বিবাহিতা কোনও নারীর স্বামী বা তাঁর পুত্রের উপর অল্পবয়সী এক সুন্দরী মেয়ের প্রভাব - এই নিয়েই জাঁতাপেষাইয়ের গান গেয়েছেন পুণের মুলশি তালুকের তিন মহিলা। তাঁদের চোখে রূপবতী সে নারী যেন তাঁদের সুখের পথে সবচয়ে বড়ো অন্তরায়

পিতৃতন্ত্র মানে শুধুই নারীর উপর চলতে থাকা অত্যাচারের সাতকাহন নয়, সমীকরণটা বরং নারী বনাম নারী হয়ে দাঁড়ায় শেষমেশ। নারীজীবনের প্রতিটা মুহূর্তে শিকল তুলে রাখে যে পিতৃতন্ত্র, আষ্টেপৃষ্ঠে তার শিকড়ে বাঁধা পড়ে গ্রামীণ জীবনের কাঠামো। জাঁতাপেষাইয়ের গানে উঠে আসে সেই নারীজীবনের বিবিধ অভিজ্ঞতা, যাপনের অলিগলি। যে সমাজ এক শিশুকন্যাকে আপদ বলে ভাবে, এই গানগুলির শিরায় শিরায় ফুটে ওঠে সে সমাজের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ। মেয়ে ও ছেলে একই বৃন্তে দুটি কুসুম হওয়া সত্ত্বেও কেন তাদের প্রতি সমাজের আচার ভিন্ন? নারী কেন পায় না তার মেহনতের দাম? ছন্দে ছন্দে এ সকল প্রশ্নই ঝলসে ওঠে এই সব গানে গানে। অথচ এই একই শিল্পরূপে দেখা যায় জীবনের ব্রহ্মসত্য হিসেবে উঠে আসছে বিয়েশাদি, বলা হচ্ছে যে নারী তার সুখের চাবিকাঠি খুঁজে পায় কেবল আলতা-সিঁদুরেই।

যে সাংস্কৃতিক রেওয়াজের ছত্রছায়ায় নারী যুগপৎ যৌথতায় বাঁধা পড়ে ও খান খান হয় নানান টুকরোয়, একাধারে বরণ করা ও শূলে চড়ানো হয় শ্রেণিতন্ত্রকে, গায়িকা ও শ্রোতার একটা গোটা প্রজন্মের হাতে একই সঙ্গে তুলে দেওয়া হয় শিকল ও শিকল-ভাঙার কল, সে রীতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে এই জাঁতাপেষাইয়ের গান। হ্যাঁ, এমনই একটি অদ্ভুত উদযাপনে একে অপরের সই ও ভগিনী হয়ে ওঠেন মহিলারা – অনন্য এ যাপনের রূপরেখা ফুটে ওঠে একাধিক গানে।

তবে নারীর সঙ্গে নারীর ঈর্ষাকাতর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঘিরেও জাঁতাপেষাইয়ের গান রয়েছে বটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই ঈর্ষার উৎস কোনও একজন পুরুষ – সম্পর্কে বর কিংবা ছেলে। যে নারীজীবন স্বীকৃতি খুঁজে ফেরে পরিবারের পুরুষদের নজরে, এ গানে প্রতিফলিত হয় নারীজীবনের দুর্বলতা – সে পুরুষ নারীর বাবা কিংবা ভাই, অথবা স্বামী ও ছেলে, এই গানগুলোয় ধরা পড়েছে তাদেরই কথা।

এই ওভিগুলিতে পরস্পরের সম্মুখীন দুই নারী। একজন বিবাহিত, সুতরাং সমাজের নজরে সম্ভ্রান্ত। অন্যজন অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী ও আইবুড়ি, এবং একাধারে সুন্দরী ও স্বাধীনচেতা হওয়ার কারণে সমাজ তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। দ্বিতীয় সে নারীর চরিত্র বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে একটি বহুল প্রচলিত মারাঠি প্রবাদ: "এক চরিত্রহীন নারীর কারণে ঘরের চালা থেকে ঝরে পড়া জল জমা হয় মেঝের উপর।" তার কুকীর্তি নাকি এমনই সীমাহীন যে: "জলভরা কলসি পলকে হয় ফাঁকা... কুয়োর জলে কাছিম ছেড়ে দিয়ে যায় সে।" অর্থাৎ অন্য এক নারীর সুখের সংসার ভাঙতে সে নাকি পটু – এমনতর দৃশ্যকল্পই ফুটে উঠেছে এই পংক্তিতে।

PHOTO • Antara Raman

'ছুঁড়ি যায় জলকে, পেয়ারা সে ছলকে যায় গো কল সি ভরে কানায় কানায়...মুখরা আমার ছেলে, আপসে যায় গো ঢলে, ঠুনকো ঠাট্টা গাঁথা বেনো পিপাসায়'

পরবর্তী ১৪টি ওভিতে ভরা-যৌবনা সে নারীর কীর্তিকলাপ তুলে ধরেছেন গায়িকা। এ যুবতীর লাস্যফাঁদে ফেঁসে যেতে পারেন তাঁর স্বামী, কথক সে ভয়েই অতিষ্ঠ। সুতরাং তাঁর রূপের মুখে ছাই দিতে কবি বলে উঠছেন: "কান খুলে রাখ শুনে যৌবন তোর, তার চে' হাজার দামি শাড়িখানা মোর," কিংবা "চুটকি আমার ততই দামি বয়স যত তোর।" গায়িকার ছেলে সেই যুবতীর সঙ্গে ইয়ারদোস্তি পাতাতে আকুল হয়ে পড়েছে, সে কথাও উঠে এসেছে দোহায়। নিজের ছেলেকে আদর করে 'রাঘু', অর্থাৎ টিয়াপাখি বলে শুধাচ্ছেন তিনি। পুত্রসন্তান কিংবা ছোটভাইকে বোঝাতে জাঁতাপেষাইয়ের একাধিক গানে ব্যবহৃত হয়েছে এই উপমাটি।

তবে শুরুর ১৭টি ওভির তুলনায় শেষের দুটি গীতিকবিতা এক্কেবারে আলাদা। হাজার একটা ভ্রান্তিবিলাসে বয়ে যাচ্ছে তাঁর ছেলের জীবন, তার থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন দোহার কথক। ফাঁদে আটকানো যায় না বা শিকলে বাঁধা যায় না এমন এক বাঘের সঙ্গে নিজের ছেলেকে তুলনা করার পাশাপাশি তিনি তোড়জোড় করছেন তার বিয়ের জন্য। ঘটা করে পুত্রবধুকে বরণ করার ব্যস্ততায় মেতে উঠেছেন গায়িকা। একাধারে যেমন শাশুড়ি-রূপে সমাজে পদোন্নতি হবে তাঁর, তেমনই যার মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে পারবেন এমন এক অল্পবয়সী নারীও আসবে সংসারে। হয়তো বা ছেলেকে তিনি বাঁধতে চান গতানুগতিক, বৈবাহিক ও পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে তথাকথিত এক অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার থেকে। কিংবা এমনও হতে পারে যে ছেলে যাতে বখে না যায়, সে কারণেই উদ্বিগ্ন মায়ের মন।

মূল মারাঠি এই ওভিগুলির অধিকাংশই শেষ হচ্ছে "না বাই" শব্দবন্ধটিতে, ফলত অনুপম এক কথোপকথনের আঙ্গিকে বাঁধা পড়ছে গানগুলি। ঠিক যেমনভাবে আমরা বলে উঠি "জানিস কী হয়েছিল?" জাঁতাপেষাইয়ে ব্যস্ত মহিলারা যেন একে অপরে সঙ্গে খোশ গল্প জুড়েছেন এই গানের মধ্যে দিয়ে।

এই ১৯টি ওভি যে তিনজন মিলে গেয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই পুণে জেলার মুলশি তালুকের মানুষ: নন্দগাঁও গ্রামের কুসুম সোনাওয়ানে ও শাহু কাম্বলে, এবং কোলাভাডে গ্রামের খড়কওয়াড়ি জনপদের তারা উভে। হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ, অর্থাৎ জাঁতাপেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পের দুই প্রতিষ্ঠাতার যে বাংলোবাড়িটি ছিল পুণেতে, সেই বাংলোরই বৈঠকখানায় এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ৫ই অক্টোবর।

তারা উভে, কুসুম সোনাওয়ানে ও শাহু কাম্বলের ক ণ্ঠে ওভিগুলি শুনুন

একচালা তার জলকে ঝরায়, শয়তানি তার অঙ্গে যে...
এ মেয়ে কেমন মেয়ে, মুখপুড়ি তিনসত্যি সে!

আলগা স্বভাব দুকান কাটা, অসভ্যতার নেইকো শেষ...
এই তো ছিল গাগর ভরা, ক্যামনে হল ফক্কা বেশ?

মুখরা সে মেয়ে তার ওঁছা বোলচাল, নেহাতই দুকান কাটা, বড্ডো বাচাল...
না জানি কী বলি সই ভেবে নাহি পাই, কুয়োতে কাছিম ছেড়ে চলে গেল হায়।

আইলো উড়ি ডাগর ছুঁড়ি, ঘরকে আমার রাতদিনে...
রাঘু রে আমার, সুখের কাহার, কাঠচাঁপা তার যৌবনে।

শোন শোন পেত্নি রে এইখানে দাঁড়া, না বলে দু'খান কথা পাবি নাকো ছাড়া...
কান খুলে রাখ শুনে যৌবন তোর, তার চে' হাজার দামি শাড়িখানা মোর।

ডাগর ডাগর মুখপুড়ি ওই পথের কাঁটা মোর...
চুটকি আমার ততই দামি বয়স যত তোর।

রাখ তোর নখরা, রাখ তোর রূপ... ছলাকলা ছেড়ে দিয়ে হয়ে যা রে চুপ...
আপসে যাবে রে বেড়ে বয়েসটা তোর, উড়বে হাজার মাছি মাথার উপর।

আমার সাথে বলছে কথা, তাতেও দেখি অসভ্যতা, বদনখানি রাখলি ঢেকে ব্রকেড শাড়ি দিয়ে...
এই যে আমার সুতলি শাড়ি, নেইকো চমক, নেইকো জরি, দেখ রে বিটি জমক তবু হাজার গুণের চেয়ে।

ভরা তোর যৌবন, ভারি তোর যৌবন, এ রূপ দেখাস কাকে ভেবে নাহি পাই...
সিঁদুরের অন্তে, এত ভেবেচিন্তে, কাজল ছোঁয়াস কেন সিঁথির তলায়?

ছলকে আঙার দিয়ে, শোন রে ডাগর মেয়ে, বড্ডো জালিম* তোর রূপের বাহার....
জলকে যে পথ বেয়ে ফিরিস গাগর নিয়ে, সেথায় তালিমখানা** আমার খোকার।

শোন রে চপলা মেয়ে, লাজের আঁচল দিয়ে রাখ ঢেকে রাখ তোর রূপের আনন্দ...
আমার ন'মাস জানে বংশী খোকার মনে জমেছে কেমনতর হেঁয়ালির গন্ধ।

ছুঁড়ি যায় জলকে, পেয়ারা সে ছলকে যায় গো কলসি ভরে কানায় কানায়...
মুখরা আমার ছেলে, আপসে যায় গো ঢলে, ঠুনকো ঠাট্টা গাঁথা বেনো পিপাসায়।

খালিখালি ঘুরঘুর, কীসের নেশায় চুর? ডাগর সে বিটি আসে অকাজে কুকাজে...
দড়ি ওই টাঙানো, গিরিমাটি রাঙানো, খোঁজে সে খোকার টুপি কাপড়ের মাঝে।

কুয়োতলা ছাড়িয়ে, মাঠঘাট মাড়িয়ে, ফুলকি সে মেয়ে ছোটে এঁদো ইঁদারায়...
হায় রে আমার বাবু, পিরিতি করেছে কাবু, এককোণে ঘাঁটি গাঁড়ে যেন সে সেপাই।

পাতকুয়ো কেঁদে মরে পিরিতির সনে, উড়কি সে মেয়ে ছোটে ইঁদারার পানে...
হায় রে আমার খোকা একলা জোয়ান, একঠায় বসে রয় যেন দারোয়ান।

ঘরের দুয়ার জানে সে মেয়ের ছায়া, শোনে না কিছুই সে তো বড্ডো বেহায়া...
"দূর হ রে মুখপুড়ি, খোকা নেই বাড়িতে!" কিছুতেই পারি না গো ছুঁড়িটারে মানাতে।

উঠোন কোণে সুয্যি গোনে খোকন বাবুর কুর্তি চার...
আঁটকুড়ি তোর ছায়ার নজর, যাক জ্বলে যাক রূপের ধার।

ঘোরাফেরা ইতিউতি, থাম্ রে চপলমতি,
সাজিয়ে বরণডালা তাড়াতাড়ি আন...
ছুটবে খোকার ঘোড়া, পানপাতা জোড়া জোড়া, বৌমা আমার সেতো আঁঝলা পরাণ।

চনমনে খোকা মোর, ফাঁদকাটা বাঘ,
রখু রে কী বলি তোরে? পিরিতি সোহাগ,
বিয়েশাদি গড় করি, দুচোখে হারায় ছুঁড়ি,
সাজিয়ে বরণডালা তাড়াতাড়ি আন...
ছুটবে খোকার ঘোড়া, সানাইয়ে সানাই জোড়া, বৌমা আমার সেতো পুণ্যি পরাণ।

*জালিম: নিষ্ঠুর

**তালিমখানা: কুস্তির আখড়া


PHOTO • Patrick Faucher

গায়িকা/পরিবেশক : তারাবাই উভে

গ্রাম : কোলাভাডে

জনপদ : খড়কওয়াড়ি

তালুক : মুলশি

জেলা : পুণে

জাতি : মারাঠা

বয়স : ৭০

সন্তান : তিনটি মেয়ে

পেশা : চাষি। এক একর জমিতে ধান, গম, রাগি এবং অল্প খানিক বাজরা চাষ করে তাঁর পরিবার।


PHOTO • Namita Waikar

গায়িকা/পরিবেশক : কুসুম সোনাওয়ানে

গ্রাম : নন্দগাঁও

তালুক : মুলশি

জেলা : পুণে

জাতি : নব-বৌদ্ধ

বয়স : ৭৩

সন্তান : দুটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে

পেশা : চাষি


PHOTO • Samyukta Shastri

গায়িকা/পরিবেশক : শাহু কাম্বলে

গ্রাম : নন্দগাঁও

তালুক : মুলশি

জেলা : পুণে

জাতি : নব-বৌদ্ধ

বয়স : ৭০ (জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের অগস্টে প্রয়াত হয়েছেন)

সন্তান : দুটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে

পেশা : চাষি

তারিখ : ১৯৯৯ সালের ৫ই অক্টোবর এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল


পোস্টার: উর্জা

হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ'র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

নমিতা ওয়াইকার লেখক, অনুবাদক এবং পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া, পারির নির্বাহী সম্পাদক। ২০১৮ সালে তাঁর ‘দ্য লং মার্চ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে।

Other stories by নমিতা ওয়াইকার
PARI GSP Team

পারি গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্ট টিম: আশা ওগালে (অনুবাদ); বার্নার্ড বেল (ডিজিটাইজেশন, ডেটাবেস নির্মাণ, রূপায়ণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ); জিতেন্দ্র মেইদ (প্রতিলিপি এবং অনুবাদ সহায়ক); নমিতা ওয়াইকার (প্রকল্প প্রধান এবং কিউরেশন); রজনী খলাদকর (ডেটা এন্ট্রি)

Other stories by PARI GSP Team
Illustration : Antara Raman

বেঙ্গালুরুর সৃষ্টি ইন্সটিটিউট অফ আর্ট, ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজির স্নাতক অন্তরা রামন একজন অঙ্কনশিল্পী এবং ওয়েবসাইট ডিজাইনার। সামাজিক প্রকরণ ও পৌরাণিকীতে উৎসাহী অন্তরা বিশ্বাস করেন যে শিল্প ও দৃশ্যকল্পের দুনিয়া আদতে মিথোজীবী।

Other stories by Antara Raman
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল করেছেন। বর্তমানে অনুবাদ সহায়ক হিসেবে জশুয়া পারি'র সঙ্গে কর্মরত। কবি, শিল্পলেখক, শিল্প সমালোচক তথা সমাজ কর্মী ইত্যাদি নানান ভূমিকায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

Other stories by Joshua Bodhinetra