শস্য পেষাই, এবং কোন কায়দায় জাঁতা ঘোরালে কিছুটা হলেও খাটনি কমে, এসব ঘিরেই ১১টি দোহা গেয়েছেন সাবিত্রা উভে। মা তাঁকে শক্ত হাতে না গড়লে এত কষ্ট সইত না তাঁর শরীরে, তাই গানে গানে রয়েছে তাঁর মায়ের কথাও
কারও ভাইয়ের হয়তো মুখ গোমড়া, জাঁতাকল নিয়ে বসে থাকা প্রাজ্ঞ এক মহিলা তাকে উপদেশ দেন: "বঁধুয়া পরাণ, একখিলি পান দিস তবে তোর ভাইটাকে।" মাদলের নাদের মতো সাবিত্রা উভের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে অপুর্ব এক ধুয়ো, ছন্দে ছন্দে যার বাঁধা পড়ে ওভিগুলি:
ঝুপঝুপে
বেলিফুল, কুঁড়কুঁড়ি ভার,
গেঁথেছে
অবাক মালা সখী সে আমার,
চাঁদেরই
পক্ষপথে চাঁদপানা মুখ,
টিয়া,
সে নীরব কেন? কীসেরই বা দুখ?
জলহীনা
জঙ্গলে শুখা তবে রই, কেন যে এমন হ'ল বল দেখি সই?
রাধিকা
রাধিকা ওলো, একখিলি পান, ভাইয়ের পরাণ তরে করে যা রে দান।
রাধিকা
রাধিকা ওলো চিরসখা তোর, একখিলি পান দিয়া বেঁধে যা রে ডোর।
সেই রমনী কি নিজের খোঁপায় বেলিফুলের মালা বেঁধেছে? নাকি এই মালা তার প্রাণসখার নিমিত্তে গাঁথা? চন্দ্রপক্ষ সম সুন্দর দুজনেই। তবে সে যা-ই হোক না কেন, আপাতত রঘু নামের যে চন্দনা চুপটি করে বসে আছে গাছের ডালে, সে তো তারই প্রিয়সখার রূপক, তার মানভঞ্জনের চেষ্টাতেই অধীর সেই নারী।
এই যে জলহীন শুষ্ক বনানী, এ যেন হাজার আমোদের মধ্যেও নিরানন্দ জীবনের উপমা। হয়তো আবারও মন কষাকষি হয়েছে তাদের, মুখ গোমড়া করে বসে আছে তার মনের মানুষ, হয়তো বা সেই নারী তার মন পাওয়ার চেষ্টাতেই ব্যস্ত। একখিলি পান যদি সাধা যায়, তাহলে সেই অভিমান দূর হলেও হতে পারে। এর আগে সাবিত্রাবাইয়ের আরেক গোছা ওভি প্রকাশিত হয়েছিল "কষ্ট পেলে বোন, কাঁদছে ভাইয়ের মন" এই শিরোনামে, মনে হয় সেখানেও এই নারীর কথাই বলা হয়েছিল।
নারী তার প্রেমার্ঘ্য স্বরূপ একখিলি পান (ভিডা) সেধে দিয়েছে সেই অভিমানী পুরুষটিকে – অর্থাৎ পানপাতায় মোড়া সুপারির কুচি, চুন আর খয়ের। লোকসাহিত্যে শৃঙ্গার রসের ধারা হয়ে এই দৃশ্যকল্পটি ফিরে আসে বারবার।
ওভি, অর্থাৎ জাঁতাপেষাইয়ের গানের একেকটি স্তবকের পর এই ধুয়োটি ঘুরেফিরে গাইতে থাকেন সাবিত্রাবাই, এখানেই তাঁর নিজস্বতা। তবে সেখানে উপস্থিত অন্য মহিলারা নালিশ জানান খেলাচ্ছলে: "বাবারে, দু'খান ওভির মাঝে এত্ত পংক্তি মনে রাখাই দায়।"
গানের পটভূমিকায় রয়েছে মহিলাদের হাসিঠাট্টা। তবে ওসবের দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই সাবিত্রাবাইয়ের, একমনে গেয়ে গেছেন তিনি। প্রথম কয়েকটি ওভির পর হঠাৎই যেন সুরটা খানিক বদলে ফেললেন, ছন্দের দ্যোতনায় নিয়ে এলেন এই দীর্ঘ অথচ অনিন্দ্য সুন্দর ধুয়োটি।
পাহাড়ের ন্যায় জাঁতাকল, অথবা সে যেন খনি থেকে কেটে আনা কুরুণ্ড মণি, তাকে চালাতে গেলে লাগে অপরিসীম শক্তি আর এ'কথাটাই তাঁর দোহায় গেঁথেছেন সাবিত্রাবাই। স্বামী, মেয়ে, ছেলে আর বৌমা – এতজনকে নিয়ে তাঁর চাঁদের সংসার, সব্বার জন্য স্তূপাকার শস্য গুঁড়ো করে সেই পাথরের কল। নারীর শ্রমের উপরেই নির্ভর করছে তার পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধি, অপরিমেয় সেই ক্ষমতার জয়গানেই গায়িকা পঞ্চমুখ: "মুই নারী আর তুই নারী সই, কার আঙিনায় ছুটছে রথ? সাতটি খণে বৌমা ভানে শাশুড়িমায়ের ক্লান্ত পথ..." খণ বলতে দেশজ স্থাপত্যে পরিমাপের একটি নির্দিষ্ট একককে বোঝায়।
শস্যের দ্বায়িত্বে থাকা মহিলা দুজন অপার শক্তিধর। এ যেন রণাঙ্গনে ছুটন্ত এক রথ – তবে এ কিন্তু যে-সে রথ নয়, বরং দুচাকার এক প্রকাণ্ড জাঁতাকল। দুজনের মধ্যে যিনি অপেক্ষাকৃত বয়স্ক, তিনি অপরজনকে বলছেন মহারথীর মতো শক্ত হয়ে বসে যৌবনের দৃঢ়তার সঙ্গে জাঁতাকলটি চালাতে, তাহলে: "ঘুরবে ঘুরবে চাকা জলেরই মতোই।"
এমন অমানবিক খাটাখাটনি, দিনের পর দিন শস্য গুঁড়ো করে চলা, এর ফলে নারীর হাতদুটি আস্তে আস্তে কেমন যেন হলদেটে হয়ে যায়। সর্বাঙ্গ ভেসে যাচ্ছে ঘামে। তবে তাঁর মা তাঁকে ছোটোবেলায় আদর করে মধুপানা দুধ আর জৈত্রীবাটা খাওয়াতেন, তা নইলে এমন ভাবে জাঁতা ঘোরানোটা সম্ভব হতো না।
সাবিত্রাবাই উভের ২৩টি ওভি প্রকাশিত হয়েছে জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্পে, তার মধ্যে এই তৃতীয়তম কিস্তিটিই সর্বশেষ। জওয়ান যে মেয়েরা সদ্য সদ্য হাত দিয়েছে জাঁতায়, তাদের জন্য গায়িকার একটাই উপদেশ রয়েছে, শস্য পেষাই করতে হলে গোটা শরীরটা দোলানোর কোনও দরকার নেই: "কব্জি বেঁধে হাতলখানা ধর তো দেখি ওই।"
সাবিত্রাবাইয়ের উদ্দাত্ত কণ্ঠে ওভিগুলি শুনুন:
জাঁতা
টানা হ'ল ঢের, আনাজ তুলেছি ফের,
এসেছে
দুয়ারে মোর বাপু আর ভাইয়া।
কানায়
কানায় ভরলো কুলো, জাঁতার কলে গমের ধুলো,
ইস্কুলে
আজ যাচ্ছে শোনো ছোট্ট খোকা মোর।
যে-সে
জাঁতা নয় এ তো পাহাড় যেমন,
রাশি
রাশি ধান ভানে, আমার খোকার তানে, ফুলেফলে ভরে ওঠে গেরস্থ কোন।
মুই
নারী আর তুই নারী সই, কার আঙিনায় ছুটছে রথ?
সাতটি খণে বৌমা ভানে
শাশুড়িমায়ের ক্লান্ত পথ।
এ যে
শুধু জাঁতা নয়, পাহাড় প্রাচীন,
কিলো
কিলো ধান ভানে, আমার খোকার তানে, ফুলেফলে ভরে ওঠে গেরস্থ দিন।
খনিভাঙা
হীরা কয়, এ যে শুধু জাঁতা নয়, কালচে কুরুণ্ডতে কালসিটে রক্ত,
শোন শোন
খুকি মোর, যৌবনে ভরা তোর হাতদুটি রাখ সিধে, মুঠো কর শক্ত।
রথী
সারথির মতো বোস দেখি সই,
ঘুরবে
ঘুরবে চাকা জলেরই মতোই।
আঙুল
দিয়ে টান রে জাঁতা, নখ বাগিয়ে টান,
মধুলপানা
দুধ খেয়েছি, আমার মায়ের দান।
বাটিভরা
ঘাম ঝরে, দুরমুশ জাঁতা,
মা আমার
খাইয়েছে জায়ফল বাটা।
হলুদপানা
হাতের তালু, ঢেঁকির তলায় যা,
শিলকে
বাটা জৈত্রীছড়া খাইয়েছিল মা।
শরীর
দিয়ে টান রে জাঁতা, শরীর দিয়ে সই,
কব্জি
বেঁধে হাতলখানা ধর তো দেখি ওই।
গানের ধুয়ো :
ঝুপঝুপে
বেলিফুল, কুঁড়কুঁড়ি ভার,
গেঁথেছে
অবাক মালা সখী সে আমার,
চাঁদেরই
পক্ষপথে চাঁদপানা মুখ,
টিয়া,
সে নীরব কেন? কীসেরই বা দুখ?
জলহীনা
জঙ্গলে শুখা তবে রই, কেন যে এমন হ'ল বল দেখি সই?
রাধিকা
রাধিকা ওলো, একখিলি পান, ভাইয়ের পরাণ তরে করে যা রে দান।
রাধিকা
রাধিকা ওলো চিরসখা তোর, একখিলি পান দিয়া বেঁধে যা রে ডোর।
পরিবেশক/গায়িকা: সাবিত্রাবাই উভে
জনপদ: খাড়াকওয়াড়ি
গ্রাম: কোলাভাডে
তালুক: মুলশি
জেলা: পুণে
জাতি: মারাঠা
তারিখ: ১৯৯৬ সালের পয়লা জুন এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল
পোস্টার: উর্জা
সাবিত্রাবাই উভের ক ণ্ঠে আরও কিছু ওভি শুনুন: কষ্ট পেলে বোন, কাঁদছে ভাইয়ের মন এবং নারীর রক্তমাংসে গড়া সুখের সংসার ।
হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ'র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন ।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)