“ফুসফুসগুলো মনে হয় পাথর। হাঁটতে পর্যন্ত পারি না,” বলছেন মাণিক সর্দার।

২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ৫৫ বছরের এই প্রৌঢ়র সিলিকোসিস ধরা পড়ে – ফুসফুসের এমন এক রোগ যার কোনও চিকিৎসা নেই এখনও। “আসন্ন ভোট নিয়ে আমার কিছু এসে যায় না,” বলতে থাকেন তিনি, “আমার শুধু চিন্তা আমার পরিবারের কী হবে।”

সিলিকোসিসে ভুগছেন নবকুমার মণ্ডলও। যোগ করলেন, “ভোট শুধু ভুয়ো প্রতিশ্রুতির খেলা। আমাদের কাছে ভোট দেওয়া একটা রুটিনের মতো। ক্ষমতায় যেই আসুক, আমাদের অবস্থা তো আর বদলাবে না।”

মাণিক ও নবকুমার পশ্চিমবঙ্গের মিনাখাঁ ব্লকভুক্ত ঝুপখালি গ্রামের বাসিন্দা, আগামী ১ জুন ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফায় ভোট এখানে।

এক-দেড় বছর ধরে কিছুদিন ছাড়া ছাড়া কারখানায় কাজ করতে গিয়ে সিলিকা গুঁড়োর সংস্পর্শে আসার দরুণ অসুস্থতা – এবং সেই অসুস্থতার জেরে উপার্জন হারানোর ধাক্কায় বিধ্বস্ত দুজনেই। ক্ষতিপূরণের আশা নেই, কারণ এই র‍্যামিং মাস কারখানাগুলোর অধিকাংশই কারখানা ডিরেক্টোরেটের তালিকায় নথিভুক্ত নয়। যেগুলোর নাম আছে সেগুলোও এঁদের কোনও নিয়োগের চিঠি বা পরিচয়পত্র দেয়নি। এমন অনেক কারখানাই আদতে বেআইনি বা আধা-আইনি, এবং সেখানকার শ্রমিকদের নাম-পরিচয় কোথাও নথিবদ্ধ নেই।

PHOTO • Ritayan Mukherjee
PHOTO • Ritayan Mukherjee

মাণিক সরকার (বাঁদিকে) এবং হর পাইক (ডানদিকে) পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ঝুপখালি গ্রামের বাসিন্দা। দুজনেই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্যত্র গেছিলেন র‍্যামিং মাস কারখানায় কাজ করতে, এবং সেখানে সিলিকা ধুলোর সংস্পর্শে এসে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন

কাজের ধরন চরম বিপজ্জনক হওয়া সত্ত্বেও ২০০০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে – অর্থাৎ প্রায় এক দশক ধরে মাণিক ও নবকুমারের মতো উত্তর ২৪ পরগনার বহু বাসিন্দা রোজগারের তাড়নায় এইসব কারখানাগুলোয় পাড়ি জমিয়েছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন আর ফসলের পড়ন্ত দামের সাঁড়াশি ধাক্কায় তাঁদের বরাবরের পেশা চাষবাস আর লাভজনক ছিল না।

“কাজের খোঁজে ওখানে গেছিলাম,” বলছেন ঝুপখালির আর এক বাসিন্দা হর পাইক, “মরণফাঁদে পা দিচ্ছি তা কে জানত।”

এই কারখানাগুলিতে কাজ করতে গিয়ে র‍্যামিং মাস তৈরির অন্যতম উপাদান সিলিকার মিহি গুঁড়ো ক্রমাগত শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢোকে শ্রমিকদের।

ধাতু এবং অ-ধাতব খনিজ গলানোর ইনডাকশন চুল্লির লাইনিং, ল্যাডল কার বা গলানো ধাতুবাহক গাড়ি এবং ক্রেডল কার বা তারবাহক যন্ত্রের মতো স্টিল উৎপাদনের নানান সরঞ্জাম তৈরির মূল উপাদান এই র‍্যামিং মাস। অগ্নি ইটের মতো বিপজ্জনক ও অস্থিতিশীল সরঞ্জাম তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় এটা।

এইসব কারখানায় শ্রমিকরা সারাক্ষণই সিলিকার গুঁড়োর মধ্যে থাকেন। “সাইটের কাছে একটা জায়গায় রাতে ঘুমোতাম। ঘুমের মধ্যেও নাকে ঢুকত ওই ধুলো,” জানাচ্ছেন হর। প্রায় ১৫ মাস ওই কারখানায় মজদুরি করেছেন তিনি। কোনওধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম তাঁদের দেওয়া হয়নি, ফলে সিলিকোসিসের আক্রমণ শুধু সময়ের অপেক্ষা।

PHOTO • Ritayan Mukherjee
PHOTO • Ritayan Mukherjee

বাঁদিকে: জলবায়ু পরিবর্তন এবং ফসলের দাম পড়তে থাকার কারণে ২০০১-২০০২ সালে উত্তর ২৪ পরগনা থেকে বহু চাষি কাজের খোঁজে বাইরে চলে যান। ২০০৯ সালের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আয়লার পর আরও বাড়ে অভিগমনের ঝোঁক। অনেকেই কোয়ার্জাইট পাথর ভাঙা ও গুঁড়ো করার কাজে ঢোকেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক কাজ। ডানদিকে: সিলিকোসিস ফুসফুসের এমন এক রোগ যা সারানো যায় না। পরিবারের মূল উপার্জনশালী পুরুষটি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন বা মারা যান, সংসার টানার দায়িত্ব এসে পড়ে বাড়ির মেয়েদের উপর, যাঁরা শোক এবং মানসিক আঘাতে এমনিতেই বিধ্বস্ত

২০০৯-১০ সালের পর থেকে মিনাখাঁ-সন্দেশখালি ব্লকের বিভিন্ন গ্রামের মোট ৩৪ জন শ্রমিক সিলিকোসিসের প্রকোপে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। এঁরা সবাই র‍্যামিং মাস কারখানায় কাজ করেছেন – নয় মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময়কালে।

সিলিকায় ভরা বায়ুতে শ্রমিকরা যখন শ্বাস নেন, ওই সিলিকার ধুলো গিয়ে জমা হতে থাকে ফুসফুসের অ্যালভিওলার স্যাক বা বায়ুথলিতে, এবং ফুসফুসকে আঁটো করে দিতে থাকে। সিলিকোসিসের প্রথম উপসর্গ হল কাশি এবং হাঁপ ধরা, তারপর ওজন কমে যাওয়া এবং গায়ের রং কালো হয়ে যাওয়া। ক্রমে ক্রমে শুরু হয় বুকে ব্যথা এবং শারীরিক ক্লান্তি। শেষ পর্যায়ে এসে রোগীকে সারাক্ষণ অক্সিজেন দিতে হয়। সিলিকোসিস রোগীদের মৃত্যু সাধারণত হয় অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে হৃদ্‌যন্ত্র বিকল হয়ে গিয়ে।

সিলিকোসিস এমন এক ক্রমবর্ধমান পেশাঘটিত রোগ যা সারানোও যায় না, কমানোও যায় না। এটি একটি নির্দিষ্ট ধরনের নিউমোকোনিওসিস বা শ্বাসবাহী পদার্থকণা-ঘটিত রোগ। পেশাঘটিত রোগ বিশেষজ্ঞ ড. কুণাল কুমার দত্ত জানাচ্ছেন, “সিলিকোসিস রোগীদের যক্ষ্মা সংক্রমণের ঝুঁকি অন্যান্যদের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি।” এই রোগকে সিলিকো-টিউবারকিউলোসিস বা সিলিকোটিক টিবি বলা হয়।

কিন্তু গত দুই দশকে কাজের চাহিদা এতই বেড়েছে যে এই বিপজ্জনক ক্ষেত্রেও পরিযায়ী শ্রমিকদের আগমন বিরামহীন। ২০০০ সালে গোয়ালদহ গ্রামের ৩০-৩৫ জন মজুর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে কুলটির একটি র‍্যামিং মাস কারখানায় কাজ করতে গেছিলেন। তার বছর দুয়েক পর মিনাখাঁ ব্লকের গোয়ালদহ, দেবীতলা, খড়িবাড়িয়া, আর জয়গ্রাম গ্রামের দারিদ্রসীমার নিচে থাকা বহু চাষি বারাসতের দত্তপুকুর এলাকার একটি কারখানায় কাজ করতে যান। ২০০৫-২০০৬ সালে সন্দেশখালি ব্লক ১ আর ২-এর সুন্দরীখালি, সরবেড়িয়া, বাতিদহ, আগরহাটি, জেলিয়াখালি, রাজবাড়ি আর ঝুপখালি গ্রাম থেকে আবারও বেরিয়ে যান চাষির দল। এই একই সময় জামুরিয়ার একটি র‍্যামিং মাস কারখানায় কাজ করতে যান এই ব্লকের আরও কিছু শ্রমিক।

“বল মিল [একধরনের পেষাই যন্ত্র] দিয়ে কোয়ার্জাইট পাথর থেকে মিহি গুঁড়ো তৈরি করতাম, ক্রাশার মেশিন দিয়ে সুজি, চিনি এইসব খাদ্যশস্য গুঁড়ানোর কাজ করতাম,” জানাচ্ছেন ঝুপখালির আর এক বাসিন্দা অময় সর্দার। “এত ধুলো হত যে এক হাত দূরে দেখা যেত না। সারা গায়ে ধুলো জমত,” যোগ করেন তিনি। প্রায় দুই বছর সেখানে কাজ করার পর ২০২২ সালের নভেম্বরে সিলিকোসিস ধরা পড়ে তাঁর। ভারি জিনিসপত্র তোলার কাজ আর করতে পারেন না। “সংসার টানতে কাজ নিয়েছিলাম। রোগে ধরে নিল,” বলছেন অময়।

২০০৯ সালে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আয়লা সুন্দরবনের চাষযোগ্য জমি তছনছ করে যাওয়ার পর আরও বাড়ে অভিগমনের ঝোঁক। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম রাজ্য কিংবা দেশের অন্যত্র কাজ করতে যেতে উন্মুখ হয়ে ওঠে।

PHOTO • Ritayan Mukherjee
PHOTO • Ritayan Mukherjee

বাঁদিকে: দু’বছর কাজ করার পর সিলিকোসিস ধরা পড়ে অময় সর্দারের। ‘সংসার টানতে কাজ নিয়েছিলাম। রোগে ধরে নিল,’ বলছেন তিনি। ডানদিকে: মহানন্দ সর্দার কীর্তন গায়ক হতে চেয়েছিলেন, সিলিকোসিস ধরা পড়ার পর এখন একটানে গাইতেই পারেন না আর

PHOTO • Ritayan Mukherjee
PHOTO • Ritayan Mukherjee

বাঁদিকে: সন্দেশখালি ও মিনাখাঁ ব্লকের বহু সিলিকোসিস রোগীকে সারাক্ষণ অক্সিজেন সহায়তা দিতে হয়। ডানদিকে: এক্স-রে ছবি পরীক্ষা করছেন এক চিকিৎসাকর্মী। সিলিকোসিস বৃদ্ধিমূলক রোগ, নিয়মিত এক্স-রে করাতে থাকলে তার সম্প্রসারণ নজরে রাখা সম্ভব

মহানন্দ সর্দার গায়ক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আয়লার পর জামুরিয়ার এক র‍্যামিং মাস কারখানায় কাজ করতে চলে যান, তারপর সিলিকোসিসে ধরে। “এখনও কীর্তন গাই, কিন্তু একটানে বেশিক্ষণ গাইতে পারি না, হাঁপ ধরে যায়,” জানালেন ঝুপখালির বাসিন্দা। সিলিকোসিস ধরা পড়ার পরেও চেন্নাইয়ের এক নির্মাণ প্রকল্পে কাজে গেছিলেন মহানন্দ। কিন্ত সেখানে দুর্ঘটনায় পড়ে ২০২৩ সালের মে মাসে বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হন।

সন্দেশখালি এবং মিনাখাঁ ব্লকে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও বাইরে বেরিয়ে রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে দিনমজুরির কাজ করে চলেছেন।

*****

এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে একদম প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় হওয়া দরকার। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চ–ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অকুপেশনাল হেল্‌থ-এর অধিকর্তা ড. কমলেশ সরকার জানাচ্ছেন, “এই রোগকে কব্জায় আনতে এবং তার সম্প্রসারণ রুখতে গেলে একদম প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় হওয়াটা জরুরি। আঙুলের ডগা ফুটিয়ে বার করা রক্তবিন্দু থেকে ক্লারা সেল প্রোটিন ১৬ [সিসি ১৬] সংগ্রহ করা যায়, যা সিলিকোসিস-সহ একাধিক ফুসফুসের রোগের বায়োমার্কার (জৈবিক লক্ষণ)।” নীরোগ মানবদেহে সিসি ১৬-এর মান মিলিলিটার প্রতি ১৬ ন্যানোগ্রাম। সিলিকোসিস রোগীদের ক্ষেত্রে রোগ ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রক্তে সিসি ১৬-এর মাত্রা কমতে কমতে শূন্য হয়ে যায়।

“সরকারের উচিত, যেসব বিপজ্জনক শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকদের টানা বা ছাড়া ছাড়া সিলিকা ধুলোর সংস্পর্শে আসতে হয়, সেখানে নিয়মিত সিসি ১৬-সহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক করে আইন আনা। এতে করে প্রাথমিক পর্যায়ে সিলিকোসিস নির্ণয় করা সম্ভব হবে,” যোগ করলেন ড. সরকার।

“কাছাকাছির মধ্যে কোনও হাসপাতাল নেই,” জানালেন রবীন্দ্র হালদার। ২০১৯ সালে সিলিকোসিস ধরা পড়েছে তাঁর। সবচেয়ে কাছের ব্লক হাসপাতাল আছে খুলনায়। ঝুপখালির বাসিন্দা রবীন্দ্রকে সেখানে যেতে হলে দু’বার নৌকা চাপতে হবে। “সরবেড়িয়ায় একটা শ্রমজীবী হাসপাতাল আছে, কিন্তু ওখানে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই,” বলে আরও যোগ করলেন, “সমস্যা গুরুতর হলে কলকাতা যেতে হবে। অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া ১৫০০-২০০০ [টাকা] পড়ে যায়।”

PHOTO • Ritayan Mukherjee
PHOTO • Ritayan Mukherjee

বাঁদিকে: ঝুপখালির আর এক বাসিন্দা রবীন্দ্র হালদার বলছেন সবচেয়ে কাছের ব্লক হাসপাতালটিতে পৌঁছতে তাঁকে দু’বার নৌকা বদলাতে হয়। ডানদিকে: গোয়ালদহ গ্রামের শফিক মোল্লাকে সারাক্ষণ অক্সিজেন দিতে হয়

গোয়ালদহর বাড়িতে গত প্রায় দু’বছর ধরে তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে শয্যাশায়ী ৫০ বছরের মহম্মদ শফিক মোল্লা। “২০ কেজি ওজন কমে গেছে, সারাক্ষণ অক্সিজেন দিতে লাগে। রোজা রাখতে পারি না,” বলছেন তিনি। “পরিবারের জন্য ভয় হয়। আমি চলে গেলে ওদের কী হবে?”

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় রাজ্য সরকার। “আমাদের হয়ে মামলা দর্জ করেছিলেন সমিত কুমার কর,” জানালেন শফিকের স্ত্রী তসলিমা বিবি। কিন্তু সে টাকাও ফুরিয়ে গেছে। “বাড়ি মেরামতি আর বড়ো মেয়ের বিয়েতে ওই টাকা লাগিয়েছি,” জানালেন তসলিমা।

অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেল্‌থ অ্যাসোসসিয়েশন অফ ঝাড়খণ্ড-এর (ওস্যাঝ ইন্ডিয়া) তরফে ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সিলিকোসিস-আক্রান্ত শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে দুই দশকেরও বেশি হল লড়ে যাচ্ছেন সমিত কুমার কর। তাঁদের হয়ে সামাজিক সুরক্ষা ও আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা লড়েন তিনি।

২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সিলিকোসিসে মৃত ২৩ জন শ্রমিকের পরিবারকে চার লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ, এবং ৩০ জন সিলিকোসিস-আক্রান্ত শ্রমিককে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে সাহায্য করেছে ওসাঝ ইন্ডিয়া। এছাড়াও রাজ্য সরকারের তরফে অবসরভাতা এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্প খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ১০ কোটি টাকা।

“১৯৪৮ সালের কারখানা আইন অনুসারে র‍্যামিং মাস এবং সিলিকা পাউডার উৎপাদক কারখানাগুলি সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রের আওতায় পড়ে, যেহেতু এই কারখানাগুলিতে ১০ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করেন এবং বিদ্যুৎ সংযোগ প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ কারখানা-সংক্রান্ত সমস্ত শ্রম আইনকানুন এখানে বলবৎ হওয়ার কথা,” বলছেন সমিত। ১৯৪৮ সালের কর্মচারী রাজ্য বিমা আইন এবং ১৯২৩ সালের শ্রমিক (কর্মচারী) ক্ষতিপূরণ আইনের আওতাতেও আসে এই কারখানাগুলি। সিলিকোসিস যেহেতু কারখানা আইনে অবশ্যজ্ঞাপনীয় রোগের তালিকায় পড়ে, তাই কোনও ডাক্তার যদি কোনও শ্রমিকের সিলিকোসিস আছে বলে নির্ণয় করেন তবে কারখানা তা মুখ্য কারখানা পরিদর্শকের কাছে জানাতে বাধ্য।

PHOTO • Ritayan Mukherjee
PHOTO • Ritayan Mukherjee

সিলিকোসিসে স্বামীকে হারিয়েছেন অনিতা মণ্ডল (বাঁদিকে) এবং ভারতী হালদার (ডানদিকে)। বহু র‍্যামিং মাস কারখানাই বেআইনি বা আধা-আইনি পদ্ধতিতে চলে, আর শ্রমিকদের সেখানে কোনও নথিভুক্তি হয় না

৩১ মার্চ ২০২৪ তারিখে কলকাতায় আয়োজিত ওসাঝ ইন্ডিয়ার একটি কর্মশালায় বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে: দীর্ঘমেয়াদে সিলিকার সংস্পর্শে থাকলে তবেই সিলিকোসিস হয় বলে যে ধারণাটা আছে সেটা একেবারেই ভুল; অল্প সময়ের জন্য শ্বাসে সিলিকা ঢুকলেও এই রোগ ধরার ঝুঁকি যথেষ্ট। র‍্যামিং মাস কারখানায় কাজ করে আসা উত্তর ২৪ পরগনার সিলিকোসিস রোগীরাই এই বক্তব্যের সাক্ষী। প্যানেলে বলা হয়, যৎসামান্য সংস্পর্শই ফুসফুসে ঢুকে যাওয়া সিলিকা কণার চারপাশে তন্তুকলা গড়ে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট, আর একবার তা শুরু হয়ে গেলে ফুসফুসে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের আদানপ্রদান বিঘ্নিত হয়, শুরু হয় শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা।

সমিত আরও ব্যাখ্যা করছেন, সিলিকোসিস যেহেতু একটি পেশাঘটিত রোগ, আক্রান্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। কিন্তু এই ক্ষেত্রের বেশিরভাগ শ্রমিকই নথিভুক্ত নন। কোন কোন কারখানায় শ্রমিকরা সিলিকোসিসের শিকার হচ্ছে তা দেখা সরকারের কর্তব্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন নীতিমালায় (ধারা ১১.৪) বলা হয়েছে, আইন যাই বলুক, শ্রমিকদের অধিকার আছে তাঁদের কর্মস্থলের থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করার।

কিন্তু বাস্তবটা অনেকটাই আলাদা বলছেন সমিত: “অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি প্রশাসন ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে সিলিকোসিস লিখতে চায় না।” আর এমনিতেও শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গেই কারখানা তাঁকে ছাঁটাই করে দেয়।

২০১৭ সালের মে মাসে সিলিকোসিসে মারা যান অনিতা মণ্ডলের স্বামী সুবর্ণ, কিন্তু কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয় “লিভার সিরোসিস (যকৃৎ ক্ষয়) এবং পেরিটোনাইটিস (পাকস্থলীর দেওয়ালের প্রদাহ) সংক্রমণ।” সুবর্ণ জামুরিয়ার র‍্যামিং মাস কারখানায় কাজ করতেন।

“আমার স্বামীর কোনওদিন লিভারের সমস্যা ছিল না,” বলছেন অনিতা, “ওঁর সিলিকোসিস ধরা পড়েছিল।” ঝুপখালির বাসিন্দা অনিতা খেতমজুরের কাজ করেন। তাঁর ছেলেও এখন পরিযায়ী শ্রমিক, কলকাতা ও ডায়মন্ড হারবারের নানা বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেন। “আমার কোনও ধারণা ছিল না ডেথ সার্টিফিকেটে কী লিখেছে। আমি তখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত। আর এসব আইনি নামধাম আমি বুঝবই বা কী করে? আমি সাদাসিধে গাঁয়ের বউমানুষ,” বলছেন অনিতা।

মা-ছেলের মিলিত উপার্জন দিয়ে মেয়ের উচ্চশিক্ষার খরচ জোগাচ্ছেন অনিতা। নির্বাচন নিয়ে কোনও আশা নেই তাঁরও। “গত সাত বছরে দুটো ভোট গেল। আমার দুর্দশা তো ঘুচল না। আপনিই বলুন, আমি মাথা ঘামাবো কেন?” প্রশ্ন করেন অনিতা।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Ritayan Mukherjee

ঋতায়ন মুখার্জি কলকাতার বাসিন্দা, আলোকচিত্রে সবিশেষ উৎসাহী। তিনি ২০১৬ সালের পারি ফেলো। তিব্বত মালভূমির যাযাবর মেষপালক রাখালিয়া জনগোষ্ঠীগুলির জীবন বিষয়ে তিনি একটি দীর্ঘমেয়াদী দস্তাবেজি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।

Other stories by Ritayan Mukherjee
Editor : Sarbajaya Bhattacharya

সর্বজয়া ভট্টাচার্য বরিষ্ঠ সহকারী সম্পাদক হিসেবে পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ায় কর্মরত আছেন। দীর্ঘদিন যাবত বাংলা অনুবাদক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর। কলকাতা নিবাসী সর্ববজয়া শহরের ইতিহাস এবং ভ্রমণ সাহিত্যে সবিশেষ আগ্রহী।

Other stories by Sarbajaya Bhattacharya
Translator : Dyuti Mukherjee

দ্যুতি মুখার্জী কলকাতা নিবাসী অনুবাদক এবং প্রকাশনা ক্ষেত্রে কর্মরত একজন পেশাদার কর্মী।

Other stories by Dyuti Mukherjee