রান্নাবান্না
শেষ হয়ে গেলে অন্যদিন সে টিভি দেখতে বসে, কিন্তু আজ আর বসলো না। ছেলেমেয়েরা জেদ
ধরেছে আজ রাত্রে ভাতের সঙ্গে রঙবেরঙের সবজি দেওয়া সেজুয়ান সস্ খাবে। যে ছেলেটা
সকালবেলায় ঠেলাগাড়িতে করে সবজি নিয়ে আসে আজ তার কাছে লাল বা হলুদ রঙের
ক্যাপসিকাম ছিল না। "আড়ত বন্ধ করে দিয়েছে দিদি। লকডাউন তো চলছেই, তার উপরে
এই নাকাবন্দি। কোথা থেকে এসব সবজি পাবো? যা যা এনেছি সেগুলোও তো সরাসরি খেত থেকে
পেয়েছি," ঠেলাগাড়ি থেকে রোজ রোজ সেই একঘেয়ে সবজি কিনতে কিনতে মহিলা বিরক্ত
হয়ে যাচ্ছে দেখে দুঃখ করছিল ছেলেটা।
ছেলেটা বকবক
করেই যাচ্ছে, হাজার একটা দুঃখের গল্প তার। সেসব এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে
বার করে দিচ্ছিল মহিলা। আনমনে ভাবছিল ছেলেমেয়ের বায়না মেটাতে ঠিক কোন রেসিপি
ব্যবহার করলে ভালো হয় রাতের খাবারের জন্য। তবে দিনের শেষে নিজেই নিজেকে চমকে দিল
সে কোক সহযোগে চাইনিজ-থাই গ্রেভি রান্না করে! বাচ্চারাও চুপচাপ মনের আনন্দে খেয়ে
নিল সবটা। তবে মনটা তাও কেমন একটা যেন খচখচ করছিল, ধুর, টিভি দেখতে আর ভালো লাগে
না আজকাল!
সবচাইতে অসহ্য লাগে
তার এই খবরের চ্যানেলগুলো। ফাটা রেকর্ডের মতন সেই একই ছবি দেখিয়ে চলেছে ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে। বস্তিতে খাওয়ার জল নেই, মেথরদের ঠিকঠাক সাজ সরঞ্জাম নেই, আরও কত কী
ভয়াবহ সব জিনিস – লাখে লাখে কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকেরা আটকা পড়েছে মাঝপথে,
বাড়ি ফিরতে পারছে না, অসহায় অবস্থায় শহরে বন্দরে বন্দি হয়ে আছে, ওষুধ নেই,
খাবার নেই, মৃত্যু, মৃত্যু, কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে, কেউ বা বিক্ষোভে প্রতিবাদে
ফেটে পড়ছে রাস্তায় রাস্তায়।
উন্মাদ পোকামাকড়ের দল! ঘুণপোকা! কাঁহাতক এদের এই আস্ফালন দেখা যায় আর?! সে আবার হোয়াটসঅ্যাপ খুলে বসলো, গ্রুপে কয়েকজন বন্ধু নতুন নতুন রান্নাবান্নার আজব সব কায়দা শেয়ার করছে। সে নিজের হাতে সাজানো ডিনার টেবিলের একটা ছবি তুলে পোস্ট করলো। আরেকটা গ্রুপে লোকজন একের পর এক অদ্ভুত সব ভিডিও শেয়ার করছে, মুম্বইয়ের ব্রীচ ক্যান্ডি ক্লাবের কাছে সাগরে ক্রীড়ারত ডলফিন, নভি মুম্বইয়ে ফ্লেমিংগোর ঝাঁক, কালিকটের রাস্তায় দেখতে পাওয়া মালাবারের ভামবেড়াল কিংবা চণ্ডীগড়ে ক্যামেরাবন্দি শম্বর হরিণ... হঠাৎ সে দেখতে পেল তার মোবাইল বেয়ে সারি সারি লাল পিঁপড়ে উঠে আসছে!
রক্তধারা
একফালি জানলাতে দেখি —
সারি সারি অশরীর
হেঁটে যায়
খুঁটে খায়
আঁকাবাঁকা দোটানায়,
রান্নঘরের কোনে
ঠিক যেন
পিঁপড়ের মতো —
নোনতা ঠিকানা খোঁজে
হাসি
হাসি অসুখের ব্রত।
বাচ্চারা খেলছে না,
শিশুরা তো কাঁদছে না,
শুনসান সড়কের ইস্তফা বুঝে
নিয়ে,
কাহনে কাফন ছুঁয়ে
শহর শহর
সে তো লাল —
নাকি খিদে খিদে আঁশটে সকাল?
একফালি জানলাতে দেখি —
মাথায় দেশের বোঝা,
হেঁটে
চলে অশরীর,
মনে তার আতঙ্ক
খিদে খিদে
নীল –
মাইল মাইল তারা
বোঝে কেন
রাস্তারা
পায়ের পাতার থেকে
কেড়ে
নেয় রক্ত জটিল।
রাজপথে রক্তিমে,
পোড়ামাটি
পশ্চিমে,
লিখে রাখে ব্যথা অনাবিল৷
লালচে সে পৃথিবীতে,
কে যাবে
আকাশ নিতে?
হাতে কার খিদের দলিল?
একফালি জানলাতে দেখি —
শুকনো স্তনের বোঝা,
শিশুরা রেখেছে রোজা,
টকটকে
সোহাগী ফড়িং।
পৌঁছেছে কেহ ঘরে,
কেউ বা পথের ধারে,
কারও গায়ে ছড়ানো ব্লিচিং।
কেউ বা বোঝাই ট্রাকে,
আলোনা
খিদের ফাঁকে,
সনাতনী সস্তা আফিং।
একফালি জানলাতে দেখি —
দিনের কালিমা মুছে
আকাশ
আবার হল লাল৷
খিদে খিদে বাস্তবে,
খেলনা
ভাঙার স্তবে
পৃথিবী ভুলেছি ক্ষণকাল৷
সিলিংয়ে কাদের দল,
টেবিলে,
খাটের তল?
বাথরুমে সিঁধ কাটে কারা?
সমাজের খিড়কিতে,
আঁধারে
আঁচল পেতে
আরশোলা চুরি করে যারা।
অডিও: সুধন্য দেশপাণ্ডে জন নাট্য মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা ও পরিচালক, সেই সঙ্গে তিনি লেফ্টওয়ার্ড বুকস্-এর একজন সম্পাদকও।
গদ্যাংশ অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)