ঘনঘন কেঁপে উঠছিল পায়ের তলার মাটি। দুরুদুরু সে কম্পন যতক্ষণে রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে গিয়ে পৌঁছালো, ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। একে একে ভেঙে পড়ছে দুর্গের দেওয়াল, নাহ্, শেষরক্ষা আর হল না বোধহয়, সেপাই-সামন্তদের ডাক পাঠিয়েও তেমন লাভ নেই আর।

আসমুদ্র এ সাম্রাজ্যের দেহে গভীর কিছু ফাটল দেখা দিয়েছে আজ। সদ্য কাটা ধানের গন্ধ ভেসে আসছিল খাদের তলা থেকে। সম্রাট বাহাদুর ভুখা-নাঙ্গা প্রজাদের প্রাণপণে ঘৃণা করতেন ঠিকই, তবে সে ঘৃণার থেকেও হাজার গুণ গভীর ছিল ফাটলগুলো। এমনকি তেনার ৫৬ আলোকবর্ষ জুড়ে প্রশস্ত পেশিবহুল বুকখানাও ফিকে পড়ে গেছে। ওই যে রাস্তাগুলো এঁকেবেঁকে প্রাসাদের চৌকাঠে গিয়ে উঠেছে, ওই যে পুতিগন্ধময় বাজারহাট, ওই যে সুপবিত্র গোশালা, গুরুগুরু সে কম্পন যতক্ষণে গুটিগুটি পায়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছালো, বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে।

পোষা দাঁড়কাকগুলোকে ছাড়ারও বুঝি সময় নেই আর। এই ভূমিকম্পটায় আদৌ ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এ যে নেহাত উটকো একটা আপদ, এসব কথা আর বোঝানো হল না প্রজাদের। ওদের শেখানো হল না কুচকাওয়াজ করা শরীরগুলোকে ঘৃণা করতে। ওই, ওই যে রোদেজলে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া অশরীরের দল, ওই ব্যাটাদের জন্যই তো শাহেনশাহের মসনদ টলোমলো আজ। এ অখণ্ড সালতানাত যে হাজার বছর টিকে থাকবে, সেকথাটাও বলা হল না আর। চিরসবুজ ওই হাতগুলো জানে কেমনভাবে মাটির গর্ভে জন্ম নেয় হলুদপানা জনার, ওরা যে সূর্য ছুঁয়েছে আজ।

কিন্তু ওরা কারা? পিশাচ, নাকি জ্বিন? আধা জন নারী, একের তিন ক্রীতদাস, গলায় তাদের যুগ যুগান্তরের শেকল, প্রতি চারজনের একজন আবার বাকিদের চেয়েও আদিম অনন্য। কারো কারো গায়ে রামধনুর বাহার... কোথাও বা ঝিলিক দিচ্ছে লাল, কোথাও বা রাত জ্বেলেছে সোনারং। একেকজন তো আবার রীতিমতো ন্যাকড়া চাপিয়েই চলে এসেছে। বেমানান, বেখাপ্পা, বেঢপ, তাপ্পিমারা। তবে রাজাধিরাজের শতসহস্র মণিমাণিক্য খচিত আঙরাখার চাইতেও সে ন্যাকড়া অনেক বেশি দামি। ঠোঁটে যুদ্ধজয়ের হাসি নিয়ে কুচকাওয়াজ করছে প্রেতগুলো, কণ্ঠভরা জয়গান। সনাতনী গাদাবন্দুক আর বৈদিক কামান দেগেও কিছু করা গেল না আর, হায় রে, জানোয়ারগুলোর লাঙলের জোর যে আরও হাজার-হাজারগুণ বেশি!

হৃৎপিণ্ডের বদলে ওই যে একটা রাক্ষুসে গর্ত আছে না? মাটিটা কাঁপতে কাঁপতে যতক্ষণ সেখানে গিয়ে পৌঁছালো, ততক্ষণে সত্যিই আর কিচ্ছুটি করার ছিল না।

প্রতিষ্ঠা পান্ডিয়ার কণ্ঠে কবিতাগুলি ইংরেজিতে শুনুন

লাঙল পোহানো দিন

১)

উড়কিধানের খিদে
রেখেছে ফজর বেঁধে,
ঘোমটা দুলিয়ে চাষা হয়েছে নহন্য?
"কুনকি রাজার দেশে
ন্যাংটা মরাই শেষে
মাটিও রেখেছে রোজা আমাদের জন্য।"

২)

মন কি বাতেঁ, গ্যাঁজলা ভাতে,
ভাগচাষিদের আবছায়াতে
ঢ্যাম কুড় কুড় নাচছে ঠাকুর খেত-কুড়ানির মাস?
"হেঁই সামালো, হেঁই সামালো,
আঁটকুড়ি ওই রাত পোহালো,
রাক্ষুসে তোর রাজার আহার জল-জমিনের লাশ।"

৩)

রাজা তার বায়না
আদানি ও হায়না,
লজ্জাটে লাঙলের খুঁটে খাওয়া ফন্দি?
সাঁওতালি চাষা কয়,
"এখানে সন্ধে হয়,
হাঁড়িকাঠে রাঙা জল-জমিনের সন্ধি।"

৪)

হাঁটি হাঁটি মাটি কার
আধপেটা অধিকার?
অছুৎ অছুৎ চাষা খুদকুঁড়ো ছোঁয়ানি,
"কাস্তেরও খিদে পায়,
আগে কেন বোঝোনি?"

৫)

হ্যাংলা চাষা প্যাংলা চাষা,
হায় ফলিডল ফোকলা চাষা,
কাঁকর কাঁকর জুটলো কি তোর জল-জমিনের ভাগ?
"গোন্ডি চাষা মান্ডি চাষা
কালসিটে মোর পিণ্ডি খাসা,
লাল লালে লাল নোনতা হাতে চাঁদকুড়ানির দাগ।"


শব্দার্থ

মসনদ: সিংহাসন।

ফজর: ভোরের নামাজ।

নহন্য: যাকে খুন করা যায় না।

মরাই: ধানের গোলা।

খেত-কুড়ানি: ফসল কাটার পর খেত থেকে শস্যের খুদকুঁড়ো কুড়িয়ে যাঁরা (মূলত খেতমজুর, দলিত এবং আদিবাসী চাষি) জীবনধারণ করতে বাধ্য হন।

ফলিডল: একপ্রকারের সিন্থেটিক সার, যেটি খেয়ে বহু চাষি আত্মহত্যা করেন আমাদের দেশে।

দলবদ্ধ এই প্রয়াসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে স্মিতা খাটোরের। তাঁকে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ।

Poems and Text : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra
Paintings : Labani Jangi

Labani Jangi is a 2020 PARI Fellow, and a self-taught painter based in West Bengal's Nadia district. She is working towards a PhD on labour migrations at the Centre for Studies in Social Sciences, Kolkata.

Other stories by Labani Jangi