar, Mumbai
PHOTO • Sumer Singh Rathore

বাঁদিকে: সবজির আড়তে যাওয়ার পথে বিইএসটির বাসে বসে আছেন মিথুন কুমার (ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন যিনি)। ডানদিকে: মুম্বইয়ের দাদর মাণ্ডিতে লেবু বাছাই করছেন মিথুন

শেষকৃত্যের জন্য এলাহাবাদের ঝুনসি শহরে নিয়ে যাওয়া হয় দাদাকে। মা বলে যে তখন নাকি গাড়িঘোড়া কিছুই চলছিল না, খ্যাপার মতন আগডুম বাগডুম জেরা করছিল পুলিশ। এমনকি বেশ কিছু শ্মশানঘাটে তো দাহ করতেও দিচ্ছিল না। দাদার শেষ কাজটুকু কোনওমতে সারা হয় ভয়ের আবহে।

এখানে বলে রাখা ভালো, আমার জন্ম কিন্তু মুম্বই শহরেই। তবে ছোটবেলাটা জৌনপুরে কেটেছে; স্কুল-টুল সব ওখানেই। পাপা, মানে আমার বাবা মোটামুটি ১৯৭৫ নাগাদ ১৫ বছর বয়েসে মুম্বইয়ে এসে ওঠেন। তবে সুদূর মুম্বইয়ে পাড়ি জমানো মুখের কথা ছিল না। পাপার জন্মের দিনকতক পরেই আমার ঠাম্মা মারা যান। ওঁর বাবা, মানে আমার দাদা রোজগেরে ছিলেন বটে, তবে কাজ বলতে অন্যের জমিতে ঘাম ঝরানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না তাঁর। এছাড়াও মাটির হাঁড়িকুড়ি আর টালি বানাতেন। দেশগাঁয়ে কোত্থাও কোনও কাজ ছিল না আর। অন্যের খেতে লাঙাল টেনে, মই চালিয়ে বাড়ির সবার পেট ভরানো অসম্ভব ছিল। বাড়ির মরদরা পোশাক বলতে খাটো ধুতির মতো একপ্রস্থ কাপড় দিয়ে লজ্জা নিবারণ করতেন। ভাগাই নামে এই ল্যাঙটখানা দিয়ে যৌনাঙ্গ ছাড়া আর কিছুই ঢাকা যেত না। খাবার বলতে বাজরা, মকাই, আলু আর কাছেপিঠের মাঠ থেকে কুড়িয়ে আনা মহুয়া ছিল কেবল, চাল বা গমের কোনও প্রশ্নই উঠত না তখন।

*****

কাদের বাড়িতে দাদা খেটে মরেছেন সে কথা খোলসা করে বলাটা অবান্তর
– জমি কার, আর কে তাতে খেটে মরে তা তো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার

হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা সত্ত্বেও হামেশাই দেখা যেত যে একটা টাকাকড়ি জুটছে না দাদার। বলা হত, পূর্বপুরুষের ঋণ এখনও নাকি মেটেনি, সেটা না চুকিয়ে রেহাই নেই তাঁর। "তোর ঠাকুরদা এই এত্তো এত্তো টাকা ধার করেছিল, তোর ঠাকুরদার বাপের এত্তো এত্তো কর্জ বাকি আছে..." কাদের বাড়িতে দাদা খেটে মরেছেন সে কথা খোলসা করে বলাটা অবান্তর – জমি কার, আর কে তাতে খেটে মরে তা তো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। পাপা একটু বড়ো হওয়ার পর দাদা যাদের বাড়িতে কাজ করতেন, সেখানেই গিয়ে ওঠেন। একে তো মা-মরা ছেলে, তার উপর নুন আনতে পান্তা ফুরায় দাদার, তাই পাপা আর তাঁর বড়োদাদার দেখভাল করার মতো কেউই ছিল না ঘরে। তাই কাজকম্ম কিছু না জুটলে মনিবের গরু আর মোষগুলো চরাতে নিয়ে যেতেন। এর বদলে চাট্টি খাবার পেতেন। মাইনে বলতে ওটুকুই। পাপা বলেন, সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়াটা যে এক্কেবারেই সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে।

PHOTO • Courtesy: Mithun Kumar
PHOTO • Courtesy: Mithun Kumar

উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর জেলায় তাঁর গ্রামের খেতে কর্মরত মিথুনের মা। ৩০ বছর আগে যখন তাঁর স্বামী মুম্বইয়ে সবজি বিক্রি করতেন, তখন গ্রাম আর শহরের মধ্যে লাগাতার আসা-যাওয়া করতেন তিনি

১৯৭০ সালে আমাদের এক পড়শি মুম্বইয়ে চলে আসেন। কলা বেচে পেট চালাতেন তিনি। উনি সাহায্য করেছিলেন বলেই বছর দুয়েক বাদে আমার বড়ে পিতাজি, অর্থাৎ পাপার বড়োদাদা মুম্বই গিয়ে ওঁর কারবারে যোগ দেন। কদিন পরে নিজে নিজেই কলা বেচা শুরু করেন জ্যাঠামশাই। পকেটে খানিক টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসাতে সেই প্রথমবারের জন্য বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। তারপর মুম্বইয়ে ফিরে যাওয়ার সময় পাপাকে সঙ্গে নিয়ে যান। কিন্তু সেই যে পরিবারটির জন্য পাপা খেটে মরতেন না? ওরা এটা শোনামাত্র কোমর বেঁধে ঝগড়া বাধায় আমাদের সেই পড়শির সঙ্গে। উনি নাকি 'ওদের মুনিষটাকে' ভুলিয়ে ফুসলিয়ে মন্দ পথে চালনা করেছেন। জলটা অনেকদূর গড়িয়েছিল, হাতাহাতি অবধি হয়েছিল। পড়শিদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়ির উপরেও নেমে আসে হুমকি, তবে পিছু হটার পাত্র মোটেই ছিলাম না আমরা। অচিরেই তাই মুম্বইয়ের পথে পাড়ি জমান তাঁরা। এটাই ছিল দাসত্বের শিকল ভেঙে ফেলার প্রথম ধাপ। তথাকথিত একটা স্বাধীন দেশে, মোটে ৪০-৫০ বছর আগে যে এমনটাও হত, এসব ভাবলেও যেন কেমন গপ্পের মতন শোনায় মাঝেমাঝে।

কিছুটা সময় জেঠুর সঙ্গে কাজ করার পর নিজের একটা ফলের দোকান দিলেন পাপা। রুজিরুটির খানিক সুরাহা হওয়ার পর গ্রামেই তাঁর বিয়ে ঠিক হয়। দিনকতক গাঁয়ে থাকার পর সেখান থেকে মুম্বইয়ে যাতায়াত শুরু করেন মা। বছরের কয়েকটা মাস পাপার সঙ্গেই থাকতেন, তারপর বাড়ি ফিরে যেতেন। তাঁর শহরে কাটানো ওরকমই একটা সময়ে জন্ম হয় আমার, মুম্বইয়ের জুহু এলাকার কুপার হাসপাতালে, সালটা ছিল ১৯৯০।

মায়ের দিকের পরিবারের অবস্থাটা তুলনায় সচ্ছল ছিল। মায়ের বাবা, মানে আমার নানার খানিক জমিজমাও ছিল। শিক্ষিত ছিলেন আমার দুই মামা-ই। সে আজ ৪০ বছর আগেকার কথা, তখন ক্লাস ১২ পড়া মানেই একটা বিশাল ব্যাপার ছিল। এছাড়াও সমাজ ও রাজনীতির প্রতি তাঁদের চিন্তাভাবনা বেশ আধুনিক ছিল বলতে হবে। তবে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ছেলেরা যতই উন্নতি করুক না কেন, মেয়েদের লড়াই কখনওই খতম হয় না। বোন এবং বৌদিদের সঙ্গে আজীবন খেত-মজুরের কাজই করে গেছেন আমার মা।

এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল মায়ের, প্রথমপক্ষের বাড়ির অবস্থাটাও ছিল তাঁদেরই মতো সচ্ছল। তবে বিয়ের দিনকতক পরেই বাপের বাড়ি ফিরে আসেন মা। কারণটা ঠিক জানি না, তবে চামড়ার কি যেন একটা রোগ ছিল মায়ের, তাই হয়তো... জানার চেষ্টাও সেভাবে করিনি কোনওদিন। নিজের বাবা আর ভাইদের সঙ্গে কয়েক বছর কাটানোর পর পাপার সঙ্গে শাদি হয় তাঁর। ব্যাপারটা জলবৎ তরলং: পাপার আর্থিক অবস্থা তথইবচ, তাই অপেক্ষাকৃত সচ্ছল কোনও পরিবার থেকে সম্বন্ধ এলে না বলার তো কোনও প্রশ্নই থাকে না।

PHOTO • Devesh
PHOTO • Sumer Singh Rathore

ভোর ৪:৩০ বাজলেই দাদরের সবজির আড়তে যান মিথুন, কেনাকাটা সেরে সব পসরা একটা টেম্পোতে (ডানদিকে) তুলে দেন, তারপর এটি তাঁর দোকানে মালপত্র নামিয়ে দিয়ে যায়

আমার জন্মের আগে অবধি পাপার দোকানটা বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু, ঠিক তার পরপরই কিছু উটকো সমস্যা এসে জোটে, হাতছাড়া হয়ে যায় দোকানটা, ফলত একখানা গুমটি ভাড়া করে ব্যবসাটা আবার কেঁচে গণ্ডূষ করতে বাধ্য হন। এক এক করে আমরা পাঁচ ভাইবোন জন্মাই, ফলত মুম্বই আসা মোটের উপর একরকম বন্ধই হয়ে যায় মায়ের। গ্রামে কিছুটা জমি ভাড়া নিয়ে ভাগচাষ শুরু করেছিলেন দাদা, সেখানেই গতর খাটানো শুরু করেন মা। কিন্তু অভাব অনটনের ফলে একদিন চিড় দেখা দেয় আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে, পাঁচ ছেলেমেয়ের হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি, শুরু হয় নতুন করে সংসার বাঁধার পালা। তবে হ্যাঁ, গোড়ার দিকে রেশনের ব্যবস্থা করে দেওয়া থেকে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করা, মামারা অনেক কিছুই করতেন বটে। তারপর মা নিজে নিজেই ভাগচাষ শুরু করেন গ্রামের এক সবর্ণ [তথাকথিত উচ্চবর্ণ হিন্দু] পরিবারের জমিতে। মায়ের সে মজুরির ফল আমরা বছর দুয়েকের মধ্যেই টের পেলাম যখন বাড়ির ভাঁড়ারে বাড়ন্ত খাবারের দিন আমাদের শেষ হল। ভাগচাষ ছাড়াও অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যেতেন মা। তিনি অমন অমানুষিক পরিশ্রম না করলে আমাদের অনটন ঘুচে গিয়ে ভালোমন্দ খাবারদাবার বা জামাকাপড় কিসুই জুটত না।

পরের বার পাপা বাড়ি এলেন যখন, মা আমাকে তাঁর সঙ্গে মুম্বই পাঠিয়ে দিলেন। সালটা যতদূর সম্ভব ১৯৯৮-৯৯, আমার বয়স তখন ৮ অথবা ৯ হবে। গাঁয়ে থাকলে সারাটাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়াই খালি, মা ভেবেছিলেন যে মুম্বই গেলে আমার এই ছন্নছাড়া স্বভাবটাও ঘুচবে, আবার পাপার কাজে হাত লাগাতেও পারব। ইতিমধ্যে পাপার কারবারটা পাক্কা বানজারা হয়ে উঠেছিল, আজ এখানে তো কাল সেখানে। কখনও ব্যবসায় মন্দা তো কখনও বিএমসির [বৃহনমুম্বই মিনিউসিপাল কর্পোরেশন] অত্যাধিক জোরাজুরি। বিক্রিবাটার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না তাঁর। তবে জনাকয় লোকের চাপে পড়ে আমাকে একটা মিউনিস্যিপ্যাল ইস্কুলে দাখিল করে দেন। বয়েসের ভিত্তিতে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হই আমি। নতুন নতুন বাচ্চাদের সঙ্গে আলাপ হল, তারই সঙ্গে ইস্কুলের প্রতি হারিয়ে যাওয়া টানটাও ফিরে এল।

*****

বছর ৩-৪ যে কাজ বন্ধ রেখে পড়াশোনা করব, পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়ে সেটা আর হয়ে উঠল না।
অগত্যা, সে স্বপ্ন ত্যাগ করলাম

পাপা সকাল হলেই সবজি মার্কেটের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। এদিকে আমি দুধ-বিস্কুট খেয়ে, পকেটে খানিক টাকা গুঁজে, ৭টা বাজতে না বাজতেই পা বাড়াতাম ইস্কুলের দিকে। দুপুরের খাওয়া বলতে ওই ১০টা নাগাদ হয় সিঙাড়া কিংবা বড়া, স্কুলের ক্যান্টিনে যেদিন যেটা পাওয়া যেত আর কি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যেত, তারপর পালা কেরোসিনের চুলায় পাপার  নির্দেশ মতো রান্না চাপানোর। কীভাবে ডাল-ভাত বা খিচুড়ি রাঁধতে হবে, সাধারণত সেটা ঘর থেকে বেরোনোর আগেই বলে দিতেন। ৯ বছরের কাঁচা মগজে যেটুকুনি ঢুকত, সেটার ভরসাতেই রান্নাবান্না করতাম সব। ভুল করে কখনও কখনও একগাদা জল ঢেলে দিতাম ভাতে, কিংবা তলাটা পুড়ে আঙার হয়ে যেত। এক-একদিন তো সেটা আধকাঁচাই রয়ে যেত। রাঁধার শেষে সবটুকু একটা টিফিন বাক্সে ভরে বিইএসটির [ভূতল পরিবহন] বাস ধরে পাপার দোকানে যেতাম, বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। খেতে খেতে হামেশাই বকাঝকা করত পাপা, "কি রেঁধেছিস রে ব্যাটা? এটা থোড়াই না বলেছিলাম আমি? পুরো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস যা দেখছি," ইত্যাদি ইত্যাদি।

PHOTO • Sumer Singh Rathore
PHOTO • Devesh

বাঁদিক: সকাল ৬:৩০ নাগাদ রাস্তার ধারে তাঁর সবজির দোকানটি খোলেন মিথুন। ডানদিকে: খুলে প্রথমেই সামনের চত্বরটা ঝাঁট দিয়ে সাফ করে নেন

দুপুর গড়ালে দোকানটা আমার জিম্মায় রেখে পাপাও একটু গড়িয়ে নিত ফুটপাথেই। তবে এখানেই শেষ নয় কিন্তু। সন্ধের দিকে পাপার ঘুম ভাঙলে আশেপাশের গলিতে লেবু আর ধনেপাতা বেচতে বেরোতাম আমি। পথচলতি মানুষদের খদ্দেরে পরিণত করার কায়দা বেশ ভালোমতনই রপ্ত করে ফেলেছিলাম, বাঁ-হাতের কবজিতে গুচ্ছ গুচ্ছ ধনেপাতা আটকে দুহাতের মুঠোয় লেবু রেখে ফেরি করতাম। দিন গেলে এগুলো বেচে দিব্যি ৫০-৮০ টাকা রোজগার হত। পাক্কা আড়াই বছর চলেছিল এভাবে। তারপর হুট করে একদিন দেশে ফিরতে হল পাপাকে, আমিও সঙ্গে যেতে বাধ্য হলাম। ক্লাস ফাইভের মাঝখানেই আমার স্কুল-জীবনে ঢ্যাঁড়া পড়ে গেল।

তবে এবার কিন্তু মা আর আমাকে বাবার সঙ্গে ফিরতে দিলেন না, গ্রামেই রেখে দিলেন। পড়াশোনার মূল্য যে কতখানি, এটা বুঝতে পেরে মনস্থির করছিলেন যে অন্তত একটি সন্তানকে তো শিক্ষিত করে তুলতেই হবে। হয়তো মুম্বইয়ে আমাকে এতোখানি কষ্ট করতে দেখেই মা আর যেতে দিলেন না সেখানে। এসব কথা জানার চেষ্টা আমি কোনওদিন করিনি, ঠিক তেমনই আমার নিজের কোথায় থাকতে ভালো লাগে, মা-ও এটা জানতে চাননি কক্ষনো। আমার ভালোমন্দ সব তিনি নিজেই ঠিক করে ফেলেছিলেন।

মামাবাড়ির পরিবেশটা কিন্তু লেখাপড়ার জন্য আদর্শ ছিল, তাই নিজের ভাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার নতুন ডেরাটা পাকা করে ফেললেন মা। তারপর, আর কি? ১১ বছর বয়সে তল্পিতল্পা সব গুটিয়ে সেখানেই গিয়ে মাথা গুঁজলাম। ওই বাড়ির সব বাচ্চারাই ইস্কুলে যেত। শিক্ষাদীক্ষার জন্য এমনতর পরিবেশ আমি পাইনি কখনও তার আগে। মামরা প্রত্যেকেই যুক্ত ছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে, তাই চারিধারের আবহাওয়াটা বেশ রাজনৈতিক ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর নাম, বা স্থানীয় নেতানেত্রীই বা কারা, এসব কথা জীবনে প্রথমবার জানলাম। একদিন দেখি, সন্ধ্যা হতে না হতেই পাশের বাড়ির 'কাকা' (বাকিরা অবশ্য তাঁকে 'কমরেড' বলেই ডাকত) একগোছা লাল পতাকা নিয়ে দোরগোড়ায় এসে হাজির। খানিক ঘ্যানঘ্যান করে জানতে পারলাম যে ওগুলো নাকি কম্যুনিস্ট পার্টির নিশান – অর্থাৎ কৃষক ও মজুরের ঝাণ্ডা। সরকারের কীসব নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বেরোনোর কথা ছিল ওঁদের। সরকার বাহাদুরের বিরুদ্ধেও যে রুখে দাঁড়ানো যায়, জীবনে প্রথমবার একথাটা মগজে ঢুকেছিল সেদিন।

২০০৮ সালে ১২ ক্লাস পাশ করার পর পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা করার কথা তুললেন মামা, প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে বললেন। কথাটা গিয়ে মায়ের কাছে পাড়তে তিনি ঠিক সম্মত হলেন না, বললেন যে বাড়ির অবস্থাটা আগের মতো অতটাও আর সচ্ছল নেই আমাদের। তবে মা বেঁকে বসলেও মামা কিন্তু সটান গিয়ে আবেদন দাখিল করে এলেন। প্রথমবার ফল ভালো হয়নি পরীক্ষার, পরের বছর আবারও বসলাম তাই। সারাটা বছর ধরে খেটেছিলাম, ফসলও তুললাম ভালো, র‌্যাংক ভালো ছিল বলে সরকারি কলেজের দরজা খুলে গেল। [ভর্তির] কাউন্সিলিংয়ের চিঠি এল, দেখা গেল যে বাৎসরিক ৬,০০০ টাকার মাইনে দিতে হবে। আবারও হাত পাতলাম মায়ের কাছে, এবারেও ফিরে আসতে বাধ্য হলাম খালি হাতে। মামা বললেন, "দেখা যাক।" এদিকে বোনেরা বড়ো হচ্ছে, পাপারও আর আগের মতো রোজগার নেই, মা তাই জোরালোভাবেই নাকচ করে দিলেন। সংসারটা চলবে কেমনভাবে শুনি? হক কথাই বলছিলেন মা। বছর ৩-৪ যে কাজ বন্ধ রেখে পড়াশোনা করব, পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়ে সেটা আর হল না। অগত্যা, সে স্বপ্ন ত্যাগ করলাম।

PHOTO • Sumer Singh Rathore
PHOTO • Sumer Singh Rathore

বাঁদিক: খদ্দের এসে ভিড় জমানোর আগেই শাক-সবজির পসরা সাজিয়ে ফেলেন তিনি। ডানদিকে: বিক্রির জন্য গুছিয়ে রাখার আগে পালং শাকের গোছা ধরে গোড়াগুলো ছেঁটে ফেলছেন মিথুন

তারপর থেকে কাজের খোঁজে সাইকেলে চেপে বারংবার পাড়ি দিয়েছিলাম দূর-দূরান্তের হাটে-বাজারে। যেখানে আমায় কেউ চেপে না, রুজিরুটির তাগিদে হন্যে হয়ে ফিরেছিলাম সেখানে। চেনা লোকেদের কাছে যেতে অস্বস্তি লাগছিল যে। যাই হোক, এই চক্করে একটা টিউশন জুটে গেল। কিন্তু মাস ২-৩ পড়িয়ে টের পেলাম যে ওরা আমার পুরো বেতনটা দিচ্ছে না। মাথাটা গরম হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম, মুম্বইতেই ফিরে যাব। পাপা তো ওখানেই আছেন, একটা না একটা কাজ ঠিক জুটে যাবেই। মা-ও সম্মত হয়ে গেলেন। সেই যে পড়শির সঙ্গে বড়ে পিতাজি প্রথমবারের জন্য মুম্বই গিয়েছিলেন না? একদিন তাঁর ছেলের সঙ্গেই আবার ফিরে গেলাম সে শহরে।

*****

ঘুরেফিরে আবার শুরু হল কাজের খোঁজ। পাকাপাকিভাবে একটা ছাদও জোটেনি মাথার উপর,
রুজিরুটির চক্করে একে একে কাটতে লাগল দিন…

মুম্বইয়ের আন্ধেরি (পূর্ব) মহল্লা। পাপার সবজির দোকানটা এখানেই ছিল। এখানেই ফুটপাথের একটা কোণেই রান্নাবান্না থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, ঘুম, সবকিছু সারতেন মানুষটা। তবে আমার পক্ষে আর এভাবে থাকা সম্ভব ছিল না, তাই একটা দুধের দোকানে কাজ জোগাড় করলাম। মালিক আমাকে তাঁর দোকানটির তদারকি করার ভার দিলেন, এছাড়াও খানকতক জায়গায় মাল পৌঁছতে হত। কামকাজ থেকে থাকা-খাওয়া, সবেরই সাকিন ওই দোকান। টানা কাজ করে যেতে হবে, ছুটিছাটার কথা ভাবাও পাপ, মাস গেলে ১,৮০০ টাকা মাইনে। লুফে নিলাম কাজটা। কিন্তু এক হপ্তা কাটতে না কাটতেই হঠাৎ পা-দুটো ফুলে ঢোল হয়ে গেল আমার। ককিয়ে উঠতাম যন্ত্রণায়। দুই দণ্ড বসলে তবেই আরাম পেতাম। দিন কুড়ি পর মালিককে জানিয়ে দিলাম যে সে মাসের শেষ পর্যন্তই টানতে পারব, তারপরে আর সম্ভব নয়।

ঘুরেফিরে আবার শুরু হল কাজের খোঁজ। পাকাপাকি ভাবে একটা ছাদও জোটেনি মাথার উপর, রুজিরুটির ধান্দায় একে একে কাটতে লাগল দিন, রাত হলে কোনও দোকানের বাইরে কিংবা বাসস্ট্যান্ডে পড়ে পড়ে ঘুমাতাম। শেষে একটা লটারির দোকানে কাজ পেলাম, ওই আর কি টাকার বাজি লড়তে লোকে আসত যেখানে। আমার কাজ ছিল একটা বোর্ডের উপর লটারির টিকিটের নম্বর লিখে রাখা। দিন গেলে ৮০ টাকা পেতাম। তারপর একদিন হল কি, আমার মালিক নিজেই টাকা বাজি রাখতে শুরু করল। শেষে ৭ কি ৮ লাখ টাকার খুইয়ে বসে থাকল ব্যাটা। তারপর সেই ব্যাটার ভরাডুবির পর দিন দুই আর দোকান খোলার নামই নেই। তৃতীয় দিন কানে এল, আমার মালিক নাকি তেনার নিজের মালিকের হাতে আচ্ছাসে মার খেয়েছেন, এবং অন্য একজন দোকানের ভার নিতে না আসা অবধি এটা বন্ধ হয়েই পড়ে থাকবে। কিন্তু নতুন সে মালিকের টিকিটিও দেখতে পেলাম না আর। ১,০০০ টাকা পাওনা ছিল আমার, পুরোটাই জলে চলে গেল। যে তিমিরে ছিলাম, সে তিমিরেই ফিরে এলাম, আবার নেমে পড়লাম কাজের খোঁজে।

PHOTO • Devesh
PHOTO • Devesh

অধিকাংশ খদ্দেরই তাঁর বাঁধা, কয়েকজন তো রীতিমতো বন্ধুই হয়ে গেছেন। মোটামুটি ২০০৮ সাল থেকে মুম্বই শহরে সবজি বেচছেন মিথুন

ইতিমধ্যে তাঁর পা-দুটো নিয়ে মস্ত জ্বালায় পড়েছিলেন পাপা। আমি বললাম যে বাড়ি ফিরে যান, দোকানপাট সব আমিই সামলাবো নাহয়। প্রথমে রাজি হননি পাপা, বললেন যে এই অলিগলির দুনিয়াটা বড্ডো প্যাঁচালো, আমার দ্বারা নাকি হবেই না। কিন্তু গ্রামে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা ভিতর ভিতর ষোল আনা ছিল পাপার, নয়তো ব্যবসার চাবিকাঠি আমার হাতে তুলে দিতে রাজি করাতে পারতাম না তাঁকে।

দ্বায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১,৫০০ টাকা জমিয়ে ফেললাম। টাকার অঙ্কটা আমার কাছে অবশ্য পাহাড়প্রমাণ ছিল; কাজের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার একটা অদম্য ইচ্ছে জন্ম নিল। টানা একমাস মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মুনাফা বাবদ ৫,০০০ টাকা জমলো। ডাক মারফত ওই টাকাটা বাড়ি পাঠাতে আনন্দ আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন মা। বাবা নিজেও কম তাজ্জব বনে যাননি। যে সঞ্চয়টা উনি আজ অবধি করে উঠতে পারেননি, সেটা প্রথম চেষ্টাতেই না জানি কীভাবে আমি করে ফেলেছিলাম।

যে রাস্তাটার উপর সবজি বেচতাম, সেটারই উল্টোদিকে আরেকজন সবজিওয়ালার দোকান ছিল, ছেলেটা প্রায় আমারই বয়সী। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললাম। একদিন এক থালা খাবার বাড়িয়ে দিয়েছিল আমার দিকে, সেদিনের কথা আজও ভুলিনি। ওর নাম আমির। তা এই আমিরের সঙ্গে দোস্তি হওয়ার পর থেকে খাবারদাবার নিয়ে ভাবতে হয়নি কখনও। কী কী রান্না করতে হবে না হবে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করত আমির। রান্নাবান্না আমার দ্বারা হয় না, তাই খেয়েদেয়ে বাসন মাজার কাজটা আমিই করতাম। ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাতাম, একদিন দেখলাম যে কেউ একটা টাকাপয়সা সটকানো শুরু করেছে। একবার তো পকেট থেকে মোবাইলটা অবধি ঝেঁপে দিল। তাই ক'দিন পর আমি আর আমির ঠিক করলাম যে নাহ্, এবার একটা বাড়ি ভাড়া নিতেই হবে। পরিচিত একজনের থেকে কাছেই একটা চওলের হদিস পেলাম। অগ্রিম ডিপোজিটের টাকা মেটানো হল। ৩,০০০ টাকা ভাড়া, সেটা আমরা ভাগাভাগি করে মেটাতে লাগলাম।

গ্রামে আমাদের বাড়িটা মাটির তৈরি। বেশ কিছুদিন আগে আগুন লেগে খানিকটা ঝলসে গিয়েছিল, হাজার মেরামতি সত্ত্বেও কাঠামো নড়বড়েই থেকে গেছে। তাই ওই জমিতেই নতুন করে বাড়ি বানাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা, কাজও শুরু হয়ে গেল। ঠিক ওই সময়টাতেই, ২০১৩ নাগাদ বিটকেল একটা ব্যথা উড়ে এসে জুড়লো বসলো আমার দুটো পায়ে। গ্রামের কম্যুনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে ডাক্তারবাবু বসতেন, তাঁর কাছে যেতে তিনি বললেন যে এটা নাকি ক্যালসিয়ামের অভাব থেকেই হচ্ছে। অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি না হওয়ায় বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে বললেন, রিপোর্টে দেখা গেল যে পোলিও হয়েছে। চিকিৎসার কোনও ফলই পাচ্ছিলাম, দিনকে দিন খারাপ হচ্ছিল হাল। কোত্থাও কোনও কূলকিনারা না পেয়ে শেষে ওঝা-সখার দ্বারস্থ হল আমার বাড়ির লোকজন। দাওয়াই আর দোয়া, দুটোর পিছনেই এককাঁড়ি টাকা বেরিয়ে গেল। তা সত্ত্বেও সুরাহা হল না কোনও। আমার এমন দুরবস্থা দেখে বেশ কয়েকজন আত্মীয় এগিয়ে এলেন। ফিরে এলাম মুম্বইয়ে।

PHOTO • Sumer Singh Rathore
PHOTO • Sumer Singh Rathore

বাঁদিক: মিথুন যে নিয়ম মেনে প্রতিদিন ব্যায়ামাগারে গিয়ে শরীরচর্চা করেন, এটা শুনে অনেকেই তাজ্জব বনে যান, জানালেন তিনি। 'কেন? সুস্থ সবল থাকার অধিকার নেই নাকি সবজিওয়ালাদের?' ডানদিকে: বাড়িতে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত মিথুন

হরেক কিসিমের চিন্তায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল মনটা আমার। কখনও মনে হত দেশগাঁয়েই পড়ে আছি, আবার কখনও ভাবতাম যে না, আমি তো মুম্বইয়েই আছি। খদ্দের দিয়ে শুরু করলেও শেষে বন্ধু বনে গিয়েছিলেন কবিতা মালহোত্রা, পেশাদার এক শিক্ষক তিনি। ব্যাপার-স্যাপার দেখে উনিও শেষে চিন্তায় পড়ে গেলেন। চেনাশোনার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে লাগলেন আমায়, ফিজটাও নিজেই দিয়ে দিতেন। লোকজনের কাছে শুনেছি, আমি নাকি মাঝেমধ্যেই কাপড়জামা সব খুলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে বেড়াতাম এদিক সেদিক। শেষে একদিন জনৈক পরিচিত ব্যক্তির সাহায্যে আমায় ট্রেনে তুলে গ্রামে ফিরিয়ে আনেন পাপা। আবার সেই ডাক্তার আর ওঝার চক্করে পড়ে গেলাম। এক এক করে এলাহাবাদবাসী সব ডাক্তারের নাম বলত গাঁয়ের লোক, ভাড়া করা হত বোলেরো গাড়ি, আর আমায় তুলে নিয়ে রওনা দিতেন মা। অথচ একটা নয়াপয়সাও আর ছিল না ওই মানুষটার কাছে; জনাকয় আত্মীয়স্বজন অবশ্য টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। রোগা হতে হতে ৪০ কিলোয় এসে ঠেকেছিল আমার ওজন। মড়ার মত পড়ে থাকতাম বিছানায়, কঙ্কালসার দেহখান যেন শুধুই বস্তাভরা হাড্ডি। লোকে বলত, আমি নাকি আর কোনদিনই ভালো হব না। আশা হারাননি কেবল আমার মা। চিকিৎসার জন্য একে একে সমস্ত গয়না বেচে দিয়েছিলেন।

ইতিমধ্যেই কারও একটা সুপারিশে আমি এলাহাবাদ নিবাসী মনোবিদ ডাঃ ট্যান্ডনের কাছে চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছিলাম। শুরুর তারিখটা ছিল ১৫ই অগস্ট, ২০১৩। কিন্তু যে বাসটায় চেপে যাচ্ছিলাম ওটা মাঝপথেই বিগড়ে গেল, ওই যে মোড়টা থেকে এলাহাবাদ যাওয়ার বাস ধরি আমরা, ওটার থেকে মোটে দুই কিলোমিটার দূরে। মনটা শক্ত করে হাঁটতে লেগেছিলাম বটে, কিন্তু খানিকটা গিয়েই সব শক্তি হারিয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম রাস্তার ধারে। মা বলে উঠলেন, "চল বাবা, তোকে আমি পিঠে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।" হাউহাউ করে কেঁদে ফেললাম এটা শুনে। ওই সময় একটা টেম্পো যাচ্ছিল ওখান দিয়ে, মা হাতজোড় করাতে চালক দাঁড়িয়ে পড়লেন। মানুষটা এত্তো ভালো ছিলেন, যে ভাড়া বাবদ একটা পয়সাও নেননি। অসুখের স্মৃতি সব ঝাপসা হয়ে গেছে ঠিকই, তবে এই ঘটনাটা আজও জ্বলজ্বল করছে স্মৃতির কোঠায়। তারপর থেকে গুটিগুটি পায়ে সুস্থ হতে শুরু করলাম। শম্বুকগতিতে বাড়ছিল ওজনটা, তার উপর ছিল নাছোড়বান্দা দুর্বলতা। ভারি কিছু তুলতেই পারতাম না। তবে মনের জোরে কোমর বেঁধে মুম্বই ফিরে এসে কাজকম্ম শুরু করে দিলাম আবার। কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম নিজেকে, বছর দুই ধরে আস্তে আস্তে ইতিবাচক হতে শুরু করল আমার অবস্থাটা। আর ঠিক তক্ষুনি, ২০১৬ সালে নোটবন্দি ঘোষণা করে দিল সরকার বাহাদুর। তাসের ঘরের মতো এক লহমায় ভেঙে পড়ল আমার কারবারটা।

*****

ভগৎ সিং পড়ার পর নিজেকে সওয়াল করলাম,
ভগৎ সিংয়ের স্বপ্নের দেশ আর আজকের এই ভারতবর্ষ কি আদৌ এক?

সময়ের সিংহভাগটাই উৎসর্গ করতাম সোশ্যাল মিডিয়ার দরবারে। হোয়াটসঅ্যাপে উড়ে আসা খবরাখবর আমার মাথাটা খেয়ে ফেলল, ভাবনাগুলো আস্তে আস্তে ডানদিকে মোড় নিতে থাকল। নাওয়া-খাওয়া, ওঠাবসা সবই একটা মুসলিম পরিবারের সঙ্গে, অথচ আড়াই বছরেই সোশ্যাল মিডিয়া আমায় এমনভাবে গ্রাস করেছিল যে সেই মুসলমানদেরকেই ঘেন্না করতে শুরু করলাম। আমির আমার আলতু ফালতু কথাগুলো খুব একটা গায়ে মাখত না। কিন্তু বাদবাকি সব মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছিল আমার পাঁজরের মধ্যে। পাকিস্তান, কাশ্মীর এবং উত্তরপূর্ব [ভারত], সব্বার উপর রাগ ছিল আমার। যে ধর্মে আমি জন্ম নিয়েছি, এমন তো অনেকেই আছেন যাঁরা সেই ধর্ম পালন করেন না, তাঁদেরকে ঘিরেও আমার হাজারটা দাবি ছিল। জিন্স পরিহিতা কোনও মেয়েকে দেখলে মনে হত, এদের জন্যই তো সমাজটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা সহ্য হত না, মনে হতো কেউ যেন আমার মসিহাকে অপমান করছে।

মনে মনে ইচ্ছে জাগলো, আমিও আমার অভিজ্ঞতাগুলো গল্পাকারে তুলে ধরবো সোশ্যাল মিডিয়ায়। ধীরে ধীরে পাঠকরাও আমার লেখার মধ্যে খুঁজে পেতে লাগলেন নিজেদের

ভিডিও দেখুন: সবজির বিকিকিনি, মগজ জুড়ে সাম্যের ধ্বনি

একদিন ময়ঙ্ক সাক্সেনা বলে এক সাংবাদিকের কথা তুলল আমির। ফেসবুক খুলে ওঁর বেশ কয়েকটা পোস্টও দেখাল। আমার মনে হল, লোকটা পাতি আবোলতাবোল বকে মরছে। কোথাকার কে না কে প্রধানমন্ত্রীর অপমান করছে, আর তার প্রশংসায় নাকি আমির পঞ্চমুখ। সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু মুখ ফুটে আমিরকে কিছু বললাম না। তারপর আচমকা একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল, হঠাৎই মুখোমুখি হয়ে গেলাম সেই ময়ঙ্কের সঙ্গে। বেঁটেখাটো মানুষ, লম্বা লম্বা চুল, একমুখ হাসি। কিন্তু রাগে ঘৃণায় সর্বাঙ্গ যেন রিরি করছিল আমার।

ময়ঙ্কের সব বন্ধুরই দেখি ওঁরই মতো ভাবনাচিন্তা। মন দিয়ে দেখতাম তেনারা কেমনভাবে তর্কে মেতেছেন। গড়গড় করে কী ছাই পরিসংখ্যান, বইয়ের নাম, লোকজন, জায়গা-টায়গার সব নাম আওড়াত, বাপের জন্মে কোনদিন শুনিনি ওসব। ময়ঙ্ক একটা বই উপহার দিয়েছিল আমায়, 'সত্য কে সাথ মেরা প্রয়োগ' [দ্য স্টোরি অফ মাই এক্সপেরিমেন্টস্ উইথ ট্রুথ]। গান্ধীর লেখা। তবে ততদিনে গান্ধী আর নেহরুর বিরুদ্ধে আমার মনটা বিষিয়ে গেছে পুরো; দুজনের উপরেই বেজায় ক্ষোভ। খুব বিরক্তিকর লাগছিল পড়তে, তাও থামলাম না। জীবনে সেই প্রথমবার গান্ধীর ব্যাপারে অতকিছু জানতে পারলাম। বুঝলাম, পড়া আর শেখার কোনও শেষ নেই। গুটিগুটি পায়ে খুলির ভিতর জমে থাকা আস্তাকুঁড়টা সাফ হতে লাগল।

সেবার দাদরে একটা জন সমাবেশ হয়েছিল। যাওয়ার পথে আমাকেও ডেকে নিলেন ময়ঙ্ক, আমি না বলিনি। গিয়ে দেখি যে দাদর স্টেশন চত্বরটা ঘিরে ফেলেছে অগুনতি মানুষ। সরকারের স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, স্লোগানে স্লোগানে ছয়লাপ হয়ে গেছে চারিদিক। বহু বছর বাদে লাল পতাকা নজরে এলো আবার। একখান ডাফলি হাতে তুলে মানুষের সুরে বিপ্লবের গান গাইতে শুরু করল ময়ঙ্ক। এর আগে কখনও বিক্ষোভ-টিক্ষোভে আসিনি, মুখটা হাঁ করে দেখছিলাম সবকিছু। ময়ঙ্কের হাত ফাঁকা হতে ওঁকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই যে এত্তো লোক জড়ো হয়েছে, কে টাকা দিয়েছে এদের আসার জন্য? বোঁ করে আমার দিকে ঘুরে ময়ঙ্ক জবাব দিল, আমাকেই বা কে আসার জন্য টাকা দিয়েছে শুনি? সওয়ালের বিরুদ্ধে সওয়াল উঠলেও, উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই।

PHOTO • Devesh
PHOTO • Devesh

খদ্দের সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান মিথুন। 'গোগ্রাসে বই গেলার ফলে লেখার জন্য হাত সুড়সুড় করতে শুরু করল।'
সাত বছর পেরিয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করছেন তিনি, নিবিড় একটি পাঠককুলও তৈরি হয়েছে তাঁর

আনোয়ার হুসেনের সঙ্গে আলাপের শুরুটাও ওখানে হয়। সবজি-টবজি কিনতে আমার দোকানে আসা শুরু করলেন। আমি যে পড়তে ভালোবাসি, এটা বুঝতে পেরে খানকতক বই রেখে যান আমার কাছে। বেশিরভাগই মান্টো, ভগৎ সিং আর মুনসি প্রেমচাঁদের লেখা। মান্টোর লেখা আমার ভিতরটা এমন নাড়িয়ে দিয়েছিল যে তারপর থেকে মেয়েদের অন্য চোখে দেখা শুরু করি। ভগৎ সিং পড়ার পর নিজেকে সওয়াল করলাম, ভগৎ সিংয়ের স্বপ্নের দেশ আর আজকের এই ভারতবর্ষ কি আদৌ এক? প্রেমচাঁদ পড়ে মনে হত আরে, এ যে আমারই জীবন, চরিত্রগুলো তো আমার আপনজন, এ তো আমারই সমাজ। তারপর হরিশংকর পারসাই ধরলাম। ওঁর কলম আমাকে আরোই যেন ছিটকে দিল, মনে হতে লাগল যে আজ তিনি থাকলে সমাজ আর আমাকে এক ঝটকায় পাল্টে দিতে পারতেন – মুখোশ খুলে দিতেন সব্বার।

বিশেষ কোনও সম্প্রদায়, লিঙ্গ, এলাকা বা জাতির প্রতি আর ঘেন্না লাগে না আগের মতো, দিনকে দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে সে বিষ। গোগ্রাসে বই গেলার ফল লেখার জন্য হাত সুড়সুড় করতে শুরু করল। ফেসবুকে নামজাদা সব লেখকের পোস্ট পড়ে কেমন যেন মেকি মনে হত। মনে মনে ইচ্ছে জাগলো, আমিও আমার অভিজ্ঞতাগুলো গল্পাকারে তুলে ধরব সোশ্যাল মিডিয়ায়। ধীরে ধীরে পাঠকরাও আমার লেখার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পেতে লাগলেন। বেশ কিছু ভালো লেখকদেরও অনুসরণ করতাম। অব্যাহত থাকল শিক্ষার জোয়ার।

*****

আমাদের বিয়েতে না ছিল মঙ্গলসূত্র না ছিল কন্যাদান, পণের তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
ডলি আর আমি একে অপরের সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছিলাম

রাস্তাঘাটে কাজ করি, তাই পুলিশের অত্যাচার সম্পর্কে সম্যক ধারণা আমার আছে বৈকি। তোলাবাজি, মারধোর, উটকো ১,২৫০ টাকার জরিমানা – এসব এতবার সহ্য করেছি যে লিখতে গেলে মহাভারতও কম পড়বে। না জানি কতজন পুলিশের হাতে আমি মার খেয়েছি বা মারের হুমকি হজম করেছি। তোলা আদায় করার সময় টাকা দিতে না চাওয়ায় টেনেহিঁচড়ে পুলিশ-ভ্যানে তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গোটা শহরের চক্কর কাটিয়েছে আমাকে। এগুলো তো রোজকার ঘটনা। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব জিনিস লিখতে গেলেই ভয় লাগে, তাই সেই পুলিশদের নাম, কিংবা শহর বা রাজ্যের কথা উল্লেখ করতাম না। নোটবন্দির পর প্রবীণ সাংবাদিক তথা চলচ্চিত্র-নির্মাতা রুক্মিণী সেনের নেকনজরে আসি, সবরং ইন্ডিয়ার জন্য উনি লিখতে বলেন আমায়। এই কাজটা আমি আজও করে যাচ্ছি।

PHOTO • Courtesy: Mithun Kumar
PHOTO • Sumer Singh Rathore

২০১৯ সালে তাঁদের বিয়ের সময় মিঠুনের (বাঁদিকে) সিঁথিতে সিঁদুর পরাচ্ছেন ডলি। মন্ত্রের বদলে তাঁরা সাম্যের ব্রত নিয়েছেন একে অপরের জন্য

২০১৭ সালে আমার ছোটবোনটারও বিয়ে হয়ে যায়। বাড়ি থেকে চাপাচাপি শুরু করে দেয় আমায় বিয়েথা দেবে বলে। অবশ্য ততদিনে একটা জিনিস হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছিলাম, বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সামাজিক চাপে পড়ে নেওয়া উচিত নয়। ঠিক এমন সময়েই আমার জীবনে এসে উপস্থিত হয় ডলি। একসঙ্গে সময় কাটাতাম বলে অনেকেরই টোখ টাটাত। হাজারগণ্ডা জেরার মুখে পড়তে হত আমায়: মেয়েটা কে? ও কোন জাতির? ডলির জাতপাত জানার ইচ্ছে দেখতাম আমার জাতের লোকেদেরই মধ্যেই সবচাইতে বেশি। অসবর্ণ শুনেই আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত তেনাদের। তবে আমি কিন্তু ততদিনে এসবের অনেক উপরে উঠে গিয়েছিলাম।

ডলি ওর বাড়িতে আমার কথা বলে, তার কদিন পরই হবু শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করে আসি। আমার পরিবার চাইছিল যাতে বিয়েটা ঝটপট হয়ে যায়। গাঁটছড়া বাঁধার ইচ্ছে আমার আর ডলিরও ছিল প্রবল, তবে নিজেদের পায়ে না দাঁড়ানো অবধি নয়। এভাবে দুই থেকে আড়াই বছর কেটে গেল, ডলির বাড়ি থেকে বড্ডো চাপ দিচ্ছিল ওকে। আসলে কী জানেন? মেয়ের মা-বাবা তো, ওঁদের ক্ষেত্রে সামাজিক দায়-দায়িত্বের বোঝাটা একেবারেই অন্য রকমের। ওর আর আমার দুজনেরই বাড়ি থেকে চাইছিল আমরা যেন প্রথাটথা সব মেনে বিয়ে করি। তবে আমার আর ডলির ইচ্ছে ছিল আদালতে সইসাবুদ করেই খান্ত থাকার। পাছে আমি ডলিকে ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়ি, এই ভয়েই মরতেন ওর মা-বাবা। আমার পাপা আর মায়ের কথাটা অবশ্য আলাদা, পাড়া হাঁকিয়ে লোক দেখিয়ে বিয়ে না দিলে চলছিল না তাঁদের। হাজারটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মাঝে মনস্থির করতে বাধ্য হলাম আমরা। ওর বাড়ির লোকজন একটা ছোট্টখাট্টো হলঘরও ভাড়া করে ফেলল।

তবে হ্যাঁ, কয়েকটা জিনিসের ক্ষেত্রে আমার আর ডলির জেদের সামনে সব্বাই ঘাড় ঝুঁকিয়েছিল। আমাদের বিয়েতে না ছিল মঙ্গসূত্র না ছিল কন্যাদান, পণের তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ডলি আর আমি একে অপরের সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছিলাম। সাত পাক ঘুরলাম। ওদিকে পুরোহিত নিজের মতো মন্ত্র আওড়াচ্ছে, এদিকে একেকটা পাকের পর আমাদের ব্রতগুলো পড়ে পড়ে শোনাচ্ছেন ময়ঙ্ক। সাম্যের মন্ত্রে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম আমি আর ডলি। হলঘরে আসা অতিথিরা প্রথমটায় বেশ মজা পেয়েছিলেন বটে, তবে অচিরেই টের পেলেন যে আলাদা কিছু একটা হচ্ছে, যুগ যুগান্তরের শিকলগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে একে একে। কেউ কেউ রাগারাগিও করেছিল। তবে এই যে প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা অসমতার ধারা, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও নারী-বিরোধী কলুষতা ভেঙে তছনছ করে দিতে পারলাম, আমাদের দুজনের কাছে এটাই ছিল সবচেয়ে দামি। বিয়ের পর ডলি আর আমি নতুন একটা বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ২০১৯ সালে যখন শাদি হয়, তখন ওই বাড়িটা খাঁখাঁ করত; তারপর ধীরে ধীরে একটা একটা করে প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনে ভরিয়ে তুলেছি। ছুঁচ থেকে আলমারি অবধি, সবই আমাদের ঘাম ঝরানোর ফসল।

PHOTO • Sumer Singh Rathore
PHOTO • Sumer Singh Rathore
PHOTO • Devesh

বাঁদিক: কোভিড-১৯ লকডাউন চলাকালীন মিথুন আর ডলি মুম্বই ছেড়ে যাননি কোথাও। মাঝখানে: 'জীবনযুদ্ধে হাল ছাড়ব না আমরা,' জানালেন মিথুন। ডানদিকে: তাঁর ছোটভাই রবি

২০২০ সালের মার্চ, শিয়রে সংক্রান্তি হয়ে দেখা দিল করোনা ভাইরাস, দুম করে নেমে এল লকডাউন। দরকারি মালপত্র কিনতে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগল মানুষ। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার দোকানটা ফাঁকা হয়ে গেল। অল্প কয়েকজন বাদে টাকাপয়সাও দেয়নি কেউ, সব ঝেঁপে দিল লোকে। প্রত্যেকটা দোকানে তখন একই অবস্থা। পুলিশ এসে গায়ের জোরে ঝাঁপ ফেরে দিয়ে গেল, কবে আবার খুলতে পারে সে ব্যাপারে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। নিজের নিজের দেশগাঁয়ের পথে দৌড় লাগাল সবাই। আমরা যে দালানটায় থাকতাম, সেটা দুদিনে ফক্কা হয়ে গেল। যত না করোনার ভয়, তার চেয়েও বেশি ভয় রুজিরুটি হারিয়ে না খেতে পেয়ে মরার। ট্রেকিংয়ের জ্যাকেট বিক্রি হয়, এমন একটা দোকানে কাজ করত ডলি। ২০২০ সালের ১৫ই মার্চ বন্ধ হয়ে গেল সেটাও।

গ্রামে ফেরার জন্য জোর করছিল আমার বাড়ি থেকে, বলছিল যে অবস্থার একটু উন্নতি হলে তখন না হয় আবার ভাবা যাবে। সঞ্চয় বলতে একটা পয়সাও ছিল না হাতে, বিশাল প্যাঁচে পড়ে গিয়েছিলাম আমরা দুইজন। আমার কারবারটা যেহেতু শাক-সবজি নিয়ে, তাই ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। তবে মালপত্তর জোগাড় করতে গিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছিলাম। দাদরের আড়তটা বন্ধ। হাইওয়ে ছাড়িয়ে চুনা ভাট্টি আর সোমাইয়ার মাঠে গিয়ে কেনাকাটা করা যায় ঠিকই, তবে ওখানে যা মারকাটারি ভিড়, ভয় হত পাছে ভাইরাসের পাল্লায় পড়ি। রোগটা বাড়ি বয়ে আনলে ডলির কী হবে? কিন্তু ভিড়ে গিয়ে গুঁতোগুঁতি না করে উপায়ও তো ছিল না, পেটে তখন ছুঁচোয় ডন মারছে। মে মাসে পৌরসভা থেকে ঘোষণা করে দিল যে দুপুর থেকে ৩টে অবধি, অর্থাৎ মোটে তিন ঘণ্টা দোকান খুলে রাখা যাবে। বাঁধা সময়ের একচুলও এদিক ওদিক হলে ডাণ্ডা উঁচিয়ে তেড়ে আসবে পুলিশ। অথচ অনলাইনে সকাল থেকে মাঝরাত অবধি সবজি পাওয়া যাচ্ছে, লোকে তাই সেদিকেই ঝুঁকলো শেষে। মার খেয়ে গেল আমার ব্যবসাটা। আর ঠিক এই সময়েই আছাড় খেয়ে পা ভেঙেছিলেন আমার দাদা। গোড়াতেই তো বলেছি, লকডাউনের সময় কেমন অসহায় অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন মানুষটা।

মাসকয়েক পর দোকানপাট বন্ধ করার সময়টা বাড়িয়ে সন্ধে ৭টা অবধি করা হয়। একদিন হয়েছে কি, ভর সন্ধেবেলায় আমার ছোটভাই রবি ঠ্যালাগাড়ি থেকে পচা টমেটো বাছাই করছে, হঠাৎ একজন পুলিশ এসে ভিডিও তুলতে শুরু করল। বেচারা ভাইটা আমার ঘাবড়ে গিয়ে ভাবল যে খানিক ঘুষ-টুষ দিয়ে রেহাই পাবে। যেই না এটা বলেছে, অমনি আকাশছোঁয়া একটা অঙ্কের দাবি করে বসল সেই কনস্টেবল, মামলা ঠুকে দেওয়ার ভয়ও দেখিয়েছিল সে ব্যাটা। শেষে রবিকে থানায় তুলে নিয়ে যায়। মাঝরাত পেরিয়ে, ওই ১টা কি ১:৩০টা নাগাদ আরেকজন পুলিশ এসে ছোঁ মেরে রবির পকেটে যেটুকু টাকা ছিল সব কেড়ে নেয়। তারপর আমার ভাইটাকে ছেড়ে দিয়েছিল বটে, তবে ওই ৬,০০০ টাকাটুকুই ছিল ওর জীবনের সম্বল। দিন দুয়েক বাদে পরিচিত একজনের মাধ্যমে উচ্চপদস্থ এক পুলিশ অফিসারকে পুরোটা খুলে বলি আমরা। দুটো দিন কাটতে না কাটতেই রবির খোঁজে এসে হাজির হয় সেই কনস্টেবলটি, কড়ায় গণ্ডায় পুরো টাকাটাই ফেরত পেয়েছিলাম।

অতিমারির শুরু থেকে আজকের তারিখ অবধি ব্যবসাপাতির অবস্থা তথৈবচ। দুনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে চেনা রাস্তায় জীবনটা ফিরিয়ে আনতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি। এই যে লেখাটা পড়ছেন না? এটা করোনা-পজিটিভ অবস্থায় লিখছি। ডলিও সংক্রমিত। দুজনেই ঘরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছি। আমার দোকানের কাছেপিঠে আরও যে কয়জন ফেরিওয়ালা রয়েছেন, মজুত করা মালটুকু বেচার দ্বায়িত্ব তাঁরাই নিয়েছেন। পয়সাকড়ি যেটুকু জমিয়েছিলাম, তা করোনার পরীক্ষা আর ওষুধপত্রের পিছনেই বেরিয়ে গেছে। তবে নাহ্, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। একদিন না একদিন করোনা নেগেটিভ হবই, আবারও বেরিয়ে পড়ব রাস্তায়। জীবন বাবাজি যতই আমাদের নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করুক না কেন, হাল ছাড়ব না। এছাড়া আর উপায়ই বা কী?

পরিচয় গোপন রাখতে কয়েকজন ব্যক্তি তথা কিছু জায়গার নাম প্রকাশ করা হয়নি।

মূল কাহিনিটি লেখক হিন্দিতে লিখেছেন, সম্পাদনার দ্বায়িত্বে ছিলেন দেবেশ।

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি সুমের সিং রাঠোড়ের তোলা।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Mithun Kumar

Mithun Kumar runs a vegetable shop in Mumbai and writes about social issues on various online media platforms.

Other stories by Mithun Kumar
Photographs : Devesh

Devesh is a poet, journalist, filmmaker and translator. He is the Translations Editor, Hindi, at the People’s Archive of Rural India.

Other stories by Devesh
Photographs : Sumer Singh Rathore

Sumer is a visual storyteller, writer and journalist from Jaisalmer, Rajasthan.

Other stories by Sumer Singh Rathore
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra