“পাখাওয়ালা [উইন্ডমিল বা হাওয়াকল], ব্লেডওয়ালারা [সৌরশক্তিকেন্দ্র] আমাদের ওরণগুলো কব্জা করে নিচ্ছে,” জানালেন সানওয়াটা গ্রামের সুমের সিং ভাটি। জয়সলমীর জেলার দেগ্রাই ওরণ লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা এই চাষি তথা পশুপালক।
ওরণের অর্থ পবিত্র কুঞ্জবন। এগুলি বারোয়ারি সম্পদ বলেই বিবেচিত, যার উপর সব্বার অধিকার আছে। প্রতিটি ওরণেরই অধিষ্ঠিত নির্দিষ্ট দেবতা রয়েছেন, কাছেপিঠের গাঁয়ের মানুষ তাঁদের উপাসনা করেন। ওরণ লাগোয়া জমিন সংরক্ষণ করার দায়িত্ব সেখানকার কৌম সমাজের — গাছগাছালি কাটা নিষিদ্ধ, শুধু খসে পড়া ডালপালা জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়, ওরণের ভিতর দালান-টালান কিচ্ছুটি বানানোর নিয়ম নেই, ভিতরকার জলাশয়গুলিকেও পবিত্র বলে গণ্য করা হয়।
অথচ, “ব্যাটারা [নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থা] শতবর্ষ পুরানো গাছ কেটে, ঘাসপালা ঝোপঝাড় সব উপড়ে দিয়ে গেছে। ওদের কেউ রুখতে পারবে বলে তো মনে হয় না,” বক্তব্য সুমের সিংয়ের।
নবায়নযোগ্য নানান শক্তি ( রিনিউএবল এনার্জি বা আরই) সংস্থার কবলে একে একে বেদখল হচ্ছে তাঁদের ওরণগুলি, জয়সলমীর জুড়ে শয়ে-শয়ে গ্রামের মানুষ আজ এই বিষয় ঘিরে সুমের সিংয়ের মতোই ক্ষুব্ধ। তাঁরা বলছেন, গত ১৫ বছরে হাওয়াকল আর বেড়া-দেওয়া সৌরকেন্দ্র এসে গিলে খেয়েছে এই জেলার হাজার হাজার একর জমি। উপরন্তু জয়সলমীর থেকে বিদ্যুৎ বাইরে পাঠানোর জন্য হাই-টেনশন তার আর মাইক্রোগ্রিড তো আছেই। স্থানীয় জৈবতন্ত্র টালমাটাল তো হয়েইছে, এমনকি যাঁদের রুজিরুটি এইসকল দেববনীর উপর নির্ভরশীল, রেহাই পাননি তাঁরাও।
“পশু চরানোর মতো একচিলতে জমিও পড়ে নেই। ইতিমধ্যেই [মার্চে] ঘাস ফুরিয়ে গেছে, আমাদের পশুগুলো কের (করেল) আর খেজরি (শমী) গাছের পাতা ছাড়া আর কিছুই খেতে পাচ্ছে না। যথেষ্ট পরিমাণে খাবার জুটছে না, তাই দুধও কম দিচ্ছে। দিনে ৫ লিটারের জায়গায় মোটে ২ লিটারে এসে ঠেকেছে,” বললেন পশুপালক জোরা রাম।
আধা-ঊষর সাভানা (নিষ্পাদপ তৃণভূমি) গোত্রের এই ওরণগুলি কৌম সমাজের হিতের জন্যই রয়েছে। আশপাশে থাকা হাজার হাজার গ্রামবাসীর চারণভূমি, পানি, আহার, পশুখাদ্য ও জ্বালানির একমাত্র উৎস এই পবিত্র বনাঞ্চল।
বেশ কয়েকবছর ধরেই দুবলা হয়ে যাচ্ছে জোরা রামের উটগুলি। “আমাদের উটগুলো হররোজ ৫০ ধরনের ঘাস আর পাতা খেতে অভ্যস্ত,” জানালেন তিনি। হাই-টেনশন তারগুলি মাটির ৩০ মিটার উপর দিয়ে গেলেও ৭৫০ মেগাওয়াটের কম্পন প্রতিবাহিত হয় নিচের উদ্ভিদে, ছুঁলেই তড়িদাহত হবে যে কেউ। মাথা ঝাঁকিয়ে জোরা রাম বলে উঠলেন, “নিজেই ভাবুন, জোয়ান একখান উট যখন গোটা মুখ দিয়ে ওই গাছ চিবোতে যায়।”
তাঁর ভাই মাসিংহ রাম থাকেন রাসলা পঞ্চায়েতে। একত্রে ৭০টি উট মালিক এই দুই ভাই। প্রতিদিন চারণভূমির খোঁজে জয়সলমীর জেলা জুড়ে ২০ কিলোমিটারেরও অধিক পথ পাড়ি দেন তাঁরা।
“পাঁচিল তুলে দিয়েছে, চরে খাওয়ার জায়গায় [হাই-টেনশন] তার আর খাম্বা [বায়ুকল], আমাদের উটগুলো আর ঢুকতেই পারে না। গাড্ডায় পড়ে জখম হয় বেচারারা, বিষিয়ে যায় আঘাতগুলো। এসব সৌরপ্লেট আমাদের কোন কাজেই আসে না,” বললেন মাসিংহ রাম।
বহু প্রজন্ম ধরে যাঁরা উটপালন করে এসেছেন, সেই রাইকা রাখালিয়া জাতির সদস্য এই ভ্রাতাদ্বয়। তবে আজ, “গায়ে গতরে মজুরি খেটে ভাত জোগাড় করছি আমরা,” কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ নেই বেচার মতো। চট করে অন্য কোনও কামকাজও পাওয়া যায় না, তাঁরা জানাচ্ছেন, “পরিবারে একজন বই আর কেউই বাইরে কাজ জোটাতে পারে না।” বাকিরা পশু চরানোর কাজটাই করে চলেন।
তবে শুধু উট নয়, এই সমস্যার জেরে নাজেহাল পশুপালকদের প্রত্যেকেই।
সকাল ১০টা বাজতে চলল, নাক বরাবর প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে তখন জয়সলমীরের গঙ্গা রাম কি ধানি ওরণে প্রবেশ করছেন নাজাম্মুদিন। ইতস্তত গজানো ঘাসের লোভে নিমেষে তিড়িং বিড়িং শুরু করল তাঁর ২০০টি ছাগল-ভেড়া।
নাটি গাঁয়ের এই ৫৫ বছরের পশুপালক এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বললেন, “এইটা বই তল্লাটে আর ওরণ নেই। খোলা আসমানের নিচে চরে খাওয়ার মতো জমি আর সহজে মেলে না।” নাজাম্মুদিনের আন্দাজে, ঘাস-বিচালির খাতে বাৎসরিক লাখ দুয়েক খরচ হয় তাঁর।
২০১৯ সালের পরিসংখ্যান বলছে: রাজস্থানের মোট গরুর সংখ্যা ১.৪ কোটি , ছাগলের সংখ্যা দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ (২.০৮ কোটি), ৭০ লক্ষ ভেড়া ও ২০ লক্ষ উট। ওরণ নামের জনসম্পদটি হাতছাড়া হওয়ায় বিশাল একখান ধাক্কা খেয়েছে গবাদি পশুকূল।
সমস্যাটা দিনকে দিন আরও গুরুতর চেহারা নিচ্ছে।
ইন্টার-স্টেট ট্রান্সমিশন সিস্টেম গ্রীন এনার্জি করিডোর যোজনার দ্বিতীয় দফায় আনুমানিক ১০,৭৫০ সার্কিট কিলোমিটার (সিকেএম) বৈদ্যুতিক তার পাতা হবে। কেন্দ্রের নয়া ও নবায়নযোগ্য শক্তি (এমএনআরই) মন্ত্রকের বাৎসরিক রিপোর্ট ২০২১-২২ মোতাবেক এটি ৬ই জানুয়ারি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সংক্রান্ত ক্যাবিনেট সমিতির (সিসিইএ) অনুমোদন লাভ করেছে, এবং রাজস্থান সহ সাতটি রাজ্য এটির আওতায় পড়ছে।
বিষয়টা কেবল নষ্ট হওয়া তৃণভূমিতেই সীমাবদ্ধ নয়। “রিনিউএবল এনার্জি কোম্পানিগুলো এসেই আগে গোটা তল্লাটের গাছ কেটে সাফ করে দেয়। ফলে স্থানীয় প্রজাতির কীটপতঙ্গ, পাখি, প্রজাপতি, মথ, ইত্যাদি সব মরে যায়, বারোটা বাজে জৈববাস্তুতন্ত্রের। পাখি আর পোকামাকড়ের বাসাগুলোও তছনছ হয়ে যায়,” স্থানীয় পরিবেশকর্মী পার্থ জাগানি জানালেন।
এছাড়াও শত-শত কিলোমিটার জুড়ে পাতা বৈদ্যুতিক তারে ধাক্কা খেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে রাজস্থান রাজ্যপক্ষী গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড সহ শতসহস্র পাখি। পড়ুন: হাই-টেনশন হাড়িকাঠে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড
সৌর প্লেটের আগমনে আক্ষরিক অর্থে পারদ চড়ছে এ অঞ্চলে। ইদানিং ভয়াবহ তাপপ্রবাহের সাক্ষী থাকছে আমাদের দেশ। রাজস্থানের মরু আবহাওয়ায় প্রতিবছরই ৫০ ডিগ্রি ছাড়ায় তাপমাত্রা, আর আজ থেকে ৫০ বছর পর ‘অত্যন্ত উষ্ণ দিনের’ আরও গোটা একটি মাস যুক্ত হতে চলেছে জয়সলমীরের সালপঞ্জিকায় — ২৫৩ থেকে বেড়ে ২৮৩ দিন — নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি বিশ্ব-উষ্ণায়ন সংক্রান্ত ইন্টের্যাক্টিভ পোর্টালে রয়েছে এই তথ্যটি।
ডঃ সুমিত ডুকিয়ার মতে, নবায়নযোগ্য শক্তির জেরে গাছ ধ্বংস হচ্ছে বলে সৌরপ্যানেল হতে সৃষ্ট তাপ উত্তরোত্তর আরও বৃদ্ধি পায়। এই সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী আজ বহু দশক ধরে বদলাতে থাকা ওরণ নিয়ে গবেষণারত। “কাঁচের প্লেটে প্রতিফলিত সূর্যরশ্মির জন্য স্থানীয় পরিবেশগত তাপমাত্রা প্রবল বেগে ঊর্ধ্বমুখী।” আগামী ৫০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পারদ ১-২ ডিগ্রি তো চড়বেই, এমনকি “সে হার আজ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং দেশি প্রজাতির পোকামাকড়, বিশেষ করে পরাগমিলনে পটু পতঙ্গরা তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাততাড়ি গোটাবে এই তল্লাট থেকে,” জানালেন তিনি।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাজস্থানে অতিরিক্ত ছয়টি সৌরশক্তি কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন মিলেছে। এমএনআরই-র উপরোক্ত রিপোর্ট অনুসারে: অতিমারির সময় আরই ধারণক্ষমতার তুঙ্গে উঠেছিল এই রাজ্যটি — ২০২১ সালে মোটে ৯ মাসের ভিতর (মার্চ থেকে ডিসেম্বর) ৪,২৪৭ মেগাওয়াটের ধারণক্ষমতা যোগ হয়।
স্থানীয় মানুষের মতে এর পুরোটাই হয়েছিল চুপিসাড়ে। “লকডাউনের সময় পুরো দুনিয়ার যখন ঝাঁপ নামানো, তখন একটানা কাজ চলেছিল।” তারপর দিগন্ত জুড়ে বিরাজমান হাওয়াকলের দিকে আঙুল দেখিয়ে পার্থ বললেন, “দেবীকোট থেকে দেগ্রাই মন্দির যাওয়ার এই যে ১৫ কিলোমিটার লম্বা রাস্তাটা, লকডাউনের আগে ওটার এপার-ওপার কোত্থাও কোনও কাঠামো [হাওয়াকল] ছিল না।”
সেসব কেমন করে হয়েছিল, সেটা বোঝাতে গিয়ে নারায়ণ রাম জানালেন, “ওরা পুলিশের লাঠি নিয়ে আসে, আমাদের হাঁকিয়ে দেয়, তারপর জোরজবরদস্তি ঢুকে গাছপালা কেটে জমিনে দুরমুশ করে দেয়।” রাসলা পঞ্চায়েতের এই মানুষটি অন্যান্য মোড়লদের সঙ্গে দেগ্রাই মাতার মন্দিরের উল্টোদিকে বসেছিলেন। এই দেগ্রাই মাতা আর কেউ নন, এই ওরণটির রক্ষাকর্ত্রী দেবী।
“ওরণগুলোকে আমরা মন্দির হিসেবেই দেখি। এটাই আমাদের ধর্ম। এটা গরু-ভেড়া চরাবার জায়গা, এটা বন্য জন্তু আর পাখিদের ঘর, জলাশয়ও আছে, তাই এটা আমাদের দেবীর মতো; উট, ছাগল, ভেড়া, সব্বাই এটা ইস্তেমাল করে,” বললেন তিনি।
জয়সলমীরের জেলা কালেক্টরের সঙ্গে বারংবার কথা বলার চেষ্টা করেও প্রতিবেদক মোলাকাত করার অনুমতি পাননি। এমএনআরই-র অন্তর্গত জাতীয় সৌরশক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও রাস্তা নেই। এই লেখাটি প্রকাশ হওয়া অবধি এমএনআরই-কে বহুবার ইমেইল করা সত্ত্বেও কোনও জবাব আসেনি।
কথা বলার আইনি অনুমোদন নেই, তবুও রাজ্য বিদ্যুৎ বিভাগের এক স্থানীয় আধিকারিক আমাদের জানান যে পাওয়ার গ্রিড ভূগর্ভস্থ করার বা রিনিউএবল এনার্জি প্রকল্পের অগ্রগতি ঢিমে করার কোনও আদেশ তাঁরা পাননি।
*****
যেভাবে আরই সংস্থাগুলি আজ অবলীলায় রাজস্থানে ঢুকে জমি অধিগ্রহণ করছে, এর মূলে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের একটি ঔপনিবেশিক গেরো। সে যুগে সমস্ত রকমের খাজনাহীন জমিকে একত্রে ‘ওয়েইস্টল্যান্ড’ বা ‘পতিত জমি’ বলে ধরা হত। যার মধ্যে এখানকার আধা-শুষ্ক খোলা সাভানা ও তৃণভূমিও পড়ছে।
বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী ও সংরক্ষণকর্মীর দল খোলা ময়দানে এ হেন ভুল শ্রেণিকরণের বিরুদ্ধে অক্লান্তভাবে লড়লেও ২০০৫ সাল থেকে ভারত সরকার একটি ওয়েইস্টল্যান্ড অ্যাটলাস বা পতিত ভূমানচিত্র প্রকাশ করতে থেকেছে। এটির পঞ্চম সংস্করণটি ২০১৯ সালে বেরিয়েছিল ঠিকই, তবে সেটা পুরোপুরি ডাউনলোড করা যায় না।
২০১৫-১৬ সালের পতিত ভূমানচিত্রে ভারতের ১৭ শতাংশ জমি তৃণভূমি রূপে চিহ্নিত। ঘোষিত সরকারী নীতি অনুসারে তৃণভূমি, রুক্ষভূমি ও কণ্টকাকীর্ণ অরণ্য ‘ওয়েইস্ট’ বা ‘ঊষর জমিন’।
সংরক্ষণ বিজ্ঞানী ডঃ অ্যাবি টি. ভানাকের কথায়: “শুখাজমির যে নিজস্ব জৈবতন্ত্র, ভারতে তার সংরক্ষণ, রুজিরুটি ও জৈববৈচিত্রের নিরিখে কোনও স্বীকৃতি নেই। ফলে এই জমিগুলি খুব সহজেই অবস্থান্তরের শিকার হয়ে পড়ছে, অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে জৈবচক্রের।” ইনি আজ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তৃণভূমির এই ভুল শ্রেণিকরণের বিরুদ্ধে লড়ছেন।
“আগে যেখানে পতিত জমি ছিল না, সৌরশক্তি কেন্দ্রের দয়ায় সেখানেও ওয়েইস্টল্যান্ড তৈরি হচ্ছে। একটা পূর্ণাঙ্গ জৈবতন্ত্র ধ্বংস করে সৌরকেন্দ্র বানাচ্ছেন। শক্তি উৎপাদন হচ্ছে বটে, তবে সেটা কি সত্যিই সবুজ শক্তি?” সওয়াল তাঁর। উপরন্তু রাজস্থানের ৩৩ শতাংশ যে উক্ত শ্রেণিকরণ মোতাবেক পতিত নয়, বরং খোলামেলা প্রাকৃতিক জৈবতন্ত্র (ওপেন ন্যাচারাল ইকোসিস্টেম বা ওএনই), সেটাও জানালেন ডঃ ভানাক।
নেচার কনজারভেশন ফাউন্ডেশনে কর্মরত পরিবেশবিদ এম. ডি. মধুসূদনের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা একটি গবেষণাপত্রে ডঃ ভানাক বলেছেন: “ভারতের ১০ শতাংশ পড়ে ওএনই-র আওতায়, অথচ সেটার কেবল ৫ শতাংশ রয়েছে সুরক্ষিত অঞ্চলের (প্রোটেক্টেড এরিয়া বা পিএ) মধ্যে।” এই নিবন্ধটির শিরোনাম ‘ভারতের আধা-শুষ্ক খোলামেলা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপ্তি এবং বিস্তৃতির রেখচিত্র ’ ।
জোরা রামের কথায় উঠে এল এসকল গুরুত্বপূর্ণ চারণভূমির প্রসঙ্গ, “সরকার আমাদের ভবিষ্যৎটা খয়রাতে বিলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের বেরাদরিটা বাঁচাতে গেলে উটগুলোকেও বাঁচাতে হবে।”
এ মুসিবতের চুল্লিতে কাঠ গুঁজতে ১৯৯৯ সালে পতিত জমি উন্নয়ন বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়েইস্টল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) নাম বদলে খুবই হাস্যকরভাবে ভূমি সম্পদ বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অফ ল্যান্ড রিসোর্সেস্ বা ডিওএলআর) রাখা হয়।
“প্রযুক্তি-কেন্দ্রিকতা দিয়ে ভূপ্রকৃতি ও জৈবতন্ত্রকে বোঝা — গায়ের জোরে সবকিছু ভেঙেচুরে একজাতকরণ,” করায় সরকারকে কাঠগোড়ায় তুলছেন ডঃ ভানাক। অশোক ট্রাস্ট ফর রিসার্চ ইন ইকোলজি অ্যান্ড দি এনভাইরনমেন্ট-র এই অধ্যাপকের কথায়, “স্থানীয় মানুষদের ইজ্জত দেওয়া হচ্ছে না, মাটির সঙ্গে ইনসানের যে জীবন্ত সম্পর্ক, আমরা সেটা উপেক্ষা করছি।”
সানওয়াটা গাঁয়ের কমল কুনোয়ার, ৩০, বললেন, “ওরণ থেকে কের সাঙ্গরি আনাটাও আর সম্ভব নয়।” স্থানীয় রান্নায় বহুল ব্যবহৃত দেশজ করেল গাছের ছোটো ছোটো বেরি-জাতীয় ফল আর শুঁটি আজ অমিল — কমল এটা নিয়েই সবচাইতে দুঃখিত, কারণ দেশজ রান্নায় বেশ নামডাক আছে তাঁর।
খাতায় কলমে ডিওএলআরের অন্যতম লক্ষ্য ‘গ্রামাঞ্চলে জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি।’ অথচ আরই সংস্থার হাতে জমি তুলে দিয়ে, মানুষের থেকে বিস্তীর্ণ চারণভূমি ও কাঠ বাদে অন্যান্য বনজ সম্পদ (এনটিএফপি) ছিনিয়ে বাস্তবে ঠিক তার উল্টোটাই হয়েছে।
জয়সলমীর জেলার মোকলা গ্রামের থাকেন কুন্দন সিং। ২৫ বছরের এই রাখালের থেকে জানা গেল যে আনুমানিক ২০টি চাষি-পশুপালক পরিবার রয়েছে এ গাঁয়ে, এবং পশু চরানোর কাজটা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। “ওরা [আরই কোম্পানি] সীমানা বরাবর দেওয়াল তুলে দেয়, তখন আমরা আর চরাতে যেতে পারি না।”
জয়সলমীরের ৮৭ শতাংশ গ্রামাঞ্চল, এখানে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষি ও পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত। “এই তল্লাটে ঘরে-ঘরে গবাদি পশু পাবেন। আমার পশুগুলোকে তো পেট ভরে চাট্টি খাওয়াতেও পারি না,” জানালেন সুমের সিং।
গবাদি পশুর মূল খাদ্য ঘাস। জুন, ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্যাটার্ন অফ প্ল্যান্ট স্পিসিজ ডাইভার্সিটি নামের একটি গবেষণাপত্র বলছে: রাজস্থানে ৩৭৫ প্রজাতির ঘাস পাওয়া যায়, আর এই প্রজাতিগুলি এখানকার যথাকিঞ্চিৎ বৃষ্টিপাতের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে।
তবে নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থাগুলি জমি অধিগ্রহণ করলে, “মাটিটা ওলটপালট হয়ে যায়। স্থানীয় উদ্ভিদের একেকটি গোছা কয়েক দশক পুরোনো, আর গোটা জৈবতন্ত্রটা তো কয়েকশো বছর প্রাচীন। চাইলেও এদের বদলে ফেলতে পারবেন না! এসব গাছপালা উপড়ে ফেলা মানে যেচে মরুকরণ ডেকে আনা,” ডঃ ভানাক বুঝিয়ে বললেন।
ভারতের অরণ্য পরিস্থিতি রিপোর্ট ২০২১ -এ বলছে যে রাজস্থানের মোট ৩.৪ কোটি হেক্টর জমি রয়েছে, কিন্তু শ্রেণিকরণের নিরিখে মোটে ৮ শতাংশ অরণ্য রূপে চিহ্নিত। কারণ বনানী বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করার সময় গাছগাছালিতে ঢাকা নেই, এমন জায়গাগুলিকে জঙ্গল বলে চিনতে সক্ষম নয় আমাদের কৃত্রিম উপগ্রহগুলি।
অথচ এই রাজ্যের বনে-বনে এমন অসংখ্য তৃণভূমিজ প্রজাতিরা বেঁচে আছে যারা হয় অসুরক্ষিত কিংবা বিপন্ন, যেমন কালো-শিখর ডাহর (লেসার ফ্লোরিকান), গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড, ভারতীয় ধূসর নেকড়ে (ইন্ডিয়ান গ্রে উল্ফ), পাতিশিয়াল (গোল্ডেন জ্যাকেল), খেঁকশিয়াল (ইন্ডিয়ান ফক্স), চিঙ্কারা (ইন্ডিয়ান গ্যাজেল), কৃষ্ণসার (ব্ল্যাকবাক্), হুঁড়রা বা ডোরাকাটা হায়না (স্ট্রাইপড্ হায়েনা), স্য়াহগোশ (কারাকাল), মরুবিড়াল (ডেজার্ট ক্যাট), কাঁটাচুয়া (ইন্ডিয়ান হেজহগ্) প্রভৃতি। এছাড়া সন্দ (স্পাইনি-টেইলড্ লিজার্ড) ও মরুগোসাপ বা মরু-গুঁইসাপের (ডেজার্ট মনিটর লিজার্ড) মতো এমন প্রজাতিও রয়েছে যাদের এক্ষুনি সংরক্ষণ না করলেই নয়।
রাষ্ট্রসংঘ ২০২১-২০৩০ সালের দশকটির নাম দিয়েছে ‘ইউএন জৈবতন্ত্র পুনঃস্থাপন দশক’ : “জৈবতন্ত্র পুনঃস্থাপন মানে ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত জৈবতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সহায়তা এবং অক্ষত জৈবতন্ত্র সংরক্ষণ।” এছাড়াও আইসিইউএন-এর প্রকৃতি ২০২৩ প্রকল্পের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে ‘জৈবতন্ত্রের পুনঃস্থাপন।’
জানুয়ারি ২০২২ সালে ঘোষিত চিতা পুনঃপ্রবর্তন পরিকল্পনায় ২২৪ কোটি টাকা ব্যয় করার পাশাপাশি বেশ বড়াই করে বলা হয়েছে: ‘তৃণভূমি’ ও ‘খোলা অরণ্য জৈবতন্ত্র’ রক্ষার্থেই চিতা আমদানি করছে ভারত সরকার। আদতে, চিতার দল এখানে কোনওমতে টিকে আছে — আফ্রিকা থেকে আনা ২০টি চিতার মধ্যে ৫টি ও এখানে ভূমিষ্ট ৩টি চিতার ছানা ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছে।
*****
“...অত্যল্প গাছগাছালি, তৃণভূমি কিংবা জৈবতন্ত্রের সহায় যেসকল শুষ্ক অঞ্চল...সেগুলোকে বনভূমি রূপে চিহ্নিত করতে হবে।” ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ আদালতের এই শুনানিটির পর জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়েছিল প্রতিটি ওরণ।
তবে বাস্তবে ফল হয়নি কিছুই। আগের মতোই দস্তখত পড়তে থেকেছে আরই চুক্তির পাতায় পাতায়। এই জাতীয় জঙ্গলের স্বীকৃতির জন্য লড়তে থাকা স্থানীয় পরিবেশকর্মী আমন সিং “নির্দেশনা এবং হস্তক্ষেপ”-এর জন্য সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানান। জবাবে ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাজস্থান সরকারকে হস্তক্ষেপ করার আদেশ দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
কৃষি এবং পরিস্থিতি বিকাশ সংস্থানের (কেআরএপিএভিআইএস) প্রতিষ্ঠাতা আমন সিং জানালেন, “ওরণ বিষয়ে যথেষ্ঠ পরিমাণে তথ্য নেই সরকারের ভাঁড়ারে। খাজনা নথির হালনাগাদ হয়নি, অসংখ্য ওরণ হয় নথিবদ্ধ নয় কিংবা/এবং দখলদারির শিকার।” কেআরএপিএভিআইএস সংস্থাটি সাধারণ চারণভূমি, বিশেষ করে ওরণ পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ওরণগুলি ‘স্বীকৃত অরণ্য’ তকমা পেলে খননকার্য, সৌর ও বায়ুনির্ভর শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, নগরায়ন তথা অন্যান্য আসন্ন বিপদের মোকাবিলা করার জন্য আরও বেশি করে আইনি সুরক্ষা পাবে। “খাজনা শ্রেণিকরণের নিরিখে এগুলি পতিত বলে ফেলে রাখলে অন্যান্য খাতে বরাদ্দ করার ভয় লেগেই থাকবে,” জানালেন তিনি।
রাজস্থানের সৌরশক্তি নীতি ২০১৯-এর আলোয় ওরণ বাঁচিয়ে রাখার লড়াইটা আরও কঠিন হতে চলেছে। কারণ এই নথি মোতাবেক সৌর শক্তিকেন্দ্র নির্মাতারা অধিগ্রহণের ঊর্ধ্বসীমা ছাড়িয়ে শালিজমি দখল করতে পারে, উপরন্তু জমি রূপান্তরণের উপর কোনও বাধানিষেধ নেই।
“ভারতের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনকানুন সবুজ শক্তির ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছে না,” জানালেন নয়াদিল্লির গুরু গোবিন্দ সিং ইন্দ্রপ্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-অধ্যাপক, বন্যপ্রাণ জীববিজ্ঞানী ডঃ সুমিত ডুকিয়া। “তবে আইনগুলো আরই-র সমর্থক, তাই সরকারের হাত-পা বাঁধা।”
আরই খামার থেকে ব্যাপক পরিমাণে অজৈব অজর বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে, এই নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই ডঃ ডুকিয়া ও পার্থের। “আরই খামারগুলো ৩০ বছরের ইজারা পাচ্ছে, অথচ বাতাসকল আর সৌরপ্যানেলের আয়ু মোটে ২৫ বছর। এগুলো কে সরাবে, আর কোথায়ই বা সরাবে?” ডঃ ডুকিয়ার প্রশ্ন।
*****
“সির সান্তে রোক রহে তো ভি সস্তা জান [কারোর মুণ্ডুর বিনিময়ে যদি একটা গাছও বাঁচানো যায়, সেটাও ঢের ভালো]।” রাধেশ্যাম বিশনোইয়ের স্মৃতিচারণে উঠে এল একটি প্রবাদ, যেটায় “বর্ণিত রয়েছে বৃক্ষরাজির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক।” ধোলিয়াবাসী রাধেশ্যাম থাকেন বাদ্রিয়া ওরণের কাছেই। গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড (স্থানীয় বুলিতে যার নাম ‘গোডাওন’) পাখি বাঁচানোর জন্য যাঁরা যাঁরা জান লড়িয়ে দিচ্ছেন, ইনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
“৩০০ বছরেরও বেশি আগে, যোধপুরের মহারাজা একখান কেল্লা বানাবেন বলে ঠিক করেন। মন্ত্রীকে হুকুম দেন কাছের খেটোলাই গাঁ থেকে কাঠ আনতে। মন্ত্রী মহাশয় সেনা পাঠান, তবে সৈন্যরা পৌঁছে দেখে যে বিশনোই জাতির মানুষজন গাছ কাটতে দিচ্ছে না। তখন মন্ত্রী আদেশ দেন, ‘গুঁড়ি জড়িয়ে থাকা লোক সুদ্ধ গাছগুলো কেটে আনো’।”
স্থানীয় লোকশ্রুতি অনুসারে, অমৃতা দেবীর নেতৃত্বে গ্রামবসীরা মাথা-পিছু একটি করে বৃক্ষ দত্তক নিয়েছিল। কিন্তু সৈন্য বাহিনী হানা দেয়, ৩৬৩ জন মানুষকে খুন করে তবেই গিয়ে থেমেছিল তারা।
“পরিবেশের জন্য শহীদ হওয়ার সেই আবেগটা আজও আমাদের মাঝে বেঁচে রয়েছে। আজও জীবন্ত আছে সেটা,” জানালেন তিনি।
সুমের সিং জানালেন যে দেগ্রাই ওরণের ৬০,০০০ বিঘার মধ্যে ২৪,০০০ বিঘা একটি মন্দিরের অছি পরিষদের অন্তর্ভুক্ত। স্থানীয় ফরমান অনুযায়ী বাদবাকি ৩৬,০০০ বিঘাও ওরণের অংশ, তবে সরকার বাহাদুর সেটিকে ট্রাস্টের হাতে তুলে দেয়নি, এবং “২০০৪ সালে সেটা বায়ুশক্তি কোম্পানিকে দিয়ে দেয় সরকার। তবে আমরা কিন্তু দাঁতে দাঁত লড়ে সেটা আজও ধরে রেখেছি,” বললেন সুমের সিং।
তবে হ্যাঁ, জয়সলমীরের অন্যত্র ছোটো ওরণগুলির রক্ষা নেই। ‘পতিতজমি’ রূপে চিহ্নিত হওয়ায় একে একে তাদের গিলে খাচ্ছে রিনিউএবল এনার্জি সংস্থাগুলো।
সানওয়াটায় নিজের খেতের দিকে তাকিয়ে সুমের সিং বলে উঠলেন, “জমিটা দেখে পাথুরে মনে হতে পারে। কিন্তু এই মাটিতেই আমরা সবচাইতে পুষ্টিকর প্রজাতির বাজরা ফলাই।” মোকলা গাঁয়ের ধারে, ডুঙ্গার পীরজি ওরণে ইতস্তত দাঁড়িয়ে রয়েছে খেজরি (শমী), কের (করেল), জাল (মিঠে পিলু বা মিসওয়াক) ও বের (কুল) বৃক্ষ — সে এখানকার ইনসান বলুন বা পশুপাখি, এসকল গাছ সবাইকেই সুস্বাদু রসদ জোগায়।
“বঞ্জর ভূমি [পতিত জমিন]!” এ শ্রেণিকরণে হতভম্ব হয়ে উঠেছেন সুমের সিং। “স্থানীয় ভূমিহীন মানুষজন, যাদের অন্য কোনও কামকাজের সুযোগ নেই, তাদের হাতে এই জমি দিয়ে দেখুন তো একবার। রাগি, বাজরা ফলিয়ে সব্বার পেট ভরিয়ে দেবে।”
জয়সলমীর থেকে খেটোলাই যাওয়ার পাকা সড়কের উপর একটা ছোট্ট দোকান চালান মাঙ্গি লাল। তাঁর কথায়: “আমরা গরিবগুর্বো মানুষ। জমির বদলে পয়সাকড়ি দিলে, না বলি কেমন করে বলুন তো?”
এই প্রতিবেদন রচনায় সাহায্য করার জন্য বায়োডাইভার্সিটি কোলাবোরেটিভের সদস্য ডঃ রবি চেল্লমের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন লেখক।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র