PHOTO • P. Sainath

এ যেন মাদারির খেল, শূন্যে দোদুল্যমান দড়ির উপর পা টিপে টিপে হেঁটে যাওয়া। নাহ্, এ বোধ করি আরও কঠিন। উপরন্তু আরও অনেকটাই বিপজ্জনক। পড়ে গেলে তাঁকে বাঁচানোর জন্য কোনও জাল পাতা নেই নিচে, নেই অন্য কোনও ধরনের সুরক্ষাকবচও। মহিলা যে কুয়ো থেকে জল তুলছিলেন তার চারধারে ছিল না কোনও দেওয়াল। ভরদুপুর বেলা, গায়ে ফোস্কা ধরানো ৪৪° সেন্টিগ্রেডে ঝোড়ো লু বইছে, ধুলোবালি কিংবা অন্য কোনও জঞ্জাল যাতে উড়ে এসে জলে না পড়ে তাই কুয়োর মুখটা ঢাকা রয়েছে কয়েকটা ওজনদার কাঠের গুঁড়ি দিয়ে। গুঁড়িগুলো এদিক সেদিক খানিকটা তেরছা করে রাখা, যাতে মাঝখানে জল তোলার জন্য একটা গর্ত তৈরি হয়।

সন্তর্পনে মহিলা সেই অসমান গুঁড়িগুলোর উপর দাঁড়িয়ে জল তুলছিলেন। কাজটায় দুটো বিপদের আশঙ্কা ছিল: এক, তিনি হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পারেন, দুই, তাঁর শরীরের ভারে গুঁড়িগুলো হড়কে যেতে পারে। দুটোর একটাও যদি ঘটে, তাহলে সটান ২০ ফুট গভীরে তলিয়ে যাবেন তিনি। সেক্ষেত্রে আরেকটা উপরি বিপদও রয়েছে, কুয়োর ভিতর পড়ে গেলে উপরের সেই গুঁড়িগুলোও হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে তাঁর মাথায়। যদি এমনটা না-ও হয়, ধরা যাক তিনি হুমড়ি খেয়ে পাশ ফিরে পড়লেন, সেক্ষেত্রেও কিন্তু রেহাই পাবেন না মোটেই। তাঁর পায়ের হাড়গোড় ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

তবে ভাগ্যক্রমে সেদিন এসবের কোনটাই হয়নি। ভিলালা আদিবাসী জনজাতির এই তরুণীটি থাকেন মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়া জেলার ভাকনের গ্রামের কোনও এক ফালিয়ায়, অর্থাৎ জনপদে (ফালিয়াগুলি সাধারণত গোষ্ঠীভিত্তিক হয়)। অবলীলাক্রমে তিনি গুঁড়িগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে দড়ি-বাঁধা একটি বালতি নামিয়ে দিলেন কুয়োর ভিতর। বালতি ভরতি করে জল তুলে সেটা একটা কলসিতে ধরে রেখে আবারও ভরে ফেললেন বালতিটা। এতকিছুর মধ্যেও কিন্তু গুঁড়িগুলো একটিবারের জন্যও কাঁপেনি, সেগুলিও তরুণীর মতোই অটল অবিচল। কানায় কানায় ভরা দুখানি জলের পাত্র, ভারী কলসিটা বাঁ হাতে সামাল দিয়ে মাথার উপর রাখা, ডানহাতে ছলছলাৎ করছে বালতি, এভাবেই তিনি হাঁটা দিলেন বাড়ির দিকে।

ফালিয়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে এই কুয়োটা অবধি একসঙ্গেই এসেছিলাম আমরা। হিসেব করে দেখলাম, প্রতিদিন যদি দুবার করেও (কখনও বা আরও বেশি) জল আনতে যেতে হয় তাহলেও শুধুমাত্র এই কাজের জন্যই তাঁকে ৬ কিমি পথ পাড়ি দিতে হবে। মহিলা ফিরে যাওয়ার পরেও আমি খানিকক্ষণ ছিলাম ওই কুয়োটার কাছে। দেখলাম যে কাতারে কাতারে অল্পবয়সী মহিলা, কয়েকজন তো রীতিমত কিশোরী, ওই একইভাবে অবলীলায় জল তোলার কাজে ব্যস্ত সবাই। মহিলাদের মুনশিয়ানা দেখে জানি না কেন মনে হল যে নির্ঘাত আমিও পারব! অমনি এক কিশোরীর কাছ থেকে দড়ি আর বালতি চেয়ে নিয়ে লেগে পড়লাম কাজে। কিন্তু পা ফেলতে না ফেলতেই গুঁড়িগুলো নড়বড় করতে লাগল। ক্ষণে ক্ষণে হড়কে যাচ্ছিল সেগুলো। জল তুলে আনার সেই গর্তটার কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই গুঁড়িগুলো বিপজ্জনকভাবে কাঁপতে কাঁপতে কেমন যেন তলার দিকে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল। বারবার চেষ্টা করেও বিফল হয়ে অগত্যা হার স্বীকার করতে হল আমাকে। রণে ভঙ্গ দিয়ে শক্ত ডাঙায় ফিরে তবে পায়ের তলায় মাটি ফিরে পেলাম যেন!

ইতিমধ্যে আমার এইসব কেরামতি দেখে চারিদিকে যেন মেলা বসে গিয়েছিল। জল নিতে আসা মহিলার দল, এমনকি ছোটো ছোটো বাচ্চারাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল কখন আমি সবশুদ্ধ হুড়মুড় করে ভেঙে তলিয়ে যাব! ভরদুপুরের এই বিনিপয়সার তামাশায় আমিই ভাঁড়। তবে এই পণ্ডশ্রমের পিছনে খুব একটা বেশি সময় নষ্ট করার কোনও মানে ছিল না, প্রথমটায় মজা পেলেও মহিলারা এবার অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। বেলা বয়ে যাচ্ছিল যে, বাড়ির জন্য জল নিয়ে যেতে হবে তো! সেই ১৯৯৪ সালের কথা যতদূর মনে পড়ছে, অনন্ত কসরতের পর আধা বালতি জল তুলতে পেরেছিলাম। তবে বালতি না ভরলেও সেই বাচ্চাদের নির্মল হাততালিতে বুকটা কিন্তু ভরে গিয়েছিল কানায় কানায়।

১৯৯৬ সালে ১২ই জুলাই , ' দ্য হিন্দু বিজনেসলাইন ' পত্রিকায় এই প্রতিবেদনটি র একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল

অনুবাদ : জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra