ছেলেটি বিরাট কোহলির বিরাট ভক্ত। মেয়েটি আবার পাগল বাবর আজমের জন্য। কোহলি শতরান করলে ছেলেটি বুক বাজিয়ে বলত, বাবর ভালো খেললে ঠাট্টা করত মেয়েটি। আয়েশা আর নুরুল হাসানের ভালোবাসার ভাষাই ছিল ক্রিকেট, আর সে ভাষা এতই মধুর যে তাঁদের দেখলে বোঝাই যেত না যে তাঁদের বিয়ে হয়েছে সম্বন্ধ করে, প্রেম করে নয়।

২০২৩ সালের জুন মাসে ক্রিকেট বিশ্বকাপের নির্ঘণ্ট বেরোতেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন আয়েশা। গুজরাটের আমেদাবাদে ১৪ অক্টোবর মুখোমুখি হবে ভারত আর পাকিস্তান। “আমি নুরুলকে বললাম, এবার তো স্টেডিয়ামে বসেই দেখতে হবে,” বলছেন ৩০ বছরের আয়েশা, তাঁর মায়ের জন্মস্থান পশ্চিম মহারাষ্ট্রের রাজাচে কুরলে গ্রামে বসে। “ভারত-পাকিস্তানের তো আর ম্যাচই হয় না। আমাদের দু’জনের প্রিয় খেলোয়াড়দের সামনে থেকে দেখার একটা বিরল সুযোগ ছিল।”

৩০ বছর বয়সি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নুরুল একে-তাকে ফোন করে দুটো টিকিটও জোগাড় করে ফেলেছিলেন, দম্পতির খুশির সীমা ছিল না। আয়েশা তখন ছয় মাসের গর্ভবতী, তাই সাতারা জেলার পুসেসাবলি গ্রামের বাসা থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত ৭৫০ কিলোমিটারের যাত্রাপথ খুব ভেবেচিন্তে ছকে ফেলেছিলেন তাঁরা। ট্রেনের টিকিট, থাকার জায়গা, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছিল। অবশেষে সেদিন এল, কিন্তু তাঁদের আর যাওয়া হয়নি।

১৪ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে সূর্য উঠল যখন, নুরুলের মৃত্যুর এক মাস পেরিয়ে গেছে। আয়েশা শোকে পাথর।

*****

১৮ অগস্ট ২০২৩ তারিখে মহারাষ্ট্রের সাতারা শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুসেসাবলি গ্রামে একটি স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, ইনস্টাগ্রামের একটি কমেন্ট বক্সে গ্রামের এক মুসলিম তরুণ ২৫ বছরের আদিল বাগওয়ান হিন্দু দেবদেবীদের অপমান করছেন। আজ পর্যন্ত আদিল বলে যাচ্ছেন যে ওই স্ক্রিনশটটি জাল, ইনস্টাগ্রামে তাঁর যে বন্ধুরা আছেন তাঁরা পর্যন্ত ওই কমেন্টটি দেখতে পাননি।

কিন্তু এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা যাতে বজায় থাকে সেই মর্মে পুসেসাবলির মুসলিম সম্প্রদায়ের বয়স্করা নিজেরাই আদিলকে নিয়ে থানায় যান এবং পুলিশকে অনুরোধ করেন ওই স্ক্রিনশটটির তদন্ত করতে। “আমরা এটাও বলেছিলাম যে আদিল যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তবে ওর শাস্তি হোক, আমরা ওর নিন্দা করব,” বলছেন ৪৭ বছরের সিরাজ বাগওয়ান, পুসেসাবলিতে একটি গ্যারেজ চালান তিনি। “পুলিশ আদিলের ফোন বাজেয়াপ্ত করে নেয়, আর ওর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির অভিযোগ আনে।”

'We also said that if Adil is found guilty, he should be punished and we will condemn it,' says Siraj Bagwan, 47, who runs a garage in Pusesavali village
PHOTO • Parth M.N.

‘আমরা এটাও বলেছিলাম যে আদিল যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তবে ওর শাস্তি হোক, আমরা ওর নিন্দা করব,’ বলছেন ৪৭ বছরের সিরাজ বাগওয়ান, পুসেসাবলিতে একটি গ্যারেজ চালান তিনি

তাতে চিড়ে ভেজেনি। সাতারার উগ্র হিন্দুত্ববাদী নানা দলের সদস্যরা পরেরদিন পুসেসাবলিতে মিছিল করে মুসলিমদের উপর খোলাখুলি আক্রমণের ডাক দেয়। আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার হুমকিও দিয়ে যায় তারা।

সিরাজ এবং গ্রামের বরিষ্ঠ মুসলমান বাসিন্দাদের যাঁরা দ্রুত স্থানীয় থানায় গিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা পুলিশের কাছে এটাও অনুরোধ করেন যে পুসেসাবলির অন্যান্য মুসলিম বাসিন্দা যাঁরা এই ঘটনার সঙ্গে কোনওভাবেই জড়িত নন, তাঁদের যেন নিরাপত্তা দেয় পুলিশ। “আমরা পুলিশকে বলেছিলাম যে দাঙ্গা বাঁধার জোর সম্ভাবনা আছে,” মনে করছেন সিরাজ। “একটু নিরাপত্তার জন্য ভিক্ষা করেছিলাম আমরা।”

কিন্তু পুসেসাবলি যে থানার অধীনে পড়ে সেই আউন্ধ থানার সহকারী ইনস্পেক্টর গঙ্গাপ্রসাদ কেন্দ্রে উলটে তাঁদের নিয়েই তামাশা করতে শুরু করেন, বলছেন সিরাজ। “উনি আমাদের জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, আমরা নবী মহম্মদকে অনুসরণ করি কেন, উনি তো সাধারণ একটা মানুষ ছিলেন,” মনে করছেন সিরাজ। “আমি ভাবতেই পারিনি উর্দিধারী কেউ এইধরনের কথা বলতে পারে।”

পরের দুই সপ্তাহ ধরে হিন্দু একতা আর শিবপ্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান নামে দুই উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলের লোকজন হঠাৎ হঠাৎ পুসেসাবলির পথেঘাটে মুসলিম ছেলেদের দাঁড় করিয়ে তাদের দিয়ে জোর করে ‘জয় শ্রী রাম’ বলাতে থাকে, না বললে ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। গোটা গ্রাম থমথম করছিল, ঝড়ের আগের স্তব্ধতা যেন।

৮ সেপ্টেম্বর একই রকমের আরও দুটো স্ক্রিনশট ভাইরাল হয় মুজাম্মিল বাগওয়ান এবং আলতামাশ বাগওয়ানের নামে। দুজনেরই বয়স ২৩, দুজনেই পুসেসাবলির বাসিন্দা, এবং ঠিক আদিলের মতোই একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টের কমেন্টে দুজনকে হিন্দু দেবদেবীদের অপমান করতে দেখা যায়। আদিলের মতোই এই দুই তরুণ দাবি করেন যে স্ক্রিনশটগুলি ফোটোশপে বানানো। যে পোস্টের তলায় এই কমেন্ট দেখা যায় সেই পোস্টটি হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মুসলিম পুরুষের হিংসাত্মক কথাবার্তার একটি সংকলন।

অভিযোগ, এই কনটেনটগুলি বানিয়েছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলের লোকজন।

পাঁচ মাস হয়ে গেছে, সংশ্লিষ্ট তিনটি স্ক্রিনশটের সত্যতা এখনও যাচাই করে চলেছে পুলিশ।

কিন্তু যে মতলবে এসব ঘটানো সেই ক্ষতি হয়েই গেছে – সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় টানটান গ্রামে বিস্ফোরণ হয়ে আসে দ্বিতীয় ঘটনাটি, শুরু হয়ে যায় হানাহানি। ৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় মুসলিমরা আবারও পুলিশের কাছে আগাম হস্তক্ষেপের মিনতি করেছিলেন, তাতে লাভ হয়নি।

১০ সেপ্টেম্বর সূর্যাস্তের কিছু পরে গ্রামে চড়াও হয় শতাধিক বিক্ষুব্ধ উগ্র দক্ষিণপন্থী হিন্দুর দল, মুসলিম দোকান, বাড়ি, গাড়িতে ভাংচুর এবং আগুন লাগানো চলতে থাকে। গ্রামের মুসলিমদের হিসাব অনুযায়ী ২৯টি পরিবারকে নিশানা করা হয়েছিল, এবং সব মিলিয়ে ৩০ লক্ষ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে তিল তিল করে গড়ে তোলা সারা জীবনের সঞ্চয়।

Vehicles parked across the mosque on that fateful day in September were burnt. They continue to remain there
PHOTO • Parth M.N.

পুসেসাবলির মসজিদের উল্টোদিকে সেই সেপ্টেম্বর থেকে রাখা আছে পোড়া গাড়িগুলি

৪৩ বছরের আশফাক বাগওয়ান গ্রামে একটি ই-সেবা কেন্দ্র চালান – সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে আদালত-বিষয়ক সমস্ত প্রয়োজনের জন্য একটি কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা এটি। ফোন বার করে প্রতিবেদককে ছবি দেখালেন একটা; এক শীর্ণকায় বৃদ্ধ মাটিতে বসে, মাথাভর্তি রক্ত। “আমাদের জানলায় যখন পাথর ছুড়েছিল, কাচ ভেঙে বাবার মাথায় এসে লাগে,” মনে করেন তিনি। “ঠিক যেন দুঃস্বপ্ন। এত গভীরভাবে কেটে গেছিল যে বাড়িতে চিকিৎসা করা যায়নি।”

কিন্তু উন্মত্ত মারমুখী জনতার সামনে বাড়ির বাইরে বেরনোর সাহসও করেননি আশফাক। যদি করতেন, তবে তাঁর পরিণতিও হয়তো আমাদের সদ্যবিবাহিত ক্রিকেটপ্রেমী নুরুল হাসানের মতোই হত।

*****

সেদিন সন্ধ্যায় নুরুল যখন কাজ সেরে বাড়ি ফেরেন, পুসেসাবলিতে তখনও আগুন জ্বলেনি। কোন দঙ্গল তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না তাঁর, তাই নুরুল স্থির হাত-মুখ ধুয়ে গ্রামের মসজিদে যাবেন নামাজ পড়তে। “আমি বলেছিলাম বাড়িতেই করে নিতে, কারণ অতিথি এসেছিলেন কয়েকজন,” মনে পড়ে আয়েশার। “কিন্তু ও বলল তাড়াতাড়ি চলে আসবে, বলে বেরিয়ে গেল।”

ঘণ্টাখানেক পর মসজিদ থেকে ফোন করে নুরুল বলেন কোনও অবস্থাতেই যেন বাড়ি থেকে না বেরোন আয়েশা। নুরুলের জন্য চিন্তায় অস্থির আয়েশা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, নুরুল মসজিদে আছেন শুনে। “আমি সত্যিই ভাবিনি ওরা উপাসনাগৃহেও ঢুকে যাবে,” স্বীকার করলেন তিনি। “এতটা বাড়াবাড়ি হবে ভাবতেও পারিনি। ভেবেছিলাম মসজিদের ভিতরে নিরাপদ থাকবে ও।”

ভুল ভেবেছিলেন আয়েশা।

মুসলিমদের ঘরদোর ভাংচুর-জ্বালানোর পর দঙ্গলটা গিয়ে ঢোকে মসজিদে, যেখানে ভিতর থেকে তালা দেওয়া ছিল। বাইরে দাঁড়ানো কিছু গাড়িতে আগুন লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কয়েকজন, বাকিরা মসজিদের দরজা ভাঙার চেষ্টা করতে থাকে। প্রতি ঘায়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে আলগা হতে থাকে ছিটকিনি। একসময়ে ভেঙে যায় ছিটকিনি, হাট করে খুলে যায় কপাট।

লাঠি, ইট, আর মেঝের টালি দিয়ে ভিতরে কয়েক মুহূর্ত আগে অবধি শান্তিতে নামাজ পড়া মুসলিমদের উপর ভয়াবহ আক্রমণ শুরু করে উন্মত্ত জনতা। একজন একটা টালি তুলে নুরুলের মাথায় ভাঙে, তারপর পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তাঁকে। গুরুতর আহত হন আরও ১১ জন। “ওর শবদেহ না দেখা অবধি আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি,” বলছেন আয়েশা।

The mosque in Pusesavali where Nurul Hasan was lynched
PHOTO • Parth M.N.

পুসেসাবলির সেই মসজিদ যেখানে নুরুল হাসানকে পিটিয়ে মারা হয়

“নুরুলের হত্যায় জড়িত অভিযুক্তদের আমি চিনি। নুরুলকে ভাই বলে ডাকত ওরা। ওকে পিটিয়ে মারার সময় সে কথা ওদের মনে পড়েনি কেন কে জানে,” বলছেন শোকস্তব্ধ স্ত্রী।

ঠিক এইধরনের হামলার আশঙ্কাতেই দিনের পর দিন পুলিশের কাছে গিয়ে নিরাপত্তার আবেদন করে গেছেন পুসেসাবলির মুসলিমরা। এমন যে হতে চলেছে সেটা তাঁরা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে শুধু পারেনি সাতারা থানার পুলিশ।

*****

মসজিদের উপর সেই ভয়াবহ হামলার পাঁচ মাস হয়ে গেছে, কিন্তু পুসেসাবলি এখনও দ্বিখণ্ডিত। হিন্দু আর মুসলিমরা মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছেন শুধু নয়, একে অপরকে আজকাল সন্দেহের চোখে দেখেন। যে মানুষগুলি এককালে একে অপরের বাড়িতে খানাপিনা করতেন, আজকাল শীতল, কাজ চালানো কথাবার্তাটুকু বলেন শুধু। গ্রামের যে তিন তরুণের বিরুদ্ধে হিন্দু দেবদেবীর অপমানের অভিযোগ উঠেছিল তাঁরা প্রাণের ভয়ে গ্রাম ছেড়েছেন; এখন আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে থাকেন।

“ভারতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে ধরাই নিয়ম,” বলছেন ২৩ বছরের মুজাম্মিল বাগওয়ান – যিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন তাঁর অবস্থান প্রকাশ না করার শর্তে। “কিন্তু আপনি যদি মুসলিম হন, তবে নির্দোষ প্রমাণ না হওয়া অবধি আপনি দোষী।”

১০ সেপ্টেম্বর রাতে পারিবারিক একটা নিমন্ত্রণ থেকে পুসেসাবলি ফিরছিলেন মুজাম্মিল; গ্রাম থেকে ৩০ কিলোমিটার মতো দূরে খাওয়ার জন্য থেমেছিলেন। খাবার আসার অপেক্ষা করতে করতে ফোনে ওয়াটস্‌অ্যাপ খুলেছিলেন, দেখলেন তাঁর যোগাযোগের তালিকায় থাকা কিছু হিন্দু বন্ধু স্টেটাস বদলেছেন।

স্টেটাস দেখার জন্য ক্লিক করেই হাড় হিম হয়ে যায় মুজাম্মিলের; গা গুলিয়ে ওঠে। তাঁদের প্রত্যেকে ওই স্ক্রিনশটটি আপলোড করেছে, তাঁর নামে ওই অপমানজনক মন্তব্য এবং তাঁর নিন্দা-সহ। “এমন কিছু একটা পোস্ট করে যেচে পড়ে ঝামেলা করতে যাব কেন আমি?” সওয়াল তুলছেন মুজাম্মিল। “ওটা একটা ফোটোশপ করা ছবি, ওটার একমাত্র উদ্দেশ্য হিংসা ছড়ানো।”

মুজাম্মিল সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানায় গিয়ে নিজের ফোনটি জমা করে দেন। “আমি ওঁদের অনুরোধ করি ফোনটা ভালো করে যাচাই করতে,” যোগ করলেন তিনি।

পুলিশ এখনও ওই কমেন্টগুলির সত্যতা যাচাই করে উঠতে পারেনি, কারণ তারা এখনও ইনস্টাগ্রামের মালিক সংস্থা মেটা-র উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সাতারা পুলিশ বলছে, প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সংস্থাকে পাঠানো হয়েছে এবং এখন সংস্থার দায়িত্ব নিজেদের সার্ভার যাচাই করে পুলিশকে জবাব পাঠানো।

“মেটা যে উত্তর দিতে এত দেরি করছে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই,” বলছেন ওসামা মানজার, ডিজিটাল এমপাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। “ওদের কাছে এই ঘটনার কোনও গুরুত্ব নেই, আর পুলিশেরও তাড়া নেই তদন্ত শেষ করার। তদন্তের প্রক্রিয়াটাই আসলে শাস্তি।”

মুজাম্মিল বলছেন, যতদিন না নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন, গ্রামে ফিরবেন না তিনি। বর্তমানে পশ্চিম মহারাষ্ট্রে ২,৫০০ টাকা দিয়ে একটি ঘরভাড়া করে আছেন। প্রতি দুই সপ্তাহে একবার বাবা-মার সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু কথাবার্তা বিশেষ হয় না। “যখনই দেখা হয়, বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়েন,” বলছেন মুজাম্মিল। “ওঁদের সামনে আমায় শক্ত থাকতে হয়।”

'In India, you are supposed to be innocent until proven guilty,' says Muzammil Bagwan, 23, at an undisclosed location. Bagwan, who is from Pusesavali, was accused of abusing Hindu gods under an Instagram post
PHOTO • Parth M.N.

‘ভারতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে ধরাই নিয়ম’, বলছেন ২৩ বছরের মুজাম্মিল বাগওয়ান, যিনি তাঁর বর্তমান অবস্থান প্রকাশে অনিচ্ছুক। পুসেসাবলির বাসিন্দা বাগওয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টের তলায় হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করেছেন

মুজাম্মিল এখন একটা মুদির দোকানে চাকরি করেন, ৮,০০০ টাকা মাইনে পান, তাতে ভাড়া আর বাকি খরচা চলে যায়। পুসেসাবলিতে তাঁর নিজের রমরমা আইসক্রিম পার্লারের ব্যবসা ছিল। “ভাড়ার দোকান ছিল,” জানালেন মুজাম্মিল। “মালিক হিন্দু। ঘটনার পর আমায় তাড়িয়ে দেয়, বলে নির্দোষ প্রমাণ না হওয়া অবধি ফেরত পাব না। বাবা-মা তাই এখন সংসার চালাতে সবজি বিক্রি করছেন। কিন্তু গ্রামের হিন্দুরা ওঁদের কাছ থেকে কেনে না।”

এই তীব্র মেরুকরণের আবহ থেকে বাদ যায়নি শিশুরাও।

এক বিকেলে মনমরা হয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে আশফাক বাগওয়ানের ৯ বছরের ছেলে উজের; অন্য বাচ্চারা তার সঙ্গে খেলতে চাইছে না। “ওর ক্লাসের হিন্দু ছেলেরা ওকে আর খেলতে নিচ্ছে না কারণ ও তো লান্ডেয়া’, মানে মুসলিমদের খতনা-সম্পর্কিত গালাগালি,” জানালেন আশফাক। আরও জানালেন। মুসলিমদের অপমান করতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গালি এটা। “বাচ্চাদের দোষ দিই না। বাড়িতে যা শোনে তাই বলে ওরা। কষ্টটা লাগে কোনখানে জানেন, আমাদের গ্রামে এরকম পরিবেশ কখনও ছিল না।”

তিন বছর অন্তর অন্তর পুসেসাবলিতে পরায়ণা অনুষ্ঠান হয়, যেখানে টানা আট দিন ধরে হিন্দুদের শাস্ত্রপাঠ চলে। শেষবার এই অনুষ্ঠান হয়েছিল ৮ অগস্ট – গ্রামে হানাহানি শুরু হওয়ার এক মাস আগে। অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের প্রথম ভোজটির খরচ দিয়েছিলেন গ্রামের মুসলিমরা। ১২০০ হিন্দুর জন্য ১৫০ লিটার শির খুরমা (সিমাইয়ের তৈরি মিষ্টি) বানানো হয়েছিল।

“৮০ হাজার টাকা খরচ করেছিলাম আমরা ওই দাওয়াতে,” জানালেন সিরাজ। “গোটা সম্প্রদায়ের সবাই চাঁদা দিয়েছিল, কারণ এটাই আমাদের সংস্কৃতি। ওই টাকা দিয়ে যদি মসজিদের জন্য একটা লোহার গেট বানাতাম তবে আজ আমাদের একটা মানুষ বেঁচে থাকত।”

*****

এই তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনস্পেক্টর মি. ডেবকরের বক্তব্য, ১০ সেপ্টেম্বরের হিংসার জন্য ৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে, ৩৪ জন ফেরার, আর ৫৯ জন ইতিমধ্যেই জামিন পেয়ে গেছে।

“মূল অভিযুক্ত রাহুল কদম আর নীতিন বীর,” জানালেন তিনি। “দুজনেই হিন্দু একতার সদস্য।”

পশ্চিম মহারাষ্ট্রে সক্রিয় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু একতার শীর্ষ নেতা হলেন বিক্রম পাওয়াসকর, যিনি কিনা মহারাষ্ট্র রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতিও বটে। তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ছবি আছে, এবং মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

বর্ষীয়ান হিন্দু নেতা বিনায়ক পাওয়াসকরের পুত্র বিক্রমের উস্কানিমূলক ভাষণ দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িক বৈরিতা ছড়ানোর ইতিহাস আছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে সাতারায় একটি “বেআইনিভাবে তৈরি হওয়া মসজিদ” ভাঙার দাবিতে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

Saffron flags in the village
PHOTO • Parth M.N.

গ্রামে উড়ছে গেরুয়া পতাকা

২০২৩ সালের জুন মাসে ইসলামপুরের একটি সভায় পাওয়াসকর ঘোষণা করেন ‘লাভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য “হিন্দুদের একজোট হতে হবে”। এই ‘লাভ জিহাদ’ হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের ছড়ানো একটি এখনও ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করে নিচ্ছে যাতে বিয়ের পরে তাদের ধর্মান্তরিত করা যায়, এবং তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল এইভাবে দেশের মুসলিম জনসংখ্যা বাড়িয়ে বাড়িয়ে একসময় গোটা ভারতের উপর রাজত্ব কায়েম করা। “আমাদের মেয়ে-বোনদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, শিকার করছে ‘লাভ জিহাদ’-এর জন্য,” বলেন তিনি। “জিহাদিরা হিন্দুধর্মের নারী ও সম্পদ ধ্বংস করতে চায়। ওদের উচিত জবাব দিতে হবে।” মুসলিমদের অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করার ডাকও দেন তিনি, এবং ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করার দাবি তোলেন।

পুসেসাবলির হিংসার এক প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, গ্রামে ওই হামলার মাত্র কয়েকদিন আগে এক অভিযুক্তের বাড়িতে একটি বৈঠক করেন পাওয়াসকর। গ্রামে যারা হামলা করেছিল তার মধ্যে অচেনা বহিরাগত ছিল শতাধিক। কিন্তু তাদের মধ্যে ২৭ জন ওই গ্রামেরই বাসিন্দা, এবং তারা কয়েকজন সেদিন পাওয়াসকরের ডাকা বৈঠকে উপস্থিত ছিল, ওই প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশকে জানিয়েছেন। মসজিদে যখন দঙ্গলটা ঢোকে কাউকে একটা বলতে শোনা গেছিল, “একটা লান্ডেয়া - কেও বাঁচিয়ে রাখবে না। বিক্রম পাওয়াসকর আমাদের সঙ্গে আছেন। কেউ দয়ামায়া দেখাবে না।”

তা সত্ত্বেও কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। সাতারার পুলিশ সুপার সমীর শেখ এই বিষয় নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে সম্মত হননি। “প্রয়োজনীয় তথ্য সবই প্রকাশ্যে আছে,” বলে তদন্তের অগ্রগতি এবং পাওয়াসকরের ভূমিকা নিয়ে সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন তিনি।

জানুয়ারি ২০২৪-এর শেষ সপ্তাহে বম্বে হাইকোর্ট সাতারা পুলিশকে ধমকও দিয়েছে পাওয়াসকরের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য।

*****

সাতারা পুলিশের হাবভাব দেখে আয়েশার মনে সন্দেহ জাগছে, আদৌ তিনি কোনওদিন ন্যায় পাবেন কিনা, নুরুলের হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে কিনা, মূল ষড়যন্ত্রকারী ধরা পড়বে কিনা। নিজে আইনজীবী আয়েশা, বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

“বেশিরভাগ অভিযুক্তই জামিন পেয়ে গেছে, গ্রামে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে,” বলছেন তিনি। “নিষ্ঠুর একটা ঠাট্টা হচ্ছে যেন।”

আপাতত রাজাচে কুরলে গ্রামে বাবা-মায়ের কাছেই বেশিরভাগ সময় থাকছেন তিনি; পুসেসাবলিতে অসুরক্ষিত বোধ করছেন, আর নুরুলের জন্য কষ্টও হচ্ছে বেশি। “দুই গ্রামের মাত্র চার কিলোমিটারই দূরত্ব, তাই যাওয়া-আসা করতে পারি,” বলছেন আয়েশা। “কিন্তু এখন আমার প্রধান লক্ষ্য হল স্বাভাবিক জীবনে ফেরা।”

Ayesha Hasan, Nurul's wife, in Rajache Kurle village at her parents’ home
PHOTO • Parth M.N.

রাজাচে কুরলে গ্রামে বাবা-মায়ের বাড়িতে নুরুলের স্ত্রী আয়েশা হাসান

ওকালতির কাজ আবার শুরু করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু আপাতত সেটা স্থগিত আছে। গ্রামে এই পেশায় উন্নতির সুযোগ নেই। “সাতারা বা পুণে চলে যেতে পারলে অন্য কথা,” বলছেন তিনি। “কিন্তু বাবা-মার থেকে দূরে যেতে চাই না। ওঁদের নানা অসুখ-বিসুখ আছে, দেখাশোনা করার জন্য আমায় কাছাকাছি থাকতে হবে।”

আয়েশার মা ৫০ বছরের শমার রক্তে উচ্চ শর্করার সমস্যা আছে। তাঁর ৭০ বছরের বাবা হানিফ ২০২৩-এর ডিসেম্বরে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন; মেয়ের পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তাই ছিল কারণ। “আমার ভাইবোন নেই,” বলছেন আয়েশা। “বাবার মনে হত নুরুল তাঁর ছেলের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। নুরুলের মৃত্যুর পর থেকে বাবা স্বাভাবিক হতে পারেননি।”

এখনকার মতো বাবা-মার কাছে থেকে দেখাশোনা করার সিদ্ধান্ত নিলেও আয়েশার অনেক কাজ বাকি। এমন একটা কিছু যা তাঁর জীবনকে নতুন অর্থ দেবে: প্রয়াত স্বামীর স্বপ্নপূরণ করতে চান তিনি।

এই ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস আগে নুরুল আর আয়েশা নিজেদের একটা নির্মাণ সংস্থা খুলেছিলেন – নাম দিয়েছিলেন আশনুর প্রাইভেট লিমিটেড। নুরুলের কাজ ছিল প্রকল্প আনার, তাঁর কাজ ছিল আইনি দিকগুলো দেখা।

নুরুল আর নেই, কিন্তু সংস্থাটা বন্ধ করে দিতে চান না আয়েশা। “আমি বাড়ি বানানোর বিষয়ে খুব একটা কিছু জানি না,” বলছেন তিনি। “কিন্তু শিখে নেব, সংস্থাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। এখন টাকার টানাটানি চলছে, কিন্তু ঠিক টাকা জোগাড় করব, সংস্থাটাকে দাঁড় করাব।”

দ্বিতীয় স্বপ্নটা তুলনায় কম দুরূহ।

নুরুল খুব চেয়েছিলেন, তাঁর সন্তান ক্রিকেট খেলতে শিখবে। যে-সে অ্যাকাডেমি থেকে নয়, যেখানে বিরাট কোহলি শিখেছেন সেই অ্যাকাডেমিতেই। আয়েশার এখন লক্ষ্য হল নুরুলের এই স্বপ্নটাকে বাস্তব করা। “আমি করেই ছাড়ব,” দৃঢ়স্বরে বলেন তিনি।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Parth M.N.

২০১৭ সালের পারি ফেলো পার্থ এম. এন. বর্তমানে স্বতন্ত্র সাংবাদিক হিসেবে ভারতের বিভিন্ন অনলাইন সংবাদ পোর্টালের জন্য প্রতিবেদন লেখেন। ক্রিকেট এবং ভ্রমণ - এই দুটো তাঁর খুব পছন্দের বিষয়।

Other stories by Parth M.N.
Editor : Vishaka George

বিশাখা জর্জ পারি’র বরিষ্ঠ সম্পাদক। জীবিকা এবং পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করেন। পারি’র সোশ্যাল মিডিয়া কার্যকলাপ সামলানোর পাশাপাশি বিশাখা পারি-র প্রতিবেদনগুলি শ্রেণিকক্ষে পৌঁছানো এবং শিক্ষার্থীদের নিজেদের চারপাশের নানা সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষা বিভাগে কাজ করেন।

Other stories by বিশাখা জর্জ
Translator : Dyuti Mukherjee

দ্যুতি মুখার্জী কলকাতা নিবাসী অনুবাদক এবং প্রকাশনা ক্ষেত্রে কর্মরত একজন পেশাদার কর্মী।

Other stories by Dyuti Mukherjee