পডকাস্টটি শুনুন

ওরা থাবা বসিয়েছে আমাদের পরিবেশে
দেখা দিন বাঘ রাজা, রক্ষা করুন জঙ্গল
ওরা খুবলে খেয়েছে আমাদের ভিটেমাটি
দেখা দিন হে মহাপ্রভু, রক্ষা করুন জঙ্গল

অনুলিপি:

ওয়াঘ দেব (বাঘ দেবতা)-এর কাছে প্রকাশ ভৈর আর্তি জানাচ্ছেন যাতে ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে দেবতা তাঁদের সম্প্রদায় ও বনের অন্যান্য সব সম্পদ রক্ষা করেন।

প্রকাশ মলহার কোলি আদিবাসী সমাজের মানুষ। উত্তর মুম্বইয়ের গোরেগাঁওয়ে সবুজ ঘেরা আরে কলোনির কেল্টিপাড়া গ্রামে তাঁর নিবাস। এখানেই জন্মেছেন, সপরিবারে এখানেই থাকেন বলে জানালেন ‘বেস্ট’ (বি.ই.এস.টি.) যাত্রীবাহী বাসের রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত কর্মী, ৪৭ বছর বয়সী প্রকাশ।

প্রকাশ ভৈর: বনজঙ্গল রক্ষা করার পরিবর্তে ওরা তো পরিবেশের ক্ষতি করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই অবস্থায় আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে আর এই জঙ্গল বাঁচানোর কাজে আমাদের সাহায্য করতে হবে।

প্রায় ৩২০০ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত আরে ভূভাগে (অনেকে বন/জঙ্গল বলেও উল্লেখ করেন) ২৭টি জনপদ ছিল। আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় ১০,০০০ মানুষের আবাসস্থল ছিল আরে।

এই বিস্তীর্ণ আরে অঞ্চল ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে। নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরে অঞ্চলে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। শুরু হয়েছিল দুধ কলোনি বা দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র দিয়ে। পরে একটি ফিল্ম সিটি (চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য নির্ধারিত চত্বর), ফিল্ম স্কুল এবং রাজ্য রিজার্ভ পুলিশের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

নিকটবর্তী নওসাচাপাড়া্র বাসিন্দাদের বিগত কয়েক দশক ধরে পৌরনিগম থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ ও জল সরবরাহের জন্য পুরাতন মুম্বই ভেটেরিনারি কলেজ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট জোগাড় করতে রীতিমতো লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল। জলের বন্দোবস্ত আজও হয়নি। নওসাচাপাড়ার বাসিন্দা রাকেশ সিংবান এই লড়াইয়ের কথা বললেন।

রাকেশ সিংবান: বিদ্যুতের লাইন আমাদের দরজার ঠিক পাশ দিয়ে চলে গেছে। এর ঠিক ওপরে উঠলেই দেখতে পাবেন একটা পুরোনো লাল রঙের বিদ্যুতের জংশন বাক্সও আছে সেখানে। আমাদের দরজার পাশ দিয়ে যে বৈদ্যুতিক লাইন চলে গেছে ওটা শুধু যেসব মালিকরা কোয়ার্টারে থাকে তাদের জন্য। আলো-টালো (বিদ্যুৎ) সব তাদের, আমাদের জন্য কিছুই নয়। ওরা চায় না আমরা এখানে থাকি, ওরাই চায় না আমাদের ঘরে বিদ্যুৎ আসুক…

Prakash Bhoir (left) of Keltipada questions the 'development' on his community's land.
PHOTO • Aakanksha
Rakesh Singhvan (right) of Navsachapada points to how the 'development has bypassed the Adivasi communities
PHOTO • Aakanksha

কেল্টিপাড়ার প্রকাশ ভৈর (বাঁদিকে) আদিবাসী সমাজের জমির ওপর গড়ে ওঠা ‘উন্নয়ন’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেমনভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে অবহেলা করে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে, সেই ছবি নওসাচাপাড়ার প্রকাশ সিংবান (ডানদিকে) আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন

এরমধ্যে সাম্প্রতিকতম এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত প্রকল্পটি হল মুম্বই মেট্রো রেল কর্পোরেশন লিমিটেডের (এম.এম.আর.সি.এল.) অধীনে মুম্বই মেট্রোর প্রস্তাবিত ৩ নং লাইনের জন্য একটি কারশেডের নির্মাণ।

এই প্রস্তাব অনুযায়ী শেডটি প্রায় ৩০ হেক্টর বা প্রায় ৭৫ একর জমি নিয়ে তৈরি হবে। আর তার জন্য মুম্বই শহরের প্রায় ২৬০০ গাছ কাটা পড়তে চলেছে – সেই মুম্বই শহর যে নাকি একটু উন্মুক্ত স্থান আর গাছের আচ্ছাদন পাওয়ার জন্য হাঁফিয়ে উঠছে। এই ঘটনার জেরে নাগরিকদের মধ্যে প্রতিবাদ দানা বাঁধছে এবং জনস্বার্থ মামলাও দায়ের করা হয়েছে।

পৌরনিগমের উদ্ভিদ বিভাগের গাছ কাটার যে সিদ্ধান্ত তার বিরুদ্ধে দায়ের করা আবেদনটি চলতি মাসের শুক্রবার, ৪ঠা অক্টোবর, ২০১৯ তারিখে বম্বে হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছে।

যাঁরা এই গাছ কাটার বিরোধিতা করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন আরে জনপদের আদিবাসীরা। আমরা কথা বললাম কেল্টিপাড়ার প্রকাশ ও প্রমীলা ভৈর, প্রজাপুরপাড়ার আশা ভোয়ে এবং নওসাচাপাড়ার রাকেশ সিংবানের সঙ্গে যাঁরা আরে এলাকায় ‘উন্নয়ন’-এর আঘাত সয়ে চলেছেন। প্রকাশ বলছিলেন তাঁদের সমাজের মানুষজন তো মেট্রোর কাজ শুরু হওয়ার সময়ও এই প্রকল্পের বিষয়ে কিছুই জানতেন না।

প্রকাশ: প্রথমদিকে, আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি যে একটা মেট্রো প্রকল্প এখানে আসতে চলেছে। অথচ দেখুন, এটা কিন্তু সরাসরি আমাদের গ্রামের ভিতর থেকে শুরু হল না। তারা এক কোণ থেকে শুরু করল, যেমন ১৯ নং প্রজাপুরপাড়া। প্রজাপুরপাড়ায় থাকেন আমাদের আশা ভোয়ে ও অন্যান্য আদিবাসীরা - তাঁরাই শুরুতে কিছু কিছু অসুবিধা ভোগ করতে থাকলেন। আরেকটা ব্যাপার ঘটল, আমাদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ চাষের জমি হারালেন। কিন্তু কৃষিজমি বাদে আমরা সবাই যা হারাতে বসেছি তা হল আমাদের বন। তাই কৃষিজমি যদি আমাদের নাও বা থাকে, জঙ্গল তো আছে আমাদের। সেখানে ২৭টি গ্রাম আছে। মানুষ বিভিন্ন বনজ সামগ্রী পায় জঙ্গল থেকে যা তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। সেজন্য যখন মেট্রোর কাজ শুরু হল, আমরাই প্রথম বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসি। আমরা তাদের বলেছিলাম এখানে কাজ শুরু করা অন্যায় কারণ এর জেরে গাছ কাটা পড়বে, তাতে বহু মানুষ চাষজমি হারাবে, ভিটেমাটি খোয়াবে বহু আদিবাসী। এখানে এটার (মেট্রো) কোনও দরকারই নেই।

প্রজাপুরপাড়া থেকে ২০১৭ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। স্থানীয় অধিবাসীদের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৭০টি আদিবাসী পরিবার এই মেট্রো প্রকল্পের জেরে গৃহহীন হয়েছিলেন। ২৭ থেকে কমে এখন এখানে বসতির সংখ্যা ১৫তে এসে দাঁড়িয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং আদিবাসী নেত্রী আশা ভোয়ে তাঁর বাড়ির বাইরে বসে একসময়ে যেখানে তাঁর প্রতিবেশী, আর তাঁর নিজের খেত-জমি দেখতে পেতেন, সেখানে আজ মেট্রো নির্মাণ প্রকল্পের করগেটের পাঁচিল দাঁড়িয়ে আছে। তিনি যখন আমাদের বলছিলেন কেমনভাবে মানুষের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তখন বিকট শব্দ করে সেখানে খোদাই যন্ত্র চলছিল।

The Mumbai Metro car shed proposes to take over 75 acres of Aarey. This has triggered citizens’ protests and litigation
PHOTO • Aakanksha

মুম্বই মেট্রো কারশেড আরে অঞ্চলের ৭৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পেশ করেছে। এই ঘটনা নাগরিকদের মধ্যে প্রতিবাদ ও মামলা-মোকদ্দমার সূত্রপাত করেছে

আশা ভোয়ে: প্রথম কথা, যখন তারা সমীক্ষা করে, তখনই তাদের উচিত ছিল আমাদের গ্রামটিকে প্রজাপুরপাড়া হিসেবে নথিভুক্ত করা, অথচ তারা ভুল করে লিখলেন সারিপুত নগর, অথচ এটা প্রজাপুরপাড়ার ঠিক পরে অবস্থিত।

সারিপুত নগর প্রজাপুরপাড়ার ঠিক পাশেই অন্য একটি বস্তি কলোনি।

আশা: যেখানে আদিবাসীরা থাকেন সেটা আদতে একটা পাড়া (জনপদ/খুব ছোটো গ্রাম)। এটা কোনোমতেই ছোটো শহর বা নগর হতেই পারে না। এলাকাটি জরিপ করে তারা জানাল যে মেট্রোর জন্য তারা এই জমি নিয়ে নিতে চলেছে, ক্ষতিপূরণ বাবদ আমাদের থাকার জন্য অন্য বাড়ি দেওয়া হবে। আদিবাসীরা নিজেদের বাড়ি-ঘর নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁদের তো কৃষি জমিও আছে, এত গাছ এখানে আছে, সেগুলোরই বা কী হবে? উত্তরে ওরা বলে আমরা এই সমস্যাগুলো একটা বৈঠকে আলোচনা করব, আর তোমাদের যা কিছু সম্পদ আছে, সে বাবদ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

কিছু বাড়ি তারা গুঁড়িয়ে দেয় ২০১৭ সালের মে মাসে। মানুষজন সরে যেতে রাজি হননি, কিন্তু বুলডোজারের সামনে তাঁদের জন্য আর কোনও বিকল্প রইল না।

আশা: আর তারপর, আমরা আমাদের জমিজমা হারালাম। ওরা একবার আমাদের জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনটুকু বোধ করল না। এসেই এই কম্পাউন্ড (দেওয়াল) তুলে দিল। তখন আমরা এই মর্মে মামলা দায়ের করি যে এই জমি আমাদের এবং ওই লোকজন আমাদের কাছ থেকে জোর করে জমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তারা খুব সাবলীলভাবে অভিযোগ অস্বীকার করে। এরপরই তারা দাবি করে যে একজন আদিবাসীও তাদের অধিগৃহীত জমিতে বাস করে না, কোনও গাছ সেখানে নেই এবং সেটি পুরোদস্তুর বস্তি কলোনি। এই কথাগুলো তারা আদালতে বলে। এবং এগুলো সব মৌখিক বিবৃতি (তারা আমাদের যা বলেছিল)। তারা কোনও লিখিত দিল না। এবং আমরাও বুঝিনি যে এগুলো তাদের কাছ থেকে লিখিত বিবৃতি হিসেবে চেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ফলত আমরা তাদের কাছ থেকে লিখিত আকারে কিছুই নিইনি।

আশা বললেন যাঁরা বাস্তুচ্যুত হলেন, তাঁদের কাজকর্মের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল, যা তাঁরা কোনও দিনই পাননি। পরিবর্তে, বাস্তুচ্যুত আদিবাসীদের কাছ থেকে বহুবার পরিচয়পত্র চাওয়া হয়। তাঁরা কালেক্টর অফিস থেকে ‘প্রকল্প দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি’ শংসাপত্রও পেলেন না, যেটি পেলে তাঁরা চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা লাভের অধিকার পেতেন।

আশা: ৭/১২ পরচা হল জমির দলিল যাতে সম্পত্তির মালিকের নাম, জমির পরিমাণ, এসব কিছু লেখা থাকে (সেই নথিতে)। ওরা দাবি করছে এটা সরকারি জমি। আপনিই দেখুন, এখানে আদিবাসীরা তো খুব শিক্ষিত নন। এসব নিয়ম কানুন তাঁরা কিছুই জানেন না। এবং এখন সরকার আমাদের বলছে যদি জমি আপনাদের হয় তাহলে ৭/১২ পরচা দেখান। তারা বলছে আদিবাসী হিসেবে নিজেদের পরিচয়ের প্রমাণ দাও। আমরা আদিবাসী, আমরা নিজেদের জাত পরিচয়ের শংসাপত্র দেখাতে পারি। তারপর তারা বলতে শুরু করল, ‘নিজেদের জামাকাপড় দেখ। কিছুতেই তোমরা আদিবাসী নও…’

Left: Asha Bhoye: 'But who is counting the trees that were cut earlier?'
PHOTO • Aakanksha
Right: Pramila Bhoir: 'I believe that trees should not be felled…'
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিক থেকে: আসা ভোয়ে: ‘কে গুনছে বলুন তো কত গাছ কাটা আগেই হয়ে গিয়েছে?’ ডানদিক থেকে: প্রমীলা ভৈর: ‘আমি মনে করি গাছ কাটা অন্যায়...’

প্রকাশও নিজের ক্ষোভ জাহির করলেন।

প্রকাশ: প্রমাণ দেওয়া তো সরকারের কাজ। আমরা তো প্রমাণ (তথ্য ও নথি) সৃষ্টি করতে পারি না।

মেট্রো কারশেডের জন্য তিনি বিকল্প স্থানের সন্ধান দিলেন।

প্রকাশ: আমরা বিকল্প জায়গার প্রস্তাবও দিয়েছিলাম যেখানে তারা দিব্যি কারশেড নির্মাণ করতে পারে। কিন্তু কেউ আমাদের কথা কানে তুলল না। আদিবাসীরা যাতে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে পারেন, তার জন্য আমরা একটা মিছিলও বের করেছিলাম। অথচ, মেট্রোর দাবিতে কিন্তু কোনও মিছিলই হয়নি। একটাও না।

আরে বনানী এবং আদিবাসীদের সমর্থনে অনেকে এগিয়ে আসেন। বৃহনমুম্বই পৌরনিগমের উদ্ভিদ কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের ২৯শে অগস্ট আরে কলোনির ২,৬০০-এর বেশি গাছ কাটা বা প্রতিরোপণের প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেওয়ার পর, নাগরিকরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন। ৪৪ বছরের আশার অবশ্য প্রশ্ন, সেইসব গাছগুলোর কী হবে যেগুলো ইতিমধ্যেই কাটা হয়ে গেছে?

আশা: কিন্তু কতগুলো গাছ আগেই কাটা হয়ে গিয়েছে, তা কে গুনছে বলুন তো?

আশার এক একরেরও কম, একচিলতে জমিটুকুও এই মেট্রো প্রকল্পের জন্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি আলু, কলা, লেবু, লাউ ও অন্যান্য মরসুমি সবজি ও ফল চাষ করা বিক্রি করতেন। প্রতিদিন ২০০ - ৩০০ টাকা উপার্জন থাকত তাঁর। আমাদের বললেন চাষের জমি অধিগ্রহণ বাবদ তাঁর পরিবারকে কোনও ক্ষতিপূরণই দেওয়া হয়নি।

আশা: আমার স্বামী আর মেয়ে বাড়িতে ছিল। এখন আমরা যে আওয়াজটা শুনছি সেই একই শব্দ সেদিন তারা শুনতে পেয়েছিল। এটা আসলে গাছ কাটাইয়ের যন্ত্রের শব্দ। দিনটা ছিল এক শুক্রবার ভোর ৪ টে। ১০-১৫ জন লোক এল এইসব যন্ত্রপাতি নিয়ে। আমার স্বামী এবং মেয়ে ছুটে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করল কী করতে এসেছে ওরা। তাতে জানা গেল, যে ওদের কাছে গাছ কাটার অনুমতি আছে। আমি তখন আরেতে ছিলাম, ফিরতে আমার মাত্র মিনিট দশেক সময় লেগেছিল। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই গাছগুলোকে ফালাফালা করে রেখেছিল। গাছ কাটার ঘটনায় বেজায় হইচই, শোরগোল হয়েছিল।

তাঁর স্বামী, কিষান ভোয়েও তাঁর সাদামাটা ছোট্ট দোকানটা দুবছর আগে হারিয়েছেন। দৈনিক ১,০০০-৩,০০০ টাকা উপার্জন ছিল তাঁর এই দোকান থেকে। তাঁদের কেসটি এখন বম্বে হাইকোর্টে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে।

আশা: দুবছর আগে, প্রধান সড়কের ওপর আমাদের একটা দোকান ছিল। সেটাকে ওরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে মানুষটা (আমার স্বামী) ঘরে বসে আছে। দোকান আর আমাদের চাষের সবজি থেকে যা আয় হত, তা দিয়ে আমরা কোনোমতে চালিয়ে নিতে পারতাম। ওটা তো (সেই দোকান) নিলই ওরা, তার সঙ্গে এটাও (জমি) নিয়ে নিল। ওরা বলেছিল যে কাঞ্জুরে (উত্তর মুম্বাইয়ের কাঞ্জুরমার্গ অঞ্চলে) অন্য একটা দোকান আমাদের দেবে। দিয়েছিল বটে, কিন্তু আমরা যখন তা দেখতে গেলাম, দেখলাম কী বীভৎস নোংরা। ঝাঁপটা ভাঙা আর দোকানটা একদম বাইরের দিকে (বিচ্ছিন্ন)। ওখানে কেমন করে বিক্রিবাট্টা করব আমরা? এখন তো সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। সামান্য কটা সবজি বেচে বেঁচে আছি। আমাকে বলতে পারেন কেমন করে এই সংসার টানব?

Left: The Adivasis of Aarey have for long cultivated their shrinking famlands right next to a growing city.
PHOTO • Aakanksha
Right: Trees marked for chopping
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: আরের আদিবাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমশ বেড়ে চলা শহরের ঠিক পাশে নিজেদের ছোটো হয়ে আসতে থাকা জমিতে চাষ করছেন। ডানদিকে: কাটার জন্য গাছগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে

বর্তমানে প্রজাপুরপাড়ার একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হিসেবে আশা প্রতি মাসে ৩০০০ টাকা উপার্জন করেন। যারপরনাই ভোগান্তির পর আশা এখন আইনি লড়াইয়ের পথ নিয়েছেন। কোনোমতেই তিনি থামবেন না বলে পণ করেছেন তিনি।

আশা: আপনি ‘উন্নয়ন’ করতে চাইলে করুন না। কিন্তু যদি সেটা আদিবাসীদের ঘাড়ে চড়ে করবেন ভেবে থাকেন, সেটা মোটেই ঠিক না। তাই না? আপনারা আদিবাসীদের কৃষিজমি কেড়ে নিচ্ছেন, ভয় দেখিয়ে ঘর থেকে উচ্ছেদ করছেন - আর তারপর তাঁদেরই জমির ওপর দাঁড়িয়ে উন্নয়ন করবেন? আপনারা তাঁদের ঘর দিয়ে বলবেন নিয়ে নাও। কিন্তু কৃষিজমি কেড়ে নিলে, আমরা ছেড়ে দেব? একে উন্নয়ন বলবেন আপনি? এসব কি সত্যিই আমাদের জন্য? একদিকে আপনারা আমাদের জীবন ধ্বংস করছেন আর তারপর দাবি জানাচ্ছেন যে আপনারা আমাদেরই জন্য উন্নয়ন নিয়ে আসছেন? আমাদের না আছে কোনও গ্রাম, না আছে অন্য কোনও ঘর। এটাই আমাদের জগৎ। আমাদের যা কিছু সব এখানে আছে। কোথায় যাব আমরা এখান থেকে?

প্রকাশের কথাগুলো আমাদের ভাবতে বাধ্য করল:

প্রকাশ: মানুষ নিজেদের খুব বুদ্ধিমান বলে মনে করে, আমি কিন্তু জোর গলায় এটাকেই প্রশ্ন করছি। সে মনে করে অনেক কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছি, সেতু, মল, মেট্রো নির্মাণ করেছি, এমনকি মঙ্গলেও পৌঁছে গেছি যখন, তখন আমরা নির্ঘাৎ ভীষণ বুদ্ধিমান। কিন্তু, আমি মনে করি আমরা ধ্বংসের পথে প্রতিযোগিতায় নেমেছি। আমার এই কথাও মনে হয় দেশে যদি সত্যিই গণতন্ত্র থাকে, তাহলে সব মানুষের কথাই তো শোনা উচিত। মানুষ এগিয়ে এসে এত বৃহৎ পরিসরে কথা বলছে যে এই পদক্ষেপের পরিণতি শুধুই ক্ষতি ও ধ্বংস। তাহলে তারা শুনছে না কেন? আমার এই বিষয়টা খুব খুব অদ্ভুত লাগছে।

সোমবার, ৭ই অক্টোবর, সুপ্রিমকোর্ট আরেতে আগামী ২১শে অক্টোবর পর্যন্ত এম.এম.আর.সি.এল.-এর গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ততদিনে অবশ্য ২৬০০-এর মধ্যে বহু গাছ কাটা হয়ে গেছে।

পেশায় কৃষক ও গৃহিণী তথা প্রকাশের স্ত্রী প্রমীলা ভৈর ৭ই অক্টোবর বাইকুল্লা থানায় দুদিনের জন্য আটক ছিলেন। অন্যান্য নাগরিকদের সঙ্গে তিনিও গাছ কাটার প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন।

প্রমীলা: ওরা গাছগুলোকে টুকরো টুকরো করে কাটছিল দেখে আমরা রক্ষা করতে ছুটে গিয়েছিলাম ওখানে। পুলিশকে আক্রমণ করতে বা কোনও ঝামেলা পাকাতেও যাইনি। আপনারা শিক্ষিত, আমার তো অক্ষরজ্ঞানটুকুও নেই। তা সত্ত্বেও আমি মনে করি গাছ কাটা অনুচিত।

পুনশ্চ: সোমবার, ২১শে অক্টোবর, সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে যে আরে কলোনিতে মেট্রো কারশেড নির্মাণের ওপর কোনও স্থগিতাদেশ জারি করা হয়নি, এবং গাছ কাটার বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের সময়সীমা বাড়িয়ে ১৫ই নভেম্বর, ২০১৯ করা হয়েছে।

ঋণ স্বীকার ও বিশেষ ধন্যবাদ:

নেপথ্য কণ্ঠ: জাহরা লতিফ, ঊর্না রাউত

অনুবাদ: মেধা কালে, জ্যোতি শিনোলি, উর্জা

সাউন্ড লেভেলিং ও অডিও ইনপুট: হপুন সাইকিয়া, হিমাংশু সাইকিয়া

অনুবাদ: কথা হালদার

Aakanksha

Aakanksha is a reporter and photographer with the People’s Archive of Rural India. A Content Editor with the Education Team, she trains students in rural areas to document things around them.

Other stories by Aakanksha
Translator : Katha Haldar

Katha Haldar is PhD student with the Indiana University, USA and is currently working on Open Quantum Systems. Her area of interest includes creative writing, drawing, singing and playing classical guitar. She wishes to work on health and empowerment among children and women in the rural areas.

Other stories by Katha Haldar