হাত প্রসারিত করে কনক বললেন, “আমার স্বামী এতো বড়ো বড়ো তিন বোতল মদ কিনে আনে শনিবার। তিনদিন ধরে সেই মদ খেয়ে যেদিন তা ফুরায় সেদিন ও আবার কাজে যায়। খাবার কেনার মতো যথেষ্ট পয়সা কখনই থাকে না। আমি কোনওমতে নিজের আর বাচ্চাদের পেট চালাই। এর উপর আমার স্বামী আবার আর একটা বাচ্চা চায়। আমি এই জীবনটাই আর চাই না!” হতাশ কণ্ঠে তিনি বললেন।
গুডালুর আদিবাসী হাসপাতালে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কনক (নাম পরিবর্তিত) — বেট্টা কুরুম্বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের এই মায়ের বয়স ২৪। তামিলনাডুর নীলগিরি জেলার গুডালুর ও পান্থালুর তালুকের ১২,০০০-এরও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে পরিষেবা দেয় উধগমণ্ডলম (উটি) থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ৫০ শয্যাবিশিষ্ট গুডালুর শহরের হাসপাতালটি।
রং-চটা সিন্থেটিক শাড়ি গায়ে ছোটোখাটো চেহারার এই মহিলা হাসপাতালে এসেছেন নিজের একমাত্র কন্যাসন্তানের চিকিৎসার জন্য। এই হাসপাতাল থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে তাঁদের জনপদে এই মাসের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাকালীন, এই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত নীলগিরি স্বাস্থ্য কল্যাণ সঙ্ঘের (এ্যাসোসিয়েশন ফর হেলথ ওয়েলফেয়ার ইন দ্য নীলগিরিস, সংক্ষেপে অশ্বিনী) এক স্বাস্থ্যকর্মী চমকে উঠেছিলেন কনকের দুই বছরের মেয়ের ওজন মাত্র ৭.২ কিলোগ্রাম দেখে (ওজন এই বয়সে হওয়ার কথা ১০-১২ কিলোগ্রাম)। এই ওজন তাকে মারাত্মকভাবে অপুষ্ট শিশুর তালিকাভুক্ত করেছে। কনক আর তাঁর মেয়েকে অবিলম্বে হাসপাতালে যেতে বলেছিলেন স্বাস্থ্যকর্মীটি।
পারবারিক আয়কে যেভাবে কনকের টেনে বাড়াতে হয় তাতে এই অপুষ্ট অবস্থা আশ্চর্য কিছু নয়। বিশের কোঠায় বয়স তাঁর স্বামী কাছাকাছি চা, কফি, কলা ও গোলমরিচ বাগিচায় সপ্তাহে মাত্র কয়েকদিন কাজ করে দিনে ৩০০ টাকা রোজগার করেন। “ও আমাকে মাসে মাত্র ৫০০ টাকা দেয় খোরাকি বাবদ,” বললেন তিনি। “তাই দিয়ে আমার গোটা পরিবারের জন্য রান্না করতে হয়।”
কনক থাকেন তাঁর স্বামীর ৫০ পেরোনো, পেশায় দিনমজুর কাকা কাকিমার সঙ্গে নিজের স্বামী সন্তানকে নিয়ে। গোটা পরিবারটির মোট দুটি রেশনকার্ড থাকায় প্রতি মাসে তাঁরা বিনামূল্যে পান ৭০ কেজি চাল, দুই কেজি করে ডাল আর চিনি এবং ভর্তুকি মূল্যে মেলে দুই লিটার তেল। “কোনও কোনও সময়ে আমার স্বামী মদ কেনার জন্য আমাদের রেশনের চালটা অবধি বিক্রি করে দেয়,” কনক বললেন। “এক-একদিন যায় যখন কিচ্ছু খাবার থাকে না।”
নিতান্ত অপ্রতুল আহারের কারণে সরকারের পৌষ্টিক প্রকল্প-ও কনক ও তাঁর শিশুর জন্য যথেষ্ট কাজে দেয় না। গুডালুরে কনকদের জনপদে সমন্বিত শিশু উন্নয়ন সেবা প্রকল্পের (আই সি ডি এস) আওতায় প্রত্যেক সন্তানসম্ভবা ও স্তন্যদানরত মায়েদের জন্য সপ্তাহে একটি ডিম ও প্রতি মাসে দুই কিলো ওজনের এক প্যাকেট সাথুমাভু (গম, মটর, বাদাম, ছোলা ও সোয়াবিন গুঁড়োর মিশ্রণ) দেওয়া হয়। তিন বছরের কমবয়সী শিশুদেরও এক প্যাকেট করে সাথুমাভু দেওয়া হয়। তিন বছরের ঊর্ধ্বে শিশুদের বালওয়াড়ি কেন্দ্রে, সকাল, দুপুর ও সান্ধ্যকালীন ভোজনের জন্য যাওয়ার কথা — বিকেলের জলযোগে তাদের দেওয়া হয় একমুঠো বাদাম ও গুড়। অতি অপুষ্ট শিশুদের প্রতিদিন বাড়তি গুড়-বাদাম দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের জুলাই থেকে সরকার নতুন মায়েদের আম্মা উত্তাছাতু পেট্টাগম নামের পুষ্টি কিট দিচ্ছে — এতে আয়ুর্বেদিক খাদ্য সম্পূরক, ২৫০ গ্রাম ঘি ও ২৫০ গ্রাম প্রোটিন গুঁড়ো থাকে। অবশ্য, অশ্বিনীর সামাজিক স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ৩২ বছর বয়সী জিজি এলামানার মতে, “এই প্যাকেট তাঁদের বাড়ির তাকেই পড়ে থাকে। আদিবাসীরা নিজেদের খাদ্যে দুধ ঘি ব্যবহার করেন না বলে ঘি তাঁরা স্পর্শও করেন না। প্রোটিন গুঁড়ো ও সবুজ আয়ুর্বেদিক গুঁড়ো ব্যবহার করতে জানেন না বলে তাঁরা ফেলেই রেখে দেন।”
একসময়ে নীলগিরি অঞ্চলের আদিবাসীরা সহজেই জঙ্গল থেকে নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতেন। চার দশক ধরে গুডালুরের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে কর্মরত মারি মার্সেল থাকেকেরা জানাচ্ছেন, “বিভিন্ন ধরনের মূল-কন্দ, ফল, শাকপাতা ও ছত্রাক সম্বন্ধে আদিবাসীদের অপরিসীম জ্ঞান। তাছাড়া তাঁরা সারাবছর মাছ ধরতেন এবং ছোটোখাটো প্রাণী শিকার করতেন। অধিকাংশ বাড়িতেই রান্নার উনুনের উপর খানিকটা মাংস ঝোলানো থাকত শুকানোর জন্য, বর্ষার রসদ হিসেবে। কিন্তু তারপর বনদপ্তর তাঁদের জঙ্গলে প্রবেশাধিকার সীমিত করতে করতে এখন একেবারে বন্ধই করে দিয়েছে।”
অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬, সাধারণ সম্পদের উপর সামাজিক অধিকার ফিরিয়ে দিলেও আদিবাসীরা আর আগের মতো নিজেদের খাদ্যের পরিপূরক জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারেন না।
গ্রামীণ উপার্জনে ক্রমশ বাড়তে থাকা ঘাটতিও এই অপুষ্টির আরেক কারণ। আদিবাসী মুন্নেত্রা সঙ্গমের সম্পাদক জানালেন যে, এখানকার জঙ্গল মুদুমালাই অভয়ারণ্যে শামিল হয়ে যাওয়ায় বিগত ১৫ বছর ধরে আদিবাসীদের মজদুরি করার সুযোগ লাগাতার কমে যাচ্ছে। অভয়ারণ্য অঞ্চলের অন্তর্গত হয়ে যাওয়া ছোটো বাগিচাগুলিতেই আদিবাসীরা কাজ পেতেন। এখন এর বেশিরভাগ স্থানান্তরিত অথবা বিক্রি হয়ে যাওয়ায় এঁরা বড়ো বাগিচা বা খামারে অনিয়মিত কাজ খুঁজতে থাকেন।
যে আদিবাসী হাসপাতালে কনক প্রতীক্ষায় ছিলেন সেখানেই একটি ওয়ার্ডে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ২৬ বছর বয়সী সুমা (নাম পরিবর্তিত)। নিকটবর্তী পান্থালুর তালুকের পানিয়ান আদিবাসী সমাজের সুমা তাঁর তৃতীয় কন্যাসন্তানটির জন্ম দিয়েছেন — তাঁর আর দুই কন্যার বয়স যথাক্রমে ১১ ও ২। সুমার প্রসব হাসপাতালে হয়নি কিন্তু তিনি হাসপাতালে এসেছেন সন্তানের জন্ম পরবর্তী যত্ন ও টিউবাল লাইগেশনের জন্য।
“আমার প্রসবের দিন কিছুটা পেছিয়ে গেছিল, অথচ এখানে আসার পয়সা আমাদের ছিল না,” জিপ ভাড়া করে তাঁর জনপদ থেকে এই অবধি এক ঘন্টার পথ অতিক্রম করার খরচের প্রসঙ্গে বলছিলেন তিনি। গীতা চেচি (অশ্বিনীর স্বাস্থ্যকর্মী) আমাকে যাতায়াতের জন্য ৫০০ টাকা আর খাবার দিয়েছিল বটে, কিন্তু আমার স্বামী তা মদের পিছনে খরচ করে ফেলল। ফলে আমি বাড়িতেই রইলাম। তিনদিন পর আমার ব্যথা আরও বাড়ায় বাড়ি থেকে বেরোতেই হল, যদিও এখানে আসার পক্ষে তখন দেরি হয়ে গেছিল বলে আমি বাড়ির কাছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সন্তান প্রসব করি।” পরের দিন প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নার্স ১০৮-এ ফোন (অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার নম্বর) করেন এবং শেষ অবধি সুমা ও তাঁর পরিবার এসে পৌঁছান গুডালুর আদিবাসী হাসপাতালে।
চার বছর আগে সুমার গর্ভপাত ঘটে গর্ভস্থ ভ্রুণের সময়োচিত বাড়বৃদ্ধির অভাবের কারণে (ইন্ট্রাইউটেরাইন গ্রোথ রেস্ট্রিকশন)। মায়ের অপুষ্টি, রক্তাল্পতা, ও ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। সুমা দ্বিতীবারের গর্ভাবস্থাতেও একই পরিস্থিতির শিকার হন বলে তাঁর দ্বিতীয় কন্যাটি মারাত্মক কম ওজন (আদর্শ ওজন ২ কিলোর চেয়ে অনেক কম ১.৩ কিলো) নিয়ে জন্মায়। বয়স তথা ওজন অনুপাত ছকের নিরিখে শিশুটির ওজন শতকরা হারের সর্বনিম্নে অবস্থান করছিল যা ‘অতি অপুষ্ট’ হিসাবে চিহ্নিত।
গুডালুর আদিবাসী হাসপাতালে পারিবারিক চিকিৎসা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বছর ৪৩-এর ডঃ মৃদুলা রাও জানালেন, “মা অপুষ্ট হলে শিশুও অপুষ্ট হবে। সুমার সন্তানের উপর ওর মায়ের খাদ্যাভাবের ছাপ পড়বে সম্ভবত; অপর শিশুদের তুলনায় ওর শারীরিক, বৌদ্ধিক ও স্নায়বিক বাড়বৃদ্ধি হবে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে।”
সুমার চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি দেখাচ্ছে যে তৃতীয় গর্ভাবস্থায় তাঁর ওজন বেড়েছিল পাঁচ কিলোগ্রাম। এই বৃদ্ধি, স্বাভাবিক ওজনের মহিলাদের ওজন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় মাত্রার অর্ধেকেরও কম আর সুমার মতো কম ওজনের মহিলাদের তুলনায় অর্ধেক — নয়মাসের গর্ভকালে তাঁর ওজন ছিল মাত্র ৩৮ কিলো।”
অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬, সাধারণ সম্পদের উপর সামাজিক অধিকার ফিরিয়ে দিলেও আদিবাসীরা আর আগের মতো নিজেদের খাদ্যের পরিপূরক জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারেন না
“সন্তানসম্ভবা মা ও সদ্যজাত শিশুকে সপ্তাহে আমি বেশ কয়েকবার দেখে আসি,” বললেন গুডালুর আদিবাসী হাসপাতালের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রচার-কর্মী, ৪০ বছর বয়সী গীতা কন্নন। “আমি দেখতাম বাচ্চাটি ছোট্টো একটা জামা পরে অবসন্ন হয়ে তার ঠাকুরমার কোলে বসে আছে। বাড়িতে কোনও রান্না হচ্ছে না। বাচ্চাটিকে পড়শিরাই খাওয়াত। সুমা একেবারে নির্জীব হয়ে শুয়ে থাকত। আমি ওকে আমাদের অশ্বিনী সাথুমাভু (রাগি ও ডালের গুঁড়ো) দিতাম আর বলতাম, নিজের আর যে বাচ্চাটিকে ও তখনও স্তন্যদান করছে, সেই দুজনেরই স্বাস্থ্যের কথা ভেবে, ভালো খেতে। কিন্তু সুমা বলত যে তার স্বামী দিনমজুর হিসাবে যা রোজগার করত তার বেশিটাই খরচ করত মদের পিছনে,” গীতা একটু থেমে বললেন, “সুমাও মদ খেতে শুরু করেছিল।”
যদিও গুডালুরের বহু পরিবারের অবস্থাই প্রায় এক তবু এই ব্লকের স্বাস্থ্য সূচকে বরাবর যথেষ্ট উন্নতি ঘটে চলেছে। হাসপাতালের নথি থেকে জানা যাচ্ছে যে ১৯৯৯ সালের (প্রতি ১০০,০০০ জীবিত জাতক পিছু) ১০.৭ প্রসূতি-মৃত্যুর হার ২০১৮-১৯ সালে কমে হয়েছে ৩.২ এবং শিশু-মৃত্যুর হার (প্রতি ১,০০০ জন জীবিত জাতক পিছু) ৪৮ থেকে ওই একই সময়কালে কমে হয়েছে ২০। বস্তুত, রাজ্য পরিকল্পনা কমিশনের মানব উন্নয়ন নথি ২০১৭ ( ডি এইচ ডি আর ২০১৭ ) বলছে যে নীলগিরি জেলার শিশু-মৃত্যু হার ১০.৭ হওয়ায় তা রাজ্যের গড় শিশু মৃত্যু হার ২১-এর থেকে কম আবার গুডালুর তালুকের হার আরও কম — ৪.০।
গুদালুরের আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে বিগত ৩০ বছর ধরে কর্মরত ডঃ পি শৈলজা দেবীর মতে, এই তথ্য সম্পূর্ণ চিত্রটি প্রকাশ করে না। তাঁর কথায়, “মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার অবশ্যই কমেছে কিন্তু বেড়েছে রোগের হার। আমাদের মৃত্যু আর রোগগ্রস্ততার মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। একজন অপুষ্ট মা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেবে আর এই শিশুর রোগগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকবে বেশি। তিনবছর বয়সী এমন শিশু উদরাময়ের মতো রোগে সহজেই মারা যেতে পারে এবং এদের বৌদ্ধিক বিকাশও ঘটবে ধীর গতিতে। এটাই হবে আদিবাসীদের পরবর্তী প্রজন্ম।”
তাছাড়া, এই এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে মৃত্যুহার কমলেও তাঁদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মদ্যাসক্তির কারণে সেই কৃতিত্ব খাটো হয়ে যাচ্ছে আর এর ফলে হয়তো আড়ালে চলে যাচ্ছে আদিবাসীদের মধ্যে বিরাজমান উচ্চমাত্রার অপুষ্টি সংক্রান্ত তথ্য। (গুডালুর আদিবাসী হাসপাতাল ইতিমধ্যে অতিরিক্ত মদ্যপান ও অপুষ্টির মধ্যে সম্পর্কের উপর একটি গবেষণাপত্র প্রস্তুত করছে যা এখনও জনসমক্ষে আনা হয়নি)। ডি এইচ ডি আর ২০১৭-এর উপরিউক্ত রিপোর্টটি যেমন দেখাচ্ছে, “মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও পুষ্টিগত উন্নতি নাও ঘটতে পারে।”
“উদরাময় আর আমাশয়ের মতো সাধারণ মৃত্যুর কারণ যখন আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি এবং সব প্রসব স্বাস্থ্য-প্রতিষ্ঠানে করাচ্ছি তখন অতিরিক্ত মদ্যপান এইসব কাজকে মাটি করে দিচ্ছে। আমরা সাব-সাহারান স্তরের বিপজ্জনক অপুষ্টি লক্ষ্য করছি যুবতী মা ও শিশুদের মধ্যে,” বললেন ৬০ বছর বয়সী, স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, ডঃ শৈলজা, যিনি গুডালুর আদিবাসী হাসপাতাল থেকে খাতায়-কলমে অবসর নিয়েছেন ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে, কিন্তু রোগীদের সঙ্গে কথা বলে আর সহকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন রোগীর সম্বন্ধে আলোচনা করে প্রতিটি সকাল কাটান সেই হাসপাতালেই। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনু্যায়ী, “৫০ শতাংশ শিশু সাধারণ থেকে অতি অপুষ্ট এখন। দশ বছর আগেই (২০১০-১১) সাধারণ মাত্রার অপুষ্টি ছিল ২৯ শতাংশের মধ্যে আর অতি অপুষ্ট ছিল ৬ শতাংশ। এটা ভীষণ চিন্তার বিষয়।”
অপুষ্টির স্পষ্ট চিহ্নগুলি উল্লেখ করে ডঃ রাও বললেন, “আগে মায়েরা হাসপাতালের বহির্বিভাগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এলে নিজেদের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতেন। এখন তাঁরা বসে থাকেন নিস্পৃহ হয়ে আর বাচ্চাগুলোকেও কেমন নির্জীব দেখায়। এই উদাসীনভাব বাচ্চাদের যত্নের উপর বিরূপ ছাপ ফেলে, প্রতিকূল প্রভাব ফেলে নিজেদের পৌষ্টিক স্বাস্থ্যের উপরেও।”
জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৪ ( এন এফ এইচ এস-৪ , ২০১৫-১৬) দেখায় যে নীলিগিরির গ্রামীণ অঞ্চলে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী ৬৩ শতাংশ শিশু যথেষ্ট আহার পায় না এবং ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী ৫০.৪ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে (প্রতি ডেসিলিটার রক্তে রক্তকণিকা ১১ গ্রামের কম — হওয়ার কথা ১২)। গ্রামাঞ্চলে প্রায় অর্ধেক মায়েদের (৪৫.৫ শতাংশ) রক্তাল্পতা আছে, যা তাঁদের গর্ভাবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
“আমরা এখনও এমন আদিবাসী মহিলা পাই যাঁদের শরীরে, বস্তুত রক্তই নেই — প্রতি ডেসিলিটাররে ২ গ্রাম রক্তকণিকা! রক্তাল্পতা পরীক্ষা করতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে রক্ত ঢালা হয় — সর্বনিম্ন সূচকচিহ্ন থাকে ২-এ। এর চেয়েও কম হতে পারে কিন্তু তা আমরা মাপতে পারব না,” বললেন ডঃ শৈলজা।
রক্তাল্পতা এবং মাতৃমৃত্যুর মধ্যে নিকট সম্পর্ক। “রক্তাল্পতার কারণে প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ, হৃদরোগের আক্রমণ, ও মৃত্যু, ঘটতে পারে,” গুডালুর আদিবাসী হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ৩১ বছর বয়সী, ডঃ নম্রতা মেরী জর্জ জানালেন। “একই কারণে বাধা পেতে পারে ভ্রুণের বাড়বৃদ্ধি এবং জন্মকালীন ওজন মাত্রাতিরিক্ত কম হওয়ায় ঘটতে পারে সদ্যজাত শিশুটির মৃত্যুও। শিশুটির ঠিক মতো উন্নতি হয়না, অপুষ্টি শুরু হয়ে যায়।”
কম বয়সে বিবাহ ও মাতৃত্ব শিশুর স্বাস্থ্যহানির বাড়তি কারণ হয়ে ওঠে। এনএফএইচএস-৪ যদিও জানাচ্ছে যে নীলগিরির গ্রামীণ অঞ্চলে মাত্র ২১ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগে বিবাহ হয় কিন্তু যে স্বাস্থ্যকর্মীরা আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে কাজ করেন তাঁরা বলছেন প্রকৃত চিত্র এর বিপরীত — তাঁদের মতে বেশিরভাগ আদিবাসী মেয়েদের বিবাহ হয় ১৫ বছরের মধ্যে অথবা রজঃস্বলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। “বিয়ের বয়স ও প্রথম গর্ভধারণের বয়স পিছিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আমাদের আরও কাজ করা দরকার,” স্বীকার করলেন ডঃ শৈলজা। “পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগেই ১৫/১৬ বছর বয়সে গর্ভবতী হলে তাঁদের অপুষ্টির কুফল ফুটে উঠবে সদ্যজাত শিশুটির মধ্যে।”
রোগী ও সহকর্মী, উভয়েই যাঁকে শৈলা চেচি (দিদি) বলে ডাকেন, আদিবাসী স্বাস্থ্য বিষয়ে তাঁর জ্ঞান অপরিসীম। “পারিবারিক স্বাস্থ্য আর পুষ্টির মধ্যে গভীর সম্পর্ক এবং পৌষ্টিক আহারের অভাব, গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মায়েদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দ্বিগুণ করে,” তিনি জানালেন। মজুরি বাড়লেও সেই অর্থ পরিবারের হাতে আসে না,” তিনি দেখালেন। “আমরা এমন ঘটনাও জানি যে একজন পুরুষ ৩৫ কিলোগ্রাম চাল রেশন থেকে তুলে মদ কেনার জন্য তা পাশের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছে। বাচ্চাদের মধ্যে অপুষ্টি বাড়বে না তো কী হবে?”
“গোষ্ঠীর সঙ্গে যে কোনও বিষয়েই আলোচনা করতে গেলে তা শেষ হয় একই সমস্যা দিয়ে —“পরিবারে অতিরিক্ত মদ্যাসক্তি,” অশ্বিনীর মানসিক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, ৫৩ বছর বয়সী বীণা সুনীল জানালেন।
এই অঞ্চলের আদিবাসীদের অধিকাংশই, বিশেষভাবে বিপন্ন জনজাতি (পার্টিকুলারলি ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপ) তালিকাভুক্ত কাট্টুনায়াকন ও পানিয়ান জনজাতির মানুষ। উধগমণ্ডলমের আদিবাসী গবেষণা কেন্দ্রের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে এঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশ বিভিন্ন খেত খামারে কৃষিশ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। এখানকার অন্যান্য তফসিলি জনজাতিসমূহের মধ্যে আছে ইরুলার, বেট্টা কুরুম্বা ও মাল্লু কুরুম্বা।
“আমরা যখন ১৯৮০-এর দশকে এখানে প্রথম আসি তখনও ১৯৭৬ সালের বেগার শ্রম (রদ) আইন সত্ত্বেও পানিয়ান আদিবাসীরা ধান, জনার, কলা, গোলমরিচ ও টাপিওকা খেতে বন্ধুয়া শ্রমিক হিসাবেই কাজ করতেন,” বললেন মারী থেকাকেরা। “গভীর জঙ্গলে ছোটো ছোটো বাগিচায় তাঁরা কাজ করতেন — জানতেনও না যে, যে জমিতে কাজ করছেন সেগুলির পাট্টা তাঁদেরই।”
এই বিষয়গুলি নিয়ে কাজ করতে, ১৯৮৫ সালে, মারী ও তাঁর স্বামী একসঙ্গে স্থাপন করলেন, অ্যাকর্ড (অ্যাকশন ফর কমিউনিটি অর্গানাইজেশন, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট)। মানুষের দান নির্ভর এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি (এনজিও) কালক্রমে আদিবাসীদের দ্বারা পরিচালিত আরও বিভিন্ন সংগঠনের এক সম্মিলিত মঞ্চ ‘সঙ্গম’ (পরিষদ) গড়ে তুলে, আদিবাসী মুন্নেত্রা সঙ্গমের সাধারণ ছাতার তলায় তাকে নিয়ে এসেছেন। এই সঙ্গম আদিবাসীদের জমি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, এবং একটি চা-বাগান ও শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছে। অ্যাকর্ড, এছাড়াও চালু করেছে অ্যাসোসিয়েশন হেলথ ওয়েলফেয়ার (অশ্বিনী) এবং ১৯৯৮ সালে স্থাপন করেছে গুডালুর আদিবাসী হাসপাতাল। এখানে এখন ছয়জন চিকিৎসক আছেন, আছে একটি পরীক্ষাগার, এক্স-রে করার ঘর, ঔষধালয় এবং ব্লাড ব্যাঙ্ক।
“৮০-এর দশকে, এখানে সরকারি হাসপাতালে আদিবাসীদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো ব্যবহার করা হত আর ওঁরাও পালিয়ে যেতেন। স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সাঙ্ঘাতিক খারাপ ছিল -মহিলারা নিয়িমিত সন্তানসম্ভবা অবস্থায় মারা যেতেন আর বাচ্চাদের মধ্যে ছিল উদরাময় রোগ আর মৃত্যু,” ডঃ রূপা দেবদাসন সে সময়ের কথা বলছিলেন। অশ্বিনীর যে চিকিৎসকরা আদিবাসীদের বাড়ি বাড়ি যেতে শুরু করেন তাঁদের মধ্যে ডঃ রূপা ও তাঁর স্বামী ডঃ এন দেবদাসন ছিলেন অগ্রগামী। “অসুস্থ বা সন্তানসম্ভবাদের বাড়িতে আমাদের ঢুকতে অবধি দেওয়া হত না। অনেক কথা বলে, নিশ্চিন্ত করে ওঁদের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছে।”
সামাজিক স্বাস্থ্যের দিকটিই অশ্বিনীর কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রয়েছে — এখানে আছেন ১৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী, ৩১২ জন স্বেচ্ছাসেবী। এই কর্মীরা সকলেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, তাঁরা গুডালুর আর পান্থালুর তালুকে নিবিড়ভাবে ভ্রমণ করেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে পরামর্শ দেন।
৫০-এর কোঠায় বয়স, মুল্লু কুরুম্বা সম্প্রদায়ের, টি আর জানু ছিলেন অশ্বিনীতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রথম স্বাস্থ্যকর্মীদের অন্যতম। পান্থালুর তালুকের চেরাঙ্গোডে পঞ্চায়েতে আয়্যানকোলি জনপদে তাঁর কার্যালয় থেকে তিনি আদিবাসী পরিবারগুলিতে উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের অনুসন্ধান করতে যান ও দরকার মতো এগুলির প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওষুধ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্বন্ধীয় পরামর্শও দেন। তিনি সন্তানসম্ভবা ও স্তন্যদানকারী মায়েদেরও খোঁজখবর রাখেন। “মেয়েরা আমাদের কাছে প্রজনন-স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসেন গর্ভাবস্থার বেশ পরের দিকে। ফোলেট-জনিত অভাব মেটাবার ওষুধ প্রথম তিনমাসে না দিলে ভ্রুণের বাড়বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করা যায় না,” তিনি বললেন।
সুমার মতো যুবতীদের ক্ষেত্রে অবশ্য আই ইউ জি আর প্রতিরোধ করা যায়নি। হাসপাতালে আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁর টিউবাল লাইগেশন হয়ে গিয়েছিল আর তার কয়েকদিন পরই তিনি আর তাঁর পরিবার বাড়ি যাওয়ার জন্য জিনিস গোছাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। নার্স এবং চিকিৎসকরা তাঁদের পুষ্টি বিষয়ে বুঝিয়ে বলে দিয়েছিলেন। তাঁকে বাড়ি ফেরার ভাড়া ও পরের সপ্তাহের খাদ্য খরচ বাবদ অর্থও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। “এবারে আশা করি টাকাটা যে জন্য বলা হয়েছে সেজন্যই খরচ হবে,” তাঁরা রওনা হওয়ার সময়ে এই কথা বললেন জিজি এলামানা।
প্রচ্ছদ চিত্র : নিউ- মিডিয়া শিল্পী প্রিয়াঙ্কা বোরার নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ভাব এবং অ ভিব্যক্তিকে নতুন রূ পে আবিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত আছেন। তিনি শেখা তথা খেলার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করছেন ; ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ায় তাঁর সমান বিচরণ এবং সেই সঙ্গে কলম আর কাগ জের চিরাচরিত মাধ্যমেও তিনি একই রকম দক্ষ।
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতা র ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধ রা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা