৪০ বছর বয়সী মলন মোরে বাড়ির বাইরে একটা খাটিয়ায় বসে মায়ের ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। পরনে তাঁর অতি প্রিয় ফুল-ছাপ ব্লাউস আর হাঁটু অবধি ঝুলের স্কার্ট। আমার দিকে উজ্জ্বল মুখ তুলে তাকালেন তিনি। আমাকে দেখে চিনতে পেরেছেন কারণ আমি আগেও একবার গিয়েছিলাম ওখানে। “আই (মা) বাড়ি নেই,” আমি ওঁদের বাড়ির ইট, কাদা-মাটি আর পাথরে তৈরি দুই কামরার বাড়ির সিঁড়িতে বসা মাত্র তিনি বললেন।
৬৩ বছর বয়সী মা, রহিবাঈ ও ৮৩ বছর বয়সী বাবা নানার সঙ্গে ওয়াদি গ্রামে থাকেন মলন মোরে (তাঁদের এবং গ্রামের নাম পরিবর্তিত)। পুণে জেলার মুলশি তালুকের এই গ্রামে আন্দাজ তিন একর জমিতে তাঁরা ধান, গম, তরিতরকারি চাষ করেন।
মলনের ১৮ বছর বয়সে পুণের সাসুন সাধারণ হাসপাতাল জানিয়ে দেয় যে তিনি ‘সীমান্তবর্তী মানসিক প্রতিবন্ধকতা’ রোগে ভুগছেন।
এর আগের ১২ বছর তিনটি স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন। রহিবাঈ বলছিলেন, “ওর সহপাঠীরা সবাই চতুর্থ শ্রেণিতে পাস করে এগিয়ে গেল কিন্তু ও মাটিতে আঁকিবুঁকি কাটার বেশি আর কিছু করতেই পারল না। শেষ অবধি ওর শিক্ষক আমাকে বললেন ওকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে।” মলনের বয়স তখন ১৫।
সেই থেকেই মলন মায়ের সঙ্গে বাড়ির ছোটখাটো কাজকর্ম করে দিন কাটান — অবশ্য সেটাও করেন নিজের খেয়ালখুশি মতো। তিনি কথা প্রায় বলেনই না; বললেও তা কেবল রহিবাঈ ও আর মাত্র অল্প কয়েকজনের সঙ্গে। কিন্তু তিনি সবই বুঝতে ও বোঝাতে পারেন। আমি যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তিনি মুচকি হেসেছেন, মাথা নেড়েছেন, আবার মাঝে মাঝে কথাও বলে উঠেছেন।
১২ বছর বয়সে মলনের প্রথম ঋতুস্রাব হয়। সেই প্রথমবার “রক্ত বেরোচ্ছে,” এই কথা বলে তিনি পরিস্থিতি বর্ণনা করেছিলেন রহিবাঈয়ের কাছে। তাঁর মা শিখিয়ে তাঁকে দেন কীভাবে কাপড়ের প্যাড ব্যবহার করতে হয়। “কিন্তু আমার ছেলের তখন বিয়ে, বাড়িতে বিয়ের নানান আচার-অনুষ্ঠান চলছিল। সুতরাং আমার মতো মলনও (ঋতুস্রাব চলাকালীন) ‘বাইরে’ এসে বসতো,” ঋতুস্রাবের সময়ে রান্নাঘরে ঢোকার বিধিনিষেধ এবং ঘরের এককোণে বসে থাকার নিয়মের কথা বোঝাতে, রহিবাঈ বললেন। যেহেতু মলনের কাছে তাঁর মা-ই ছিলেন মাসিক ঋতুস্রাব বিষয়ে তথ্য সরবরাহের একমাত্র মাধ্যম সেহেতু তিনি হুবহু নিজের মায়ের চলনই অনুসরণ করতেন।
কিছুকাল পরে মলনের হিস্টেরকটমি করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ আসে রহিবাঈয়ের কাছে। “কখনও মলনের পাঁচ-ছয়মাস ঋতুস্রাব হতো না আর আমি ভয়ে মরতাম (ও সন্তানসম্ভবা হয়ে গেল ভেবে)। ও তো বিশেষ কথা বলে না। কিছু ঘটে থাকলে আমি জানবো কী করে? আমি ওকে পরীক্ষা করাতে দুবার (ওয়াদি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে) পুণের পরিবার পরিকল্পনায় চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাই (ভারতের পরিবার পরিকল্পনা সঙ্ঘ) — শেষবার যাই ২০১৮ সালে।” গর্ভসঞ্চার হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার কিট সহজেই পাওয়া যায় ওষুধের দোকানে কিন্তু রহিবাঈয়ের পক্ষে মলনের জন্য তা জোগাড় করা কঠিন।
ঋতুস্রাবকে সামাজিকভাবে ঝামেলা বা সমস্যা হিসাবে দেখা, যৌনশিক্ষার অভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাব - ইত্যাদি কারণে মানসিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন অল্পবয়সী মেয়ে এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে হিস্টেরেকটমি অর্থাৎ অস্ত্রোপচার করে জননাঙ্গ বাদ দিয়ে দেওয়ানোর প্রবণতা দেখা যায়।
এই প্রবণতার কথা প্রথম খবরের শিরোনামে আসে ১৯৯৪ সালে, যখন ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন মেয়েদের হিস্টেরেকটমি করা হয় পুণের সাসুন সাধারণ হাসপাতালে। পুণে জেলার শিরুর তালুকের, সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মানসিক প্রতিবন্ধতাসম্পন্ন বালিকাদের বিদ্যালয় থেকে তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ একে ঋতুস্রাব ও মেয়েদের উপর যৌন অনাচার সামলানোর উপায় হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে।
রহিবাঈ আমাকে বলেছিলেন, ‘পুণের চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসকরা [মলনের] জরায়ু বাদ দেওয়ার আপারেশন করাতে বলেছিলেন। কিন্তু, আমি জানতে চাইলাম যে জরায়ু বাদ দেওয়ার বদলে নাসবন্দি (টিউবেকটমি) করা যায় কি না’
বিনা অনুমতিতে এমনকি ১০ বছরের শিশুদের উপরেও এই অস্ত্রোপচার হচ্ছে, এই তথ্যের ভিত্তিতে পুণের জনস্বাস্থ্য কর্মী ডঃ অনন্ত ফাড়কে বম্বে উচ্চন্যায়ালয়ে রিট পিটিশন দাখিল করেন। যাঁরা পিটিশন দাখিল করেছিলেন তাঁরা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন যে প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন মহিলারা বিভিন্ন স্থানে যৌন নির্যাতন, অবহেলা, অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের শিকার হন। এই পিটিশন জনতার মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করার ফলে অস্ত্রোপচার বন্ধ হয় কিন্তু ততদিনে ১১টি অস্ত্রোপচার করা হয়ে গেছে বলে তখন খবর পাওয়া যায়। গতবছর, পিটিশন দাখিলের ২৫ বছর পর ১৭ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে বম্বে উচ্চন্যায়ালয় জানায় যে সব তর্কবিতর্ক শেষ হয়েছে এবার কেবল বিচারের ফলাফল প্রকাশের অপেক্ষা।
রহিবাঈ আমাকে বলেছিলেন, “পুণের চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসকরা [মলনের] জরায়ু বাদ দেওয়ার আপারেশন করাতে বলেছিলেন। কিন্তু, আমি জানতে চাইলাম যে জরায়ু বাদ দেওয়ার বদলে নাসবন্দি (টিউবেকটমি) করা যায় কি না।”
বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মেয়েদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা চলছে তখন সুদূর ওয়াদি গ্রামে রহিবাঈ নিজের মেয়ের প্রয়োজন অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন। মলনের ছোটো বোন (বিবাহিত, পুণে নিবাসী) এবং সব তুতো বোনেরাও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ওঁদের বক্তব্য ছিল, “যৌবনকালে কিছু হয়নি যখন এখন কেন আর ওকে যন্ত্রণা দেওয়া? থাক না।” ফলে মলনের না করাতে হয়েছে বন্ধ্যাত্বকরণ না হিস্টেরেকটমি।
কিন্তু, বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মেয়েদের কখনও বিয়ে বা সন্তান হবে না অতএব এঁদের জরায়ু রেখে লাভ নেই — এই যুক্তিতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বহু মেয়ের মা-বাবা-ই তাঁদের উপর এই অস্ত্রোপচার করিয়ে নেন এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মেয়েদের জন্য বিশেষ আবাসিক প্রতিষ্ঠানগুলিও অনেকসময়ে এই অস্ত্রোপচারকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসাবে রাখেন। এই পদ্ধতি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মেয়েদের ঋতুস্রাব সামাল দিতে সাহায্য করে। যৌন নির্যাতন ও তজ্জনিত গর্ভধারণের আশংকা থেকেও এই অস্ত্রোপচার করানো হয়।
কিন্তু এইসব ভীতির সেই অর্থে বাস্তব ভিত্তি থাকে না। “প্রতিবন্ধকতার সীমানায় থাকা অধিকাংশ মেয়েরাই বয়ঃসন্ধিকালে কী হয় তা বোঝে, ফলে ঋতুস্রাবের সময় কী করা উচিত তা তাঁদের শেখানো সম্ভব,” বললেন অচ্যুত বোরগাভকার, পুণের তথাপি ট্রাস্টের পূর্বতন সঞ্চালক। তথাপি ট্রাস্ট, মা-বাবা, শিক্ষক ও শুশ্রুষাকারীদের প্রতিবন্ধকতা ও যৌনতা বিষয়ক সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। “কিন্তু আমাদের জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থায় এই (জীবন দক্ষতা এবং প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জন্য যৌন শিক্ষার) ব্যবস্থা নেই।”
পোক্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জনকল্যাণমুখী পরিকাঠামো এবং পরিবার ও সমাজের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া প্রতিবন্ধী মানুষের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক অধিকারগুলি রক্ষা করা খুব কঠিন বলে জানালেন মেধা টেংশে।
“আমরা নিরুপায়”, বললেন ওয়াদি থেকে আন্দাজ ১০ কিলোমিটার দূরে কোলওয়ান উপত্যকায় অবস্থিত, ১৯৯৪-সালে প্রতিষ্ঠিত (নথিভুক্ত সংস্থা হিসাবে) সাধনা গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মেধা টেংশে (বিগত ২০ বছর ধরে রহিবাঈ, সামান্য সাম্মানিক নিয়ে সাধনা গ্রামের সমাজকর্মী হিসাবে কাজ করছেন)। “মোটামুটি ১৫ বছর আগে আমরা এমন নিবেদিতপ্রাণ শুশ্রুষাকর্মী পেয়েছিলাম, যাঁরা আমাদের বয়ঃপ্রাপ্ত আবাসিকদের ঋতুস্রাবের সময়ে খেয়াল রাখতেন এবং সাহায্য করতেন। এই অবস্থা আজ আর নেই। নিজের যত্ন যাতে নিতে পারেন এমন মৌলিক প্রশিক্ষণ আমরা এখানকার আবাসিক মহিলাদের দিয়ে থাকি। কিন্তু কখনও কখনও আমরাও সামাল দিতে পারিনা। তখন আমাদের অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।”
শক্তিশালী জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার অভাব চোখে পড়ে কোলওয়ান গ্রামে অবস্থিত, ওয়াদির নিকটতম স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রটিতে। মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রজনন-স্বাস্থ্য রক্ষা বিষয়ক চাহিদার কথা জিজ্ঞেস করায় ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দুজন পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মী, একজন পুরুষ স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং দুজন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। “আমরা কিশোরী আর মহিলাদের মধ্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করি,” বললেন একজন সহায়ক নার্স ও ধাত্রী। আর কী করেন জানতে চাওয়ায় তাঁরা দ্বিধান্বিতভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কুলে গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ওয়াদির নিকটতম (১১ কিলোমিটার দূরে) — সেখানেও অবস্থা তথৈবচ। সুবর্ণা সোনার নামের এক আশা-কর্মী (স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সামাজিক স্বাস্থ্য-কর্মী) জানালেন যে কুলে গ্রামে দুজন মেয়ে আছে যাদের ‘শিখতে বেশি সময় লাগে’ আর কোলওয়ানে এমন মেয়ে আছে চার-পাঁচ জন। কিন্তু তিনি আরও জানালেন যে এদের জন্য কোনও বিশেষ স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই বললেই চলে। “বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছালে এদের ব্যবহার বদলে যায়। আমরা বুঝি না ওদের কীভাবে কী বলব।”
৩মে ২০০৮-এ প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সংক্রান্ত, রাষ্ট্রসংঘের বিশেষ সভায় গৃহীত প্রস্তাবের ২৫ (এ) ধারা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় — এই ধারা অনুসারে, ‘রাষ্ট্র আর সব মানুষের যা প্রাপ্য সেই মানের যৌন ও প্রজনন কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসহ আর সব স্বাস্থ্য পরিষেবার এবং জনসংখ্যা-ভিত্তিক জনস্বাস্থ্য প্রকল্পের ব্যবস্থা প্রতিবন্ধী মানুষের জন্যেও বিনামূল্যে অথবা স্বল্প মূল্যে করবে’।
ভারত রাষ্ট্রসংঘের সভার সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি জানালেও কেবলমাত্র ২০১৬ সালের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের অধিকার সংক্রান্ত আইন বলে প্রথমবার তাঁদের অনুমতি ছাড়া নির্বীজকরণ/বন্ধ্যাত্বকরণ নিষিদ্ধ করে। এই আইন অনুসারে রাষ্ট্র, ‘প্রতিবন্ধী মানুষ, বিশেষত প্রতিবন্ধী মহিলাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে’ এবং ‘দেখতে বাধ্য থাকবে যাতে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সঠিক তথ্য তাঁরা পান’।
কিন্তু এই আইনেও বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী ও মন্দবুদ্ধি সম্পন্ন মহিলাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কিছু বলা নেই — অথচ সামজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে ভারতে এমন মহিলার সংখ্যার ৬ লাখ যার মধ্যে ৪ লাখ থাকেন গ্রামাঞ্চলে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধীদের যৌন চাহিদাহীন অথবা অতিরিক্ত যৌন চাহিদাসম্পন্ন মনে করা হয়। তাঁদের প্রজনন কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য ‘সামলানোর’ নামে তাঁদের ভালোবাসা, সাহচর্য্য, যৌন চাহিদা এবং ঘনিষ্ঠতার প্রয়োজনীয়তা ও মাতৃত্বের অধিকার অস্বীকার করা হয় বলে জানাচ্ছে, ২০১৭ সালের প্রতিবন্ধতা ও যৌনতা বিষয়ক একটি গবেষণা পত্র।
মলনের বিয়ের কথা কখনও ভেবেছিলেন কি না আমি রহিবাঈকে জিজ্ঞেস করলাম। “অনেকে এই পরামর্শ দিয়েছিল বটে, এমনকি বিয়ের প্রস্তাবও এনেছিল কিন্তু আমরা ওর বিয়ে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই,” তিনি বললেন। “ও শাড়ি পরতেই পারে না, তো নিজের সংসার কী করে সামলাবে? ওর ভাইরাও (দুইজন) বলে ‘ওকে নিজের বাড়িতেই মরতে দাও’।” রহিবাঈ জানেন মলনের মতো অনেক মেয়েই বিয়ের পর স্বামীর ঘরে মানিয়ে নিতে না পেরে মা-বাবার কাছেই ফিরে আসেন।
পুণের এক শিক্ষাব্রতী, পরামর্শদাতা ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তির মা ডঃ সুনীতা কুলকর্ণি অবশ্য বললেন যে বয়ঃপ্রাপ্ত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের যৌন অধিকারের স্বীকৃতি জরুরি। “এবং যৌনতা মানে সর্বদা দৈহিক মিলন না,” বললেন তিনি। “যৌনতার কত দিক আছে। বন্ধুত্ব আছে, ঘনিষ্ঠতা আছে, অল্পস্বল্প খুনসুটি বা একসাথে এক কাপ কফি খাওয়া। কিন্তু এইটুকুও কেউ মেনে নেয় না।”
তার বদলে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালে যৌন অনুভূতির প্রকাশ ঘটালে বেশিরভাগ পরিবার এবং শুশ্রুষাকারী এতে বাধা দেয়, অনেকে ওষুধ দিয়ে যৌন হরমোন নিঃসরণ রোধ করে আবার অনেকে যৌনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটলে নিদারুণ শাস্তি অবধি দেয়। “এই অনুভূতিগুলি থেকে এঁদের বঞ্চিত করে আমাদের কী লাভ হয়?” প্রশ্ন তুললেন ডঃ শচীন নগরকর, যিনি মুলশি তালুকের পাওদ গ্রামে ১৫ বছর যাবৎ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষদের সাথে কাজ করছেন। “যৌন চাহিদা খুব স্বাভাবিক এবং সুস্বাস্থ্যের বহিঃপ্রকাশ। একে থামানো, রোধ করা বা অস্বীকার করা যায় না।”
একদিকে তাঁদের যৌন চাহিদা অস্বীকার করা হয়, অথচ প্রতিবন্ধী মহিলা এবং মেয়েরা বহুসময়েই যৌন আক্রমণ ও নিপীড়নের শিকার হন। মলন এবং তাঁর তুতো বোন, দুজনেই গ্রামের ছেলেদের হাতে আক্রান্ত ও হেনস্তা হয়েছেন
একদিকে তাঁদের যৌন চাহিদা অস্বীকার করা হয়, অথচ প্রতিবন্ধী মহিলা এবং মেয়েরা বহু সময়ে যৌন আক্রমণ ও নিপীড়নের শিকার হন। মলন এবং তাঁর তুতো বোন, ৩৮ বছর বয়সী রূপালী (নাম পরিবর্তিত), যিনি মানসিক প্রতিবন্ধী - দুজনকেই গ্রামের ছেলেদের হাতে আক্রান্ত এবং হেনস্তা হতে হয়েছে হয়েছে তাঁদের যৌবনকালে। “কোনও কোনও ছেলে টিটকারি দিত, কেউ ওদের শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করত, কেউবা বাড়িতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা না থাকাকালীন এসে হাজির হত,” রহিবাঈ আমাকে জানালেন। তিনি সর্বদা এই নির্যাতন তার ফলাফলের ভয় দিন কাটাতেন।
কিন্তু রহিবাঈ নিজের দুশ্চিন্তা নিয়ে গুমড়ে থাকেননি। ওয়াদি গ্রামের ৯৪০ জন মানুষের মধ্যে ছয়জনের কোনও না কোনও ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা আছে - এঁদের মধ্যে মলন সহ দুইজন মহিলা ও চার জন পুরুষ। রহিবাঈ গ্রামের একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য, সেই গোষ্ঠীর মহিলারা সম্মিলিতভাবে গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এই বিশেষ বন্ধুদের জন্য দেবরাঈ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। ছয়জন ‘বিশেষ বন্ধুর’ জন্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে ও (নিজেদের যত্ন নেওয়া সহ) বিবিধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে, সপ্তাহে দুদিন, ওয়াদি থেকে ময়ূরী গাইকওয়াড় এবং সাধনা গ্রাম থেকে শলন কাম্বলে এখানে আসেন। “গ্রামের কেউ কেউ আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করে কারণ ওরা ভাবে যে এই ‘পাগল’ ছেলে-মেয়েদের কিছু শেখানোই বৃথা। কিন্তু আমরা মোটেও থেমে যাব না,” বললেন ময়ূরী।
“আমি তৈরি করেছি”, এই কাজের অঙ্গ হিসাবে সবুজ-সাদা পুঁথি দিয়ে বানানো একটা মালা সগর্বে তুলে ধরে মলন বললেন।
আর পাঁচটা গড়পড়তা দিনে মলন বাড়ির কাজ বাবদ কল থেকে ড্রামে জল ভরে আনেন পরিবারের ব্যবহারের জন্য আর স্নান করেন। তারপর যথারীতি মাটির উনানে খানিক চা চলকে ফেলে মায়ের কাছে বকুনি খান।
তারপর এইভাবেই, স্নেহময় পরিবারের ছত্রছায়ায়, ঝলমলে রাঙা ব্লাউজ আর প্রিয় গোড়ালি অবধি ঝুলের স্কার্টটা পরে মলন আরেকটা দিনের সম্মুখীন হন।
নিবন্ধকার তথাপি ট্রাস্টের অছি-সদস্য, বিগত ১৮ বছর তিনি তথাপির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
সাধনা ভিলেজ-এর মেধা টেংশে, বিজয়া কুলকর্ণি এবং পুণের তথাপি ট্রাস্টের আছুত বোরগাভকারকে নিবন্ধকারের সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ।
প্রচ্ছদ চিত্র: নিউ - মিডিয়া শিল্পী প্রিয়াঙ্কা বোরার নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ভাব এবং অভিব্যক্তিকে নতুন রূপে আবিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত আছেন । তিনি শেখা তথা খেলার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করছেন ; ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ায় তাঁর সমান বিচরণ এবং সেই সঙ্গে কলম আর কাগজের চিরাচরিত মাধ্যমেও তিনি একই রকম দক্ষ ।
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
অনুবাদ : চিলকা