জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল – এ’বছরের বন্যার জল এখনও নামেনি। ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম উপনদী সুবনসিরি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে থাকেন রুপালি পেগু – প্রতি বছর বর্ষায় অসমের বিরাট অংশ জলে ডুবে যাওয়ার এক বড়ো কারণ এই নদী।

চারপাশে জল, কিন্তু ব্যবহারের উপযোগী জল পাওয়া দুষ্কর, জানালেন তিনি। অসমের লখিমপুর জেলায় তাঁর গ্রাম বরডুবি মালুওয়ালে পানীয় জল সংক্রমিত হয়ে গিয়েছে। “আমাদের গ্রাম, আশপাশের গ্রামের সব হ্যান্ডপাম্পগুলো ডুবে গেছে,” রুপালি বলছেন।

বড়ো রাস্তার পাশের নলকূপটা থেকে জল আনতে হলে ডিঙি চড়ে যেতে হয় তাঁকে। তিনখানা পেল্লায় সাইজের স্টিলের পাত্র নিয়ে ডিঙি বেয়ে ওদিকে চলেছেন তিনি, রাস্তাখানাও আংশিক জলমগ্ন। আখাম্বা বাঁশের লগি ঠেলে ঠেলে বানভাসি গ্রামের ভিতর দিয়ে সাবধানে পথ চলেন তিনি। “মণি, চলে আয়!” প্রতিবেশিনীকে হাঁক পাড়েন তিনি। প্রায়শই একসঙ্গে এইধরনের কাজে বেরোন দুই বন্ধু, পরস্পরকে জল ভরতে সাহায্য করেন।

PHOTO • Ashwini Kumar Shukla
PHOTO • Ashwini Kumar Shukla

বাঁদিকে: অসমের লখিমপুর জেলার বাসিন্দা রুপালি, যেখানে ফি’বছর বন্যায় হাজারো সমস্যা দেখা দেয়। ডানদিকে: গ্রামের বাকিদের মতোই রুপালি থাকেন চাং ঘরে – মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচু করা বাঁশের ঘর, বন্যার জল যাতে ঘরে না ঢোকে সেইটা মাথায় রেখে বানানো

PHOTO • Ashwini Kumar Shukla
PHOTO • Ashwini Kumar Shukla

বাঁদিকে: ব্রহ্মপুত্রের উপনদী সুবনসিরির খুব কাছে অবস্থিত রুপালির গ্রাম। বন্যায় গ্রাম ডুবে গেলে ডিঙি বেয়ে যাতায়াত করেন তিনি। ডানদিকে: নলকূপের পথে রুপালি, পরিষ্কার জলের সন্ধানে

কয়েক মিনিট নাগাড়ে পাম্প করার পর অবশেষে নলকূপ থেকে পরিষ্কার জল বেরোতে শুরু করে। “তিন দিন হল বৃষ্টি হয়নি, তাই আজকে জল পাওয়া গেল,” স্বস্তিতে মৃদু হাসেন রুপালি। জল আনা মেয়েদের কাজ বলে ধরা হয়, আর তাই নদীতে জল বাড়লে সেই বিপদের বোঝাও মেয়েদের ঘাড়েই এসে পড়ে।

নলকূপ থেকে যখন জল পাওয়া যায় না, তখন? বাড়ি ঘিরে থাকা কাদাজলের ঘূর্ণি দেখিয়ে ৩৬ বছরের রুপালি জানান, “তখন এই জলই ফুটিয়ে খাই।”

এই অঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়ির মতো রুপালির বাড়িটিও বন্যা মোকাবিলার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। এই ধরনের বাড়িকে এখানে বলা হয় চাং ঘর – বাঁশের খুঁটির উপরে মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে বাঁধা হয় বন্যার জল থেকে বাঁচতে। রুপালির হাঁসগুলি তাঁর দাওয়ায় ঠাঁই নিয়েছে, চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা যায় তাদের প্যাঁকপ্যাঁকানি।

শৌচ করতে গেলেও এখন রুপালির ভরসা তাঁর ডিঙিখানা। বাড়িতে শৌচঘর ছিল বটে, কিন্তু সেটা এখন জলের তলায়। “অনেক দূর যেতে হয়, নদীর দিকে,” জানালেন তিনি। রাতের অন্ধকারে এই কাজটি সেরে আসেন তিনি।

PHOTO • Ashwini Kumar Shukla
PHOTO • Ashwini Kumar Shukla

বাঁদিকে ও ডানদিকে: চারপাশে জল, কিন্তু ব্যবহারের উপযোগী জল পাওয়া দুষ্কর

দৈনন্দিন জীবন শুধু নয়, ব্যাহত হয়েছে এখানকার মূলত মিসিং জনজাতির অধিবাসীদের রুজিরোজগারও। “আমাদের ১২ বিঘা জমি ছিল, ধান ফলাতাম। কিন্তু এ’বছর সব ফসল ডুবে গেছে, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে,” জানালেন রুপালি। তাঁর জমির একাংশ আগেই নদীগর্ভে চলে গিয়েছে। “এ’বছর নদীতে কতটা জমি গেল সেটা বানের জল নামলে তবেই বোঝা যাবে,” বলছেন তিনি।

মিসিং জনজাতির (রাজ্যে তফসিলি জনজাতি হিসেবে নথিভুক্ত) চিরাচরিত পেশা চাষবাস। চাষের উপায় না থাকায় অনেকেই এখন কাজের খোঁজে দেশান্তরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ২০২০ সালের এই সমীক্ষাটি বলছে, লখিমপুর থেকে দেশান্তরে যাওয়ার হার ২৯ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের তিন গুণেরও বেশি। রুপালির স্বামী মানুস হায়দরাবাদে গেছেন দারোয়ানের কাজ নিয়ে, সংসার এবং দুই ছেলেমেয়ের দায়িত্ব পুরোটাই এখন রুপালির কাঁধে। মাসে ১৫,০০০ টাকা রোজগার করেন মানুস, বাড়িতে ৮,০০০-১০,০০০ টাকা পাঠান।

বছরে ছয় মাস বাড়ির নিচে জল খেলে, আর কাজকর্ম জোটানো দুষ্কর হয়ে পড়ে, জানাচ্ছেন রুপালি। “গত বছর সরকার থেকে কিছু সাহায্য এসেছিল – পলিথিন শিট, রেশন। এ’বছর কিচ্ছু আসেনি। টাকা থাকলে এখান থেকে চলেই যেতাম,” বিষণ্ণ গলায় যোগ করেন তিনি।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Ashwini Kumar Shukla

অশ্বিনী কুমার শুক্লা ঝাড়খণ্ড নিবাসী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ২০২৩ সালের পারি-এম এমএফ ফেলোশিপ প্রাপক অশ্বিনী নয়াদিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাস কমিউনিকেশন থেকে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক হয়েছেন।

Other stories by Ashwini Kumar Shukla
Translator : Dyuti Mukherjee

দ্যুতি মুখার্জী কলকাতা নিবাসী অনুবাদক এবং প্রকাশনা ক্ষেত্রে কর্মরত একজন পেশাদার কর্মী।

Other stories by Dyuti Mukherjee