ইয়েল্লাপান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছেন বটে, কিন্তু একইসঙ্গে বেজায় চটে আছেন।

“আমরা উপকূলে থাকি না, আমরা জেলে জাতিও নই। [সুতরাং] আমাদের সেম্বানন্দ মারাভার অথবা গোসাঙ্গি বলে চিহ্নিত করা কেন?”

“আমরা শোলাগা,” জোরগলায় জানালেন এই ৮২ বছর বয়সি মানুষটি, “[সরকার] আমাদের কাছে প্রমাণ চায়। আমরা তো এখানেই খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। এটা ঠিকঠাক প্রমাণ নয়? আধারা আনতে আধারা। ইয়েল্লিন্দা তারলি আধারা? [প্রমাণ! প্রমাণ! ওনারা শুধু এটাই চান]।”

এই ইয়েলাপ্পান সম্প্রদায়টির বসত তামিলনাড়ুর মাদুরাই জেলার সাক্কিমঙ্গলম গাঁয়ে, এঁদের মধ্যে চাবুক-মারার প্রথার প্রচলন আছে বলে স্থানীয়দের মুখে চাতই জাতি নামে পরিচিত। অথচ, জনগণনায় এঁদের পরিচয় সেম্বানন্দ মারাভার, এবং সেই সুবাদে সবচাইতে অনগ্রসর জাতির তালিকায় (মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট বা এমবিসি) নিবন্ধিত।

“[সেনসাস্] সার্ভে করা বাবুবিবিরা আমাদের কাছে আসেন, এটাসেটা প্রশ্ন করেন, তারপর ইচ্ছেমতন বিভাগে আমাদের নাম গুঁজে দেন,” সাফ কথা ইয়েল্লাপানের।

ইয়েল্লাপান সহ প্রায় ১৫ কোটি ভারতবাসী আজ এইরকমই ভুলভাবে পরিচিত তথা নিবন্ধিত হয়ে বেঁচে আছেন। ঔপনিবেশিক যুগে, অপরাধী জনজাতি আইন, ১৮৭১-এর আওতায় বহু জনগোষ্ঠীকে ‘বংশগত অপরাধী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৫২ সালে এই আইন রদ হওয়ার পর থেকে উক্ত জনজাতিগুলি হয় বিমুক্ত জনগোষ্ঠী (ডি-নোটিফায়েড ট্রাইবস্ কিংবা ডিএনটি) কিংবা যাযাবর জনগোষ্ঠী (নোম্যাডিক ট্রাইবস্ কিংবা এনটি) বলে পরিচিত হয়ে এসেছে।

তা সত্ত্বেও বিমুক্ত যাযাবর ও আধা-যাযাবর জাতিসমূহের জাতীয় কমিশন থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি সরকারি রিপোর্টে বলা হয়েছে: “যেমন অসম্পূর্ণ, তেমনই অপর্যাপ্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সামাজিক অনুক্রমের সর্বনিম্ন স্তরেই এঁদের সেঁটে দেওয়া হয়েছে, ফলত ঔপনিবেশিক শাসনকালে যে পক্ষপাতের সৃষ্টি হয়েছিল, এঁদের আজও তা সইতে হয়।”

Yellappan, part of the Sholaga community
PHOTO • Pragati K.B.
lives in Sakkimangalam village in Madurai district of Tamil Nadu
PHOTO • Pragati K.B.

শোলাগা সম্প্রদায়ের ইয়েল্লাপানের (বাঁদিকে) নিবাস তামিলনাড়ুর মাদুরাই জেলার সাক্কিমঙ্গলম গাঁয়ে (ডানদিকে)

তারপর, উক্ত তালিকা থেকে বেশ কয়েকটি জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে তফসিলি জনজাতি (এসটি), তফসিলি জাতি (এসসি) ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহের (ওবিসি) বিভাগে স্থান পায়। কিন্তু ২৬৯টি সম্প্রদায় আজও আছে যেগুলি এখনও পর্যন্ত কোনও বিভাগে ঠাঁই পায়নি — এটাও বলা রয়েছে ২০১৭ সালের রিপোর্টে। এর ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, জমি বরাদ্দকরণ, রাজনৈতিক স্তরে অংশগ্রহণ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণের অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হয়েই রয়ে গেছেন। যে সামাজিক কল্যাণমূলক ব্যবস্থাগুলি তাঁদের হক, সেগুলি আজও তাঁদের অধরা।

কেউ কেউ ইয়েল্লাপানের মতো রাস্তায় রাস্তায় তাঁদের প্রথাগত শিল্প পরিবেশন করে বেড়ান, কেউ বা সার্কাসের শিল্পী বা জ্যোতিষী, কেউ কেউ সাপুড়ে, ওঝা, জড়িবুটি বা তাবিজ-মাদুলি বিক্রেতা। শূন্যে টাঙানো দড়ির উপর হেঁটে হেঁটে মাদারির খেল দেখানো থেকে ষাঁড়ের শিং ধরে লড়াই করা — এই সম্প্রদায়গুলির সদস্যরা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত। পরিযায়ী জীবন, যারপরনাই অসুরক্ষিত জীবিকা। আজও তাঁরা যাযাবর, কারণ নিত্যনতুন খদ্দের না ঢুঁড়লে পেট চলবে না। তবে হ্যাঁ, একটা করে স্থায়ী ডেরা রয়েছে, সন্তান-সন্ততির শিক্ষার কথা মাথায় রেখেই পর্যায়ক্রমে সেখানে ফিরে ফিরে আসেন তাঁরা।

তামিলনাড়ুতে, জনগণনার নথি অনুযায়ী পেরুমল মাট্টুকরন, দোম্মারা, গাডুগুডুপাণ্ডি ও শোলাগা জনজাতিগুলি এসসি, এসটি ও ওবিসির তালিকাভুক্ত। প্রত্যেকেরই স্বীয় স্বীয় আত্মপরিচয় রয়েছে, অথচ সেসব তোয়াক্কা না করে ওঁদের আড়িয়ান, কাট্টুনায়কন ও সেম্বানন্দ মারভার সম্প্রদায়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য জুড়ে অন্যান্য অনেক জনজাতির সঙ্গেও এমনটা ঘটেছে — হয় আলাদা ভাবে তাঁদের গণ্যই করা হয়নি, কিংবা ভ্রান্ত জাতি-পরিচয়ের তকমা দেওয়া হয়েছে।

“শিক্ষা-দীক্ষা বা চাকরি, সংরক্ষণ ছাড়া আমাদের বাচ্চাকাচ্চারা এক-পাও এগোতে পারবে না। কোনও রকমের সহায়তা ছাড়াই অন্যদের [ডিএনটি ও এনটি নন যাঁরা] মাঝে আমরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারব — এমনটা ভাবাও হাস্যকর,” বলছিলেন পাণ্ডি - পেরুমল মাট্টুকরন সম্প্রদায়ের এক সদস্য। তাঁর বেরাদরির মানুষজন রংচঙে সাজানো বলদ নিয়ে দরজায় দরজায় ফেরেন। এই জনজাতিটি বুম বুম মাট্টুকরন নামেও পরিচিত। এঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকের হাত দেখেন, আবার ভক্তিমূলক গান গেয়ে ভিক্ষাও করেন। ২০১৬ সালে তাঁরা তফসিলি জনজাতির তকমা পেয়েছিলেন বটে, তবে বলা নেই কওয়া নেই আড়িয়ান জাতির সঙ্গে ওঁদের জুড়ে দেওয়া হয়। তাঁরা একেবারেই খুশি নন এবং অবিলম্বে পেরুমল মাট্টুকরন পরিচয় ফিরে পেতে ইচ্ছুক।

পাণ্ডির সঙ্গে কথাবার্তার মাঝে, হঠাৎই দেখলাম বাহারি ফেস্টুন সাঁটা একটি ষাঁড় টানতে টানতে ওঁর ছেলে ধর্মদোরাই ফিরে আসছে। কাঁধে ঝুলছে মাধুকরীর ঝোলা, আর হাতে একখান প্রকাণ্ড বই — শিরোনাম ‘প্র্যাকটিক্যাল রেকর্ড বুক’।

His father, Pandi, with the decorated bull
PHOTO • Pragati K.B.
Dharmadorai is a student of Class 10 in akkimangalam Government High School in Madurai.
PHOTO • Pragati K.B.

মাদুরাইয়ের সাক্কিমঙ্গলম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে ধর্মদোরাই (ডানদিকে)। তার বাবা পাণ্ডির (বাঁদিকে) সঙ্গে সাজগোজ করা সেই ষাঁড়টি

মাদুরাইয়ের সাক্কিমঙ্গলম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে ধর্মদোরাই। বড়ো হয়ে সে জেলা কালেক্টর হতে চায়, আর সে জন্য ইস্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা জরুরি। ইস্কুল থেকে সাতখানা বই কিনতে বলেছিল, কিন্তু ৫০০ টাকার বেশি দিতে পারেননি পাণ্ডি, ও দিয়ে ছটা বইয়ের বেশি কেনা সম্ভব ছিল না। তাই ষষ্ঠ পুস্তকটি কেনার বন্দোবস্ত নিজেই করে নিয়েছে ধর্মদোরাই।

“[ফেস্টুন সাজানো] বলদটা নিয়ে ৫ কিলোমিটার হেঁটে ২০০ টাকা জোগাড় করেছি। এই বইটা ওই টাকাতেই কেনা,” সগর্বে জানান দিল কিশোরটি।

সবচাইতে বেশি সংখ্যক বিমুক্ত জনজাতির বাস তামিলনাড়ুতে — ৬৮টি; আর যাযাবর জনজাতির ক্ষেত্রে দুই নম্বরে রয়েছে এ রাজ্য — ৬০। তাই নেহাতই বেড়ালের ভাগ্যে শিকে না ছিঁড়লে যে ধর্মদোরাই শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারবে না, একথা হাড়ে হাড়ে জানেন পাণ্ডি। এঁদের বহু আগে থেকে যাঁরা তফসিলি জনজাতির পরিচয় লব্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদের প্রসঙ্গে তিনি বলে উঠলেন: “বড্ড বেশি লোকের সঙ্গে রেষারেষি করতে হচ্ছে আমাদের।” তামিলনাড়ুতে, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে ৬৯ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছে অনগ্রসর জাতি (বিসি), সবচাইতে অনগ্রসর জাতি (এমবিসি), ভান্নিয়ার, বিমুক্ত জনজাতি, এসসি ও এসটি-দের।

*****

“ধরুন যে গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেখানে কারও কিছু খোয়া গেল, ব্যাস, আর যায় কোথাই! সব্বার আগে দোষ চাপবে আমাদের ঘাড়ে। হাঁস-মুরগি, গয়নাগাঁটি, কাপড়জামা — সে যা-ই হোক না কেন — আমাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করে, জেলে পুরে, মেরে-পিটিয়ে, বেইজ্জত করবে লোকে,” বলছিলেন মহারাজা।

PHOTO • Pragati K.B.
His wife, Gouri performing stunts with fire
PHOTO • Pragati K.B.

বাঁদিকে: মালপত্র সব বান্দি-বোঝাই করতে ব্যস্ত মহারাজা, ডোম্মার সম্প্রদায়ের এই মানুষটি রাস্তায় রাস্তায় সার্কাস দেখিয়ে বেড়ান। ডানদিকে: আগুনের খেল দেখাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী গৌরী

বছর তিরিশেকের আর মহারাজা ডোম্মার সম্প্রদায়ের মানুষ, এঁরা পথে পথে মাদারির খেল দেখিয়ে বেড়ান। শিবগঙ্গা জেলার মনমাদুরাইয়ে তিনি সপরিবারে একটি বান্দিতে (অস্থায়ী কাফেলা-গাড়ি) থাকেন। তিন-চাকার এই শকটে সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঘুরে-বেড়ান এই দম্পতি, ঘরবাড়ি বলতে এটাই। তাঁদের দলে আরও ২৩টি পরিবার রয়েছে। মাদুর-তোশক, বালিশ ও একখান কেরোসিনের স্টোভ ছাড়াও চোঙা (মেগাফোন), ক্যাসেট প্লেয়ার, ধাতব ডাণ্ডা ও যে চক্রগুলি দিয়ে তাঁরা সার্কাস দেখান — দম্পতিটির সঙ্গে সঙ্গে কাফেলা চেপে ঘুরে বেড়ায় সবকিছুই।

“সকাল হলেই আমি আর আমার বউ মিলে বান্দি নিয়ে রওনা দিই। রাস্তায় প্রথম যে গ্রামটা পড়ে, সেই তিরুপাথুরে পৌঁছেই গাঁয়ের থালাইভার থেকে বান্দি [শিবির] পাতা আর খেলা দেখানোর অনুমতি চাইতে যাই। এছাড়াও আমাদের লাউডস্পিকার আর মাইকের জন্য বিজলি সংযোগ চেয়ে নিই।”

অনুমতি পেলেই গোটা গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে তাঁরা জানান দিতে থাকেন সার্কাসের কথা, তারপর বিকেল ৪টে বাজলেই শুরু হয় পরিবেশন — ঘণ্টাখানেক ধরে চলে মাদারির খেল, তারপর আরও একঘণ্টা গান চালিয়ে নাচতে থাকেন ইচ্ছেমতন (ফ্রিস্টাইল)। নাচগান মিটে গেলে, ঘুরে ঘুরে দর্শকের কাছে হাত পাততে থাকেন তাঁরা।

ঔপনিবেশিক যুগে অপরাধী জনজাতির তকমা দেওয়া হয়েছিল ডোম্মারদের। আজ তাঁরা বিমুক্ত হলেও, “সারাটাক্ষণ ভয়ে ভয়ে কাটান এঁরা। অহরহ নেমে আসে পুলিশের অত্যাচার আর গণপিটুনি,” জানালেন টিইএনটি (দি এম্পাওয়ারমেন্ট সেন্টার ফর নোম্যাডস্ অ্যান্ড ট্রাইবস্ বা যাযাবর ও জনজাতি ক্ষমতায়ন কেন্দ্র) সোসাইটির সচিব আর. মহেশ্বরী। মাদুরাই-কেন্দ্রিক এই বেসরকারি সংস্থাটি ডোম্মার সমাজের অধিকার নিয়ে লড়ছে।

তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতি (নৃশংসতা প্রতিরোধ) আইনের দ্বারা এসসি ও এসটি মানুষেরা বৈষম্য ও হিংসার থেকে বাঁচার আইনি সুরক্ষাকবচ পেলেও চূড়ান্ত ভাবে অসুরক্ষিও ডিএনটি ও এনটি সম্প্রদায়গুলির কাছে যে সাংবিধানিক ও আইনি কোনও কবচই নেই, একথা জানা গেল মহেশ্বরীর জবানে। হাজার গণ্ডা কমিশন ও রিপোর্টে বারবার সুপারিশ করা সত্ত্বেও কোনও লাভ হয়নি।

Kili Josyam uses a parrot to tell fortunes.
PHOTO • Pragati K.B.
People from Narikuruvar community selling trinkets near the Meenakshi Amman temple in Madurai
PHOTO • Pragati K.B.

বাঁদিকে: একটি টিয়াপাখির সাহায্যে লোকের ভাগ্য বলে ফেরেন কিলি জোস্যাম। ডানদিকে: মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী আম্মান মন্দিরের কাছেই টুকিটাকি বেচছেন নারিকুরুভার জনজাতির মানুষজন

ডোম্মার শিল্পীরা রাস্তায় নামলে একেকসময় বছর না কাটিয়ে ঘরে ফেরেন না, জানালেন মহারাজা। “যদি বৃষ্টি নামে, বা খেলার মাঝে পুলিশ এসে বাগড়া দেয়, তো সারাদিন একটা পয়সাও কামাতে পারি না,” যোগ করলেন গৌরী। তার পরের দিন, বান্দি চালিয়ে পাশের গাঁয়ে গিয়ে হাজির হন, আবারও পুনরাবৃত্তি হয় একই নিয়মের।

ওঁদের সন্তান মণিমারানের বয়স মোটে ৭। তাঁদের গোষ্ঠী জীবনের উদ্যোগে বাচ্চারা যেটুকু পড়তে-লিখতে শেখে, ওটুকুই ভরসা। মহারাজার কথায়: “বাচ্চাকাচ্চাদের দেখভাল করতে কোনও কোনও বছর আমার ভাইয়ের পরিবার গাঁয়ে থেকে যায়, তো কখনও আমার খুড়োমশাই সেই দায়িত্ব নেন।”

*****

উঠতি বয়সে রুক্মিণীর খেলা হাঁ করে দেখত দর্শকবৃন্দ। ইয়াব্বড় ভারি ভারি সব পাথর চুলে বেঁধে তুলতেন, আরেকজনের সঙ্গে মিলে অবলীলায় বাঁকিয়ে দিতেন ধাতব ডাণ্ডা। আজও তাঁর আগুনের কসরৎ, লাঠি-খেলা ইত্যাদি দেখতে ভিড় জমায় মানুষ।

৩৭ বছরের রুক্মিণী পথেঘাটে সার্কাস দেখিয়ে বেড়ানো ডোম্মার জনজাতির সদস্য, থাকেন তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলার মনমাদুরাইয়ে।

অশ্লীল খিল্লি-টিটকিরির তাঁর রোজকার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর কথায়, “মেকআপ চড়িয়ে, রংচঙে পোশাক পরে খেলা দেখাই, তাই মরদরা ভাবে আমি বুঝি ওদেরকেই কাছে ডাকছি। শ্লীলতাহানি করে, টিটকিরি দেয়, আমাদের ‘দর’ জিজ্ঞেস করতেও ছাড়ে না।”

পুলিশ কুটোটাও নাড়ে না। উপরন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উল্টে সে পুরুষেরাই অপমানিত বোধ করে। রুক্মিণীর কথায়, “ব্যাটারা মিছিমিছি আমাদের উপর চুরির নালিশ ঠোকে, আর ঠোকামাত্র পুলিশ কাজে নেমে পড়ে, আমাদের হাজতে পুরে যাচ্ছেতাই অত্যাচার করে।”

এতকাল পর, এইসবে ২০২২ সালে এই এনটি জনজাতিটি — স্থানীয়ভাবে যাঁরা কলাইকূটাডিগল নামে পরিচিত — তফসিলি জাতির আওতায় আসতে পেরেছে।

Rukmini, from the Dommara settlement in Manamadurai, draws the crowds with her fire stunts, baton twirling, spinning and more
PHOTO • Pragati K.B.

আগুনের খেলা, লাঠিখেলা ও আরও নানান কিছু দেখিয়ে ভিড় টানতে ওস্তাদ মনমাদুরাইয়ের ডোম্মারা বসতির রুক্মিণী

রুক্মিণী যে যে অভিজ্ঞতার কথা বললেন, সাবেক ডিএনটি ও এনটি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সেগুলি একেবারেই বিরল নয়। অপরাধী জনজাতি আইন রদ হলেও কয়েকটি রাজ্যে তার জায়গা নিয়েছে অভ্যাসগত অপরাধী আইন — যার ফলে একই রকম ভাবে নিবন্ধিত তথা নজরবন্দি হয়ে বেঁচে আছেন উক্ত জনজাতির মানুষজন। তফাত একটাই — আস্ত সম্প্রদায়ের বদলে এখন বেছে বেছে কয়েকজনকে নিশানা করা হয়।

এই সম্প্রদায়টি অস্থায়ী তাঁবু, কাফেলা ও ইট-সুরকির ঘর বেঁধে শিবির পেতেছে গাঁয়ের ভিতর। রুক্মিণীর ৬৬ বছর বয়সি পড়শি সেলভিও পথে পথে মাদারির খেল দেখিয়ে বেড়ান, উনিও ডোম্মারা জনজাতির মানুষ। চার সন্তানের — দুটি মেয়ে ও দুটি ছেলে — এই মায়ের কথায় উঠে এল যৌন হেনস্থার বীভৎস কাহিনি: “রাত নামলেই গাঁয়ের মরদরা আমাদের তাঁবুর ভিতর ঢুকে দিব্যি আমাদের পাশে শুয়ে পড়ে। ওদের এড়াতে গিয়ে আমরা নোংরা হয়ে থাকতে বাধ্য হই, চুল আঁচড়াই না, চান করি না, সাফসুতরো জামাকাপড়ও পরি না। তা সত্ত্বেও ওই শয়তানগুলো কিছুতেই পিছু ছাড়ে না।”

“আমরা সার্কাস দেখাতে যখন বেরোই, আমাদের দেখলে চিনতেই পারবেন না। এতটাই নোংরা হয়ে থাকি তখন,” বললেন সেলভির স্বামী রত্তিনাম।

এই সমাজের মধ্যে সর্বপ্রথম ইস্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করতে চলেছে তায়াম্মা। ১৯ বছরের এই তরুণী সান্নাথিপুডুকলমের সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী।

কিন্তু হায়, কলেজে গিয়ে “কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা” করার স্বপ্নটা তার খোয়াব হয়েই থেকে যাবে, কারণ মেয়েটির মা-বাবা বোধহয় অনুমতি দেবেন না।

“আমাদের মতো বেরাদরির মেয়েদের জন্য কলেজগুলো নিরাপদ নয়। ইস্কুলে গেলে [ওদের] ‘সার্কাস পোডারভা ইভা’ [সার্কাস পার্ফর্মার] বলে খ্যাপায়, বেছে বেছে উত্যক্ত করে মারে। কলেজে গেলে তো আরওই বিচ্ছিরি অবস্থা হবে,” বললেন তায়াম্মার মা লছমি। তারপর খানিক থেমে যোগ করলেন, “তাছাড়া ওকে ভর্তিটাই বা কে নেবে? তাও ধরুন ও কলেজে দাখিল হল, তখন ওর মাইনে-টাইনে এসব কোথা থেকে দেব আমরা?”

Families in the Sannathipudukulam settlement
PHOTO • Pragati K.B.
take turns fetching drinking water in a wheel barrow (right) every morning
PHOTO • Pragati K.B.

রোজ সকালবেলা একখান ঠ্যালাগাড়ি (ডানদিকে) নিয়ে পালা করে জল আনতে যায় সান্নাথিপুডুকলম বসতির (বাঁদিকে) পরিবারগুলি

ঠিক এই কারণেই এই সম্প্রদায়ের মেয়েদের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়, বোঝালেন টিইএনটির সচিব মহেশ্বরী। “কোনও দুর্ঘটনা [যৌন হামলা, ধর্ষণ ও গর্ভাবস্থা] যদি ঘটে, তখন বেরাদরির লোকেরাও মেয়েটাকে একঘরে করে দেবে, এ জন্মে বিয়ে আর হবে না,” জানালেন সেলভি।

সুতরাং মড়ার উপর একবার নয়, দু-দুটো খাঁড়ার ঘা নিয়ে বেঁচে আছেন এই সকল সম্প্রদায়ের মহিলারা — জনগোষ্ঠী-ভিত্তিক বৈষম্য তো আছেই, উপরন্তু তার দোসর হয়ে জুটেছে লৈঙ্গিক ভেদাভেদ।

*****

“১৬ বছর বয়সেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। পড়াশোনা করার সুযোগ পাইনি। লোকের হাত দেখে পেট চালাই। তবে আমি চাই, এই কাজটা যেন আমার প্রজন্মের সঙ্গেই খতম হয়ে যায়। তাই আমার বাচ্চাদের আমি ইস্কুলে পাঠাই,” বলছেন তিন সন্তানের মা ২৮ বছরের হংসভল্লি।

গুডুগুডুপাণ্ডি সম্প্রদায়ের এই সদস্য মাদুরাই জেলার গাঁয়ে-গাঁয়ে লোকের হাত দেখে বেড়ান। একেক দিনে প্রায় ৫৫টি করে দরজায় গিয়ে দাঁড়ান হংসভল্লি, মধ্য তামিলনাড়ুর ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড সয়ে পদব্রজে ১০ কিলোমিটার পাড়ি দেন রোজ। ২০০৯ সালে তাঁর বসতির সব্বাইকে কাট্টুনায়কন — একটি তফসিলি জনজাতি বিশেষ — রূপে নিবন্ধিত করা হয়েছিল।

“ওই ঘরগুলো থেকে খানিক খাবারদাবার আর কয়েকমুঠি করে আনাজ পাই আমরা। একেকজন তো এক-দুটাকাও দেয়,” মাদুরাই সিটির জেজে নগর বসতিতে নিজের ঘরে বসে জানিয়েছিলেন তিনি। মাদুরাই জেলার থিরুপালানকুন্দ্রম শহরের এই বসতিতে আনুমানিক ৬০ খানা পরিবার থাকে।

Hamsavalli with her son
PHOTO • Pragati K.B.
in the Gugudupandi settlement
PHOTO • Pragati K.B.

গুডুগুডুপাণ্ডি বসতিতে (ডানদিকে) হংসভল্লি ও তাঁর ছেলে (বাঁদিকে)

এই গুডুগুড়পাণ্ডি জনপদটিতে না আছে বিদ্যুৎ সংযোগ, না আছে কোনও শৌচব্যবস্থা। বসতির চারিধারে দুর্ভেদ্য ঝোপঝাড়, সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করতে গিয়ে হামেশাই সাপের ছোবল খান এখানকার মানুষজন। “এমন একেকটা সাপ আছে গো, কুণ্ডলি পাকিয়ে ফনা তুললে আমার কোমর পর্যন্ত উঠে যায়,” হাতে ভয়ার্ত ইশারা করে জানালেন হংসভল্লি। বৃষ্টি নামলেই তাঁবু ভেদ করে পানি পড়ে, তখন অধিকাংশ পরিবারই রাত কাটান একখান ‘স্টাডি সেন্টারে’ — প্রকাণ্ড এই হলঘরটি একটি বেসরকারি সংস্থার বানানো।

তবে ১১, ৯ ও ৫ বছর বয়সি তিন সন্তানের ভাত জোগাতে নাভিশ্বাস উঠে যায় তাঁর, রোজগারে কুলোয় না। “বাচ্চাগুলো সারাক্ষণ এটা-সেটায় ভুগতে থাকে। ডাক্তারবাবু বলেন, ‘পুষ্টিকর খাবার খাও, পুষ্টি না পেলে বাচ্চারা শক্তি পাবে না, রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাটাও জন্মাবে না। কিন্তু রসম মেশানো রেশনের চালের জাউ ছাড়া আর যে কিছুই খাওয়াতে পারি না ওদের!”

ঠিক এই কারণেই তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “এই কাজটা যেন আমার প্রজন্মের সঙ্গেই চুকেবুকে শেষ হয়ে যায়।”

এই সকল সম্প্রদায়গুলি যে যে অভিজ্ঞতার শিকার, সে প্রসঙ্গে বি. আরি বাবু জানালেন, “সম্প্রদায়ের শংসাপত্র কেবলমাত্র বিভাগ চিহ্নিত করার কাগজ নয়, মানবাধিকার বাস্তবায়িত করার হাতিয়ারও বটে।” ইনি মাদুরাইয়ের আমেরিকার মহাবিদ্যালয়ে কর্মরত একজন সহকারী অধ্যাপক।

তাঁর মতে এই শংসাপত্রগুলি, “এঁদের সামাজিক বিচারের মাধ্যম, যাতে দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা অন্যায়-অবিচার মুছে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপে এঁরা জনসমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।” বাফুন নামে একটি অলাভজনক ইউটিউব চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা আরি বাবু। অতিমারি ও লকডাউনের সময় তামিলনাড়ুর প্রান্তবাসী সম্প্রদায়গুলি কতখানি নাজেহাল হয়ে উঠেছিল, তার খতিয়ান আছে এই চ্যানেলটিতে।

*****

“৬০ বছর বয়সে এই প্রথম ভোট দিয়েছি এবারে [২০২১-এর তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচন],” সান্নাথিপুডুকলমে নিজগৃহে সগর্বে তাঁর নির্বাচনী পরিচয়পত্র তুলে ধরলেন আর. সুপ্রামণি। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে আধার সহ অন্যান্য সরকারি নথিও তিনি জোগাড় করে ফেলেছেন।

“লেখাপড়া শিখিনি তো, তাই অন্য কিছু করে যে পেট চালাব, তার জো নেই। সরকারের উচিত আমাদের কিছু বৃত্তি-প্রশিক্ষণ দেওয়া আর কর্জের ইন্তেজাম করা। তাহলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে খুব সুবিধে হবে,” জানালেন তিনি।

১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে, বিমুক্ত জনজাতি অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিকল্পনা (স্কিম ফর ইকোনমিক এম্পাওয়ারমেন্ট অফ ডিএনটিজ্ বা এসইইডি) শিরোনামে একটি যোজনা শুরু করেছে আমাদের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক। যে যে পরিবারের “বাৎসরিক আয় ২.৫ লাখের কম, এবং যারা কেন্দ্র সরকার তথা রাজ্য সরকারের থেকে অনুরূপ কোনও সুযোগ-সুবিধা উপলব্ধ করতে পারছে না,” তাদের কথা মাথায় রেখেই চালু হয়েছে এই পরিকল্পনাটি।

A palm-reader in front of the Murugan temple in Madurai .
PHOTO • Pragati K.B.
A group of people from the Chaatai or whip-lashing community performing in front of the Tirupparankundram Murugan temple in Madurai
PHOTO • Pragati K.B.

বাঁদিকে: মাদুরাইয়ের মুরুগন মন্দিরের সামনে কর্মরত একজন হাত-দেখিয়ে গণৎকার। ডানদিকে: মাদুরাইয়ের তিরুপ্পারানকুন্দ্রম দেউলের সামনে তাঁদের প্রথাগত কায়দায় চাবুক-মারা পরিবেশন করছেন একদল চাতই জনজাতির মানুষ

এই সম্প্রদায়গুলি যুগ-যুগ ধরে যে অবিচারের শিকার, তার স্বীকৃতি রয়েছে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত উপরোক্ত ইস্তেহারে। এছাড়াও বলা হয়েছে যে আনুমানিক “২০০ কোটি টাকা খরচ করা হবে ৫ বছর সময়কাল জুড়ে — অর্থনৈতিক বৎসর ২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬ পর্যন্ত।” অথচ জনগণনার প্রক্রিয়া আজও খতম হয়নি, তাই এখনও পর্যন্ত বিমুক্ত বা যাযাবর জনজাতিগুলির হাতে একটি পয়সাও পৌঁছয়নি।

“এসসি আর এসটি সমাজের মতো আমাদেরকেও আলাদা ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে সংবিধানে। রাষ্ট্র যাতে আমাদের আর অবহেলা না করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার ওটাই পয়লা পদক্ষেপ,” বললেন সুপ্রামণি। ঠিকঠাক জনগণনা হওয়া অবধি হকের পরিচয় যে তাঁরা কখনওই পাবেন না, এটাও জোর গলায় জানালেন তিনি।

নিবন্ধটি ২০২১-২২ সালের এশিয়া প্যাসিফিক ফোরাম অন উইমেন, ল্য অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এপিডাব্লিউএলডি) মিডিয়া ফেলোশিপের অধীনে লিখিত।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Pragati K.B.

Pragati K.B. is an independent journalist. She is pursuing a master’s in Social Anthropology at the University of Oxford, UK.

Other stories by Pragati K.B.
Editor : Priti David

Priti David is the Executive Editor of PARI. She writes on forests, Adivasis and livelihoods. Priti also leads the Education section of PARI and works with schools and colleges to bring rural issues into the classroom and curriculum.

Other stories by Priti David
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra