“আমার বানানো ঝোপড়িগুলো (ঝুপড়ি) ৭০ বছর তো টেকেই।”
বিরল দক্ষতার মালিক বিষ্ণু ভোসলে — কোলাপুর জেলার জাম্ভালি গ্রামের এই মানুষটি ঝোপড়ি বানাতে ওস্তাদ।
কাঠের কাঠামোর উপর ছাউনি পেতে কুঁড়েঘর বানানোর কৌশলে প্রয়াত পিতা গুন্দুর কাছে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন ৬৮ বছরের বিষ্ণু। আজ অবধি ১০টারও অধিক ঝোপড়ি বেঁধেছেন, আর সমসংখ্যক ঝোপড়ি বাঁধার কাজে সহায়তাও করেছেন। “গরমকালে তো মাঠেঘাটে কাজ থাকে না তেমন, তাই [সাধারণত] শুধু ওই সময়টাতেই এসব বানাতাম,” তারপর মনে করে বললেন, “ঝোপড়ি বাঁধা ঘিরে লোকজনের উৎসাহের অন্ত থাকত না।”
বিষ্ণুর মনে পড়ে, মোটামুটি ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি ঝোপড়ি ছিল জাম্ভালি গাঁয়ে। হাতের কাছে যা কিছু মাল-মশলা পাওয়া যেত, তা দিয়েই একে অপরের সাহায্যে কুঁড়েঘর বানাতেন বন্ধুরা মিলে। তাঁর জবানে: “ঝোপড়ি বানাতে একটা কড়িও খরচা করিনি কখনও। অত পয়সা ছিলই না কারও কাছে। যতক্ষণ না জুতসই সাহিত্য [মাল-মশলা] মিলছে, ততদিন পর্যন্ত বাড়ি বাঁধার কাজে হাত দিত না কেউ, তিন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকত।”
বিংশ শতাব্দীর শেষে, ৪,৯৬৩ জন (জনগণনা ২০১১) মানুষের এই গাঁয়ে ছাউনি পাতা কাঠের বাড়ি হটিয়ে জায়গা দখল করে ইট, সিমেন্ট ও টিন। প্রথমে আসে স্থানীয় কুমোরদের বানানো খাপরি কৌলু (ছাদ-ছাওয়ার টালি) বা কুম্ভারি কৌলু, তারপর দেখা দেয় যন্ত্রনির্মিত ও অপেক্ষাকৃত শক্তপোক্ত এবং টেকসই বেঙ্গালুরু কৌলু — এভাবেই উধাও হতে থাকে প্রথাগত ঝোপড়ি।
অপেক্ষাকৃত কম রক্ষণাবেক্ষণেই টিকে থাকত টালি, বসানোও ছিল সহজ, বেশি সময়ও লাগত না — উল্টোদিকে ঝোপড়ির চালা ছাইতে মেহনত লাগত বিস্তর। তারপর, ইট-সুরকির পাকা দালানবাড়ি এসে শেষ পেরেকটা মেরে দিয়ে যায় ঝোপড়ির কফিনে, হুহু করে কমতে থাকে তাদের সংখ্যা। জাম্ভালির মানুষজন ঝোপড়ির ইস্তেমাল একে একে বন্ধ করে দিতে থাকেন, আজ হাতে-গোনা কয়েকটি বাদে কুঁড়েঘর আর দেখাই যায় না।
“কালেভদ্রে দুয়েকটা ঝোপড়ি চোখে পড়ে গাঁয়ে। কয়েক বছর পর প্রথাগত কুঁড়ে আর একটাও থাকবে না। এগুলো টিকিয়ে রাখা বহুত ঝকমারির কাজ, অত ঝুটঝামেলা আর কেউই পোহাতে চায় না,” জানালেন বিষ্ণু।
*****
এ হেন খরা কাটিয়ে বিষ্ণু ভোসলের কাছে ঝোপড়ি বাঁধার প্রস্তাব নিয়ে আসেন তাঁর বন্ধু ও পড়শি নারায়ণ গায়কোয়াড়। পেশায় তাঁরা দুজনেই চাষি, দেশের বহু কৃষক-আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছেন তাঁরা। (পড়ুন: ভগ্ন বাহু আর অটুট উদ্যম নিয়েই লড়াইয়ে সামিল জাম্ভালির এক কৃষক ।)
জাম্ভালিতে যথাক্রমে ১ ও ৩.২৫ একর জমি আছে বিষ্ণু ও নারায়ণের। আখের পাশাপাশি দুজনেই জোয়ার, খাপলি (এমের) গম, সোয়াবিন, সাধারণ বিন ও পালংশাক, মেথি ও ধনের মতো পত্রবহুল সবজি চাষ করেন।
আজ এক দশক ধরে মনের ভিতর ঝোপড়ি বানানোর ইচ্ছে ধরে রেখেছেন নারায়ণ। ঔরঙ্গাবাদ জেলায় গিয়ে কামকাজের পরিবেশ বিষয়ে কথা বলছিলেন খেতমজুরদের সঙ্গে, তখন একখানা গোলাকার কুঁড়েঘর দেখে ভেবেছিলেন, “আগডি প্রেক্শনি [অত্যন্ত সুন্দর]। ত্যাচা গুরুত্বাকর্ষণ কেন্দ্র আগডি বরোবর হোতা [মাধ্যাকর্ষণ-কেন্দ্রটি খুবই ভালোভাবে ভারসাম্য বজায় রেখেছিল]।”
খড়-নির্মিত ঝোপড়িটির প্রতিটা অংশ ছিল নিপুণভাবে বানানো, মনে পড়ে ৭৬ বছর বয়সি নারায়ণের। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন যে সেটি একজন খেতমজুরের বানানো, তাঁর সঙ্গে মোলাকাত হয়নি ঠিকই, তবে নোটবইয়ে সবটা লিখে রেখেছিলেন। দশকের পর দশক ধরে, প্রতিনিয়ত দিনচর্যার মধ্যে চিত্তাকর্ষক কিছু দেখতে পেলেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় ভরে ওঠে তাঁর খাতা। সে পকেটে আঁটুক বা এ-ফোর আকারের হোক — এমন ৪০টি ডায়েরির হাজার হাজার পাতায় ভরা আছে স্থানীয় মারাঠি বুলিতে লেখা বিবরণী।
এক দশক পর ৩.৫ একর খামারের উপর এমনই একটি কুঁড়েঘর বানানোর ইচ্ছে হয় তাঁর। কিন্তু ইচ্ছে হলেই তো আর হয় না, ঝক্কি অনেক, ঝোপড়ি বাঁধতে পারেন এমন একজন কারিগরও দরকার।
তখন অভিজ্ঞ ঝোপড়ি-শিল্পী বিষ্ণু ভোসলের সঙ্গে কথা বলেন নারায়ণ। তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টার জলজ্যান্ত প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে খড়ে-ছাওয়া কাঠের ঝুপড়িটি, হাতে-বানানো স্থাপত্য কারিগরির এক অনন্য নিদর্শন।
“যতদিন ঝোপড়িটা আছে, ততদিন এক হাজার হাজার বছর প্রাচীন এই শিল্পের কথা মনে রাখবে উঠতি প্রজন্ম,” জানালেন নারায়ণ। তাঁর স্থাপত্যসঙ্গী বিষ্ণু ফুট কাটলেন পাশ থেকে, “নইলে লোকে আমার কাজের কথা জানবে ক্যামনে শুনি?”
*****
ঝুপড়ি বানানোর প্রথম ধাপে বুঝে নিতে হয় কুঁড়েঘরটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য, “সেটার উপর নির্ভর করছে ঝোপড়ির আকার আর গড়ন,” বললেন বিষ্ণু। এই যেমন খড়বিচালি রাখার ঝোপড়ি হয় তিনকোনা, আর ছোট্টখাট্ট পরিবার বাস করলে আকারটা ১২ বাই ১০ হাতের চৌকো হলে ভালো।
নারায়ণ বই পড়তে ভালোবাসেন, তাই ছোটো একখান কামরার আকারের ঝোপড়ি চেয়েছিলেন, যেখানে আয়েশ করে বসে বই পড়তে পারবেন। বই, পত্রিকা, খবরের কাগজ, সবই এই ঘরে রাখবেন বলে জানালেন তিনি।
ঝোপড়িটা কোন কাজে ইস্তেমাল করবেন, এ বিষয়ে অবগত হওয়ার পর খানকতক কাঠি দিয়ে বাড়িটার একটি ক্ষুদ্র অবয়ব বানিয়েছেন বিষ্ণু। তারপর, ঘরের গঠন ও হরেক খুঁটিনাটি নিয়ে ঝাড়া ৪৫ মিনিট আলোচনা চলেছিল দুই বন্ধুর। নারায়ণের মাঠে বারকতক ঘোরার পর এমন একটা জায়গা বেছেছেন যেখানে বাতাসের চাপ সবচাইতে কম।
“স্রেফ গ্রীষ্ম বা শীতের কথা মাথায় রেখে ঝোপড়ি বানালে চলবে না। বহু দশক ধরে টিকিয়ে রাখতে হবে ঘরটাকে, তাই অনেক কিছু নিয়ে মাথা ঘামানো প্রয়োজন,” বললেন নারায়ণ।
কুঁড়েঘরের পরিধি বরাবর ১.৫ হাত তফাতে তফাতে দুহাত গভীর গর্ত খোঁড়া দিয়ে শুরু হল ঝোপড়ি-নির্মাণ। ১২ হাত বাই ৯ হাত হবে ঝুপড়িটির কলেবর, তাই ১৫টা গর্ত না খুঁড়লেই নয় — প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছিল এসব করতে। তারপর পলিথিন কিংবা প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হল গর্তগুলো, “যাতে এর মধ্যে কাঠের খাম্বা পুঁতলে সেগুলোয় জল না লাগে, কাঠামোটা ওয়াটারপ্রুফ করা চাই,” জানালেন বিষ্ণু। খুঁটিতে কিছু হলে গোটা ঝুপড়িটাতেই পচন ধরে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
সবচাইতে দূরে দূরে থাকা গর্তদুটো এবং যেটা মাঝখানে রয়েছে, রাজমিস্ত্রি ও দোস্ত অশোক ভোসলের সঙ্গে মিলে গর্তগুলোর মধ্যে সন্তর্পণে একটি মেড়কা বসিয়ে দিলেন বিষ্ণু। মেড়কা বস্তুটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১২ হাত, আকারে লাতিন হরফের ‘ওয়াই’। এটি আদতে চন্দন (সান্তালুম আলবুম), বাবলা (ভাকেল্লিয়া নিলোটিকা) কিংবা কডু লিম্ব অর্থাৎ নিম (আজাডিরাকটা ইন্ডিকা) গাছের ডাল।
‘ওয়াই’ খুঁটির সুচালো প্রান্তে আড়াআড়ি কাঠের গুঁড়ি চাপানো হয়। “ঘরের মধ্যিখানে যে দুটো মেড়কা বা চূড়ার বরগা (টপ কর্ড) রয়েছে, তাদের নাম আড়কাঠ। দৈর্ঘ্যে এগুলো ১২ হাতের কম হলে চলে না, বাকিগুলো ১০ হাত করে হয়,” জানালেন নারায়ণ।
শেষে এই কাঠের কাঠামোর উপর চাপবে ছাউনি। বৃষ্টির পানি যাতে ঘরে চুঁইয়ে চালার গা বেয়ে না ঝরে পড়ে মাটিতে, সেটা নিশ্চিত করবে দুই হাত উচ্চতার মেড়কাগুলি।
এমন আটখানা মেড়কা দাঁড়িয়ে গেলে ঝোপড়ির ভিত তৈরি। মেড়কা পুঁততে ঘণ্টা দুয়েক লাগে। তারপর মেড়কার উপর এসে চাপে স্থানীয় এক প্রজাতির বাঁশ দিয়ে নির্মিত ভিলু (বটম কর্ড, অর্থাৎ নিচের বরগা), যাতে কুঁড়েঘরের দুটি প্রান্ত একত্রে জুড়ে দেওয়া যায়।
“দিন দিন চন্দন আর বাবলা গাছ পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই জাতীয় দরকারি [দেশি] গাছগাছালির জায়গা দখল করেছে আখ কিংবা ঘরবাড়ি,” বক্তব্য বিষ্ণুর।
কাঠামো তৈরি হয়ে গেলে আসে কড়ি চাপানোর পালা, এটা ছাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো। এই ঝুপড়িটার জন্য ৪৪টি কড়ির কথা ভেবে রেখেছেন বিষ্ণু, ছাদের কাঠামোর দুই দিকে ২২টা করে। শতাব্দী বা আগাভে গাছের (আমেরিকান ক্যাকটাস) গুঁড়ি দিয়ে বানানো হয় এগুলো, স্থানীয় মারাঠিতে যার নাম ফাড়্যাচা ভাসা। একেকটা শতাব্দী গাছের গুঁড়ি ২৫-৩০ হাত উঁচু হয়, এই গাছের কাঠ যে কতটা শক্তপোক্ত তা এখানকার মানুষ খুব ভালো করেই জানেন।
“এই গুঁড়ি বেশ মজবুত, সেজন্য ঝুপড়িগুলো বহুদিন টেকে,” বুঝিয়ে বললেন বিষ্ণু। যত কড়ি-বরগা চাপাবেন, ততই টেকসই হবে বাড়ি, তবে “ফাড়্যাচা ভাসা কাটা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়,” বলে সাবধানও করে দিলেন তিনি।
আমেরিকান ক্যাকটাসের তন্তুও মারাত্মক টেকসই, তাই অনুভূমিক কাঠামোটা সেই তন্তু দিয়েই বাঁধা হয়। আগাভের পাতা থেকে আঁশ বা তন্তু ছাড়াতে গিয়ে আমার বা আপনার নাভিশ্বাস উঠে যাবে, কিন্তু এই কাজে নারায়ণ সিদ্ধহস্ত — কাস্তে দিয়ে তন্তু ছাড়াতে ২০ সেকেন্ডও লাগে না তাঁর। সহাস্যে বললেন, “লোকে তো এটাই জানে না যে শতাব্দীর পাতার ভিতর এরকম তন্তু আছে।”
এই জাতীয় আঁশ দিয়ে পরিবেশবান্ধব জৈবপচনযোগ্য (বায়োডিগ্রেডেব্ল) দড়িও তৈরি হয় এখানে। (পড়ুন: লুপ্তপ্রায় ভারতের প্রসিদ্ধ দড়ি শিল্প ।)
কাঠের খুঁটি ও কড়ি-বরগা তৈরি হয়ে গেলে নারকেল পাতা ও আখের গুঁড়ি দিয়ে দেওয়ালগুলো এমন কায়দায় বাঁধা হয় যে চাইলে একখান কাস্তেও গুঁজে রাখতে পারবেন।
চার দেওয়ালের কাঠামো নির্মাণ হয়ে গেলে মনোনিবেশ করা হয় ছাদের উপর। আখ গাছের আগা দিয়ে ছাউনি পাতা হয় — কচি আখ, পাতা, কাজে লাগে সবই। “আগেকার দিনে যাদের কোনও গরু-ছাগল ছিল না, সেই চাষিদের থেকে জোগাড় করতাম এসব,” বললেন নারায়ণ। তবে গুরুত্বপূর্ণ পশুখাদ্য হওয়ায় এইরকম উপজাত বস্তুর আজ মূল্য অনেকখানি, তাই চাষিরা আর এগুলো বিনেপয়সায় বিলোতে চান না।
ছাউনির কাজে জোয়ার ও খাপলি গমের খড়ও ব্যবহৃত হয় — ফাঁকফোঁকর ভরাটও হয়, আবার দেখতেও তোফা লাগে। নারায়ণের কথায়: “একেকটা ঝোপড়ি বানাতে কম করে আট বিন্দা [প্রায় ২০০-২৫০ কেজি আখের নুটি] তো লাগেই।”
ছাউনি দেওয়ার কাজটা খুবই মেহনতের, প্রায় তিনদিন ধরে তিনটে মানুষ ঘাম ঝরায় এই কাজে — মাথাপিছু প্রতিদিন ৬-৭ ঘণ্টা করে। “প্রত্যেকটা বৃন্ত দেখে-শুনে ছাইতে হয়, নইলে বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে পড়বে,” বোঝালেন বিষ্ণু। তিন-চার বছর অন্তর অন্তর নতুন করে ছাদ ছাইতে হয় — মারাঠি ভাষায় যাকে ছপ্পর শেকরনে বলে — যাতে ঝুপড়িটা বেশিদিন টেকে।
বিষ্ণুর স্ত্রী অঞ্জনার বয়স বছর ষাটেক হবে, তিনি জানালেন, “প্রথাগতভাবে জাম্ভালিতে শুধু মরদরাই ঝোপড়ি বানায়, তবে কাঁচামাল খুঁজতে সাহায্য করা থেকে মাটিটা দুরমুশ করে বসানো — এসব কাজে মহিলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
ঝোপড়ির উপরি গঠনটা শেষ হতে না হতেই শুরু হয় মেঝে বানানো। গোড়ায় প্রচুর পরিমাণে জল ঢেলে তিনদিন ফেলে রাখা হয় শুকোনোর জন্য। নারায়ণ বুঝিয়ে বললেন, “এর ফলে মাটির চটচটে ভাবটা বেরিয়ে আসে।” এরপর, চাষি বন্ধুদের থেকে কিনে আনা পান্ঢরি (সাদা) মাটি চাপান সেটার উপর। এই মাটিটা দেখতে খানিক সাদাটে, কারণ পরিস্রুত এই মৃত্তিকা লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ মুক্ত।
পান্ঢরি মাটির ক্ষমতা বাড়াতে ঘোড়া, গরু তথা অন্যান্য গবাদি পশুর বিষ্ঠা মেশানো হয়। চটচটে সেই মাটির উপর এটি ছড়ানো হলে পুরুষেরা ধুম্মুস নামে একপ্রকার কাষ্ঠনির্মিত যন্ত্র দিয়ে দুরমুশ করতে থাকেন। ধুম্মুসের ওজন অন্তত ১০ কেজি হয় — কেবল অভিজ্ঞ ছুতোররাই এটি বানাতে সক্ষম।
পুরুষদের মাটি পেটানো হয়ে গেলে বাড়ভনা হাতে এগিয়ে আসেন মহিলারা — বাবলা কাঠ দিয়ে বানানো এই তিন কেজির যন্তরটি ক্রিকেট ব্যাটের মতন দেখতে, হাতলটা অবশ্য বেশ খাটো। নারায়ণ বহু আগেই তাঁর বাড়ভনাটি হারিয়ে ফেলেছেন, তবে তাঁর ৮৮ বছর বর্ষীয় বড়দা সখারাম নিজেরটা সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন, নইলে গেরো হত।
ঝোপড়ি বানানোয় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন নারায়ণের স্ত্রী কুসুমও। ৬৮ বছর বয়সি কুসুম জানালেন, “চাষবাসের কাজ থেকে ফুরসত পেলেই মাটি পিটিয়ে সমান করতে লেগে যেতাম।” কাজটা অত্যন্ত কঠিন, তাই পরিবারের সক্কলে তথা বন্ধুবান্ধব সবাই সাহায্য করেছেন একে একে।
মাটিটা সমান হয়ে গেলে গোবরের ছড়া দিতে আরম্ভ করেন মহিলারা — কৌমজ্ঞান বলে যে এটি মাটি ধরে রাখতে সাহায্যও করে, আবার মশাও তাড়ায়।
ফটক বিনে ঘর ভাবাই যায় না। সাধারণত দেশি প্রজাতির জোয়ারের বৃন্ত, নারকেলের শুকনো পাতা দিয়েও দরজা বানানো হতো এতকাল। কিন্তু, দেশি প্রজাতির জোয়ার চাষ করেন, এমন চাষি আর একজনও নেই জাম্ভালি গ্রামে। তাই মহা ফ্যাসাদে পড়েছেন ঝোপড়ি-নির্মাতারা।
“সব্বাই এখন হাইব্রিড প্রজাতি চাষ করে, কিন্তু ওগুলো পশুখাদ্য হিসেবে ভালো নয় তেমন — পৌষ্টিক গুণাগুণ কম। তাছাড়া দেশি প্রজাতির মতো অতদিন টেকেও না,” জানান দিলেন নারায়ণ।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খোলনোলচে পালটেছে কৃষিকাজের, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে রীতিমতো শেষ হতে বসেছে ঝোপড়ি-শিল্প। আগে যখন গরমকালে বিশেষ চাষবাস হত না, তখন ঝুপড়ি বানানো হত। কিন্তু এখন বছরের কোনও সময়েই মাঠঘাট ফাঁকা পড়ে থাকে না বলে জানালেন বিষ্ণু ও নারায়ণ। “আগে, বছরে মোটে একবার ফসল ফলাতাম আমরা। কিন্তু এখন দু-তিনবার চাষ করেও নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে,” বললেন বিষ্ণু।
নারায়ণ, বিষ্ণু, অশোক ও কুসুমের সম্মিলিত মেহনতে তৈরি এই কুঁড়েঘরটি বানাতে পাঁচমাস জুড়ে লেগেছে প্রায় ৩০০ ঘণ্টা, পাশাপাশি খেত-খামারের কাজ তো ছিলই। নারায়ণের কথায়: “বড্ড ক্লান্ত করে ছাড়ে এই প্রক্রিয়াটা, কাঁচামাল পেতে পেতেই জান ঢিলা হয়ে যায়।” এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে, জাম্ভালির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাঁচামাল খুঁজে এনেছেন তিনি।
ঝোপড়ি বাঁধতে গিয়ে বারেবারে আহত হতে হয়, কাঁটায়-চোঁচে জেরবার হয়ে যান কারিগরেরা। “এ ব্যথা-বেদনা যদি সইতে না পারেন, তাহলে চাষি হয়েছেন কেন শুনি?” নিজের ক্ষতবিক্ষত আঙুল দেখিয়ে বলে উঠলেন নারায়ণ।
শেষমেশ তৈরি হয়েছে ঝুপড়িখানা। কারিগরির কাজে যাঁরা যাঁরা হাত লাগিয়েছেন, প্রত্যেকেই শ্রান্ত, তবে ঘরখানি দেখে হাসি ফুটেছে সব্বার মুখে। যতদূর মনে হচ্ছে, জাম্ভড়ি গাঁয়ে এটাই শেষ ঝোপড়ি। কারণ হাতেনাতে এই কাজ শিখতে তেমন একটা কেউ আসেনি, বললেন বিষ্ণু। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে দিতে নারায়ণ বললেন, “কোন ইওদে কিভা নাহি ইওদে, আপল্যালা কাহিহি ফরক পড়ত নাহি [লোকজন আসুক বা না আসুক, তাতে কিছুই এসে যায় না।]” নিজ সহায়তায় নির্মিত এই ঝোপড়ির ভিতর অন্তত শান্তিতে যে ঘুমোতে পারছেন, এটাই অনেক। তাছাড়া এটিকে গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করার ইচ্ছে আছে তাঁর।
“বাড়িতে কোনও ইয়ার-দোস্ত বা মেহমান এলে, সগর্বে এই ঝোপড়িটা দেখাই তাঁদের, আর এই প্রথাগত শিল্পটি বাঁচিয়ে রেখেছি বলে সব্বাই প্রশংসা করে,” জানালেন নারায়ণ গায়কোয়াড়।
মৃণালিনী মুখার্জি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় লিখিত সংকেত জৈনের এই প্রতিবেদনটি গ্রামীণ কারিগরদের ঘিরে সৃষ্ট একটি সিরিজের অংশ।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র