দেখা করতে গেছি যখন, তাঁর বয়স ১০৪। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন, সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা হাতগুলোকে মহা বিরক্তিতে দূর দূর করে সরিয়ে দিলেন। হাতের লাঠিটায় ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন, কারও কাছ থেকে কিছুতেই কোনও সাহায্য নিলেন না। এই বয়সেও নিজের জোরেই হেঁটে এলেন, তারপর এক দণ্ড দাঁড়ালেন আর অবশেষে চেয়ারে বসলেন। সাহায্য নেবেন কি, বরং পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার চেপুয়া গ্রাম নিবাসী তাঁর একান্নবর্তী পরিবারের চার প্রজন্মের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান আবর্তিত হয়েছে এই কৃষক গৃহিণীকে ঘিরেই।
স্বাধীনতা সংগ্রামী ভবানী মাহাতো ২০২৪, ৩০ অগস্ট রাত একটা নাগাদ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৬ বছর। লাস্ট হিরোজ: ফুট সোলজারস অফ ইন্ডিয়ান ফ্রিডম (পেঙ্গুইন, নভেম্বর ২০২২) বইয়ে যে ১৬ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা লিখেছি, ভবানী মাহাতোর মৃত্যুর পর তাঁদের মধ্যে রইলেন আর মাত্র চারজন মুক্তিযোদ্ধা। পারি’র স্বাধীনতার সেপাই সংকলনে যে সকল অনন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাক্ষাৎকার আছে, এক অর্থে তাঁদের মধ্যেও ব্যতিক্রমী চরিত্র ভবানী মাহাতো। একমাত্র তিনিই আমাদের দীর্ঘ কথোপকথনের মধ্যে দেশের মুক্তির মহাসংগ্রামে বারংবার নিজের ভূমিকাকে অস্বীকার করে গেছেন। “ওইসব ব্যাপারস্যাপারের সঙ্গে আমার আবার কীসের যোগসাজশ?” তাঁর সপাট প্রশ্ন ছিল ২০২২-এর মার্চে আমাদের প্রথাম মোলাকাতের সময়ে। পড়ুন: পুরুলিয়ার ভবানী মাহাতোর শ্রমে পুষ্ট স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায়
স্মরণে রাখা দরকার ১৯৪০-এর দশকে যখন তিনি একা হাতে সব সামাল দিচ্ছিলেন, বাংলা জুড়ে তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সঙ্গে তিনি যে কেমন করে মোকাবিলা করছিলেন, তা ভাবতে বসলে কল্পনাও হার মানে
তা যোগসাজশ ছিল বইকি, গভীর যোগ ছিল। দেখতে গেলে দু’দশক আগে প্রয়াত তাঁর কৃতী স্বামী, স্বীকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী বৈদ্যনাথ মাহাতোর থেকেও খানিক বেশিই ছিল সংযোগ। মানবাজার ১ ব্লকে, ভবানী মাহাতোর ভিটেবাড়িতে পৌঁছে খোদ তাঁর মুখ থেকেই যখন শুনলাম যে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর কস্মিনকালেও কোনও যোগই ছিল না তখন আমি আর আমার সহকর্মী স্মিতা খাটোরের একেবারে আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা! কেন যে এমনটা বলেছিলেন সেটা ঠাহর করতে অনেক সময় লেগেছিল সেদিন।
আসলে এর জন্য দায়ী ১৯৮০ সালের স্বতন্ত্রতা সৈনিক সম্মান যোজনার শর্তানুযায়ী ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’র সংজ্ঞা। এ এমন সংকীর্ণ এক সংজ্ঞা যার থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে সামিল ভবানী মাহাতোর মতো নারী এবং তাঁদের প্রয়াসগুলি; এই আগমার্কা সংজ্ঞায় কারাবাসের উপর এতটাই গুরুত্ব আরোপিত হয়েছিল যে গা ঢাকা দেওয়া, আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবীদের একটা বিশাল অংশকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি। এতটাই অসংবেদনশীল এক সংজ্ঞা যা আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবীদের কাছ থেকে তাঁদেরই অপরাধী হওয়ার 'প্রমাণ' দাবী করে – অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের শিলমোহরে নির্ধারিত হবে কে ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী!
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে যখন নতুন করে আলোচনা করলাম, তখন তাঁর আত্মত্যাগের ব্যাপ্তি অনুধাবন করে চমকিত হলাম। বুঝতে পারলাম পুরুলিয়ার জঙ্গলে গা ঢাকা দেওয়া আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবীদের খাবারের জোগান দিয়ে করে কত বড়ো ঝুঁকি নিচ্ছিলেন ভবানী মাহাতো। ঘরের জনা পঁচিশেক সদস্যের জন্য রান্নাবান্নার পাশাপাশি অন্তত কুড়িজন গা ঢাকা দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীর মুখে দিনের পর দিন অন্ন তুলে দেওয়ার মতো শ্রমসাধ্য কাজ করে গেছেন তিনি। ফসল ফলানো, শস্য কাটা, বাড়ি অবধি তা বয়ে আনা আর অবশেষে সেই শস্য পরিবার-পরিজনের জন্য নিজের হাতে রাঁধা – এইসবটাই তো তিনিই করতেন একা হাতে। স্মরণে রাখা দরকার ১৯৪২-৪৩-এ যখন তিনি একা হাতে এতসব সামাল দিচ্ছিলেন, বাংলা জুড়ে করাল দুর্ভিক্ষের সময় ছিল সেটা। এমন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে চাষের কাজ সামলে এত মানুষকে রেঁধে খাওয়ানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবিসংবাদিত অবদানে পুষ্ট করেছেন তিনি ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামকে।
ভবানীদি, আপনার এইসব ভেলকি যে খুব মনে পড়বে আমাদের।
অনুবাদ: স্মিতা খাটোর