সময়টা চলতি বছরের ১১ অগস্ট। মধ্য কাশ্মীরের বুদগাম জেলার যুগো খারিয়েনের ২১ বছরের এক যুবক ওয়াজিদ আহমেদ আহাঙ্গার তিন দিনের এক বিশেষ উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলেন তোসাময়দানের উদ্দেশে। এই মনোরম সবুজ তৃণভূমির বুকে লুকিয়ে থাকা এ যাবৎ না-ফাটা একটি বোমা (শেল) আচমকাই ফেটে পড়েছিল। ঠিক যেন "ঘোড়ায় চড়া রাজকুমার" ওয়াজিদ বাড়ি থেকে নতুন পোশাকে সেজে বের হয়েছিলেন, আর ফিরে এল তাঁর নিথর নিষ্প্রাণ দেহ — পরে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে এই বিবরণ দিয়েছিলেন সন্তানহারা বাবা। বাকি তিন সঙ্গীও গুরুতর জখম হয়েছিলেন।
উৎসবের জৌলুসে মুহূর্তেই শোকের ছায়া নেমে এসেছিল সেদিন। এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দেয়, ঠিক কীভাবে কাশ্মীরকে এখনও তাড়া করছে তার অতীত।
ঠিক এক বছর আগের কথা। এই অগস্ট মাসেই, বুদগাম জেলার খাগ ব্লকের শুঙ্গলি পোরা গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ আক্রম শেখ আমাকে বোঝাচ্ছিলেন "জশ্ন্-এ-তোসা" উৎসবটির তাৎপর্য। সেই ২০১৫ সাল থেকে পরবটি এই তৃণক্ষেত্রের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আর জম্মু-কাশ্মীর সরকারও এটিকে পর্যটন উৎসবের অন্যতম অংশ হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেছে।
তিনি বলছিলেন যে এই উৎসব এখানকার জনগোষ্ঠীর কাছে তাঁদের উন্মুক্ত জমি ফিরে পাওয়ার উদযাপন। পাঁচ দশক ধরে ফায়ারিং রেঞ্জ হিসেবে সেনাবাহিনীর অধিকৃত ছিল এই ময়দান। এরপর ২০১৪ সালে দীর্ঘ সংগ্রামের পর জমির দখল ছেড়ে দেয় তারা।
এই আজাদি উদযাপন করেছিলেন গ্রামবাসীরা — মৃত্যু, আঘাত কিংবা হুমকির ভয় ছাড়াই যেমন খুশি ঘুরে বেড়ানোর কিংবা রাখালিয়া জীবন-জীবিকা পালন করতে পারার আজাদি। আক্রমজি বড়ো সুন্দরভাবে এই তৃণভূমির মুক্তি পাওয়ার ঘটনাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘রাহাত কি সাঁস’ অর্থাৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস হিসেবে।
তবে, এমন স্বাধীনতা আদতে যে ভ্রম-মাত্র তা ২০১৮ সালের অগস্টের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় — সামরিকীকরণ ঠিক কেমন করে গোটা জায়গার চালচিত্র আমূল বদলে দিয়ে এই মাটির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রায় ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভারী চমৎকার এক আল্পীয় তৃণভূমি এই তোসাময়দান। তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে পীর পঞ্জাল পর্বতশ্রেণি, সীমানা বেঁধে দিয়েছে ঘন অরণ্য। সেই কবে থেকে গুজ্জর, বাকরওয়াল এবং চোপানদের মতো যাযাবর এবং পশুপালক সম্প্রদায়ের মানুষজন গ্রীষ্মকালে একে চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। লোককথায় বলে এমনকি মুঘলরাও এই তৃণভূমি পার করে ১৩,০০০ ফুট উঁচু বাসমাই গাল্লি গিরিপথ দিয়ে পুঞ্চ উপত্যকায় যেত।
১৯৬৪ সালে জম্মু ও কাশ্মীর সরকার সেনাবাহিনীকে ৬৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই তৃণভূমিটি গোলাবারুদ মহড়ার জন্য ফায়ারিং রেঞ্জ হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি বাবদ একখানা পাট্টায় সইসাবুদ করে দেয়। এতে করে এখানকার মানুষজন কিংবা পরিবেশের যে কী হালত হবে সেসব নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামানোর দরকার বোধ করেনি।
প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে বরফ গলার যে মরসুম বসন্তের খবর আর তৃণভূমির চারণোপযোগী সব ঢালের উদ্দেশে রাখালিয়া গোষ্ঠীগুলোর যাত্রা শুরুর বার্তা আনে, সেই সময়টা থেকেই সেনাবাহিনীর বচ্ছরভরের কামান-বন্দুক দাগার মহড়া শুরু হয়ে গেছিল সেবার। পাহাড়ের এক ঢাল থেকে অন্য ঢালে গোলাগুলি বর্ষানোয় হাত মকশো করা হত রকেট লঞ্চার, গ্রেনেড এবং মর্টার বন্দুকের মাধ্যমে। ফলে হাজারও না-ফাটা গোলাবারুদে ছয়লাপ হয়ে যেত ঘাসে ঢাকা ময়দানটা।
খাগ ব্লকের অন্তর্গত ছবির মতো সুন্দর সীতা হরণ গ্রামটার অবস্থান এইসব পাহাড়ি ঢাল আর সবুজ তৃণভূমিগুলোর মুখোমুখি। রাজ্যের এহেন সিদ্ধান্তের জেরে কতরকম ধকল যে সইতে হয়েছে এখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলোকে, সেকথা বারবার উঠে আসে তাঁদের বয়ানে। গ্রামপ্রধান গুলাম মহিদ্দুন শেখের বিবি এই তৃণক্ষেত্রেই তাঁদের ঢোকের (কাঠ ও মাটি দিয়ে তৈরি ঘর) মধ্যে অস্থায়ীভাবে থাকছিলেন তখন। দুপুরে খেতে বসে শেখ সাহেব বলছিলেন কীভাবে তাঁর পরিবার এবং অন্যান্য গ্রামবাসীরা হাজারও বিধিনিষেধের মধ্যে, মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে, বেড়ে উঠেছিলেন কোনওমতে। “আমরা যখন গবাদি পশুদের নিয়ে চরাতে যেতাম কিংবা মহিলারা যখন জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ করতে যেত, সেনাবাহিনী ঠিক আমাদের থামিয়ে তল্লাশি করত। অথচ দেখুন আমরা তো কেউ বহিরাগত নই।"
তিনি বলে চলেন, এই তৃণভূমি আঁকড়ে বেঁচে থাকা কত মানুষ সেনার মহড়ার সময় লক্ষ্যভ্রষ্ট গোলার আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন, কখনও না-ফাটা গোলাবারুদের সংস্পর্শে এসে ছিন্নভিন্ন হয়েছে শরীর কিংবা বিকলাঙ্গ হয়েছেন গুরুতর জখমের পর। কাঠ কাটতে গিয়ে এক কাঠুরের কুঠারখানা একটা শেলের ওপর গিয়ে পড়লে চিরজীবনের মতো লোকটার একটা হাত খোয়া যায়। ওষধি গাছড়ার খোঁজে খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে হাতের আঙুল উড়ে যায় আরেকজনের। গবাদি পশুগুলোর ওপরেও চরম ক্ষতি হেনেছে এসব গোলাগুলি। শেখ সাহেবের মনে পড়ে, একবার এক পশুপালক কীভাবে তাঁর ৬০টি ভেড়া একসঙ্গে বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়ার মতো হাড় হিম করা দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন।
“আমাদের গ্রামেই তো চারজনের ইন্তেকাল হয়েছিল— দু'জন মহিলা, যাঁদের মৃতদেহ জঙ্গলে পাওয়া যায়, খুব সম্ভবত তাঁরা না-ফাটা শেলের সংস্পর্শে এসেছিলেন। আরও দুটো জোয়ান ছেলে সেনার গুলির মহড়ার সময় মারা গেছিল সেবার,” তিনি বলেন।
তথ্য অধিকার আইনের (আরটিআই) অধীনে প্রাপ্ত খবর অনুসারে, তোসাময়দানে অন্তত ৬৮ জন নিহত হন, অঙ্গহানি হয় ৪৩ জনের। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মৃত্যুর সাক্ষী থাকে শুঙ্গলি পোরা। ৩৭ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান ৪,৮০০ বাসিন্দার এই গ্রামে।
রেহাই পায়নি শিশুরাও। ২০১৪ সালের ১৯ মে, সাত বছুরে ছোট্ট সিমরন পারে লাফাতে লাফাতে ঘরে ফেরে আর তৃণভূমিতে খুঁজে পাওয়া একটা থলে নিয়ে মনের খুশিতে খেলায় মেতে ওঠে। থলেটার মধ্যে ছিল না-ফাটা কয়েকটা বোমা। ভীষণ এক বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সিমরনের একরত্তি শরীর আর তার পাঁচ বছরের ভাই ফায়াজের দেহ থেকে পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পেশায় ছুতোর মহম্মদ আক্রম শেখ, শুঙ্গলি পোরা গ্রামের প্রাক্তন সরপঞ্চ এবং তোসাময়দান বাঁচাও ফ্রন্টের সহ-সভাপতি। ময়দানে ফায়ারিং রেঞ্জের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছিল একসময়। তাঁর শারীরিক ও মানসিক জখমগুলোর কথা আমার সঙ্গে ভাগ করে নেন আক্রম সাহেব: “বড়ো ভাইয়া আব্দুল করিমকে যখন হারাই, আমি তখন নেহাতই ছোটও একটা ছেলে। সালটা ১৯৯০। ভাইয়ার বয়স ছিল ২৩, সদ্য বাগদান হয়েছিল ওর। গরমের ছুটি চলছিল বলে সেবার আমি তোসাময়দানেই ছিলাম আর ও আমায় স্কুলের বইগুলো এনে দিয়ে তারপর গেছিল গবাদি পশুগুলোর দেখভাল করতে।”
আচমকা এক ঝাঁক গুলি ধেয়ে আসে করিমের দিকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। এদিকে খাগ থানায় এফআইআর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) দায়ের করতে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এই বলে যে, হত্যাকাণ্ডটি ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে ঘটেছে। “লোকসান যা হওয়ার, আমাদের হয়েছে। আমাদের পরিবারের একটা মানুষকে হারিয়েছি আমরা। অথচ আমাদেরই এই হত্যার বিরুদ্ধে সওয়াল করার কোনও হক ছিল না। [পুলিশ এবং সেনারা] এমনি করেই আমাদের দাবিয়ে রাখতে চাইছিল।”
২০০৩ সালের ১৫ জুলাই মহম্মদ আক্রম নিজেই আহত হন। এখন তাঁর বয়স প্রায় চল্লিশ। প্যান্টটা গুটিয়ে দেখালেন পায়ের ডিমের ওপর লম্বা এক ক্ষতচিহ্ন। “সবে সবে তখন নিকাহ হয়েছে আমার, গিয়েছিলাম একদিন ওই ময়দানে। একজন হেডমাস্টারমশাই আর আরও কয়েকজন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সকলে মিলে মৌজ করে চা খাচ্ছিলাম; এমন সময়, আগে থাকতে কোনও হোঁশিয়ারি ছাড়াই, মাগামের ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ ক্যাম্প থেকে গুলির মহড়া শুরু হল। একটা শেল বিলকুল আমাদের পাশে ফাটল…।” আক্রম সাহেবের বরাতজোরে ঠিক সময়ে ইলাজ শুরু হয়, নাহলে হয়তো পাটা অস্ত্রোপচার করে বাদই দিতে হত।
শুঙ্গলি পোরা গ্রামের এক পশুপালক গুলাম আহমেদ আমাকে জানালেন, শুধুমাত্র হত্যা এবং অঙ্গহানি নয়, এইসব গোলাগুলি মহড়ার চক্করে বাচ্চা-বড়ো সবাইকে এমনিও অনেক ভুগতে হয়েছিল। "তালিম-টালিম (পড়াশোনা) তো শিকেয় উঠেছিল। স্কুলের সময় গোলাগুলির সময়ের সঙ্গে মিলে যেত। বুম বুম বুম... সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বন্দুকের গর্জন আর শেলের সোঁসোঁ শব্দে থরথরিয়ে উঠত গোটা এলাকা। স্কুলের বাড়িগুলো কাঁপত, আর ভয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকত বাচ্চারা। অনেকের কানে শুনতে পরেশানি হচ্ছিল। একবার একটা শেল তো নিশানা ভুল করে চিল-ব্রাসে একটা স্কুলবাড়ির কাছেই এসে পড়েছিল। ড্রাঙ, খাগ, সীতা হরণ গ্রামের ঘরবাড়িগুলোর জানালার শার্সি চৌচির হয়ে যেত, বাড়ির দেয়ালে ফাটল ধরত।”
এছাড়াও পরিবেশের যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল তা তো বলাই বাহুল্য। বরফ গলার মরসুমে বা ভারী বৃষ্টির সময়, শেলগুলো ধুয়ে গিয়ে পড়ত নালা বা হিমবাহের পানিতে, যা কিনা বুদগাম অঞ্চলে জলের প্রধান উৎস। গোলাবারুদের জেরে ঝোপঝাড়ে আগুন লাগত আর মাঠে বিশাল বিশাল গর্ত তৈরি হত।
গুলাম আহমেদের খেদোক্তিতে উঠে আসে আরও একটা লোকসানের কথা, বিস্ফোরকে ব্যবহৃত রাসায়নিককেই এর জন্য দায়ী করেন তিনি: “এখানে অনেক পাখির প্রজাতি ছিল — বক, বন মোরগ, সারস — সবই হারিয়ে গেছে পরিবেশের ক্ষতির জেরে। অনেক ওষধি গাছও মনে হয় গায়েব হয়ে গেছে বেমালুম।”
বহু বছর ধরে, স্থানীয় মানুষজন এই মৃত্যু ময়দানকে এক অনিবার্য বিপদ বলেই মেনে নিয়েছিলেন এবং বাইরের বিশ্বও যেন তাঁদের এ দুর্ভোগ দেখেও দেখছিল না। ফায়ারিং রেঞ্জের কারণে গবাদি পশু ও ফসলের ক্ষতির জন্য তাঁরা খেসারৎ দাবি করতে পারবেন কি না সে বিষয়েও কিছু অস্পষ্টতা ছিল। ১৯৩৮ সালের ‘ম্যানুভার্স ফিল্ড ফায়ারিং এবং আর্টিলারি প্র্যাকটিস অ্যাক্ট’-এর অধীনে কোনও নির্দেশিকা না থাকার দরুণ বহু বছর ধরে কোনও এফআইআর দায়ের করা হয়নি, এবং ক্ষতিপূরণের জন্যেও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
অবশেষে ২০১৩ সালে, তোসাময়দান বাঁচাও ফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে গ্রামের বাসিন্দারা একজোট হয়ে সম্মিলিতভাবে সংগ্রাম শুরু করেন। এই আন্দোলনের শুরুয়াতটা হয়েছিল শ্রীনগরের চিকিৎসক গুলাম রসুল শেখের হাত ধরে। শ্রীনগরে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ডাক্তারবাবু জানান যুবক বয়সে ওই অঞ্চলে ট্রেকিং করতে গিয়ে বুদগামে ফায়ারিং রেঞ্জ থাকার ব্যাপারটা প্রথম জানতে পারেন তিনি। “ওখানে একটার পর একটা গাছ কাটা পড়ছে দেখে লোকজনকে বললাম এসব বন্ধ করে পরিবেশ-ভিত্তিক পর্যটন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে। যা শুনলাম তাতে উদ্বেগ বাড়ল বৈ কমল না। এই বেনজির খুবসুরতির দেশে ওই এক ফায়ারিং রেঞ্জের জন্য নাকি পর্যটনের কোনও সওয়ালই উঠতে পারে না।”
পরে, চলমান স্বাস্থ্য সেবা উদ্যোগে সরকারি মেডিকেল অফিসার পদে থাকাকালীন ডক্টর রসুল জানতে পারেন শুঙ্গলি পোরা গ্রামের বেশ কয়েকজন বিধবা মহিলার কথা, যাঁদের স্বামীরা এই ফায়ারিং রেঞ্জের দরুণই প্রাণ হারিয়েছেন। দস্তুরমতো চমকে ওঠেন ডাক্তারবাবু। এমন একটি পরিবারের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয়েছিল, কতকগুলো বছরে যাদের তিনজন পুরুষ সদস্যের ইন্তেকাল হয়ে গেছে ওই এক ফায়ারিং রেঞ্জের জন্য। তাঁকে একেবারে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ঘটনাটা।
পরবর্তীকালে জম্মু-কাশ্মীরে তথ্য অধিকার আন্দোলনেরও পথিকৃৎ হয়ে ওঠা ডক্টর রসুল, ১৯৬৯ সাল থেকে ফায়ারিং রেঞ্জের প্রভাবগুলো খতিয়ে দেখার তাগিদে আরটিআই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল উক্ত প্রভাবের দরুণ ঘটা মৃত্যু, জখম এবং পঙ্গুত্বের পরিসংখ্যান এবং সেনাবাহিনীকে দেওয়া জমির ইজারার অনুপুঙ্খ বিবরণ সহ যাবতীয় তথ্য হাসিল করা।
প্রথমে মানুষজন সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রের ভয়ে তাঁদের বিরোধিতার কথা প্রকাশ করতে ভয় পেতেন। কিন্তু ২০১০-২০১১ সালে কাশ্মীরে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘোষণার পর একটা নতুন কৌশল দেখা যায়। যাঁরা ফায়ারিং রেঞ্জের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং তৃণভূমি খালি করাতে চেয়েছিলেন, তাঁদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত করা হতে থাকে। পরে এই পঞ্চায়েতগুলো তোসাময়দান সম্পর্কিত বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজে মদত দেয়।
“অনেক বিধবা মহিলা ছিলেন, যাঁদের স্বামীরা ফায়ারিং রেঞ্জের কারণে মারা যান, এবং তাঁদের একা হাতে কঠিন হালতের মধ্যে সন্তানদের মানুষ করতে হয়েছিল। এখানে যেমন চল, সেই মাফিক তাঁরা অনেকেই মসজিদের বাইরে বসে ভিক্ষা করে রোজগারের খামতিটুকু পূরণের চেষ্টা করতেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তো আশ্চর্য তাকত ছিল লড়াকু মানুষগুলোর। আমরা তাঁদের অনেককে বুঝিয়ে-সুজিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাঁড়াতে রাজি করিয়েছিলাম। তাঁরা স্পষ্টবাদী এবং অনেকসময় কোনও ফয়সালা নেওয়ার ক্ষেত্রে জোরগলায় তর্ক করে তা আদায় করতেও ওস্তাদ,” বলেন লুবনা সায়েদ কাদরি। পেশায় তিনি শ্রীনগরের স্কুল ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (এসআরডিই) কার্যনির্বাহী পরিচালক, যে সংস্থা তোসাময়দানে গোষ্ঠী-ভিত্তিক পর্যটন চালু করার বন্দোবস্ত করছে। বহু বছর যাবৎ বাকরওয়াল এবং গুজ্জর সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করছেন লুবনা জি।
তোসাময়দান গ্রাম কমিটি গঠন হওয়ার পর, দেখতে দেখতে ৬৪টি গ্রামের প্রতিনিধিত্বকারী ৫২ জন সরপঞ্চ, ফায়ারিং রেঞ্জের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেন এবং তোসাময়দান বাঁচাও ফ্রন্ট গঠনের জন্য একজোট হন।
এই স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্য নানান পরিবেশবিদ, কাশ্মীর বার কাউন্সিলের সদস্য এবং বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনকে আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আরটিআই-এর মাধ্যমে একখানা জরুরি তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। গ্রামবাসীরা যে ভাবতেন টানা ৯০ বছরের জন্য এ তৃণভূমির অধিকার সেনাবাহিনীর – তেমনটা আদৌ নয়, বরং ১০ বছর পর পর নবীকরণ হওয়ার কথা এই ইজারার। ২০১৪ সালে সেই ইজারাটি পুনর্নবীকরণের বছর ছিল। তাই ইজারা নবীকরণ না করার দাবিতে তৎকালীন ন্যাশনাল কনফারেন্স সরকারকে চাপের মুখে ফেলার জন্য জোরকদমে প্রচার শুরু হয়ে যায়। প্রতি মাসে অন্তত দুবার শ্রীনগরে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলতে থাকে এবং স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে।
অবশেষে, ২০১৪ সালের ১৮ এপ্রিল, সেনাবাহিনী তৃণভূমিটি খালি করে দেয় এবং ৮৩ দিনের এক সাফাই প্রক্রিয়া শুরু করে যার মাধ্যমে না-ফাটা শেল ইত্যাদি সরিয়ে জায়গাটাকে সাফসুতরো করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংবাদমাধ্যমে হাজার বাহবা কুড়োলেও, যেমনটি দাবি করা হয়েছিল ততটা সফল হয়নি এই প্রচেষ্টা। ২০১৮ সালের অগস্ট মাসে ওয়াজিদ আহমেদ আহাঙ্গরের মৃত্যুর পর আরও একটি সাফাই অভিযানের প্রয়োজন দেখা দেয়।
জীবনহানি ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির খেসারৎ এবং তোসাময়দান অঞ্চলের আশেপাশের গ্রামগুলোতে গ্রাম-ভিত্তিক পর্যটন গড়ে তুলতে রাজ্যের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তার মতো কয়েকটা বিষয় এখনও মিটমাট করা হয়নি।
২০১৭ সালের মার্চ মাসে তোসাময়দান বাঁচাও ফ্রন্ট এবং এসআরডিই শ্রীনগরের উচ্চ আদালতে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে ক্ষতিপূরণের জন্য। পরবর্তীতে রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু পরিমাণ অর্থ (অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে এখনও সুস্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি) বরাদ্দ করলেও, সেই টাকা এখনও পর্যন্ত কারও হাতেই পৌঁছয়নি।
গ্রামীণ পর্যটনের জন্য একটা খসড়া পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে এবং লুবনা সায়েদ কাদরি জানান যে এতে কাশ্মীরের সামাজিক রীতি-রেওয়াজকে মাথায় রেখেই মহিলাদের জন্য নতুন নতুন জীবিকার সুযোগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। “মহিলারা তো আর টাট্টুওয়ালা হতে পারবেন না, তাই আমরা তাঁদের জন্য হস্তশিল্প বা স্থানীয় খাবারদাবার বিক্রির মতো নানান কিসিমের কাজের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করছি।”
মহম্মদ আক্রমের বয়ান অনুযায়ী গুলমার্গ বা পহেলগামের মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আকছার যেসব পর্যটন শিল্পের ধাঁচ দেখা যায় তাতে আর গ্রামবাসীদের মোটে ভরসা নেই। সেখানে বড়ো পর্যটন সংস্থাগুলো জমি ইজারা নিয়ে মস্ত মস্ত হোটেল বানিয়ে লাভের সিংহভাগ নিয়ে যায়। "এই মডেলগুলোতে আমাদের গাঁয়ের লোকগুলোর হাতে ফুটোকড়িও থাকবে না, শুধু বাসন মাজা আর ফাইফরমাশ খাটার কাজ পাব আমরা। তার ওপর পরিবেশের ক্ষতি তো আছেই।”
তবে সামগ্রিকভাবে উপত্যকার ভয়াবহ পরিস্থিতি পর্যটনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি, এই তৃণভূমিতে চোরাগোপ্তা বিপদ নিয়ে ফের মাথাচাড়া দেওয়া আশঙ্কাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বেলাগাম সামরিকীকরণের জেরে এইসব অঞ্চলে আরও কোন কোন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে এখনও।
খাগের এক ছোটো খানাপিনার ঠেকে, মালিক আর্জি জানালেন একবারটি যাতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে পর্বতমালা আর তৃণভূমির খুবসুরত দৃশ্যখানা দেখি। "দোকানটা বাড়িয়ে এই জায়গাটা তৈরি করেছিলাম, মনের মতো সাজিয়েছিলাম। উমিদ ছিল প্রচুর ট্যুরিস্ট পাব,” বলতে বলতে ভারী হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠ। "কিন্তু মেহমানদের সবচাইতে বড়ো দল হিসেবে পেলাম সেনাবাহিনীর লোকগুলোকে, ঘেরাও আর তল্লাশি অভিযানের সময় হানা দিয়েছিল যারা..."
অনুবাদ: কথা হালদার
অনুবাদ সম্পাদনা: রম্যাণি ব্যানার্জী