৪ঠা মে, দুটো দেহের সৎকার হওয়া বাকি আছে তখনও। সহকর্মী পাপ্পুকে এটাই বলতে চেয়েছিলেন হরিন্দর সিং, তবে তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি যে পাপ্পু ওরকম ঘাবড়ে যাবে। আসলে যেভাবে তিনি কথাটা পেড়েছিলেন সেটা ছিল অত্যন্ত উদ্ভট।

হরিন্দর বলেছিলেন: "ভাই রে, ছোকরা দুটো শুয়ে আছে তো।" প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেলেও তাঁর সহকর্মীরা যখন বুঝতে পারেন যে হরিন্দরের গলায় একফোঁটাও কৌতুক নেই, তখন হাসিতে ফেটে পড়েন তাঁরা। নিগম বোধ – নয়া দিল্লির ব্যস্ততম শ্মশানঘাট – দগদগে ছাই আর ঘেমো শরীরের মধ্যে ফারাক বলতে যেখানে আঙার ছাড়া আর কিছুই থাকে না, সেখানে এমন হাসিঠাট্টার সুযোগ সত্যিই কদাচিৎ মেলে।

তবে হরিন্দরও নাছোড়বান্দা, ব্যাপারটা আমাকে ঠিকঠাক না বোঝানো অবধি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। সারি সারি চুল্লির কাছেই একটা ছোট্টো কামরায় সহকর্মীদের সঙ্গে নৈশভোজ সারছিলেন তিনি। বুকভরে খানিকটা দম নিলেন। নারকীয় অতিমারির আবহাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারাটাও পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার! তারপর বলতে শুরু করলেন, "ওই তো, আপনারা যাদের লাশ বলেন, আমরা তাদের বলি 'ছোকরা'!"

"যারা যারা সব আসছে এখানে, সব্বাই তো কারও ছেলেমেয়ে বলুন? আমিও তো একজন বাবা," বলতে লাগলেন পাপ্পু, "ওদেরকে চুল্লিতে ঢোকানোর সময় বুকটা ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, জানেন তো? কিন্তু ওদের আত্মার সদগতি না করে উপায়ও তো নেই আমাদের, তাই না?" আজ প্রায় একমাস হতে চললো, রোজই ২০০ জন মানুষের সদগতির দ্বায়িত্ব নিয়ে চলেছে নিগম বোধ ঘাট – তা সে গ্যাস-চালিত চুল্লিতে হোক, কিংবা খোলা আকাশের নিচে জ্বলন্ত কাঠের চিতায়।

সেদিন, অর্থাৎ ৪ঠা মে, ৩৫ জনকে দাহ করা হয়েছিল নিগম ঘাটের ওই সিএনজি (ঘনীভূত প্রাকৃতিক গ্যাস) চুল্লিগুলোয়। তবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন নাভিশ্বাস উঠেছিল দিল্লির, তখন গড়ে ৪৫-৫০টি দেহ পুড়ত এখানে, আজকের সংখ্যাটা তার চেয়ে খানিকটা হলেও কম। আর এই অতিমারির আগে? মেরেকেটে সারা মাসে ওই ১০০টির মতো শবদেহের মুখ দেখতো এখানকার সিএনজি চুল্লিগুলো।

যমুনার ধারে দিল্লি কাশ্মীর গেট এলাকায় রয়েছে একটা প্রকাণ্ড দেওয়ালচিত্র, সেটাই এই ঘাটে ঢোকার রাস্তা। সেখানে লেখা রয়েছে: "আমায় এতদূর বয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ। এবার আমার একলা চলার পালা।" তবে এবছর এপ্রিল-মে নাগাদ আমাদের রাজধানীর মসনদ যখন কোভিড-১৯এর দখলে, তখন মৃতেরা কিন্তু আদৌ একা ছিলেন না – ওপারে হেঁটে যাওয়ার পথে অন্তত একজন হলেও সঙ্গী জুটেছিল তাঁদের পোড়া কপালে।

Left: New spots created for pyres at Nigam Bodh Ghat on the banks of the Yamuna in Delhi. Right: Smoke rising from chimneys of the CNG furnaces
PHOTO • Amir Malik
Left: New spots created for pyres at Nigam Bodh Ghat on the banks of the Yamuna in Delhi. Right: Smoke rising from chimneys of the CNG furnaces
PHOTO • Amir Malik

বাঁদিকে: যমুনার পাড়ে চিতা সাজানোর জন্য নতুন জায়গার বন্দোবস্ত করা হয়েছে দিল্লির নিগম ঘাটে। ডানদিকে: সিএনজি চুল্লির চিমনি থেকে গলগল করে বেরোচ্ছে নিকষ কালো ধোঁয়া

সেখানে ঢুকতে না ঢুকতেই টের পেলাম মড়াপোড়ার গন্ধ আর যমুনার পচা জল মিলেমিশে বাতাসটাও কেমন যেন ভারী হয়ে উঠেছে, অথচ দু-দুটো মাস্ক পরেছিলাম আমি। নদীর গাঙে দাউদাউ করে জ্বলছে প্রায় ২৫টি চিতা। শ্মশান থেকে যে সরু রাস্তাটা এঁকেবেঁকে নদীর পাড়ে গিয়ে উঠেছে, তার ডানদিকে জ্বলছিল আরও ৫ জন, বাঁদিকে আরও ৩। এখানেই শেষ নয়, পিছুপিছু সারি দিয়ে অপেক্ষা করছিল অসংখ্য অশরীর।

শ্মশান চত্বরে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় দুরমুশ করে সাজানো হয়েছিল আরেকটি কাঠের চুল্লি, একসঙ্গে ২১ জনের শেষকৃত্য করা সম্ভব সেখানে – কিন্তু হায়, তা সত্ত্বেও জায়গা কম পড়ে যাচ্ছে। শ্মশানের ঠিক মাঝখানটাতে বৃথাই বেড়ে ওঠার চেষ্টা করছিল একটা গাছ, চিতার আগুনে ঝলসানো তার ডালপালা যেন বিধ্বস্ত এই দেশের বিহ্বলতার স্বাক্ষী।

হতভাগ্য আমাদের জন্মভূমি আজ মৃত্যুর সাতকাহনে মশগুল, এখানকার কর্মীরা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাঁরা যেখানটায় কাজ করেন, অর্থাৎ কয়েকটি হলঘর জুড়ে যেখানে সারি দিয়ে সাজানো রয়েছে সিএনজি চুল্লিগুলি, সেখানে দিন নেই, রাত নেই, জীবন্ত লাশ হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। তাঁরা সকলেই মৃতের আত্মীয়স্বজন। কেউ বা উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটে বেড়াচ্ছেন, কেউ বা থমকে আছেন, কোথাও পাক দিয়ে উঠেছে কান্নার রোল, কারও বিলাপে মিশে আছে অসহায় প্রার্থনা – ভালোবাসার মানুষগুলো পরলোকে আর কিছু না হোক যেন শান্তিটুকু পায়। মিটমিটে টিউবলাইটে সাজানো কয়েকটা বিশ্রামাগার রয়েছে বটে, তবে সেগুলো কেউ ব্যবহার করেন না সচরাচর।

সব মিলিয়ে ছ'খানা চুল্লি রয়েছে এখানে যার মধ্যে "আধা তো গতবছরই বানানো হ'ল, ওই যবে থেকে করোনা এসে লাশের ঢের লাগাতে শুরু করলো," জানালেন পাপ্পু। অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে সিএনজি চুল্লিগুলোর উপর অধিকার একমাত্র তাঁদেরই যাঁরা করোনার কোপে প্রাণ হারিয়েছেন।

যখন যাঁর পালা আসে পুড়ে ছাই হওয়ার, তখন তাঁকে চুল্লি অবধি বয়ে আনার দ্বায়িত্ব থাকে তাঁর আত্মীয়স্বজন, হাসপাতালের কর্মী কিংবা এখানকার কর্মচারীদের উপর। কিছু মৃতদেহ সাদা চাদরে ঢাকা – তাঁরা কপাল করে জন্মেছিলেন বলতে হবে, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃতদেহগুলিকে সাদা প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে সরাসরি অ্যাম্বুল্যান্স থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়। কেউ আসেন স্ট্রেচারে শুয়ে শুয়ে, কারও ভাগ্যে জোটে শ্মশানসঙ্গীর কাঁধ।

মৃতদেহ রাখা হয় তলায় চাকা-লাগানো পিঁড়ির আকারের একটি লোহার পাতের উপর, তারপর দুটি রেললাইনের সহায়তায় অশরীরগুলো এক ঝটকায় পৌঁছে যায় চুল্লির অন্দরে। এর পরের ধাপটার জন্য অসম্ভব ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন, দেহটিকে চুল্লিতে ঢুকিয়েই তৎক্ষণাৎ ওই চাকা-লাগানো পাতটিকে বাইরে এনে দড়াম করে চুল্লির দরজা বন্ধ করে দেন কর্মীরা। লোহার এ নির্মম গর্ভে এক এক করে অদৃশ্য হয়ে যায় শরীর, আর চোখের জল মুছতে মুছতে মৃতের পরিবার দেখেন কেমনভাবে তাঁদের ভালোবাসার মানুষটি এবার চিমনি থেকে বেরিয়ে আসছেন গলগলে নিকষ কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে।

Left: A body being prepared for the funeral pyre. Right: Water from the Ganga being sprinkled on the body of a person who died from Covid-19
PHOTO • Amir Malik
Left: A body being prepared for the funeral pyre. Right: Water from the Ganga being sprinkled on the body of a person who died from Covid-19
PHOTO • Amir Malik

বাঁদিকে: সৎকারের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে একটি শবদেহ। ডানদিকে: কোভিডে প্রাণ হারানো এই ব্যক্তিটির দেহে ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে গঙ্গাজল

"দিনের প্রথম দেহটা পুড়ে ছাই হতে ঘন্টা দুয়েক লাগে, বুঝলেন? আসলে চুল্লিটা গরম হতে একটু সময় লাগে তো, তাই। তারপর থেকে ওই ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই এক একটা শরীর শেষ হয়ে যায়," জানালেন পাপ্পু। দৈনিক ৭-৯টা দেহ সৎকার করার ক্ষমতা রাখে এখানকার প্রতিটা চুল্লি।

যে চারজন কর্মী নিগম বোধ ঘাটের যাবতীয় দায়দায়িত্ব সামলান তাঁরা প্রত্যেকেই কোরি সম্প্রদায়ের (উত্তরপ্রদেশের একটি তফশিলি জাতি বিশেষ)। সবচাইতে বেশিদিন ধরে রয়েছেন উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার ৫৫ বছরের হরিন্দর। ২০০৪ সাল থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তিনি। ৩৯ বছরের পাপ্পু উত্তরপ্রদেশের কাঁশীরাম নগর জেলার সোরন ব্লকের বাসিন্দা, তিনি এখানে কাজ করছেন ২০১১ থেকে। সবার শেষে যোগ দিয়েছেন গোন্ডা জেলার বাহুবন মাদার মাঝা গ্রামের রাকেশ (২৮) এবং সোরন ব্লকের রাজু মোহন (৩৭)।

এবছর এপ্রিল আর মে মাস জুড়ে তাঁরা প্রতিদিন টানা ১৫-১৭ ঘন্টা (সকাল ৯টা থেকে ভোররাত অবধি) অমানবিক পরিশ্রম করে গেছেন নিজেদের জীবনের কোন তোয়াক্কা না করেই। ভাইরাসের হাত থেকে যদিও বা হয়তো বাঁচা যায়, কিন্তু ৮৪০° তাপের ওই যে গনগনে হল্ক? সে যে জলজ্যান্ত মানুষকেও ছাই করে দিতে পারে এক নিমেষে! "কতটা গরম থাকে জানেন? ধরুন রাত্তিরবেলা আপনি চুল্লি বন্ধ করে দিলেন, কিন্তু ভেতরে কারও একটা তাজা লাশ রয়ে গে'ল। সকালে উঠৈ দেখবেন, একমুঠি ছাই ছাড়া আর কিস্যুটি পড়ে নেই," বলছিলেন হরিন্দর।

একটানা এই যে অক্লান্ত পরিশ্রম, এর মাঝে একটা মিনিটের জন্যও বিশ্রাম মেলে না তাঁদের। "[বিশ্রাম] নেবই বা কেমন করে? চা-জল গেলারই সময় জোটে না," বলছিলেন পাপ্পু, "বেশি নয়, এই ধরুন ঘন্টা দুয়েকের জন্যও যদি ছুটি নিই আমরা, সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে!"

অথচ তাঁদের কাউকেই স্থায়ী কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়নি। নিগম বোধ ঘাটের এই শ্মশানটি পৌরসভার আওতায় পড়লেও এটির সবরকমের দ্বায়িত্ব সামলায় বড়ি পঞ্চায়েত বৈশ্য বিশে আগরওয়াল নামের একটি দাতব্য সংগঠন (তবে স্থানীয় লোকজন এটিকে 'সংস্থা' বলেই ডাকেন)।

এই সংগঠনটি থেকে হরিন্দর প্রতি মাসে ১৬,০০০ করে টাকা পান। দৈনিক হিসেবে ৫৩৩ টাকা, অর্থাৎ দিনে ৮ জনের শেষকৃত্য করলে হিসেব মতো ৬৬ টাকা জোটে লাশপিছু। অন্য তিনজনের বেতন তো আরও কম, পাপ্পু পান মাসিক ১২,০০০ টাকা এবং রাজু মোহন ও রাকেশের কপালে জোটে মাত্র ৮,০০০। "সংস্থার বাবুরা আমাদের বলেছিলেন বটে যে বেতনটা বাড়াবেন, তবে কতটা বাড়াবেন সেটি কিন্তু একটিবারের জন্যও মুখ ফুটে বলেননি তেনারা," হরিন্দর জানালেন আমায়।

Left: Harinder Singh. Right: The cremation workers share a light moment while having dinner in a same room near the furnace
PHOTO • Amir Malik
Left: Harinder Singh. Right: The cremation workers share a light moment while having dinner in a same room near the furnace
PHOTO • Amir Malik

বাঁদিকে: হরিন্দর সিং। ডানদিকে : চুল্লির কাছেই অপরিসর একটা কামরায় রাতের খাবার খেতে খেতে অল্প একটু হাসিঠাট্টায় মেতেছিলেন রাজু মোহন, হরিন্দর, রাকেশ এবং পাপ্পু

তবে তাঁদের বেতন বাড়ানোর কোনও ইচ্ছে আদৌ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না 'সংস্থাটির', যদিও এদিকে শেষকৃত্যের খরচ তারা এক লাফে ১,৫০০ টাকা (যেটা অতিমারির আগে অবধি ১,০০০ টাকা ছিল) করে দিয়েছে দিব্যি। সংগঠনটির সভাপতি সুমন গুপ্তা জানালেন: "বেতনটা একবার বাড়িয়ে দিলে আর রক্ষে নেই! সারা বছর টানতে হবে সেটা।" তাই কর্মীদের "বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা" দিয়ে খুশি রাখেন তিনি।

কিন্তু ওই যে ছোট্টো অপরিসর কামরা যেখানে কর্মীরা রাতের খাবারটুকু খাচ্ছিলেন, এটাই কি সেই "বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার" উদাহরণ? সিএনজি চুল্লি থেকে মেরেকেটে মিটার পাঁচেক দূরত্বে থাকা এই ঘরটি গরমকালে নিজেই যেন একটা চুল্লি হয়ে উঠেছে। পাপ্পু তাই বাধ্য হলেন বাইরে গিয়ে সবার জন্য ঠান্ডা পানীয় কিনে আনতে। "সুযোগ সুবিধার" ঠেলায় ৫০ টাকারও বেশি খসে গেল তাঁর – অর্থাৎ সেদিন একটা শরীর পোড়ানোর শ্রমের মূল্য।

একটি শবদেহ জ্বলেপুড়ে ছাই হতে ১৪ কিলো সিএনজি লাগে, এমনটাই আমায় বুঝিয়ে বলেছিলেন পাপ্পু: "সক্কালবেলা প্রথম যে লাশটা আসে, তাকে পোড়াতে কতটা গ্যাস লাগে জানেন? রান্নাঘরের ওই যে সিলিন্ডারগুলো? ওরকম দু-দুটো সিলিন্ডারের সমান গ্যাস খরচা হয়। পরের দেহগুলো অবশ্যি একটা কি খান দেড়েক সিলিন্ডারেই হয়ে যায়।" এপ্রিল মাসে ৫৪৩ জন মানুষের শেষযাত্রার সঙ্গী ছিল নিগম বোধের ওই সিএনজি চুল্লিগুলো, জানালেন গুপ্তা, তাই গ্যাসের পিছনে সারা মাসে ৩,২৬,৯৬০ টাকা খরচা হয়েছিল সংস্থার।

মাঝেমাঝেই চুল্লির দরজা খুলে একটি লম্বা একটা লাঠি দিয়ে কর্মীরা জ্বলন্ত দেহগুলিকে ঠেলে ঠেলে চুল্লির আরও গভীরে ঢুকিয়ে দেন, খানিকটা হলেও এতে সময়টা বাঁচে দহনের। "এমনটা না করলে এক একটা লাশ জ্বলতেই তো ২-৩ ঘন্টা কাবার হয়ে যাবে," জানালেন হরিন্দর, "পুরো ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই ভালো। এছাড়া গ্যাসও বাঁচে, তাই সাত-তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে নিই আমরা। নয়ত পুরো লোকসানটাই সংস্থার ঘাড়ের উপর দিয়ে যাবে।"

শ্মশানকর্মীরা জান দিয়ে লড়ছেন যাতে দাতব্য এই সংগঠনটির খরচাপাতি লাগামছাড়া না হয়ে পড়ে, অথচ আজ দুই বছর হতে চলল তাঁদের বেতন বাড়ানোর কথা সংগঠনটি ভুলক্রমেও মুখে আনেনি। "এখন যাদের সৎকার করছি বুঝলেন, তারা সব্বাই কোভিডে মারা গেছে। ভাবুন দেখি কতটা ঝুঁকি নিচ্ছি আমরা ক'জন?" স্বল্প বেতনে কাজ করার যে অসন্তোষ, সেটা স্পষ্টত ঝরে পড়ছিল পাপ্পুর কণ্ঠে। তাঁর স্বরে স্বর মেলালেন হরিন্দর: "কিছু বলতে গেলেই তো ওরা সেই এক ফাটা রেকর্ড চালিয়ে দেবে: 'দয়াভিক্ষার উপরে টিকে আছে সংস্থা, কিচ্ছুটি করার নেই।'" আক্ষরিক অর্থেই এই চারজনের জন্য সত্যি কিচ্ছুটি করা হয়নি।

Pappu (left) cuts bamboo into pieces (right) to set up a pyre inside the CNG furnace
PHOTO • Amir Malik
Pappu (left) cuts bamboo into pieces (right) to set up a pyre inside the CNG furnace
PHOTO • Amir Malik

২০১১ সাল থেকে নিগম বোধ ঘাটে কাজ করছেন পাপ্পু। ডানদিকে: তাঁর হাজারো কাজের মধ্যে একটি হল সিএনজি চুল্লির ভিতরে চিতা সাজানোর জন্য বাঁশ কেটে টুকরো টুকরো করা

এই কর্মীদের কেউই টিকার দুটো ডোজ পাননি। এবছর গোড়ার দিকে যখন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকা কর্মীদের টিকাকরণ চলছিল, তখন পাপ্পু ও হরিন্দর প্রথম ডোজটি পেয়েছিলেন। "দ্বিতীয় ডোজটা নেওয়া আর হল কই? সময়ই তো পেলাম না। শ্মশানের কাজের যা চাপ, তাতে আমার মরারই সময় নেই তো আর টিকা..." দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন পাপ্পু, "টিকাকরণ কেন্দ্র থেকে ফোন করেছিল বুঝলেন, আমি সোজা বলে দিলাম যে আমার জন্য বরাদ্দ ডোজটা যেন অন্য কাউকে দিয়ে দেয়।"

ব্যবহার করা পিপিই পোশাক ফেলার জন্য একটা মস্ত বড়ো ডাস্টবিন রাখা আছে শ্মশানের বাইরেটায়। অথচ সেদিন সক্কাল সক্কাল পাপ্পু আবিষ্কার করলেন যে গতকাল কোনও এক মৃতের পরিবারের লোকজন তাঁদের পিপিই পোশাক আশাক হলঘরের মধ্যেই ফেলে রেখে কেটে পড়েছেন। চুল্লির সামনেই একটা ছোট্টো ডাস্টবিন রয়েছে, সেখানেই কোনওমতে গুঁজে রাখা আছে ব্যবহৃত পোশাকগুলি। পাপ্পুর নিজের গায়ে না ছিল পিপিই, না ছিল হাতে দস্তানা, তবু তিনি বাধ্য হয়ে একটা লাঠি দিয়ে ওগুলো টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে এলেন।

চুল্লির কালান্তক ওই আঁচের সামনে পিপিই পরে থাকা যায় না, বুঝিয়ে বললেন তিনি, "পিপিইতে আগুন লেগে যায় যদি? লাশের পেট-টা যখন ফাটে, তখন চুল্লির ওই যে দরজাটা দেখছেন, ওটার ফাঁক দিয়ে তখন লকলক করে আগুন বেরিয়ে আসে। আর এ এমন প্যাঁচের পোশাক যে তাড়াতাড়ি গা থেকে খুলতেও তো পারব না। শেষে পুড়ে মরি আর কি!" সায় দিলেন হরিন্দরও, "এসব পিপিই টিপিই পরলে হাঁসফাঁস করি যেন, একটুও নিশ্বাস নিতে পারিনা। আরে বাবা, সাধ করে মরতে চাই নাকি আমি?"

করোনার বিরুদ্ধে তাঁদের রক্ষাকবচ বলতে শুধুমাত্র একটি করে মাস্ক, যদিও সেটাও যে কতটা সুরক্ষিত সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কারণ বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে তাঁরা একটা মাস্কই পরে আছেন। "আপনি বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা, ভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তা আমাদের সব্বার আছে, তবে সেদিকে পাত্তা দেওয়ার সুযোগটাই তো পাচ্ছি না। দেশের দশের এমন বিপদআপদের দিনে অন্য কিছু ভাবা যায়? বলছিলেন পাপ্পু। "মানুষজন এমনিতেই ভয়ে-দুঃখে আধমরা হয়ে আছে, এমন অবস্থায় তাদের ছাড়া যায় না।"

এর বাইরেও হরেক রকমের বিপদ ওঁত পেতে রয়েছে তাঁদের জন্য। একবার একটি শবদেহ সৎকার করার সময় পাপ্পুর বাঁ হাতের খানিকটা আগুনে ঝলসে গিয়েছিল, রয়ে গেছে ক্ষতের চিহ্ন। "খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। তবে কি-ই বা আর করার আছে।" আমি ওখানে যাওয়ার ঘন্টা দুই আগে একটা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন হরিন্দর। আমাকে বললেন, "চুল্লির দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎই হাত ফসকে সেটা ধড়াম করে হাঁটুতে এসে লাগল।"

Left: The dead body of a Covid-positive patient resting on a stretcher in the crematorium premises. Right: A body burning on an open pyre at Nigam Bodh Ghat
PHOTO • Amir Malik
Left: The dead body of a Covid-positive patient resting on a stretcher in the crematorium premises. Right: A body burning on an open pyre at Nigam Bodh Ghat
PHOTO • Amir Malik

বাঁদিকে: শ্মশান চত্বরে স্ট্রেচারের উপর শোয়ানো রয়েছে কোভিড-পজিটিভ এক রোগীর মৃতদেহ। ডানদিকে: নিগম বোধ ঘাটে খোলা আকাশের নীচে পুড়ছে কেউ একজন

"চুল্লির দরজাটা ভেঙে গেছিল, আমরা কোনওমতে বাঁশের একটা টুকরো দিয়ে ঠেকনা দিয়েছি," বলছিলেন রাজু মোহন। পাশেই মাথা নাড়ছিলেন হরিন্দর: "মিস্ত্রি ডেকে দরজাটা ঠিক করাতে হবে, বড়োবাবুকে বললে বলে যে, 'এই লকডাউনের মার্কেটে কাকে দিয়ে ঠিক করাবো ও'সব?' ধুস্, ওটা ওরকম জোড়াতালি দিয়েই পড়ে থাকবে, কেউ যে কিছুই করবে না তা আমরা বুঝে গেছি।"

নিদেনপক্ষে প্রাথমিক চিকিৎসার ন্যূনতম যে ব্যবস্থাটুকু থাকা দরকার, সেটাও জোটে না তাঁদের কপালে।

ইদানিং কিছু উটকো বিপদ এসে উপস্থিত হয়েছে। হাজারবার বারণ করা সত্ত্বেও চুল্লিতে ঢোকানোর আগে মরদেহে ঘি আর গঙ্গাজল ঢেলে একাকার করে দিচ্ছেন মৃতের আত্মীয়স্বজন। ফলত মেঝেটা এতটাই পিচ্ছিল হয়ে গেছে যে হুটহাট আছাড় খাওয়াটা আশ্চর্যের কিছুই নয়। "এটা যতটা অস্বাস্থ্যকর, ঠিক ততটাই বিপজ্জনক। আমরা তো এই ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছি, কিন্তু লোকজন মানতেই চাইছেন না কোনকিছু," জানালেন অমর সিংহ, ইনি দিল্লি পৌরসংস্থায় (এমসিডি) কর্মরত একজন আধিকারিক। অতিমারি চলাকালীন নিগম বোধ ঘাটের কাজকর্ম তদারকি করতে যে সাতজনকে নিয়োগ করেছে এমসিডি, তিনি তাঁদেরই একজন।

সন্ধ্যা ৮টার মধ্যে যেসব মৃতদেহ এসে পৌঁছয় তাদের দিনে দিনেই দাহ করা হয়, জানালেন সিং। তারপর কেউ এলে একা একা অপেক্ষা করতে হয় সারারাত, কাছেপিঠে কেউ থাকে না। ফলত অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া একলাফে অনেকটা বেড়ে যায়। তাঁর কথায়, "একখানা উপায় তো আছেই হাতের কাছে, চুল্লিগুলো না নিভিয়ে দিনরাত চালিয়ে রাখলেই হয়।"

এমনটা কি আদৌ সম্ভব? "কেন নয়?" সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন সিং, "ধরুন আপনি একটা তন্দুরে মুরগির মাংস রান্না করছেন, তা সেখানে মাংসের সঙ্গে সঙ্গে কি তন্দুরটাও পুড়ে যায়, বলুন? এখানকার চুল্লিগুলো হেসেখেলে ২৪ ঘন্টা জ্বলতে পারে, তবে ওই আর কি, সংস্থার লোকজন রাজি হবে না।" এই যুক্তিটা কিন্তু পাপ্পু মোটেও মানতে চান না, তিনি বলছিলেন, "আরে বাবা, সে যন্ত্র হোক বা মানুষ, মাঝে সাঝে একটু আধটু না জিরোলে সবাই অকেজো।"

তবে একটা বিষয়ে তাঁরা দুজনেই একমত, এই শ্মশানঘাটে পর্যাপ্ত সংখ্যায় কর্মীর বড়ো অভাব। "এখানকার কাজকর্ম এমনিতেই কোনওমতে টায়ে টায়ে চলছে, আজ এদের কারও যদি একটা কিছু হয়, তাহলে পুরোটাই হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়বে," বললেন সিং, সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্বীকার করলেন যে এখানকার কর্মীদের মধ্যে কারও বিমা করানো নেই। পাপ্পুর চিন্তাধারাটা খানিকটা আলাদা: "হরিন্দর বা আমার মতো আরও গুটিকয় কর্মী যদি থাকতো এখানে, তাহলে খাটাখাটনিটা একটু হলেও কমতো বই কি আমাদের, কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু আধটু জিরিয়েও নিতে পারতাম।"

Left: The large mural at the entrance of Nigam Bodh Ghat. Right: A garland of marigold flowers and dried bananas left on the ashes after cremation
PHOTO • Amir Malik
Left: The large mural at the entrance of Nigam Bodh Ghat. Right: A garland of marigold flowers and dried bananas left on the ashes after cremation
PHOTO • Amir Malik

বাঁদিকে: নিগম বোধ ঘাটের দোরগোড়ায় সেই প্রকাণ্ড দেওয়ালচিত্রটি। ডানদিকে: চিতাভস্মে সজ্জিত রয়েছে একছড়া শুকিয়ে যাওয়া কলা এবং গাঁদাফুলের মালা

গুপ্তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে এখানকার কোনও কর্মীর যদি হঠাৎই একটা কিছু হয়ে যায় তাহলে কী হবে। তার জবাবে উনি জানালেন, "কী আবার হবে? বাকি তিনজন সমস্ত কাজকর্ম সামলাবে। তাতেও না কুলোলে বাইরের থেকে দু-একটা মুনিশ ডেকে আনবো।" তাঁর মতে এখানকার কর্মীদের যথেষ্ট পরিমাণে সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। "আরে ভাই, এমন তো নয় যে আমরা এদের খেতে পরতে দিই না! যা যা লাগে সবকিছুই পায় ওরা। খাবারদাবার, ওষুধপত্র, স্যানিটাইজার সবই তো দিচ্ছি, আর কী দেব বলুন তো?"

সেদিন রাতের দিকে নিজের সহকর্মীদের সঙ্গে সেই ছোট্টো একফালি কামরাটায় নৈশাহার সারছিলেন হরিন্দর। ঠিক তার পাশেই একটা চুল্লিতে অচেনা কারও শরীর কুরে কুরে খাচ্ছিল আগুন। কর্মীরা ততক্ষণে গ্লাসে হুইস্কি সাজিয়ে ফেলেছেন। "[মদ] খেতে তো আমাদেরকে হবেই। এটা না থাকলে সটান মরে যাবো আমরা, দু-পাত্তর না চড়ালে এখানে টিকে থাকা অসম্ভব," বুঝিয়ে বললেন হরিন্দর।

অতিমারির আগে দিনে তিন পেগ (এক পেগে ৬০ মিলিলিটার মদ থাকে) হুইস্কি যথেষ্ট ছিল এঁদের জন্য। তবে আজকাল সারাটা দিন মাতাল না হয়ে থাকতে পারছেন না কেউই। "সক্কাল বেলা এক কোয়ার্টার, দুপুর দুপুর আরেকটা, সন্ধে নামতে না নামতেই ফের আবার একটা, তারপর রাত্তিরবেলা খাওয়া দাওয়া সেরে আরেকখান। কোনও কোনও দিন তো এমনও হয় যে বাড়ি ফিরেও মদ না খেয়ে থাকতে পারি না," বলছিলেন পাপ্পু। "বিশাল ভাগ্যি আমাদের বুঝলেন? এ ব্যাপারে সংস্থার লোকজন কিছু বলে তো না-ই, উল্টে রোজ আমাদের জন্য মদের বন্দোবস্ত করে দেয়," জানালেন হরিন্দর।

শয়ে শয়ে দেহ পোড়ানোর যে ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণা এবং শারীরিক কষ্ট, তার থেকে শ্মশানকর্মীদের মুক্তি দেয় মদ। "ওরাও লাশ, আমরাও লাশ, দিনের পর দিন এভাবে মুখ বুজে খাটাখাটনি করা, শরীর বলুন বা মন, কিচ্ছুটি আর ভালো থাকে না," বলছিলেন হরিন্দর। "একটা পেগ খেয়ে নেশাটা যেই না একটু চড়ে, ওমনি দেখতে পাই যে লাইন দিয়ে লাশগুলো অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ব্যাস, নেশা ফেশা সব নেমে যায়," পাশ থেকে বলে উঠলেন পাপ্পু। "ছাই, ধুলো, ধোঁয়া, গলার মধ্যে সবকিছু কেমন যেন দলা পাকিয়ে আটকে যায়, মদটা খেলে একটু অন্তত স্বস্তি পাওয়া যায় বুঝলেন।"

তবে স্বস্তির সে মুহূর্ত ছেড়ে চলে গেছে কবেই। পাপ্পু উঠে দাঁড়ালেন, সেই দুই 'ছোকরার' এবার সদগতি করতে হবে তো! "আমরাও কাঁদতে পারি গো। চোখে আমাদেরও জল আসে। বিশ্বাস করুন," ছলছলে দুচোখ মেলে কাতর কণ্ঠে বলছিলেন তিনি, "তবে বুকের খাঁচায় এই যে হৃদপিণ্ডটা রয়েছে না? এটাকে আঁকড়ে ধরেই তো বেঁচে থাকি আমরা।"

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Amir Malik

আমির মালিক একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক ও ২০২২ সালের পারি ফেলো।

Other stories by Amir Malik
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার (পারি) ভারতীয় ভাষাবিভাগ পারিভাষার কন্টেন্ট ম্যানেজার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল উত্তীর্ণ জশুয়া একজন বহুভাষিক কবি তথা অনুবাদক, শিল্প সমালোচক এবং সমাজকর্মী।

Other stories by Joshua Bodhinetra