তামিলনাডুর আর পাঁচটা জায়গার মতো থুথুকুডি শহর জুড়ে লোকে রাস্তায় নেমে এলো – তাদের দলে যোগ দিতে দৌড়ে এলো ছোট্টো একটি ছেলে। মুহূর্তের মধ্যে প্রতিবাদী জনতার মধ্যে মিশে গিয়ে বিপ্লবী স্লোগান দিতে শুরু করল। “আজকের দিনে বসে হয়তো আপনার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়,” তিনি বলছিলেন আমাদের, “কিন্তু ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি তামিলনাড়ুর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক আবেগময় মুহূর্ত ছিল। মানুষ হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিল, কত কত লোককে কাঁদিয়েছিল এই ঘটনা।”
“আমার বয়স তখন সবে নয় বছর,” মুচকি হাসেন তিনি।
আজ, তিনি ৯৯ বছরে পা দিলেন (১৫ই জুলাই, ২০২০), কিন্তু আজও অমলিন সেই তেজ এবং উদ্দীপনা যার জোরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী, লেখক, সুবক্তা এবং বিদ্রোহী বুদ্ধিজীবী। ব্রিটিশ সরকারের কারাগার থেকে তিনি ছাড়া পান ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট। “বিচারক সেদিন নিজে সেন্ট্রাল জেলে এসে আমাদের মুক্তি দেন। আমরা মাদুরাই ষড়যন্ত্র মামলায় খালাস পেলাম। মাদুরাই সেন্ট্রাল জেল থেকে বেরিয়েই আমি স্বাধীনতার মিছিলে যোগ দিলাম।”
শতাব্দী স্পর্শ করে এখনও বৌদ্ধিকভাবে সক্রিয় শঙ্করাইয়া। এখনও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, বক্তৃতা দেন। এমনকী ২০১৮ সালের শেষের দিকে, চেন্নাইয়ের শহরতলির ক্রোমপেটে তাঁর বাড়ি, যেখানে আমরা তাঁর সাক্ষাত্কার নিচ্ছিলাম, সেখান থেকে মাদুরাই গিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর প্রগতিশীল লেখক এবং শিল্পীদের জমায়েতে বক্তৃতা দিতে। স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার জন্য যে মানুষটি স্নাতক স্তরের পড়াশোনাই শেষ করে উঠতে পারেননি তিনিই পরবর্তীকালে অসংখ্য রাজনৈতিক পত্রিকা, পুস্তিকা, প্রচারপত্র এবং সংবাদ-নিবন্ধ লিখেছেন।
১৯৪১ সালে মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য আর ফাইনাল পরীক্ষায় বসা হয়নি নরসিমহালু শঙ্করাইয়ার, নইলে মাদুরাইয়ের আমেরিকান কলেজ থেকে তিনি সহজেই ইতিহাসে বি.এ. পাস করে ফেলতেন। “আমি কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক ছিলাম।” মেধাবী ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি তিনি কলেজের কবিতা সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং ফুটবলে কলেজের প্রতিনিধিত্বও করেছেন। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন শঙ্করাইয়া। “কলেজের দিনগুলিতে, বাম আদর্শে বিশ্বাসী বহু মানুষের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে স্বাধীনতা না পেলে ভারতবর্ষের সামাজিক সংস্কার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” ১৭ বছর বয়সেই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন (পার্টি তখন নিষিদ্ধ এবং আন্ডারগ্রাউন্ড)।
আমেরিকান কলেজের মনোভাব ইতিবাচক ছিল বলেই তাঁর মনে পড়ে। “পরিচালক এবং শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন আমেরিকান, বাকিরা তামিল। তাঁরা নিরপেক্ষ হলেও, ব্রিটিশপন্থী ছিলেন না। পড়ুয়াদের ক্রিয়াকলাপ অনুমোদিত ছিল…” ১৯৪১ সালে, ব্রিটিশবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার জন্য আন্নমালাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মীনাক্ষীকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে মাদুরাইয়ে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। “এবং আমরা এই উপলক্ষ্যে একটা প্রচারপুস্তিকা ছেপেছিলাম। আমাদের ছাত্রাবাসের ঘরগুলিতে পুলিশ হানা দেয় এবং এই প্যামফ্লেট রাখার জন্য নারায়ণস্বামীকে (আমার বন্ধু) গ্রেপ্তার করে। পরে আমরা তার গ্রেপ্তারের ঘটনার নিন্দা জানাতে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলাম...”
“এর পরে, ১৯৪১ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি, আমার ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক ১৫ দিন আগে ব্রিটিশ সরকার আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমি আর কলেজে ফিরে আসিনি, বিএ শেষও করিনি।” গ্রেপ্তারের এই মুহূর্তটি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি কয়েক দশক পরে বলবেন, “ভারতের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা, স্বাধীনতার জন্য কারাগারে যাওয়া এসব আমার জন্য গর্বের বিষয়। এটাই তখন আমার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান ছিল।” এতে যে তাঁর পেশাজীবন গোল্লায় গেল তা নিয়ে তাঁর মোটেও কোনও বক্তব্য নেই। এই গল্প মনে করায় তৎকালীন বিদ্রোহী যুবসমাজের প্রিয় স্লোগান: “আমরা নই চাকরি শিকারী; আমরা স্বাধীনতার দিশারী।”
“১৫ দিন মাদুরাই কারাগারে রাখার পর আমাকে ভেলোর জেলে পাঠানো হল। সেইসময় তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালার আরও অনেককেই ওখানে আটক করে রাখা হয়েছিল।”
“কমরেড এ কে গোপালনকে [কেরালার প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা] একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য ত্রিচি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একই সঙ্গে এই অনুষ্ঠান থেকে কেরালার অন্যান্য কমরেডদের মধ্যে ইম্বিচি বাভা, ভি সুব্বাইয়া, জীবানন্দমকেও আটক করা হল। তাঁরা সবাই ভেলোর জেলেই ছিলেন। মাদ্রাজ সরকার আমাদের দুটি দলে ভাগ করার চেষ্টায় ছিল যার মধ্যে একটি ‘সি’ স্তরের রেশন পাবে, যা বরাদ্দ ছিল দাগী অপরাধীদের জন্য। আমরা এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ১৯ দিনের অনশন ধর্মঘট করলাম। দশ দিনের মধ্যে, তারা আমাদের দুটি দলে ভাগ করে দেয়। আমি তো তখনও ছাত্র।”
কারাগারগুলির মহাপরিদর্শক জেলকক্ষে কিশোর শঙ্করাইয়াকে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘ মা ’ পড়তে দেখে যারপরনাই আশ্চর্য। “’ভুখ হরতালের দশমতম দিনে অনশনে থাকা অবস্থায় তুমি কিনা সাহিত্য পড়ছো - গোর্কির ‘ মা ’ ?” স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে শঙ্করাইয়ার চোখগুলি কৌতুকে চকচক করে ওঠে।
অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের আলাদা কারাগারে রাখা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন “কামরাজার [কে. কামরাজ, ১৯৫৪-৬৩ – এই সময়কালে মাদ্রাজ রাজ্য অর্থাৎ আজকের তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন], পট্টভী সীতারামাইয়া [স্বাধীনতা লাভের পরপরই কংগ্রেস সভাপতি হয়েছিলেন] এবং আরও অনেকে। তাঁরা অবশ্য এই বাড়িটিতে ছিলেন না, তাঁদের রাখা হয়েছিল অন্য একটি কারাগারে। কংগ্রেসিরা অবশ্য অনশন ধর্মঘটে অংশ নেননি। তাঁদের বক্তব্য ছিল: ‘আমরা মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শ অনুসরণ করব’। যা হল: ‘কারাগারে কোনও আলোড়ন তুলবে না’। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে কিছু দাবি মানা হলে আমরা ১৯ দিনের মাথায় অনশন তুলে নিয়েছিলাম।”
শঙ্করাইয়া বলছিলেন তীব্র নীতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও, “কামরাজার কমিউনিস্টদের খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। মাদুরাই এবং তিরুনেলভেলি কারাগারে জেলকুঠুরিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন যে বন্ধুরা তাঁরা ছিলেন কমিউনিস্ট। আমি কামরাজারের খুব কাছের মানুষ ছিলাম। তিনি আমাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের চেষ্টাকে রুখতে একাধিকবার হস্তক্ষেপ করেছিলেন। একথাও ঠিক যে কারাগারে [কংগ্রেসি এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে] প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হত, বিশেষ করে যখন জার্মান-সোভিয়েত যুদ্ধ শুরু হল।
“কিছুদিন পরে, আমাদের মধ্যে আটজনকে রাজামুন্দ্রি (বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশে] কারাগারে স্থানান্তরিত করে একটি পৃথক বাড়িতে রাখা হল।”
“১৯৪২ সালের এপ্রিলের মধ্যে সরকার আমাকে বাদে সমস্ত ছাত্রকে মুক্তি দিল। হেড ওয়ার্ডেন এসে জিজ্ঞাসা করলেন: ‘শঙ্করাইয়া কে?’ এবং তারপরে জানালেন যে সবাই ছাড়া পেয়েছে - আমি বাদে। একমাস ওই বাড়িতে আমিই একা বন্দি ছিলাম!”
তাঁর এবং অন্যান্য বন্দিদের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আনা হয়েছিল? “কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই আটক করে রাখা হয়েছিল। প্রতি ছয় মাস অন্তর তারা আটক করার কারণ উল্লেখ করে লিখিত নোটিশ পাঠাত। কারণগুলি এইরকম: রাষ্ট্রদ্রোহ, কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ ইত্যাদি। আর আমরা একটি কমিটিতে এই নোটিশের উত্তরে আমাদের লিখিত প্রতিক্রিয়া জমা দিতাম যা অবশ্যই ওই কমিটি প্রত্যাখ্যান করত।”
ঘটনাচক্রে, “আমার যেসব সঙ্গী রাজামুন্দ্রি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিল রাজামুন্দ্রি স্টেশনে তাদের সঙ্গে কামরাজের দেখা হয়ে গল, - তিনি তখন কোলকাতা থেকে ফিরছিলেন। যখন জানতে পারলেন যে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি, তিনি মাদ্রাজের মুখ্যসচিবকে এই মর্মে চিঠি লিখলেন যে আমাকে যেন অবশ্যই আবার ভেলোর কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। তিনি আমাকেও একটি চিঠি লিখেছিলেন। একমাস পরে আমাকে ভেলোর কারাগারে পাঠানো হল - সেখানে আমি প্রায় ২০০ জন সহকর্মীর সঙ্গে ছিলাম।”
এক জেল থেকে অন্য জেলে শঙ্করাইয়া যখন চক্কর কাটছিলেন, এমনই এক সময়ে তাঁর সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যত রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটরমণের দেখা হয়। “১৯৪৩ সালে কারাগারে থাকাকালীন, তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন। পরে অবশ্য তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। এতদসত্ত্বেও, আমরা বেশ কয়েকবছর একসঙ্গে কাজ করেছি।”
আমেরিকান কলেজ - এবং বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনের শরিক শঙ্করাইয়ার সমসাময়িক অনেকেই স্নাতক হওয়ার পর সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের কেউ তামিলনাড়ুর মুখ্যসচিব হলেন, কেউ বা হলেন বিচারক, কেউ আবার আইএএস অফিসার হয়ে কয়েক দশক আগে মুখ্যমন্ত্রীর সচিব হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও শঙ্করাইয়া বারবার কারাগারে গেছেন। ১৯৪৭ সালের আগে যেসব কারাগারে থেকেছেন তার মধ্যে আছে - মাদুরাই, ভেলোর, রাজামুন্দ্রি, কান্নুর, সালেম, তাঞ্জাভুর…
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার একবার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। ১৯৫০ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং বছরখানেক পরে মুক্তি পান। ১৯৬২ সালে, ভারত-চিন যুদ্ধের সময় যে অসংখ্য কমিউনিস্টদের কারাবন্দি করা হয়, শঙ্করাইয়া ছিলেন তাঁদের একজন, এই দফায় তিনি সাতমাসের জন্য জেলে ছিলেন। ১৯৬৫ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার দমনমূলক পদক্ষেপ নিলে আরও একবার শঙ্করাইয়াকে ১৭ মাস জেলে কাটাতে হয়।
স্বাধীনতার পরেও যাঁদের দমন-পীড়নের লাগাতার লক্ষ্য ছিলেন শঙ্করাইয়া, তাঁদের প্রতি বিন্দুমাত্র তিক্ততা নেই তাঁর মনে। তাঁর জন্য এইসবই ছিল রাজনৈতিক লড়াই, ব্যক্তিগত নয়। ব্যক্তিগত লাভের কথা চিন্তা না করে সারাটা জীবন ধরে তিনি পৃথিবীর নিপীড়িত হতভাগা মানুষের জন্য লড়াইয়ে নিজেকে নিয়োগ করেছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বা অনুপ্রেরণামূলক মুহূর্ত কোনগুলি তাঁর কাছে?
“অবশ্যই ব্রিটিশ সরকারের হাতে ভগত সিংয়ের ফাঁসি [২৩শে মার্চ, ১৯৩১]। ১৯৪৫ সালে শুরু হওয়া ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির [আইএনএ] সদস্যদের বিচার, এবং ১৯৪৬ সালে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির [আরআইএন] বিদ্রোহ।” এইগুলোই “সেই যুগান্তকারী ঘটনা যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে শক্তি যুগিয়ে তাকে তীব্রতর করে তুলেছিল।”
পরবর্তী দশকগুলিতে বামপন্থী আদর্শের প্রতি সঙ্গে তাঁর যোগ এবং দায়বদ্ধতা দুটোই আরও গভীর হয়। আজীবন তিনি পার্টির হোলটাইমার থেকেছেন।
“১৯৪৪ সালে আমি তাঞ্জাভুর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মাদুরাই জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। ২২ বছর ধরে আমি দলের রাজ্য কমিটির নির্বাচিত সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছি।”
জনতাকে সংগঠিত করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল শঙ্করাইয়ার, মাদুরাই ১৯৪০এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, বামপন্থীদের একটি অন্যতম প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। “পি সি জোশি [সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক] যখন ১৯৪৬ সালে মাদুরাই এলেন, তখন সেই সভায় হাজির মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ। আমাদের বহু সভাতেই এইরকম বিশাল ভিড় হত।”
তাঁদের এই ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত ব্রিটিশরা [তামিলনাড়ুর কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয় নেতা] পি রামমূর্তিকে মূল অভিযুক্ত, শঙ্করাইয়াকে দ্বিতীয় অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে এবং সিপিআইয়ের আরও বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে এক মামলা সাজালো যা ‘মাদুরাই ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসাবে পরিচিত। তাঁদের বিরুদ্ধে পার্টি কার্যালয়ে বসে অন্যান্য ইউনিয়ন নেতাদের হত্যার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনা হয়। মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন জনৈক ঠেলাওয়ালা, পুলিশের বক্তব্য ছিল নেতাকর্মীদের কথা শোনার পর কর্তব্যপরায়ণ মানুষটি কর্তৃপক্ষকে সব কথা জানান।
২০০৮ সালে প্রকাশিত এন রামকৃষ্ণণ (শঙ্করাইয়ার ছোটো ভাই) রচিত ‘ পি রামমূর্তি : আ সেন্টিনারি ট্রিবিউট’ এই জীবনীগ্রন্থে লিখছেন, “তদন্ত চলাকালীন, রামমূর্তি [যিনি নিজেই নিজের হয়ে মামলাটিতে সওয়াল-জবাব করেন] প্রমাণ করেছিলেন যে মামলার প্রধান সাক্ষীটি বহুবার জেলফেরত এক প্রতারক ও ছিঁচকে চোর।” যে বিশেষ বিচারকের অধীনে এই মামলার শুনানি হচ্ছিল তিনি “১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট কারাগারে এসেছিলেন... আর এই মামলায় জড়িত সকলকে মুক্তি দিয়ে শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে এই মামলা করার জন্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।”
অতীতের এই ঘটনার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে - অবশ্য একজন বিশেষ বিচারক কারাগারে সশরীরে হাজির হয়ে নির্দোষ বন্দিকে মুক্তি দেবেন এবং সরকারের কৃতকর্মের জন্য তার জন্য নিন্দা করবেন এমনটা আমাদের সময়ে অসম্ভব বলেই মনে হয়।
১৯৪৮ সালে সিপিআই নিষিদ্ধ হওয়ার পরে, রামমূর্তি এবং অন্যান্য নেতাদের আবার জেল হল – আর এসবই হচ্ছিল স্বাধীন ভারতে। সামনেই ছিল নির্বাচন, আর বামপন্থীদের জনপ্রিয়তা মাদ্রাজের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
“রামমূর্তি কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকাকালীনই জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে তাঁর মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের মাদ্রাজ নির্বাচনে মাদুরাই উত্তর বিধানসভা আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আমি ছিলাম তাঁর প্রচারের দায়িত্বে। অন্য দুজন প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা চিদাম্বরম ভারতী এবং জাস্টিস পার্টির পি টি রাজন। জেলে আটক থাকাকালীনই ফলাফল ঘোষণা করা হল, রামমূর্তি ভালোভাবেই নির্বাচন জিতলেন। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ভারতী এবং রাজনের জামানত বাজেয়াপ্ত হল। নির্বাচনে রামমূর্তির জয় উদযাপন করতে যে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল তাতে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল।” স্বাধীনতা লাভের পর তামিলনাড়ু বিধানসভায় বিরোধী দলের প্রধান নেতা হিসাবে উঠে এলেন রামমূর্তি।
১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলে শঙ্করাইয়া সদ্য গঠিত সিপিআইএম দলে যোগ দেন। “১৯৬৪ সালে সিপিআইয়ের জাতীয় কাউন্সিলের সভা থেকে বেরিয়ে আসা ৩২ জন সদস্যের মধ্যে আমি এবং ভি এস অচ্যুতানন্দনই এখনও বেঁচে আছি।” দেড় কোটি সদস্য সম্বলিত ভারতের বৃহত্তম কৃষক সংগঠন সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শঙ্করাইয়া এবং পরবর্তীকালে তিনি সভাপতিও হয়েছেন। সাত বছর সিপিআইএমের তামিলনাড়ুর রাজ্য সেক্রেটারি এবং দুই দশকেরও বেশি সময় জুড়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
তাঁর জন্য অশেষ গর্বের বিষয় যে, “আমরাই প্রথম তামিলনাড়ু বিধানসভায় তামিল ভাষার ব্যবহার শুরু করেছিলাম। ১৯৫২ সালে তামিলনাড়ু বিধানসভায় তামিল ভাষায় কথা বলার কোনও রীতিই ছিল না, আদানপ্রদানের একমাত্র মাধ্যম ছিল ইংরেজি, কিন্তু [আমাদের বিধায়করা] জীবানন্দম এবং রামমূর্তি তামিল ভাষাতেই কথা বলতেন যদিও তা স্বীকৃতি পায় আরও ছয় সাত বছর পরে।”
শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী জনতার প্রতি শঙ্কারাইয়ার দায়বদ্ধতা অমলিন থেকেছে। তাঁর বিশ্বাস, “কমিউনিস্টরা নির্বাচনী রাজনীতি ঘিরে সঠিক উত্তরের সন্ধান পাবেন” এবং বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তুলবেন। দেড় ঘন্টা হয়ে গেল সাক্ষাত্কারের, এখনও এই ৯৯ বছর বয়সী মানুষটির কথাবার্তায় সেই উদ্দীপনা আর আবেগ যা ইন্টারভিউয়ের শুরুতে ছিল। তাঁর মধ্যে আজও বজায় আছে সেই ৯ বছর বয়সী কিশোরের উদ্যম যে ভগত সিংয়ের ত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে পথে নেমে এসেছিল।
পুনশ্চ : এই কাহিনি রচনায় অমূল্য অবদানের জন্য কবিতা মুরলিধরনকে অশেষ ধন্যবাদ।
বাংলা অনুবাদ : স্মিতা খাটোর