স্বজাতি মানুষের মৃত্যু নিয়ে যখনই লিখতে বসি, মাথার ভিতরটা অসাড় লাশের মতো মনে হয়।

আমাদের চারপাশের জগতে কী চোখধাঁধানো উন্নয়ন, অথচ হাতে করে বর্জ্য সাফাইকারী মানুষগুলোর দিকে তাকিয়েও দেখে না সমাজ। রাষ্ট্র মানতেই চায় না যে এইধরনের মৃত্যু আদৌ ঘটে, অথচ এবছর লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রী রামদাস আথাওয়ালের দেওয়া তথ্য অনুসারে ২০১৯-২০১৩ সালের মধ্যে ৩৭৭ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে "নর্দমা এবং সেপটিক ট্যাঙ্কের বিপজ্জনক সাফাইকার্যের কারণে।“

গত সাত বছরে অগুন্তি মানুষের ম্যানহোলে আটকে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি আমি। শুধু চেন্নাই লাগোয়া আভাদিতেই ২০২২ সাল থেকে ১২টি ম্যানহোল মৃত্যু ঘটেছে।

১১ অগস্ট অরুন্ধতিয়ার সম্প্রদায়ভুক্ত আভাদির বাসিন্দা ২৫ বছরের হরি নিকাশি নালা সাফ করতে গিয়ে ডুবে যান। চুক্তি শ্রমিক হিসেবে সেখানে কাজ করছিলেন তিনি।

বারো দিন বাদে হরি আন্নার মৃত্যুর খবর করতে যাই আমি। তাঁর বাড়ি পৌঁছে দেখি একটা ফ্রিজার বাক্সে শোয়ানো আছে তাঁর দেহ। তাঁর স্ত্রী তামিল সেলভিকে পরিবার থেকে বলা হয়েছে শেষকৃত্য এবং বিধবার কর্তব্যকর্ম করে নিতে। পাড়াপ্রতিবেশী তাঁর সারা গায়ে হলুদ মাখিয়ে তাঁকে স্নান করিয়েছেন, তারপর তাঁর থালি [বিবাহিতা নারীর মঙ্গলচিহ্ন] ছিন্ন করে দিয়েছেন। পুরো সময়টা নীরব, গম্ভীর ছিলেন তিনি।

PHOTO • M. Palani Kumar

বর্জ্য সাফাই করতে গিয়ে মারা যান হরি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তিনি ও তাঁর প্রতিবন্ধী স্ত্রী তামিল সেলভি। তাঁর দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তামিল ও তাঁদের কন্যা

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: দীপা আক্কা প্রয়াত গোপির স্ত্রী। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে তাঁর নাম ডান হাতে উল্কি করিয়েছিলেন। ডানদিকে: গোপির মৃত্যু হয় ১১ অগস্ট, ২০২৪ তারিখে, ২০ আগস্ট তাঁর বিবাহবার্ষিকী ছিল, আর মেয়ের (ছবিতে দেখা যাচ্ছে) জন্মদিন ৩০ অগস্ট

অন্য ঘরে কাপড় ছাড়তে গেলেন যখন, গোটা আঙিনা স্তব্ধ। লাল ইট দিয়ে তৈরি বাড়িখানা, সিমেন্ট চাপানো হয়নি। প্রতিটা খোলা ইট ক্ষয়ে ক্ষয়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় যে কোনও মুহূর্তে ধসে পড়ে যাবে বাড়িটা।

শাড়ি বদলে ফিরে এসে হঠাৎ চিৎকার করে ফ্রিজার বাক্সটার দিকে ছুটে গেলেন তামিল সেলভি আক্কা। বাক্সের সামনে বসে আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছিলেন। তাঁর কান্নার শব্দে বাকি গোটা জটলাটা নির্বাক হয়ে গেল, ঘরে শুধু পাক খাচ্ছিল তাঁর কান্না।

“চোখ খোলো জান! আমার দিকে দেখো, মামা [আদরের ডাক]। ওরা আমায় শাড়ি পরাচ্ছে। আমি শাড়ি পরলে তোমার ভালো লাগে না, তাই না? ওঠো, ওদের বারণ করো আমায় জোর করতে।”

আজ পর্যন্ত শব্দগুলো আমার বুকের ভিতর ধাক্কা খেয়ে ফেরে। তামিল সেলভি আক্কার শারীরিক প্রতিবন্ধতা আছে, একটি হাত খুইয়েছেন তিনি। শাড়ির কুঁচি-আঁচল করতে সমস্যা হয়। সেই কারণেই শাড়ি পরেন না। এই স্মৃতিটা আমায় তাড়া করে বেড়ায় সর্বদা।

এমন যেকটা শেষকৃত্যে গিয়েছি, সবগুলো আমার ভিতরে থেকে গিয়েছে।

প্রতিটি ম্যানহোল মৃত্যুর পিছনে চাপা পড়ে থাকে বহু কাহিনি। আভাদির সাম্প্রতিক ম্যানহোল দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়েছেন ২২ বছরের দীপা। তাঁর সওয়াল, ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণে কি তাঁদের জীবনে আনন্দ ফিরে আসবে? “২০ অগস্ট আমাদের বিয়ের তারিখ আর ৩০ অগস্ট আমাদের মেয়ের জন্মদিন, আর এই মাসেই চলে যেতে হল ওকে,” বলছেন তিনি। ক্ষতিপূরণের যে টাকা পেয়েছেন তাতে সংসারের সমস্ত খরচ মিটছে না।

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: গোপির শবদেহ রাস্তায় বার করার আগে শুকনো পাতা পুড়িয়ে আগুন জ্বালাচ্ছেন পরিবার-পরিজন। ডানদিকে: উপচারের অঙ্গ হিসেবে মাটিতে ফুল ছড়ানো হচ্ছে

PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: বরফের বাক্সে শোয়ানো হচ্ছে গোপির দেহ। ২০১৩ সালে হাতে করে বর্জ্য সাফাই বেআইনি ঘোষিত হলেও আজও এই পরম্পরা চলে যাচ্ছে। কর্মীরা জানাচ্ছেন, প্রশাসন থেকে তাঁদের বাধ্য করা হয় ম্যানহোলে ঢুকতে, রাজি না হলে মজুরি কেটে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়

PHOTO • M. Palani Kumar

স্বামী গোপির দেহ আঁকড়ে দীপা আক্কা, কিছুতেই যেতে দিতে চান না

যেসব পরিবারে ম্যানহোলে আটকে মৃত্যু ঘটে, তাদের নারী ও শিশুদের বিপন্ন বলে ধরাই হয় না। তামিলনাডুর পূর্বপ্রান্তে ভিল্লুপুরমের মাড়মপাট্টু গাঁয়ে যখন অনুশিয়া আক্কার স্বামী মারি ম্যানহোলে আটকে পড়ে মারা যান, কাঁদতেও পারেননি তিনি। আট মাসের গর্ভবতী ছিলেন কিনা। গর্ভের সন্তান ছাড়া দম্পতির তিনটি মেয়ে; বড়ো দুই মেয়ে কান্নাকাটি করছিল কিন্তু ছোটোটি বুঝতেই পারেনি কী ঘটেছে, খালি এঘর-ওঘর ছুটছিল।

ক্ষতিপূরণের টাকায় রক্তের গন্ধ লেগে আছে বলে মনে করা হয়। “কিছুতেই ওই টাকায় হাত দিতে পারি না। কিছুতে খরচ করতে গেলে মনে হয় আমার স্বামীর রক্ত চুষে খাচ্ছি,” বলেন অনুশিয়া আক্কা।

তামিলনাডুর কারুর জেলায় মৃত সাফাইকর্মী বালকৃষ্ণনের পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম, গভীর অবসাদে ভুগছেন তাঁর স্ত্রী। জানাচ্ছেন, কাজ করতে করতে হামেশাই চারপাশের হুঁশ হারিয়ে ফেলেন তিনি। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে সময় লাগে।

এই পরিবারগুলির জীবন একেবারে ছারখার হয়ে গেছে। আমাদের কাছে এগুলো খবর ছাড়া আর কিছুই না।

PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: ভিল্লুপুরমের মাড়মপাট্টু গ্রামে হাতে করে বর্জ্য সাফ করতে গিয়ে মৃত্যু হয় মারির। রেখে যান আট মাসের গর্ভবতী স্ত্রী অনুশিয়াকে

PHOTO • M. Palani Kumar

মারির দেহ ভিটেবাড়ি থেকে তাঁদের সম্প্রদায়ের মানুষের শেষকৃত্যের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। জায়গাটা অন্যান্য সম্প্রদায়ের সৎকার স্থল থেকে দূরে

১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে আভাদির ভীমা নগরের বাসিন্দা সাফাইকর্মী মোজেসের মৃত্যু হয়। এলাকায় একমাত্র তাঁরই টালির চালের বাড়ি। তাঁর দুই মেয়ে, দুজনেই পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছিল। তাঁর দেহ বাড়িতে আসার আগের দিন সেখানে গিয়েছিলাম আমি, দুই মেয়ের পরনে ছিল টিশার্ট – সেগুলোতে লেখা, ‘ড্যাড লাভস মি’ [বাবা আমায় ভালোবাসে], ‘ড্যাডস্‌ লিটিল প্রিন্সেস’ [বাবার ছোট্ট রাজকন্যা]। সমাপতন কিনা, বুঝতে পারিনি।

সারাদিন ধরে কেঁদেই চলেছিল ওরা, কারও কোনও সান্ত্বনাই থামাতে পারছিল না।

আমরা যতই এই ঘটনাগুলিকে নথিবদ্ধ করি, মূলধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা করি, আদতে ঝোঁকটা হল এটাকে আরও একটা খবর বলে এড়িয়ে যাওয়ার।

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

চেন্নাইয়ের কাছে আভাদি ভীমা নগরে অন্য আরেকটি শেষকৃত্য। প্রয়াত মোজেসের শোকস্তব্ধ পরিবার তাঁর মরদেহে ফুল দিচ্ছে। ডানদিকে: দেহের সামনে প্রার্থনারত পরিবার

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে:  আভাদি মোজেসের দেহ থেকে পচা গন্ধ বেরোতে শুরু করলে তড়িঘড়ি সবাই দেহ সরিয়ে নিয়ে যান। ডানদিকে: প্রয়াত আভাদি মোজেসের বাড়ি

এক সপ্তাহ আগে শ্রীপেরুম্বুদুরের কাঞ্জিপাট্টুর কাছে তিন নিকাশি কর্মী – নবীন কুমার (২৫), তিরুমালাই (২০) এবং রঙ্গনাথন (৫০) মারা যান। তিরুমালাইয়ের সদ্য বিয়ে হয়েছিল। রঙ্গনাথন দুই সন্তানের পিতা। যে শ্রমিকেরা মারা যান তাঁদের অনেকেই সদ্যবিবাহিত, তাঁদের বিধবা স্ত্রীদের অসহায়তা দেখলে বুক ভেঙে যায়। স্বামীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে আত্মীয়পরিজন মুথুলক্ষ্মীকে সাধভক্ষণ করান।

আমাদের দেশে হাতে করে বর্জ্য সাফাই বেআইনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ম্যানহোল মৃত্যুর সংখ্যা আমরা কমাতে পারছি না। এই সমস্যা নিয়ে ভবিষ্যতে কীভাবে এগোনো যায় তার কোনও ধারণা আমার নেই। আমার লেখা আর ছবিই এই ঘোরতর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার একমাত্র হাতিয়ার।

প্রতিটি মৃত্যু আমার বুকের উপর ভারী হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, ওঁদের শেষকৃত্যে চোখের জল ফেলার কি আমার কোনও অধিকার আছে? পেশাদারি শোক বলে তো কিছু হয় না। শোক মাত্রেই ব্যক্তিগত। কিন্তু এই মৃত্যুগুলো না ঘটলে আমি কোনওদিন চিত্রগ্রাহকও হতাম না। আরও একটা ম্যানহোল মৃত্যু ঠেকাতে হলে আমায় কী করতে হবে? আমাদের কী করতে হবে?

PHOTO • M. Palani Kumar

২ অগস্ট, ২০১৯ তারিখে চেন্নাইয়ের পুলিয়ানথোপ্পুতে হাতে করে বর্জ্য সাফাই করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যান মোজেস। নীল শাড়িতে তাঁর স্ত্রী মারি

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

রঙ্গনাথনের বাড়িতে শেষকৃত্যের উপচার হিসেবে চাল দান করছেন আত্মীয়রা। দিওয়ালির এক সপ্তাহ আগে তামিলনাডুর শ্রীপেরুম্বুদুরের কাছে কাঞ্জিপাট্টু গ্রামে একটি সেপটিক ট্যাংক সাফ করতে গিয়ে মারা যান রঙ্গনাথন ও নবীন কুমার। ডানদিকে: শ্রীপেরুম্বুদুরে সেপটিক ট্যাংক সাফ করতে গিয়ে তিনজনের মৃত্যুর পর শ্মশানে ব্যস্ততার শেষ ছিল না

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

২০২৪ সালের অক্টোবরে বেতন নিয়মিত করা এবং বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ দেখান চেন্নাই পুরনিগমের কর্মীরা। দীনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনা-জাতীয় জীবিকা মিশনের অধীনে চাকরি দেওয়া হয়েছে তাঁদের। এখানে দেখা যাচ্ছে, বামপন্থী লেফ্‌ট ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার বা এলটিইউসি সদস্যরা পাকা চাকরি আর বেতনবৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ডানদিকে: ৫, ৬ এবং ৭ নং জোনের শত শত সাফাইকর্মী কোভিড পরবর্তীকালে কঠিন বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তাঁদের পরে আটক করে পুলিশ

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

M. Palani Kumar

এম. পালানি কুমার পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার স্টাফ ফটোগ্রাফার। তিনি শ্রমজীবী নারী ও প্রান্তবাসী মানুষের জীবন নথিবদ্ধ করতে বিশেষ ভাবে আগ্রহী। পালানি কুমার ২০২১ সালে অ্যামপ্লিফাই অনুদান ও ২০২০ সালে সম্যক দৃষ্টি এবং ফটো সাউথ এশিয়া গ্রান্ট পেয়েছেন। ২০২২ সালে তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম দয়ানিতা সিং-পারি ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি পুরস্কার বিজেতা। এছাড়াও তামিলনাড়ুর স্বহস্তে বর্জ্য সাফাইকারীদের নিয়ে দিব্যা ভারতী পরিচালিত তথ্যচিত্র 'কাকুস'-এর (শৌচাগার) চিত্রগ্রহণ করেছেন পালানি।

Other stories by M. Palani Kumar
Editor : PARI Desk

আমাদের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রাণকেন্দ্র পারি ডেস্ক। দেশের নানান প্রান্তে কর্মরত লেখক, প্ৰতিবেদক, গবেষক, আলোকচিত্ৰী, ফিল্ম নিৰ্মাতা তথা তর্জমা কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে পারি ডেস্ক। টেক্সক্ট, ভিডিও, অডিও এবং গবেষণামূলক রিপোর্ট ইত্যাদির নির্মাণ তথা প্রকাশনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সামলায় পারি'র এই বিভাগ।

Other stories by PARI Desk
Translator : Dyuti Mukherjee

দ্যুতি মুখার্জী কলকাতা নিবাসী অনুবাদক এবং প্রকাশনা ক্ষেত্রে কর্মরত একজন পেশাদার কর্মী।

Other stories by Dyuti Mukherjee