নাহ্, ছবির কাজ কেবল কামরা সাজানো নয়। দুশমনের বিরুদ্ধে একাধারে সে ঢাল ও তরোয়াল
– পিকাসো

মারাঠি ভাষায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে: "বামুনের গৃহে রয় পুণ্যি আখর, শস্যে আনাজে ভরা কুনবির ঘর, মাঙ্গ্ ও মাহার জানে গানের খবর।" পরম্পরাগত গ্রামীণ কাঠামোয় মাঙ্গ্ জাতির মানুষজন হালগি বাজান, গোন্ধালিরা বাজান সাম্বাল, ধাঙড়দের বাজনা ঢোলক, এবং মাহার সম্প্রদায়ের হাতে সুর খুঁজে পায় একতারি। জ্ঞান, কৃষিকাজ, শিল্প ও সংগীত মিলে যে চিরন্তন সাংস্কৃতিক আকর, বর্ণাশ্রম ভেদাভেদের কাঁটাতারে বেঁধেছে তাকে। হাজার হাজর বছর ধরে অকথ্য অত্যাচার ও বৈষম্য সয়ে দলিত সমাজ তার ইতিহাস, সাহস, যন্ত্রণা, সুখ, দর্শন, সমস্ত কিছু ধরে রেখেছে জাত্যাভরচি ওভি (জাঁতাপেষাইয়ের গান বা কাব্য), মৌখিক কথকতা, গান ও লোকসংগীতের মাঝে। জাতীয় মঞ্চে ডঃ আম্বেদকরের উত্থানের আগে মাহার জাতির মানুষজন হয় একতারি বাজিয়ে কবীরের দোহা গাইতেন, কিংবা ভজন ও ভক্তিগীতি গেয়ে আরাধনা করতেন বিট্ঠল তথা অন্যান্য দেবদেবীর।

১৯২০ সালের পর দলিত রাজনীতির দিগন্তে যখন নবসূর্য রূপে উদিত হন ডঃ আম্বেদকর, তখন তাঁর আলোকবর্তিকাসম আন্দোলনের কথা জনমানসে উজাগর করে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে উক্ত শিল্পধারা তথা শিল্পীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাবাসাহেবের হাতে জন্ম নেওয়া সামাজিক পরিবর্তন, আন্দোলনের রোজনামচা, তাঁর ভূমিকা ও বাণী, জীবন এবং সংগ্রামের খবর তাঁরা এমনভাবে তুলে ধরেন যাতে সমাজের নিরক্ষর এবং অজ্ঞ মানুষগুলিও তা সহজে অনুধাবন করতে পারেন। মুম্বইয়ের নয়গাঁও মহল্লার ওয়েলফেয়ার ময়দানে একবার একটি জলসায় (সংগীতের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিক্ষোভ) ভীমরাও কার্দক কে সদলবদলে গানবাজনা করতে দেখে ডঃ আম্বেদকর বলেছিলেন: "কার্দক আর তাঁর দলের একেকটা জলসা আমার দশখানা সভা আর জমায়েতের সমান।"

বাবাসাহেবের সামনে সংগীত পরিবেশন করতে করতে শাহির ভেগড়ে গেয়েছিলেন:

মাহার কুলের ছোট্ট ছেলে বুদ্ধি বেজায় তার
ভাই রে ভাই বুদ্ধি বেজায় তার...
এই জগতে এমনটি আর হবেক নাই রে কভু
দলিত মানুষ জানলো সেদিন, ওই ছেলেটাই প্রভু।
ভাই রে ভাই ওই ছেলেটাই প্রভু...
রাত ঘুচালো পথ দ্যাখালো মাহার কুলের ছা,
এই জগতের কোথাও রে আর এইটি পাবি না।

PHOTO • Keshav Waghmare
PHOTO • Keshav Waghmare

বাঁদিকে: বীডের একটি গেরস্থালির মাঝে জ্বলজ্বল করছে বাবাসাহেবের এই চিত্রটি। আত্মারাম সালভের মতো আম্বেদকরোত্তর যুগের শাহিররা বইয়ের পাতায় খুঁজে পেয়েছেন ডঃ আম্বেদকরের গণআন্দোলনের ইতিহাস। ডানদিকে: আত্মারাম সালভের একটি দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র

দলিত সমাজে নবজাগরণ রূপে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল ডঃ আম্বেদকরের আন্দোলন। এই সংগ্রামের প্রধান অস্ত্র ছিল জলসা, যার মাধ্যম ছিল শাহিরি (পরিবেশিত কাব্য), আর আন্দোলনের পদাতিক সৈন্য ছিলেন হাজার হাজার খ্যাতনামা ও অনামা শিল্পী।

ক্রমশ আম্বেদকরবাদী আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে গিয়ে পৌঁছয়। দলিত বস্তির দৃশ্যপট ছিল বাঁধাধরা – আধা বাড়িতে টিনের চালা, বাকি আধায় খড়ের ছাউনি। বস্তির মধ্যিখানে বাঁধা হত মঞ্চ, উত্থিত হত নীল পতাকা। আর সদর্পে উড়তে থাকা নীল নিশানের নিচে জমায়েতে হাজির বাচ্চাকাচ্চা, মহিলা, পুরুষ এবং প্রবীণেরা। শুরু হল একের পর এক সভা, এবং প্রতিটি সভাতেই বুদ্ধ-ভীমগীতি গাওয়া হত। চৈত্যভূমি [মুম্বইয়ে] এবং দীক্ষাভূমি [নাগপুরে] সহ বিভিন্ন শহর থেকে আনা হত ছোটবড়ো নানান কবির বই। দলিত বস্তির অধিকাংশ বাসিন্দা নিরক্ষর ছিলেন, অগত্যা ইস্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের সেই গানগুলি পড়ে শোনাতে বলতেন, যাতে শুনে শুনে আত্মস্থ করে তাঁরা নিজেরা গাইতে পারেন। এছাড়াও শাহিরদের দেখে দেখে গান-কবিতা সব কণ্ঠস্থ করে ফেলতেন, তারপর নিজ নিজ বস্তিতে গিয়ে পরিবেশন করতেন সেগুলি।

হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দিনান্তে ঘরে ফিরছেন মহিলা খেতমজুরের দল, সমবেত কণ্ঠে হঠাৎই তাঁরা, "ভীম রাজা কি জয়! বুদ্ধ ভগবান কি জয়!" বলে গাইতে শুরু করলেন। এক নিমেষে বস্তির পরিবেশে মিশে যেত একরাশ আনন্দ, ফুর্তি ও আশা। গ্রামীণ দলিতদের জীবনে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এই গানগুলিই ছিল। এই গানগুলি না থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে তথাগত ও বাবাসাহেবের মোলাকাত সম্ভবই হত না। এইসব গায়ক ও শাহিরদের সোজাসাপটা চাঁছাছোলা ভাষার ছুঁচে নতুন প্রজন্মের মননে আজীবনের মতো গেঁথে গেল বুদ্ধ, ফুলে ও আম্বেদকরকে ঘিরে জন্ম নেওয়া গান-মালা – এ মালা ছেঁড়া যে নিতান্তই অসম্ভব। একটা গোটা প্রজন্মের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মনন গড়ে তুলেছিলেন সেই শাহিরের দল। তেমনই এক জাদুকর ছিলেন শাহির আত্মারাম সালভে - মারাঠওয়াড়ার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের অন্যতম প্রধান স্থপতি।

১৯৫৩ সালের ৯ই জুন তাঁর জন্ম হয় বীড জেলার মাজালগাঁও ব্লকের ভাটওয়াড়গাঁও গ্রামে। ১৯৭০-এর দশকে ছাত্রাবস্থায় সালভে এসে ওঠেন ঔরঙ্গাবাদে।

তখনকার দিনে মারাঠওয়াড়া অঞ্চলটি ছিল নিজামের দখলে, শিক্ষা সহ সমাজের নানান স্তম্ভই পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। ১৯৪২ সালে এই পটভূমিকায় 'পিপলস্ এডুকেশন সোসাইটি'-র নেতৃত্বে ঔরঙ্গাবাদের নাগসেনবন এলাকায় মিলিন্দ মহাবিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন করেন ডঃ আম্বেদকর। নাগসেনবন কলেজ চত্বরে তিনি দলিত জাতির পড়ুয়াদের জন্য উচ্চশিক্ষার বীজ পোঁতেন। এই মহাবিদ্যালয়টি তৈরি হওয়ার আগে অবধি সমগ্র মারাঠওয়াড়ায় একটিমাত্র সরকারি কলেজটি ছিল ঔরঙ্গাবাদে, এবং তাও আবার কেবলমাত্র 'ইন্টার' স্তর অবধি! (ইন্টার বলতে অন্তর্বর্তী কিংবা প্রাক-ডিগ্রি স্তরের কথা বলা হচ্ছে)। গোটা মারাঠওয়াড়ায় মিলিন্দ কলেজটিই প্রথম যেখানে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করা যেত। ফলে স্বভাবতই এ অঞ্চলে সৃষ্টি হয় এক প্রজ্ঞাগর্ভ বিদ্যাচর্চার পরিবেশ, সেই সঙ্গে বদলে যায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহ। নবজাগরণের ছটায় ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ তথা অঞ্চল আলোকিত হয়ে ওঠে, তৈরি হয় পরিচিতি ঘিরে সচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস। মহারাষ্ট্রের আনাচকানাচ ছাড়াও কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং গুজরাত থেকে পড়তে আসত শিক্ষার্থীর দল, আর ঠিক এইসময়েই পড়ুয়া রূপে মিলিন্দ কলেজে দাখিল হন আত্মারাম সালভে। ঔরঙ্গাবাদের মারাঠওয়াড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলে ফেলার আন্দোলনটিও কিন্তু এই কলেজের ক্যাম্পাসেই শুরু হয়, আর দু-দুটি দশক ধরে সে লড়াইয়ে ইন্ধন জুগিয়েছিল শাহির সালভের কবিতা। সুতরাং, নামান্তর এবং দলিত প্যান্থার - দুটি আন্দোলনের সাংস্কৃতিক রাশ যে তিনি একাহাতে ধরে রেখেছিলেন, এটা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না।

PHOTO • Labani Jangi

বর্ণাশ্রম প্রথার জেরে দলিত জাতির বিরুদ্ধে নেমে আসা যুদ্ধে অস্ত্র হয়ে উঠেছিল আত্মারাম সালভের শাহিরি, কণ্ঠ ও শব্দজাল

১৯৭০-এর মতো উত্তাল দশক আর দুটি নেই। এটি ছিল আজাদ ভারতে জন্মানো প্রথম প্রজন্মটির যৌবনকাল। যুবসমাজের সিংহভাগ কড়কড়ে ডিগ্রি হাতে কলেজ থেকে পাশ করেছিল বটে, কিন্তু তাদের আশা-ভরসা-স্বপ্ন সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকা দেশের হাল-হকিকত। একের পর এক নানান ঘটনা আঁচড় কেটে যায় তাদের মননে: পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি বিদ্রোহ, তেলেঙ্গানা রাজ্য আন্দোলন, বিহারে জয়প্রকাশ নারায়ণের নবনির্মাণ বিপ্লব, বিহার ও গুজরাতে অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহের সংরক্ষণের জন্য আন্দোলন, মুম্বইয়ে মিল মজুরদের ধর্মঘট, শাহাদা আন্দোলন, মারাঠওয়াড়া মুক্তি আন্দোলন, সবুজ বিপ্লব ও মারাঠওয়াড়া জুড়ে চলতে থাকা খরা। তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল দেশ ও তার যুবসমাজ, উন্নয়ন ও পরিচিতির আকাঙ্ক্ষায় ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে বিদ্রোহ।

নাগসেনবন কলেজের পড়ুয়ারা সচেতন হয়ে ওঠে এই আবহে। ১৯৭৪ সালের ২৬শে জুন, ডঃ মচ্ছিন্দ্রনাথ মোহোলের নেতৃত্বে তারা মারাঠওয়াড়া রিপাবলিকান স্টুডেন্টস ফেডেরেশানের ছত্রছায়ায় মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখে দাবি জানায় যাতে মারাঠওয়াড়ার দুটি ইউনিভার্সিটির যে কোনও একটির নাম বদলে অবিলম্বে ডঃ আম্বেদকরের নামে রাখা হয়। তবে ভারতীয় দলিত প্যান্থারস্‌রা যোগ দেওয়ার পরেই এই 'নামান্তর' আন্দোলনটি সংগঠিত হয়ে ওঠে। নামদেও ধাসাল ও রাজা ঢালের মধ্যে চলতে থাকা সংঘাতের ফলে 'দলিত প্যান্থারস্‌' দলটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন ঢালে। তবে অধ্যাপক অরুণ কাম্বলে, রামদাস আথাভালে, গঙ্গাধর গাডে এবং এস.এম. প্রধানের নেতৃত্বে অচিরেই ভূমিষ্ঠ হয় আরেকটি দল, নাম তার 'ভারতীয় দলিত প্যান্থারস্‌'। দলিত প্যান্থারসের হাত ধরে মহারাষ্ট্রে শুরু হওয়া কাজগুলি তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যান।

নব সংগঠিত ভারতীয় দলিত প্যান্থারস্‌দের ঘিরে আত্মারাম সালভে এই গানটি বেঁধেছিলেন:

ভীম-কা সিপাই আমি আমি প্যান্থার
কাম্বলে অরুণ সে তো মহা সর্দার।
জয় ভীম বলি সবে
অবিচার দূর হবে
সাঁজোয়া সিপাই মোরা সাহস বিশাল,
কাউকে ডরাই না রে
ভেঙে ফ্যালা অবিচারে
এগিয়ে যাবোই মোরা আজ কিবা কাল।
দলিত, কিষান ওহে জাগো মজদুর,
পাকিয়ে বিষম ঘুসি, জোট বাঁধা সুর!

এই গানটির দ্বারা নব্য প্যান্থারস্‌দের স্বাগত জানিয়েছিলেন সালভে, তারই সঙ্গে তুলে নিয়েছিলেন মারাঠওয়াড়ার উপসভাপতির সকল দায়-দ্বায়িত্ব। ৭ই জুলাই, ১৯৭৭, মারাঠওয়াড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পাল্টে ডঃ আম্বেদকরের নামে রাখার গণদাবি তোলেন সদ্য সংগঠিত ভারতীয় দলিত প্যান্থারসের সাধারণ সচিব গঙ্গাধর গাডে।

PHOTO • Keshav Waghmare
PHOTO • Keshav Waghmare

বাঁদিকে: শাহির আত্মারাম সালভের দলে এক দশকেরও অধিক সময় জুড়ে সদস্য ছিলেন মহারাষ্ট্রের নান্দেড জেলার মুখেড়ের বাসিন্দা তেজেরাও ভাদ্রে, তিনি ছিলেন ওস্তাদ হারমোনিয়াম এবং ঢোলকি বাজিয়ে। ডানদিকে: আম্বেদকরবাদী আন্দোলনে ভাদ্রের সাংস্কৃতিক অবদানের প্রমাণস্বরূপ একটি শংসাপত্র

১৯৭৭ সালের ১৮ই জুলাই সমস্ত কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়, মারাঠওয়াড়া ইউনিভার্সিটির নামান্তরের দাবিতে একটি প্রকাণ্ড মিছিল বার করে সর্বদলীয় স্টুডেন্ট অ্যাকশন সমিতি। ঠিক তারপরেই, ১৯৭৭, ২১শে জুলাইয়ে ঔরঙ্গাবাদের সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সরস্বতী ভুবন কলেজ, দেওগিরি কলেজ ও বিবেকানন্দ কলেজের সবর্ণ [হিন্দু উচ্চবর্ণ] পড়ুয়ারা প্রথমবারের জন্য আন্দোলনে নামে নামান্তরের বিরুদ্ধে। নামান্তরের পক্ষে ও বিপক্ষে দিকে দিকে ফুঁসে ওঠে বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও মিছিল। আগামী দুই দশক জুড়ে দলিত বনাম উচ্চবর্ণের যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয় মারাঠওয়াড়া। "দলিতদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া বর্ণবাদী যুদ্ধে" নিজের শাহিরি, কণ্ঠ ও শব্দে শানানো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আত্মারাম সালভে।

শাহির আন্নাভাউ সাঠে, ভীমরাও কার্দক, শাহির ঘেগড়ে, ভাউ ফাক্কড়, রাজানন্দ গাডপায়েলে এবং ওয়ামন কার্দকের মতো যাঁরা যাঁরা স্বচক্ষে আম্বেদকরপন্থী আন্দোলন দেখে গেছেন বা খোদ অংশগ্রহণ করেছেন, সেই শাহিররা যখন সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক জগত থেকে বিদায় নিয়েছেন, ঠিক এমনই একটি সময়ে বর্ণাশ্রম-বিরোধী লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে আত্মপ্রকাশ করেন শাহির আত্মারাম।

বাবাসাহেবের বিদ্রোহ কিংবা তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত ধর্মান্তর – দুটোর একটাও স্বচক্ষে দেখেননি বিলাশ ঘোগারে, দলিতানন্দ মোহানাজি হাটকর এবং বিজয়ানন্দ জাধবের মতো আম্বেদকরোত্তর যুগের শাহিররা। এককথায় বলতে গেলে নতুনভাবে পথচলা শুরু করেন এঁরা। কিতাবের পাতা উল্টে বাবাসাহেব (ডঃ আম্বেদকর) এবং তাঁর আন্দোলনের কথা জেনেছিলেন গ্রামীণ এই লোককবির দল। সুতরাং এঁদের শাহিরির শান, বিশেষ করে আত্মারাম সালভের গান যে তরোয়ালকেও হার মানাবে এ তো বলাই বাহুল্য!

নামান্তর আন্দোলনটি কিন্তু নিছকই একখানা নাম পরিবর্তনের লড়াই ছিল না। এটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল নিপীড়িতের আত্মপরিচিতি ঘিরে নতুন করে খুঁজে পাওয়া সচেতনতা এবং মনুষ্য চৈতন্যের হলফনামা।

হঠাৎ করে নামান্তর আন্দোলন থেকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বসন্তদাদা পাতিল সমর্থন তুলে নেওয়ায় ঝলসে ওঠে আত্মারাম সালভের কলম:

বসন্ত দাদা ওগো আমাদের তালে
খোয়াবে কুর্শি তুমি ঝগড়া বাঁধালে,
ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে দলিতের দল
ধূলামাটি মেখে তুমি হইবা কোতল।
খ্যামতা গিলেই তুমি হয়েছ মাতাল
শোনো হে নষ্ট রাজা, থাকিবে না কাল,
স্বৈরতন্ত্র তবে দাও ছেড়ে দাও
কান খুলে এই কথা নাও শুনে নাও।

কেসারাবাই ঘোটমুখে গাইছেন:
'বসন্ত দাদা ওগো আমাদের তালে, খোয়াবে কুর্শি তুমি ঝগড়া বাঁধালে'

সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হবে, এই দোহাই দিয়ে হামেশাই তাঁর অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিত পুলিশ, তবু হার মানতেন না আত্মারাম সালভে

আত্মারাম সালভে যে এই গানটি শুধু লিখেইছিলেন তা নয়, বসন্তদাদা পাতিল নান্দেড ভ্রমণে এলে শত সহস্র মানুষের সামনে তিনি এটি পরিবেশনও করেছিলেন। এই ছুতোয় তাঁর নামে মামলা ঠুকে দেয় রাজ্য সরকার – সারা জীবনে এক এক করে অসংখ্য রাজনৈতিক মামলার শিকার হয়েছিলেন আত্মারাম। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯১ সালে তাঁর মৃত্যু অবধি সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে বিভিন্ন থানায় একাধিক কেস নথিভুক্ত করা হয় এই লোকশাহিরের বিরুদ্ধে, অভিযোগের শেষ নেই - কোথাও মারামারি, কোথাও বা সরকারি কাজে বিঘ্ন ঘটানো, আবার কোথাও দাঙ্গা বাধানো কিংবা সামাজিক শান্তিভঙ্গ করার প্রয়াস। বহুবার তাঁকে খুনের চেষ্টাও হয়েছিল। সালভের দোস্ত ও সহকর্মী দেগলুর-নিবাসী চন্দ্রকান্ত থানেকরের কথায়: "১৯৮০ সালে দেগলুর ব্লকের [নান্দেড জেলা] মারখেল গ্রামে তাঁর উপর হামলা হয়। বেন্নাল গাঁয়ে কালে নামে এক দলিত মজুর খুন হন, আর সেই খুনের কেসে ডাঃ নাভাল জালি ডেথ সার্টিফিকেট জারি করেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছিলেন আত্মারাম, তারপর আর যাবেন কোথায়! ওমনি শাহিরের নামে মামলা দায়ের করা হল, উনি নাকি সেই ডাক্তারকে খুন করার চেষ্টা করেছেন। এর জন্য সালভে, রাম খারগে আর আমার ঘাড়ে দুবছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০০ টাকার জরিমানা এসে চাপে। পরে অবশ্য একটি উচ্চতর আদালত থেকে অব্যাহতি মেলে।"

এই মারখেল গ্রামেই নগরবাই সোপান ওয়াজারকর নামে এক ৭০ বছর বয়সী মহিলার কাছ থেকে আত্মারাম সালভের হাতে লেখা একটি নোটবই পেয়েছিলাম, শাহিরের বেশ কিছু গান লিপিবদ্ধ করা ছিল সেখানে। এই খাতাটি তিনি ৪০ বছর ধরে সযত্নে তুলে রেখেছিলেন একটি মাটির পাত্রে। মারখেলে যখন আত্মারামকে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়, তখন নগরবাই-ই তাঁর প্রাণ বাঁচান। আরেকটি ঘটনার কথা বলি, প্যান্থারস্‌রা বনধ ডাকায় মাজালগাঁওয়ের বেনিয়ারা জোট বেঁধে আত্মারামকে বার করে দিতে চেয়েছিল, তারপর থেকে বীড জেলায় আনাগোনা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। শাহিরের গানের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সঙ্গত করতেন মুখেড়-নিবাসী তেজেরাও ভাদ্রে, তিনি জানালেন: "আত্মারামের বক্তৃতায় যতটা আবেগ থাকত, গানগুলো ছিল ততটাই আঁতে ঘা দেওয়ার মতো। দলিতেরা বড্ড ভালোবাসত তাঁর গান শুনতে, তবে সবর্ণরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠত, মাঝেসাঝে তো ইট-পাটকেল অবধি ছুঁড়ে মারত ব্যাটারা। তিনি গান ধরলে সামনের সারির লোকে কয়েন ছড়াত, আর যারা খেপে যেত তাদের দিক থেকে উড়ে আসত পাথর। শাহির মানুষ তো, একই সঙ্গে প্রেম আর ঘৃণা কুড়োতে অভ্যস্ত ছিলেন, খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে সে যতই ইট-পাটকেল ছুঁড়ুক না কেন, তাঁর গান কেউ থামাতে পারেনি। ভিতরে জমে থাকা রাগের ধিকিধিকি আঙার ঢেলে দিতেন গানে, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন যাতে তারা আত্মসম্মানের জন্য লড়তে শেখে। তিনি চাইতেন সবাই যাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।"

সামাজিক শান্তিভঙ্গের দোহাই দিয়ে হামেশাই তাঁর অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিত পুলিশ, তবুও হার মানতেন না সালভে। পরিবেশনের সময় আত্মারামের জুড়িদার হতেন ফুলে পিম্পলগাঁওয়ের শাহির ভীমসেন সালভে, তাঁর মনে আছে: "বীড জেলায় ঢোকা নিষেধ ছিল আত্মারামের, কিন্তু একবার হয়েছে কি, রাত্তিরবেলা জেলার মধ্যে তাঁর শাহিরি করার কথা, কেউ একটা গিয়ে পুলিশকে জানিয়ে এসেছে। তেনারা তো হন্তদন্ত হয়ে এসে আত্মারামকে বলল গান-টান বন্ধ করতে। তা সেই গাঁয়ের মধ্যিখান দিয়ে একটা নদী বয়ে যায়, উনি সেটা পার হয়ে ওপারে গিয়ে গাইতে লাগলেন। নদীর ওই পাড়টা অন্য জেলায় পড়ছে। লোকজন এপারে বসে বসে গান শুনছে, ঝুপসি আঁধারে। গায়ক গাইছে জেলার সীমান্ত ছাড়িয়ে, অথচ শ্রোতারা বসে আছে জেলার ভিতর। সেকি কাণ্ড! পুলিশ তো হতভম্ব, কিস্যুটি আর করার নেই।" এ হেন অগুনতি পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেন আত্মারাম, কিন্তু একটিবারের জন্যও গান-বাজনা থামাননি। তাঁর প্রাণভ্রমর যে গানেই লুকিয়ে ছিল।

টানা দুই দশক ধরে চলেছিল মারাঠওয়াড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামবদলের আন্দোলন, আর সে লড়াইয়ে ইন্ধন জুগিয়েছিল শাহির সালভের কবিতা

শাহির অশোক নারায়ণ গাইছেন:
'নামান্তরের বিদ্রোহে তাই, নাব দেখি বোন, নাব দেখি ভাই'

আত্মারাম সালভেকে ঘিরে আরেকটি ঘটনার কথা লেখা রয়েছে মানবী হাক্কা অভিযানের (বীড-কেন্দ্রিক) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অ্যাডভোকেট একনাথ আওয়াদের আত্মজীবনী জাগ বাদল ঘালুনি ঘাও -য়ে (এক ঘা মেরে জগতটা বদলা, জেরি পিন্টো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন): "আত্মারাম নাকি সামাজিক শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন, শাহিরির দ্বারা লোকজনকে খ্যাপাচ্ছেন, এসব আগডুম-বাগডুম কথা বলে বীড জেলায় আসা-যাওয়ার উপর জারি হল নিষেধাজ্ঞা। তাই তিনি নান্দেড গিয়ে উঠলেন। এ জেলায় প্যান্থারস্‌দের একটি শাখা শুরু করলাম আমরা, অবিলম্বে সংগঠিত হল একটি জলসা। অম্বাজোগাইয়ের পারালি ওয়েসে বহুসংখ্যক দলিতের বাস। তাই ঠিক করলাম যে জলসাটা ওখানেই হোক। বীডে তো আত্মারামের পা রাখা বারণ, শকুনের মতো নজর রেখেছে পুলিশ। জনৈক ইন্সপেক্টর কদম তো আগ বাড়িয়ে ওঁৎ পেতেছিলেন তাঁকে গ্রেফতার করবে বলে। আমরা গিয়ে দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে, বললাম যে 'গান-টান গাওয়া হয়ে গেলে তারপর না হয় গ্রেফতার করুন।' রাজি হয়ে গেলেন। গানের দরিয়ায় নিজের সবটুকু ঢেলে দিলেন আত্মারাম, সুরে সুরে উঠে এল নামান্তরের দাবি। ইন্সপেক্টর কদম দেখলাম দিব্যি উপভোগ করছেন গানগুলো। এমনকি খোশ মেজাজে 'বিদ্রোহী শাহির'-এর তকমাও ছুঁড়ে দিলেন সালভের দিকে। তবে তারিফ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত ছিলেন হাতকড়া নিয়ে। না জানি কেমন করে সেটা টের পেয়ে যান আত্মারাম। তৎক্ষণাৎ নিজের জায়গায় অন্য একজনকে বসিয়ে রেখে তিনি চম্পট দিলেন। ওদিকে গ্রেফতার করবেন বলে মঞ্চে উঠে ইন্সপেক্টর কদম দেখলেন যে পাখি উড়ে পালিয়েছে, ত্রিসীমানায় টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না!"

২২শে জুলাই ১৯৭৮, মহারাষ্ট্র বিধানসভায় মারাঠওয়াড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পাল্টানোর সংকল্প পাশ হওয়া মাত্র সমগ্র মারাঠওয়াড়া অঞ্চলে দলিতদের উপর নেমে এল হলোকস্ট। একদিনের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ল যাতায়াত ব্যবস্থা, বেছে বেছে আগুন লাগানো হল শত সহস্র দলিত মানুষের বাড়িতে। কয়েক জায়গায় তো ঘরসমেত পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন মহিলারা, বাঁচল না শিশুরাও। খুন হন নান্দেড জেলার সুগাঁও গ্রামের জনার্দন মেওয়াডে ও তেম্ভুরনি গ্রামের ডেপুটি সরপঞ্চ (উপপ্রধান) পোচিরাম কাম্বলে। দলিত হওয়ার কারণে প্রাণ হারান পারভানি জেলার ধমনগাঁও গ্রামের পুলিশ আধিকারিক সাম্ভাজি সোমাজি ও গোভিন্দ ভুরেওয়র। আহত হন হাজার হাজার নিম্নবর্ণের মানুষ। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুটেপুটে শেষ হয়ে যায়। খেতের ফলন্ত শস্য থেকে খামার, রেহাই পায়নি কিছুই। অসংখ্য গ্রামে একঘরে করে দেওয়া হয় দলিতদের। খাবারদাবার বা পানি, সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখা হয় তাঁদের। হাজার হাজার মানুষ বাধ্য হন ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে চলে আসতে। ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ১.৫ কোটি টাকায়। একাধিক স্থানে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বাবাসাহেব আম্বেদকরের মূর্তি। এক লহমায় সমগ্র মারাঠওয়াড়া অঞ্চলটি জাতপাতের রণাঙ্গনের চেহারা ধারণ করে।

মারাঠওয়াড়া জুড়ে দলিতদের উপর নেমে আসা হিংসার বিভীষিকা আত্মারামের নিম্নে উল্লিখিত গানটির ছত্রেছত্রে প্রকাশ পেয়েছে:

ধিকিধিকি জ্বলে ছাই, পল্লী বা কোনো গাঁয়,
ছোট্ট সে শিশু গেল নলগিরে পুড়ে।
মুঠিতে পরাণ হায়, জঙ্গলে ছুটে যায়
দলিত মানুষ হেথা আদাড়ে বাদাড়ে।
পদে পদে অপমান, সবর্ণ হানে বাণ,
কামকাজ গেল চুকে, দলিত সে মরে ভুখে
ঠান্ডা হেঁশেলে তার আঁশটে বিচার...
জাগো রে জাগো রে সবে, এ ঘুম ভাঙবে কবে?
অবর্ণ ঘরপোড়া, এ দেশ কাহার?
বয় যদি যাক বয়ে রক্তের বন্যা,
শিরা কেটে স্নান করি, যুদ্ধ সে হোক না!
শেষের লড়াই হবে, আয় তবে আয় রে,
ইনকিলাবের দানা পুঁতবি না ভাই রে?

এই দলিত-বিদ্বেষ কিন্তু একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এ ঘৃণা নিজামের শাসনকালেও বজায় ছিল। নিজাম-বিরোধী লড়াইয়ে সামনের সারিতে ছিলেন আর্য সমাজের স্বামী রামানন্দ তীর্থ। খাতায় কলমে আর্য সমাজের জন্ম ব্রাহ্মণ্যবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে হলেও এদের নেতৃত্ব কিন্তু আদ্যপান্ত ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের মুঠোয়। এ সেই নেতৃত্ব যারা রাজাকারকের বিরুদ্ধে সংঘাত চলাকালীন পক্ষপাতদুষ্ট দলিত-হিংসার বীজ পুঁতেছিল। 'দলিতরা নিজাম সমর্থক', 'দলিত মহল্লা রাজাকারদের আশ্রয়' – এই জাতীয় মিথ্যাচারের ফলে আম্বেদকরবিরোধী সবর্ণ সমাজের মনে জমা হয় বৈরি। সুতরাং রাজাকারদের উপর পুলিশি হামলা চলাকালীন একাধিক নৃশংস হামলার শিকার হন দলিত জাতির মানুষেরা। এই জাতীয় নিপীড়নের উপর একটি রিপোর্ট বানিয়ে ডঃ আম্বেদকর ও ভারত সরকারকে পাঠিয়েছিলেন মারাঠওয়াড়া তফসিলি জাতি ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি ভাউসাহেব মোরে।

PHOTO • Keshav Waghmare
PHOTO • Keshav Waghmare

ভারতীয় দলিত প্যান্থারস্‌দের মহিলা শাখার অবসরপ্রাপ্ত উপসভাপতি কেসারাবাই ঘোটমুখের কথায়: 'আমাদের প্রতিটি বিক্ষোভে সামিল ছিলেন আত্মারাম সালভে। ঝড়ের বেগে নিত্যনতুন গান লিখতেন, আর ধুয়ো তুলে সেগুলি আমরা সমবেত কণ্ঠে গাইতাম।' ডানদিকে: শাহির অশোক নারায়ণ চৌরে জানালেন যে শিক্ষিত দলিত যুবসমাজের একটা বড়ো অংশ প্রভাবিত হয়েছিল নামান্তর আন্দোলনের দ্বারা। 'যন্ত্রণার অংশীদার ছিল আমাদের পুরো প্রজন্মটাই'

ভূমি অধিকারের যে শাশ্বত সংগ্রাম, বাবাসাহেবের পর তার নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন দাদাসাহেব গায়কোয়াড়, তাঁর স্লোগান ছিল: 'কাসেল ত্যাচি জমীন, নাসেল ত্যাচে কায়?' অর্থাৎ: লাঙল যার জমি তার, তাহলে ভূমিহীনদের কী হবে? এ বিদ্রোহের অগ্রদূত ছিল মারাঠওয়াড়ার দলিত সমাজ। লাখে লাখে মহিলা ও পুরুষ কারাবরণ করেন এ লড়াইয়ের সামিল হয়ে। জীবনধারণের খাতিরে লাখ-লাখ একর জমির দখল নেন অবর্ণ মানুষেরা। সাধারণ চারণভূমির উপর নিম্নবর্ণের এ দখলদারী ঠিক হজম করে উঠতে পারে না সবর্ণ সমাজ। তাদের মনে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে ক্ষোভ, আর এ রোষের আগুনে ঘি ছিটিয়ে দেয় বসন্তদাদা পাতিল ও শরদ পাওয়ারের রেষারেষি। একের পর এক গ্রামে ঘৃণা ও হিংসা হয়ে ফুটে ওঠে সবর্ণের এই বিদ্বেষ। নামান্তর আন্দোলন চলাকালীন নিত্যনতুন জন্ম নিত অবান্তর সব গুজব: "ইউনিভার্সিটি নীল রং করা হবে", "ডিগ্রির শংসাপত্রে ডঃ আম্বেদকরের ছবি থাকবে", "অসবর্ণ বিবাহের প্রচার করতেন বাবাসাহেব, এবার এই জোয়ান দলিতরা শিক্ষিত হলে আমাদের মেয়েদের ছিনিয়ে নিয়ে পালাবে।"

"নব-বৌদ্ধ আন্দোলনের যে মূল দর্শন, তার মধ্যেই কিন্তু মারাঠওয়াড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামান্তরের দাবিটি নিহিত। এটা যে আদতে দলিত অস্তিত্বের নিরিখে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই, সেটা বেশ স্পষ্ট, তার জন্য বৌদ্ধ দেশগুলির থেকে সাহায্য চাইছেন দলিতরা। এমনকি ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করতেও তাঁরা রাজি। সুতরাং, অবিলম্বে একটি পাকাপোক্ত ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের" – লাতুর সভার পর এই সংকল্পটি গ্রহণ করে নামান্তর বিরোধী ক্রুতি সমিতি। দলিত সমাজকে তার বসতভূমি থেকে ছিন্ন করতে তৎপর হয়ে ওঠে এই সমিতি। নামান্তর আন্দোলনটিকে হিন্দু বনাম বৌদ্ধ সংঘাতের রঙে রাঙিয়ে তোলা হয়, এবং এই জাতীয় অসত্যের প্রভাব দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নামান্তর আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে থেকেই যে মারাঠওয়াড়া জ্বলছিল, এই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে উত্তরোত্তর বেড়ে চলে সে বিদ্বেষবহ্নির শিখা। নামান্তরের লড়াই চলাকালীন শহিদ হন দলিত সমাজের ২৭জন সদস্য।

এই আন্দোলনের পরিধি শুধুই যে অস্তিত্ব ও অস্মিতা ঘিরেই যে ছিল, তা নয়, একে একে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কগুলিও মিশে যায় তার দেহে। সে জন্ম হোক অথবা বিবাহ কিংবা মৃত্যু – এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানে। বিয়েশাদি এবং শ্রাদ্ধের সময় লোকে স্লোগান দিতে শুরু করে: 'ডঃ আম্বেদকরনচা বিজয় আসো (বাবাসাহেবের জয় হোক)' এবং 'মারাঠওয়াড়া বিদ্যাপিঠাচে নামান্তর ঝালেচ পাহিজে (মারাঠওয়াড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলাতেই হবে)'। মানুষের মাঝে নামান্তরের কথা ছড়িয়ে দেওয়া থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মননের রূপান্তরের এই সংগ্রামে এক লড়াকু সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিলেন শাহির আত্মারাম সালভে।

PHOTO • Keshav Waghmare

বীডের ছাত্র সুমিত সালভে আত্মারাম সালভের গান করেন। 'শাহিরের গান ছুঁয়েছে নতুন প্রজন্মকে'

অচিরেই তাঁর জীবনের সম্পূর্ণ দখল নিল আম্বেদকরের জীবনদর্শন আর নামান্তর। তিনি বলতেন, "ইউনিভার্সিটির নামটা সরকারিভাবে পাল্টালে আমি আমার ভিটেমাটি খেত-খলিয়ান সবকিছু বেচে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের খিলানে সোনালি অক্ষরে লিখে দেব আম্বেদকরের নাম।" যুগ যুগান্তরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুক্তির মশাল জ্বালিয়ে পথে নেমেছিলেন এই মহান মানুষটি, হাতিয়ার বলতে নিজের কণ্ঠ, শব্দ ও শাহিরি। নামান্তরের কথা জনে জনে পোঁছে দিতে হাজার কষ্ট সয়ে শুধুমাত্র পদ যুগলকে সম্বল করে তিনি মহারাষ্ট্রের দশদিকে ছুটে বেড়াতেন। তাঁর কথা স্মরণ করে ঔরঙ্গাবাদের ডাঃ অশোক গায়কোয়াড় বললেন: "আমার গ্রামের নাম বোন্ডগাওহান, নান্দেড জেলায় অবস্থিত, এখনও পর্যন্ত গ্রামে আসার জন্য একটা সড়ক তৈরি হয়নি, গাড়িঘোড়া কিস্যু পাবেন না। তা সত্ত্বেও ১৯৭৯ সালে জলসা করতে আত্মারাম এসেছিলেন। আমাদের জীবনে দীপ জ্বেলে গিয়েছিল তাঁর শাহিরি, তাঁর গানে দলিতেরা খুঁজে পেয়েছিল লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা। প্রকাশ্যে বর্ণবাদী লোকদের চিহ্নিত করে দিতেন আত্মারাম। তাঁর কণ্ঠ ছিল বজ্রগম্ভীর, গলা ছেড়ে গান ধরলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ছুটে আসত, যেন দিনের শেষে আপন চাকে ফিরছে মৌমাছির দল। গানের ছোঁয়ায় শরীরে যেন নতুন করে প্রাণসঞ্চার হত। এমনই জাদু ছিল তাঁর শাহিরিতে যে মৃতস্য মৃত মননও পুনরুজ্জীবিত হয়ে নেমে পড়ত বিদ্বেষ-বিরোধী লড়াইয়ে।"

কিনওয়াতের (নান্দেড জেলা) দাদারাও কায়াপাক মহাশয়ও সযত্নে লালন করছেন আত্মারামের স্মৃতি: "সালটা ১৯৭৮, গোকুল গোন্দেগাঁওয়ে শুরু হয় দলিতদের একঘরে করা। এটার প্রতিবাদ করতে এস.এম. প্রধান, সুরেশ গায়কোয়াড়, মনোহর ভগত, অ্যাডভোকেট মিলিন্দ সার্পে এবং আমি মিলে একটা মোর্চ বার করি। ওদিকে পুলিশ তো ১৪৪ [সিআরপিসি বা ফৌজদারি দণ্ডবিধি] ধারা জারি করে রেখেছিল, জমায়েত করা বারণ। আত্মারাম সালভের নেতৃত্বে একটি জলসার আয়োজন করা হল, থমথমে পরিবেশ। ওদিকে শাহির সালভে এবং প্যান্থারস্‌দের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে সোচ্চার সবর্ণ সমাজ। পুলিশ অধ্যক্ষ শ্রুঙ্গারওয়েল এবং উপাধ্যক্ষ এস.পি. খানকে ঘেরাও করা হয়, আগুন লাগানো হয় পুলিশ গেস্টহাউজ চত্বরের পাঁচিলে। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি, পুলিশ গুলি চালায়, একজন দলিত সাফাইকর্মীসহ প্রাণ হারান কংগ্রেসের বিধায়ক তথা উত্তমরাও রাঠোড়ের বন্ধু জে. নাগরাও।"

শাহির আত্মারাম সালভের গানে বারবার ফিরে আসে মনুষ্যত্ব, সাম্য, মুক্তি, কৌমচেতনা ও ন্যায়ের কথা। তাঁর শাহিরির আকাশে নক্ষত্রসম জ্বলজ্বল করে কিছু শব্দ: লড়াই, ঠিঙ্গি (স্ফুলিঙ্গ), ক্রান্তি (ইনকিলাব), আগ (আগুন), রণ, শস্ত্র, তোপ, যুদ্ধ, নব ইতিহাস প্রভৃতি। দৈনন্দিন জীবনে বারংবার এগুলির সম্মুখীন হতেন তিনি। তাঁর প্রতিটা গানেই ফুটে উঠত যুদ্ধের ডাক:

আর দেরি নয়, এনেছি কামান
মনুর ব্যাটাকে করব খতম,
চল চল দেখি, ইতিহাস লিখি
বিদ্রোহবীজে লইব জনম।
ট্রিগারের পেটে ফুটেছে বুলেট,
হোলিকার বুকে লালচে কয়লা,
ইনকিলাবের চারাগাছ হয়ে
ভাঙ ভাঙ দেখি মনুর কেল্লা।

তেজেরাও ভাদ্রের ভাষ্যে শুনুন
'শোন্ রে দলিত ভাই, হৃদমাঝারে আঙার ছাড়া আর যে উপায় নাই'

আত্মারাম সালভে কিন্তু কখনও নিছক প্রমোদ, পয়সাকড়ি, খ্যাতি বা নাম-কামানোর জন্য গাইতেন না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে শিল্প নিরপেক্ষ হতেই পারে না, বরং দিনবদলের লড়াইয়ে অন্যতম প্রধান অস্ত্র শিল্প

একজন প্রকৃত শিল্পী ও শাহির হওয়ায় ধরি মাছ না ছুঁই পানি জিনিসটা তাঁর ধাতে ছিল না। ১৯৭৭ সালে বিহারের বেলছি গ্রামে সংঘটিত হয় দলিত বীভৎস এক গণহত্যার ঘটনা। তৎক্ষনাৎ বেলছিতে গিয়ে আন্দোলন শুরু করেন এই লোকশাহির। পুরস্কার স্বরূপ ১০ দিন জেল খাটতে হয় তাঁকে! সেই হত্যাকাণ্ড ঘিরে তিনি লিখেছিলেন:

আজি এ হেঁদুর দেশে বেলছি গেরামে
জ্বলছে আমার ভাই, মনুর হারামে
পুড়ছে মা-বোন, শিশু, পালাতে না পারে...
স্বচক্ষে দেখেছি রে হেঁদুয়ানি ধারে।

এই একই গানে তিনি তুলে ধরেছেন দলিত নেতাদের অন্তঃসারশূন্যতা ও স্বার্থপর রাজনীতির কথা:

কংগ্রেসি হাতে কেহ নাচুনি পুতুল,
কেউ বা "জনতা দলে" দেহ-মন-হিয়া, সবকিছু সঁপে দিলা ঝাঁপখানি দিয়া।
এমন অশনি ক্ষণে কেহ মারে গুল,
নেমকহারাম ব্যাটা আর.এস. গাভাই, শত্তুরে শত্তুরে মিলে গেছে তাই।

১৯৮১ সাল, গুজরাতে স্নাতকোত্তর স্তরে তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতির পড়ুয়াদের সংরক্ষণের বিরুদ্ধে নেমে আসে অতর্কিত আক্রমণ, শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে হামলা চালায় একটি সংরক্ষণ-বিরোধী দলের কর্মীরা। অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ছুরি-চাকু চালিয়ে, কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে, দাঙ্গা বাধিয়ে সে এক নারকীয় অবস্থার মুখে ফেলে দেওয়া হয় দলিতদের। আহমেদাবাদে পুড়ে ছাই হয়ে যায় দলিত মজুরদের কলোনি। সৌরাষ্ট্র ও উত্তর গুজরাতের গ্রামাঞ্চলে দলিত বসতির উপর নেমে আসে সবর্ণদের আক্রমণ। ভিটেমাটি ফেলে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন অসংখ্য দলিত মানুষ।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঝলসে ওঠে আত্মারাম সালভের কলম:

আজকেরে ভাই রিজার্ভড্ সিটের নামে,
মুনিষদের ওই ছোটাচ্ছো কালঘামে?
বড়ই মিঠা ভোটতন্ত্রের চিনি,
সব চেটে তাও খেলছ ছিনিমিনি?
আজ রাতে ভাই গুজরাতের ওই চিতা,
কালকে সে ছাই মাখবে ভারতমাতা।
ধিক্-ধিকি নয়, মাতলা আগুন জ্বলে,
আঙার মেখে নাচছ কেন? আত্মা শাহির বলে।

আত্মারাম সালভে কিন্তু কখনই নিছক প্রমোদ, পয়সাকড়ি, খ্যাতি বা নাম-কামানোর জন্য গাইতেন না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে শিল্প নিরপেক্ষ হতেই পারে না, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিনবদলের লড়াইয়ে শিল্প অন্যতম প্রধান অস্ত্র। সংখ্যায় ৩০০ ছাড়িয়ে গান লিখেছিলেন তিনি, বর্তমানে এর মধ্যে ২০০টি গান লিপিবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে আমাদের কাছে।

তাঁর গানের একটি সংকলন রয়েছে ভোকারের লক্ষণ হীরে, মারখেলের নগরবাই ভাজরকর, মুখেড়ের (সবকটিই নান্দেড জেলায় অবস্থিত) তেজেরাও ভাদ্রে এবং ফুলে পিম্পলগাঁওয়ের (বীড জেলা) মাহেন্দ্র সালভের কাছে। এছাড়াও লোকস্মৃতিতে রয়ে গেছে বহু অসমাপ্ত গান। এগুলি কার কলম-নিঃসৃত? কেউ জানে না। অথচ আজও এই গীতিমালার গুঞ্জন শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে।

আমরা সবাই জয় ভীমওয়ালে
আমাদের সর্দার ওই রাজা ঢালে

সালভের লেখা এই 'দলিত প্যান্থার মূলগীতি'-টি তখন প্রত্যেক প্যান্থারসের ঠোঁটে লেগে থাকত। মারাঠওয়াড়ার জনসাধারণের হৃদয় ও মননে আজও উজাগর হয়ে আছে গানটি।

দ্রোহনীল দ্রোহনীল, হোক ফুলকি সামিল,
বুনি আঙারে আঙার
বলো দিন কত আর, মোরা কাটাবো চুপটি করে
না করিয়া কিছু?
জ্বলছে হৃদয়বীজে,
আগামী দিনের খোঁজে
মায়ের জঠর মাঝে ছটফটে শিশু।
ভীমের সিপাই দ্রোহনীল দ্রোহনীল,
তবে জাগো রে জাগো রে হোক ফুলকি সামিল!

PHOTO • Labani Jangi

আত্মারাম গান গাইছেন সে খবর পেলেই আশপাশ তথা দূর-দূরান্ত থেকে পদব্রজে দলে দলে এসে উপস্থিত হতেন দলিত মানুষেরা

উপরোক্ত জনপ্রিয় গানটিও আত্মারামের সৃষ্টি। এছাড়াও মারাঠওয়াড়ার নামান্তর পোওয়াড়াটি লিখেছিলেন তিনি, এটির উল্লেখ তাঁর পাণ্ডুলিপির সূচিপত্রে থাকলেও আমাদের কাছে কোনও লিখিত খসড়া নেই। তবে, পুণের রিপাবলিকান পার্টি অফ ইন্ডিয়ার নেতা রোহিদাস গায়কোয়াড় এবং আম্বেদকরাপন্থী আন্দোলনের প্রবীণ মিশনারি নেতা বসন্ত সালভে সেই পোওয়াড়া (গাথাকাব্য) থেকে খানকতক পংক্তি গেয়ে শুনিয়েছেন আমাকে। ইন্দাপুর তালুকের বাওডা গ্রামের উচ্চবর্ণরা যখন দলিতদের একঘরে করে রেখেছিল, তখন সশরীরে পুণে এসে এ বস্তি থেকে সে বস্তি সংগীত পরিবেশন করেছিলেন শাহির সালভে। সেই গানগুলির হৃদয়ে ছিল যৌথ সংগ্রাম তথা সংবেদনশীলতার আখ্যান। আত্মারাম এসেছেন, এ খবর পেলেই পুঁটুলিতে ভাকরি বেঁধে আশেপাশের সমস্ত গ্রাম ঝেঁটিয়ে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তাঁর জলসায় এসে হাজির হতেন দলিতেরা। শাহিরের গান-বাজনা হয়ে গেলে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন প্যান্থার কর্মীরা। নামান্তরের আন্দোলন তথা প্যান্থারস্‌দের লড়াইয়ের আসরে চুম্বকের মতো লোক টেনে আনতেন আত্মারাম। নামদেও ধাসাল যদি [দলিত] প্যান্থার যুগের প্রতিনিধিস্থানীয় কবি হন, তাহলে সে যুগের আদর্শ চারণ অবশ্যই আত্মারাম সালভে। কাব্য যেমন নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে নামদেওয়ের কবিতায়, ঠিক তেমনই আম্বেদকরোত্তর যুগে শাহিরি তার নতুন দিশা পেয়েছে সালভের গীতিকায়। প্যান্থার যুগকে প্রকৃত রূপে বুঝতে গেলে নামদেওয়ের কবিতা আর আত্মারামের গান - দুটির একটিকেও বাদ দেওয়া চলে না। একাধারে শ্রেণি ও বর্ণচেতনা উঠে আসে ধাসালের লেখায়, তবে সালভে কিন্তু আরও এককাঠি উপরে, তাঁর গানের নিশানায় যুগপৎ বর্ণিত হয় জাত, শ্রেণি তথা লিঙ্গভিত্তিক অবদমন। নিজে যেমন প্যান্থারস্‌দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনই প্যান্থার তথা ওই যুগের মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিলেন আত্মারাম। অপার সাহস ও সাধনায় ব্রতী হয়ে একে একে নিজের উচ্চশিক্ষা, চাকরি, ঘরদুয়ার, সবকিছু ছেড়েছুড়ে করে আত্মত্যাগের রাস্তায় পা বাড়ান তিনি।

নামদেও ধাসাল যদি দলিত প্যান্থার যুগের প্রতিনিধিস্থানীয় কবি হন, তাহলে সে যুগের আদর্শ চারণ অবশ্যই আত্মারাম সালভে

সুমিত সালভের কণ্ঠে শুনুন
'আর কতদিন থাকবি বেঁধে মান্ধাতার ওই কাঁথা?'

দুই দশকেরও বেশি সময় জুড়ে আত্মারাম সালভের বন্ধু ছিলেন ভাসাইয়ের প্রাক্তন বিধায়ক বিবেক পণ্ডিত। তাঁর কথায়: "ভয় ও স্বার্থচিন্তা – আত্মারামের অভিধানে এ দুটো শব্দ ছিল না।" নিজের কণ্ঠ ও শব্দমালার উপর অভূতপূর্ব দখল ছিল সালভের। যতটুকু জানতেন, ততটুকুর উপর বজ্রসম পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। মারাঠি ছাড়াও হিন্দি, উর্দু এবং ইংরেজি ভাষায় সাবলীল ছিলেন, এমনকি হিন্দিতে বেশ কয়েকটি কাওয়ালিও গেয়েছেন তিনি। তবে একটিবারের জন্যও নিজের শিল্পকে বিক্রির বা খোলা বাজারে নিয়ে আসার কথা ভাবেননি। জাতপাত-শ্রেণি-লিঙ্গের বিরুদ্ধে একনিষ্ঠ এক সেপাই হয়ে মৃত্যু অবধি একলা একলাই লড়ে গেছেন আত্মারাম, অস্ত্র বলতে তাঁর শিল্প, তাঁর শব্দজাল ও আকণ্ঠ ভীমনাদ।

যে কোনও শিল্পীর কাছে পরিবার, আন্দোলন ও পেশা তাঁর মানসিক অবলম্বনের প্রধান উৎস। গণআন্দোলনের দ্বায়িত্ব এগুলিকে একত্রিত করে এমন একটি বিকল্প পরিসরের সৃষ্টি করা যেখানে বিপ্লবী তথা লোকশিল্পীরা সুস্থভাবে বেঁচে থেকে নিজেকের কর্মযজ্ঞ বজায় রাখতে পারেন – অর্থাৎ এমন এক আশ্রয় যেখানে বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব তাঁদের গ্রাস করবে না।

শিল্পীরা যাতে মানসিক অবসাদের গহ্বরে তলিয়ে না যান, আম্বেদকরপন্থী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। এমনকি অবসাদগ্রস্ত শিল্পীরা যে ন্যূনতম কোনও সাহায্য পেয়েছেন, সেকথাও বলা চলে না। ফলত খুব স্বাভাবিকভাবেই আত্মারাম সালভের মতো এক ক্ষণজন্মা লোকশাহিরের যে পরিণতি হওয়ার ছিল, সেটাই হয়েছে।

জীবনের অন্তিম অধ্যায়ে তিনটি ধাপেই চরম নিরাশার সঙ্গে ঘর বাঁধতে বাধ্য হন আত্মারাম সালভে। আন্দোলনের জেরে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিবার। নেশার আসক্তি (মদ) তাঁকে ঠেলে দেয় অতল আঁধারে। শেষদিকে মানসিক ভারসাম্যটুকুও হারিয়ে যেতে থাকে। নিভু নিভু জীবনের পিলসুজ, সে অবস্থাতেও কেউ গান গাইতে বললে হুট করে যত্রতত্র দাঁড়িয়ে প্রকৃত শাহিরের মতো গাইতে শুরু করতেন – সড়কের মাঝখানে, শহরের মোড়ে, সে যেখানেই হোক না কেন। নেশার ভারে ডুবতে ডুবতে অবশেষে ১৯৯১ সালে শহিদ হন শাহির। একদা যে মানুষটি প্রাণপাত করেছিলেন নামান্তরের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নামটি আর সোনালি আখরে খিলানগাত্রে লেখা হয়নি তাঁর।

মূল প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে মারাঠি ভাষায়।

পোওয়াড়াগুলি মারাঠি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন: নমিতা ওয়াইকর।

এই প্রতিবেদনটি লিখতে সাহায্য করেছেন ভোকারের লক্ষণ হীরে, নান্দেডের রাহুল প্রধান এবং পুণের দয়ানন্দ কণকদণ্ডে। তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছেন লেখক।

এই মাল্টিমিডিয়া প্রতিবেদনটি 'প্রভাবশালী শাহিরবৃন্দ, মারাঠওয়াড়ার গাথা' (ইনফ্লুয়েনশিয়াল শাহিরস্, ন্যারেটিভস্ ফ্রম মারাঠওয়াড়া) নামে একটি সংকলনের অংশবিশেষ, পিপলস্ আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার সহযোগিতায় এই প্রকল্পটি আর্কাইভস্ অ্যান্ড মিউজিয়াম প্রোগ্রামের আওতায় রূপায়িত করেছে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস। নয়াদিল্লির গ্যোটে ইন্সটিটিউট/ম্যাক্স ম্যুলার ভবনের আংশিক সাহায্য না পেলে এই কাজটি সম্ভবপর হত না।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Keshav Waghmare

মহারাষ্ট্রের পুণে নিবাসী লেখক ও গবেষক কেশব ওয়াঘমারে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত দলিত আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের (ডিএএএ) প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। বহু বছর ধরে মারাঠওয়াড়ার কৌম সমাজগুলির দস্তাবেজিকরণের কাজে নিযুক্ত আছেন তিনি।

Other stories by Keshav Waghmare
Illustrations : Labani Jangi

২০২০ সালের পারি ফেলোশিপ প্রাপক স্ব-শিক্ষিত চিত্রশিল্পী লাবনী জঙ্গীর নিবাস পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। তিনি বর্তমানে কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাঙালি শ্রমিকদের পরিযান বিষয়ে গবেষণা করছেন।

Other stories by Labani Jangi
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার (পারি) ভারতীয় ভাষাবিভাগ পারিভাষার কন্টেন্ট ম্যানেজার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল উত্তীর্ণ জশুয়া একজন বহুভাষিক কবি তথা অনুবাদক, শিল্প সমালোচক এবং সমাজকর্মী।

Other stories by Joshua Bodhinetra