“ এহ কোমল! কায় মাল আহে!” “এহ লাল, চান দিস্তে! ” এইসব টিটকিরি ভেসে এল পুরুষ দর্শকদের মধ্যে থেকে। মঞ্চে নৃত্যরত পঞ্চদশী কোমল, তার পোশাকের রঙ লক্ষ্য করে বা সরাসরি নাম ধরে দর্শকদের ছুঁড়ে দেওয়া টিটকিরিতে এখন একরকম অভ্যস্ত। কোমলের কথায়, “কিছু কিছু দর্শকের মধ্যে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য রীতিমত প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে। একজনের দিকে তাকালে তার বন্ধু তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে বলবে, ওর দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, ওর কিন্তু প্রেমিকা আছে! আমার দিকে তাকাও’।”
কে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেল তা নিয়ে অবশ্য মঙ্গলা বানসোডে এবং নীতীন কুমার তামাশা মণ্ডলের নর্তকীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। অষ্টাদশী কাজল শিন্দে জানায়, তারাও পুরুষ দর্শকদের আরও জোরে শিস্ এবং টিটকিরি দিতে উৎসাহ জোগায়। দর্শকদের লক্ষ্য করে তারা বলে, “আরে তুমি খাওয়াদাওয়া করোনি নাকি... তোমার শরীর ভালো তো?” “তোমার কথা আমরা মোটেই শুনতে পাচ্ছি না!” কানে হাত রেখে, অঙ্গভঙ্গি করে নর্তকীরা।
কাজল এই দলের প্রধান নর্তকীদের একজন, আরেকজন কোমল। প্রায় ১৫০ জন শিল্পী, শ্রমিক এবং কারিগরের এই
ফড
অর্থাৎ দলটির কর্ণধার অভিজ্ঞ তামাশা শিল্পী মঙ্গলা বানসোডে। মহারাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলে তামাশা এখনও একটি জনপ্রিয় লোক শিল্প হিসেবে সমাদৃত। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত মরশুমে সময়
ফডগুলি
মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে তামাশা প্রদর্শন করে, ফলে বছরের এই কয়েক মাস জুড়ে তাঁরা প্রায় প্রতিদিন এক স্থান থেকে অন্যত্র যাত্রা করেন। রাত ১১টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়, চলে ভোর রাত পর্যন্ত। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে মুক্তমঞ্চ প্রস্তুত করা হয়, অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরেই সবকিছু আবার গোটানোর পালা চলে। মঙ্গালাতাঈয়ের দলটি সফলতম
ফডগুলির
একটি; অন্যান্য অনেক দলই বর্তমানে টিকিটের বিক্রি এবং লাভের হার কমে যাওয়ায় কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। (দ্রষ্টব্য: ‘
তামাশার কারাগারে আমি চিরদিন বন্দি থাকতে চাই
’ এবং ‘
তামাশা: সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা এক শিল্প
’)
তাঁর ফড -এর অনুষ্ঠানে, মঞ্চ সাজানো হয় রঙিন আলোয়, সঙ্গে থাকে বিশাল বিশাল স্পিকার। গানের নাটকীয় মুহূর্তগুলিতে সার দিয়ে রাখা যন্ত্রের সাহায্যে মঞ্চে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে ওঠে। আবার কিছু কিছু গানের সময় নর্তকীরা মঞ্চের কোণে রাখা ধাতব পোলে আরোহণ করেন। আহমেদনগর জেলার শেভগাঁও উপজেলার শেভগাঁও গ্রাম থেকে আসা কোমল জানালেন “মাঝে মাঝে, পোলগুলো থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। তাই আমরা সর্বদাই খুব সতর্ক থাকি।”
টিকিটের কাটতির উপর তামাশা দলের সাফল্য নির্ভর করে - আর একটা অনুষ্ঠান কত বেশিমাত্রায় দর্শকদের উচ্চগ্রামে চিৎকার, তারিফ জোটাতে সক্ষম হচ্ছে তার সঙ্গে টিকিট বিক্রির ব্যপারটা সরাসরি যুক্ত। “আমরা দর্শকদের জোরে জোরে শিস্ দিতে অনুরোধ করি, কারণ একমাত্র জনতা আমাদের অনুষ্ঠান উপভোগ করলে তবেই তামাশার দম বাড়ে,” কাজল বলছেন।
দর্শকদের মধ্যে থেকে যখন জনপ্রিয় গানের জন্য “আর একবার হোক” চিৎকার ভেসে আসে, তখন, দলের সদস্যদের সেই আবদার মেনে চলতেই হয়। ৬৬ বছর বয়সী মঙ্গালাতাঈয়ের বক্তব্য, “আমরা জনতার সেবক। আমরা তাঁদের মুখে হাসি ফোটাই, তাঁদের বিনোদনের ব্যবস্থা করি। তাঁদের জীবনের সমস্যা ভুলিয়ে দিই আমরা।”
এইজন্য, নর্তকীদের প্রবল উদ্যমে শিল্প প্রদর্শন করতে হয়, দর্শকদের কাছ থেকে আসা চটুল মন্তব্য হজম করতে হয়, এমনকি টিটকিরিতে খুশি হওয়ার ভানও করে যেতে হয়।
দর্শকদের সঙ্গে এই ইঙ্গিতপূর্ণ আদানপ্রদানের ফলে নানান সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনুষ্ঠানের আগে বা পরে দর্শকরা নর্তকীদের সঙ্গে নৈকট্য বাড়ানোর চেষ্টা করলে কোমল তাঁদের সাফ জানিয়ে দেন যে তিনি বিবাহিত। “মাঝে মাঝে মিথ্যা বলতে বাধ্য হই, বলি যে আমার পাঁচটা বাচ্চা আছে,” কোমল হেসে ফেলেন। কোমলের বাবা ফড -এর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন এবং গতবছর দল থেকে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর মা তামাশা শিল্পীর পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। সাত বছর বয়স থেকেই কোমল মঞ্চে ভগবান কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করছেন, মাত্র ১২ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে তামাশা দলে তিনি যোগ দেন। ২৮ বছর বয়সী তাঁর দিদি রমা এই একই দলে নর্তকী।
কোমল, রমা এবং অন্যান্য নর্তকীরা এটা বিলক্ষণ জানেন যে দর্শকের মধ্যে থেকে যখন নির্দিষ্ট কোনও পুরুষ তামাশার নির্ঘণ্ট মনে রাখেন এবং বারবার অনুষ্ঠান দেখতে আসেন, সেটা বিপদের সংকেত। কখনও কখনও আবার পুরুষরা এসে মেয়েদের সঙ্গে সেলফি তোলার আবদার করেন। আমরা এদের কাছে ঘেঁষতে দিই না। কোমল বলছেন, “আমরা সাধারণত এই ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলি এবং সেলফি তোলার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করি। তা সত্ত্বেও যদি কেউ আমাদের পিছু ধাওয়া করে, তাহলে আমাদের ম্যানেজারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।”
এটা কোনও ‘অশ্লীল’ পেশা নয়
এসব ছাপিয়ে তামাশার কাজ থেকে অর্জন করা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বীকৃতির কথাও মহিলারা বললেন। কাজলের কথায়, “নাচতে আমার খুব ভালো লাগত। আমার স্কুলে নাচের জন্য আমি প্রথম পুরষ্কার লাভ করেছিলাম।” তামাশা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে তিনি আনন্দিত – এখানে কাটানো সময় এবং শিল্প প্রদর্শনের মঞ্চ দুটোই উপভোগ করছেন তিনি।
১৫০ জনের দলে মহিলা সদস্য ২৫ জন। দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত পুরুষ শিল্পীদের এক প্রারম্ভিক বন্দনা দিয়ে তামাশার অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। তারপর প্রদর্শিত হয় কৃষ্ণ ও গোপীদের মধ্যে আলাপের উপর ভিত্তি করে নৃত্য
গভলন
। এই নাচের বিশেষ পোশাকটি হল আগে থাকতে সেলাই করা নয় হাত শাড়ি,
গভলন
শেষে এই পোশাক পরিহিত মহিলা শিল্পীরা ছুটে এসে হাজির হন তাঁদের ‘সাজঘরের’ তাঁবুটিতে এবং তড়িঘড়ি পরবর্তী দৃশ্যের জন্য সাজসজ্জা করে প্রস্তুত হতে থাকেন। প্রত্যেক শিল্পী ৭-৮টি গানের সঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন করেন – কখনও সহকারী নর্তকী হিসেবে, আবার কখনও প্রধান নর্তকী হিসেবে। সাধারণত বলিউডি সিনেমার গান এবং মারাঠি চলচ্চিত্রের গান ব্যবহার করা হয়, একটা-আধটা জনপ্রিয় হরিয়ানভি বা ভোজপুরি গানও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকেই তামাশা দলের জীবনযাত্রাকে ‘অশ্লীল’ বলে বিবেচনা করেন এবং ফড -এ কর্মরত মহিলাদের নিচু চোখে দেখেন। “মঞ্চে আমাদের দেখে দর্শকদের মধ্যে থেকে যখন ‘রান্ডি’ ‘ছিনাল’ [যৌন কর্মীদের জন্য ব্যবহৃত অপমানজনক পরিচয়] ইত্যাদি সম্বোধন শুনি তখন মাথা ঠান্ডা রেখে, রাগ না করে তাদের শান্ত করতে হয়,” এমনটা জানা গেল সাঙ্গলী জেলার তাসগাঁও তালুকের ধুলগাঁও গ্রাম থেকে আগত এই দলের ৪৩ বছর বয়সী নর্তকী ও অভিনেত্রী শারদা খাডের কাছ থেকে। “আমরা তাঁদের এই প্রশ্ন করি, ‘এইরকম অভব্য আচরণ কেন করো? তোমাদের বাড়িতেও তো মা বোনেরা আছেন।’ দর্শকদের উত্তর: ‘কিন্তু আমাদের বাড়ির মহিলারা তোমাদের মতো আচরণ করে না! তাঁরা উল্টে আমাদের জিজ্ঞাসা করেন আমরা তামাশা দলের কাজ ছেড়ে অন্য কোনও স্থায়ী কাজকর্ম করি না কেন?’ আমরা তাদের বলি, “এটাও তো একটা কাজ!”
কাজের অনিয়মিত, কঠোর সময়সূচী এবং বাধ্যতামূলকভাবে টানা আটমাসের কাজের ধকল নেওয়া তামাশা দলের মহিলা কর্মীদের জন্য খুবই কষ্টকর, বিশেষ করে যাঁদের ছোট সন্তান আছে। মঙ্গলাতাঈয়ের ছেলে এবং এই দলের ম্যানেজার অনিল বানসোডে জানালেন, “এত কষ্ট সহ্য করেও যাঁরা দলে কাজ করছেন তাঁদের আমরা উঁচু হারে বেতন দিই।” মঙ্গলাতাঈয়ের দলের মহিলা শিল্পীদের ২০১৭-১৮ সালের তামাশার মরশুমে প্রারম্ভিক বেতন মাসিক ১০,০০০ টাকা থেকে শুরু হয়েছিল। অনুষ্ঠানের সংখ্যা, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার নিরিখে এই বছর সহকারী শিল্পীদের সর্বোচ্চ বেতন ছিল ১৬,০০০ টাকা।
প্রায়শই দেখা যায় তামাশা শিল্পীদের উপার্জনটাই তাঁদের পরিবারের স্থায়ী আয়ের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস। সাঙ্গলী জেলার শিরালা তালুকের শিরালা গ্রাম থেকে আগত, দলের প্রধান নর্তকীদের একজন কাজল শিন্দে এবং তাঁর ২৮ বছর বয়সী দিদি জ্যোৎস্নার উপার্জনের উপর তাঁদের আট সদস্যের পরিবার নির্ভরশীল। প্রায় ছয় বছর আগে, মাত্র ১২ বছর বয়সে কাজল তামাশায় যোগ দেন। বছর কয়েক আগে জ্যোৎস্নাকে তাঁর স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তিনিও এই দলে কাজ নেন। তামাশার উপার্জন থেকেই তাঁর ১০ বছরের ছেলে এবং ৭ বছরের মেয়ের ভরণপোষণ সম্ভব হয়, সন্তানেরা গ্রামে থাকে জ্যোৎস্নার মায়ের সঙ্গে।
জ্যোৎস্নার কথায়, “আমার মেয়ে তখন খুব ছোটো, মাতৃদুগ্ধ খায়, অথচ সেইসময়েই আমি তাকে আমার মায়ের কাছে রেখে তামাশার দলে যোগ দিতে বাধ্য হই।” পরিবারের অবস্থা স্থিতিশীল না হওয়া অবধি কাজল বিয়ে করবেন না বলে মনস্থির করেছেন। প্রথম যখন তিনি তাঁর মাকে
ফড
-এ যোগ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তখন তাঁর মা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কাজল তাঁর মাকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তামাশার দলে নর্তকীর কাজ মোটেই কোনও অশ্লীল পেশা নয়।
না আছে আড়াল, না আছে যন্ত্রণার উপশম :
সেপ্টেম্বর এবং মে মাসের মধ্যে দলটি বছরের মোট ২১০ দিন পথে পথেই কাটায়। এই সময় তাঁরা তল্পিতল্পা নিয়ে প্রায় ভবঘুরের মতো জীবন কাটান এবং এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার পথে বাসেই ঘুমিয়ে নেন। শৌচালয়ের সন্ধান না পেলে মহিলারা উন্মুক্ত জায়গায় স্নান করতে বাধ্য হন। শারদার কথায় তামাশার দল একটা বড়ো পরিবারের মতো, “জামাকাপড় বদল করার প্রয়োজন হলে পুরুষ সদস্যরা তাঁবু থেকে বেরিয়ে যায়। অথবা খোলা জায়গায় জামাকাপড় ছাড়তে হলে, তারা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। অবশ্য কেউ কেউ যে তাকিয়ে থাকে না এমন নয়...”
কোমল বলেছেন, “আমরা যখন তাঁবুর ভেতর পোশাক পরিবর্তন করি, গ্রামবাসীদের কেউ কেউ ভেতরে উঁকি মারার চেষ্টা করে, শাপশাপান্ত করে আমরা তাদের তাড়াই। তেমন নাছোড়বান্দা হলে আমি পা থেকে চপ্পল খুলে ছুঁড়ে মারি।” পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মহিলারা পুরুষ সহকর্মী অথবা ম্যানেজার কিংবা অনুষ্ঠানের সময় উপস্থিত পুলিশদের সাহায্য চান।
শারদা জানাচ্ছেন, এক স্থান থেকে অন্যত্র যাতায়াতের পথে মাসিক ঋতুস্রাবের সময়ে, “আমরা বারোয়ারি শৌচালয় খুঁজে সেখানেই ঋতুকালীন প্রয়োজন মেটাবার চেষ্টা করি।” কোমল জানান, প্রতিবার ঋতুস্রাব শুরু হলেই তাঁর বাড়ির কথা মনে হয়। এই সময়ে আড়ালের অভাব বেশি করে জানান দেয়। তা সত্ত্বেও যাবতীয় অস্বস্তি নিয়েই কাজ করে যেতে হয়। তাঁর দিদি রমা বলছেন, মাসিকের সময়ে যতই ব্যাথা হোক না কেন, অনুষ্ঠানে যদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তার মধ্যেই কাজ করে যেতে হয়। তাঁর কথায়, “একাধিক গান থাকলে অথবা প্রধান ভূমিকায় অভিনয় থাকলে মাসিকের যন্ত্রণার মধ্যে আমরা বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশটুকুও পাই না; যতই অসুস্থ থাকি না কেন, মঞ্চে উঠতেই হবে।”
দলের অন্যতম প্রধান নর্তকী রমার দুই বছর বয়সী এক শিশুকন্যা আছে, তার নাম ভক্তি। “ভক্তি যখন আমার গর্ভে, সেইসময়েও আমি তামাশার মরশুমের শেষ পর্যন্ত কাজ করেছি। দুটো মরশুমের মধ্যবর্তী বার্ষিক বিরতিতে সে জন্মায়। প্রসবের ঠিক দেড় মাস পরেই আমি আবার কাজে যোগ দিয়ে পথের জীবনে ফিরে আসি। রমার মা বিমল যিনি নিজে গতবছর অবধি এই দলেই গায়িকা হিসেবে কাজ করেছেন, অবসরের আগে পর্যন্ত রমার সন্তানের দেখভাল করতেন। এই বছর ভক্তির দেখাশোনা করার ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ আমার মা এখন বাড়িতে ফিরে গেছেন। ঠিক মঞ্চে ওঠার আগে ভক্তি কান্নাকাটি শুরু করলে তাকে ফেলে রেখে যাওয়া মুশকিল। আমাকে না দেখা পর্যন্ত সে অনবরত কেঁদেই চলে,” রমা বললেন ।
শিশুর বাবা একই দলের কর্মী হলে বাচ্চার দেখভাল করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। পিতা বা মাতার মধ্যে একজন যখন মঞ্চে থাকেন, তখন অন্যজন সন্তানের দেখাশোনা করতে পারেন।
নৃত্য, সংগীত কিংবা সন্তান-প্রসব সবটাই রঙ্গমঞ্চে
প্রথিতযশা শিল্পী ভিঠাবাঈ নারায়ণগাঁওকরের মঞ্চে সন্তান প্রসবের গল্পটি তামাশার এক কিংবদন্তী হয়ে উঠেছে। গর্ভবতী ভিঠাবাঈয়ের যখন মনে হল তাঁর প্রসব বেদনা ওঠার সময় হয়েছে, তিনি তখন তাঁর মেয়েকে নিজের অভিনয় দৃশ্যগুলির মাঝে মাঝে গানের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে বললেন। তারপরের গল্পটা এইরকম: মঞ্চের পেছনে কারও সাহায্য ছাড়াই, একটি তাঁবুর ভেতর তিনি নিজে নিজেই তাঁর সন্তান প্রসব করলেন (মঙ্গলাতাঈয়ের ভাই কৈলাশ সাওন্ত), তারপর সদ্যজাত শিশুকে একটা কম্বলে মুড়ে রেখে, মঞ্চে ফিরে তামাশার অবশিষ্ট অংশটি পরিবেশন করলেন।
ভিঠাবাঈয়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা মঙ্গলাতাঈ ১৯৭৬ সালে ছোটো ছেলে নীতীনের জন্মের সময় একই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন, “আমরা তখন একটি ঐতিহাসিক
ভাগ নাট্য
[লোকনাটক] পরিবেশন করছিলাম। যুদ্ধের একটা দৃশ্যে অভিনয়ের মাঝে আমার স্বামী আমার দিকে ইশারা করে আমার প্রকৃত অবস্থাটা বোঝালেন। ততক্ষণে মঙ্গলাতাঈয়ের প্রসবকাল ঘনিয়ে এসেছিল।
মঙ্গলাতাঈয়ের কথায়, “আমি ওই দৃশ্যের অভিনয়ে এতটাই মশগুল ছিলাম যে আমার নিজের অবস্থাটাও উপলব্ধি করতে পারিনি। অবশেষে যখন সম্বিত ফিরল, ততক্ষণে আমি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছি। তড়িঘড়ি মঞ্চের পেছনে গেলাম, গ্রামের মহিলাদের সাহায্যে আমার প্রসব করানো হল। সন্তান প্রসবের পর আমি আবার অনুষ্ঠানের পোশাক পরে মঞ্চে হাজির হয়েছিলাম - কিন্তু দর্শকরা আমার অবস্থার প্রতি সম্মান জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন।”
মঙ্গলাতাঈয়ের ছোট বোন এবং এই দলের একজন গায়িকা ৫৩ বছর বয়সী ভারতী সোনাওয়ানের সংযোজন, “আমি আমার তিন সন্তানের প্রত্যেকটিকে জন্ম দেওয়ার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আবার মঞ্চে ফিরে আসি। মায়ের মতোই, আমার সন্তান জন্মানোর পর আমি কোনও বিরতি নিইনি।”
নিত্য যাতায়াতের ধকল, অনুষ্ঠানের সময়ের স্থিরতা না থাকা এবং খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম ইত্যাদির প্রভাবে সদস্যদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যাহত হয়। “আমাদের মধ্যে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও, হাসপাতালের চক্কর দিনের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলতে হয়। রাতে মঞ্চে অনুষ্ঠানে হাজির হতেই হবে,” রমা জানালেন। গত বছর, যখন ছোট্ট ভক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তাঁদের তামাশার দল তখন একই গ্রামে দুদিন জুড়ে অনুষ্ঠান করছিল। আরও জানাচ্ছেন তিনি, “সে তখন হাসপাতালে, তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। সারাদিন তার সঙ্গে কাটানোর পরেও, আমাকে রাতে মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে হয়েছে।”
রমা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর মেয়ে ভক্তি বড়ো হলে তাকে বাড়িতে রেখে আসবেন। “আমি চাই না সে তামাশায় কাজ করুক, ইদানীংকালের দর্শকরা ভয়ানক অভব্য। ততদিনে দর্শকরা আরও কত অশালীন হয়ে উঠবে কে জানে?”
বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর