এক চুল এদিক-ওদিক হওয়ার জো নেই।

আমনের চোখের দৃষ্টি স্থির, সরু সুচ অতি সাবধানে খরিদ্দারের কর্ণকূহরে প্রবেশ করাতে ব্যস্ত তাঁর দুটি হাত। সুচের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ থেকে নিস্তার পেতে আগা তুলোয় মোড়া। কাজ করছেন অতি ধীরে, যাতে কোনওভাবেই চামড়ায় না ফোটে, বা কানের পর্দায় আঘাত না লাগে। “কানের খোলটুকুই শুধু বার করে আনতে হবে,” মনে করাচ্ছেন তিনি।

বিস্তীর্ণ এক বটের ছায়ায় বসে পারি-র সঙ্গে কথা বলছেন তিনি, পাশে একটি কালো ব্যাগে তাঁর সরঞ্জাম— একটি সিলাই (সুচের মতো সরঞ্জাম), চিমটি, আর অনেকটা তুলো। ব্যাগে আরও আছে নানা জড়িবুটিতে তৈরি ভেষজ তেল, কান সাফাইয়ের জন্য তাঁর পারিবারিক গোপন ফর্মুলায় বিশেষভাবে তৈরি।

“সিলাই সে ম্যায়েল বাহার নিকালতে হ্যায় অউর চিমটি সে খিচ লেতে হ্যায় [সিলাই দিয়ে কানের ময়লা তুলি আর চিমটি দিয়ে টেনে বার করে আনি]।” কারও কানে খোল জমে ঢিপি হয়ে গেলে তবেই ভেষজ তেলটা ব্যবহার করা হয়। “আমরা সংক্রমণের চিকিৎসা করি না, শুধু কানের খোল আর চুলকুনি দূর করি।” কান চুলকোতে গিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করে আঘাত লেগে গেলে চুলকুনি সংক্রমণে পরিণত হতে পারে, জানাচ্ছেন তিনি।

PHOTO • Sanskriti Talwar
PHOTO • Sanskriti Talwar

বাঁদিকে: আমন সিংয়ের কাজের সরঞ্জাম হল একটি সিলাই, একটি চিমটি, তুলো, এবং জড়িবুটি দিয়ে বানানো বিশেষ ভেষজ তেল। এইসব একটা কালো ব্যাগে নিয়ে ঘোরেন তিনি। ডানদিকে: ভেষজ তেলটি তাঁর পরিবারের গোপন এক প্রণালী মেনে নানা জড়িবুটি দিয়ে তৈরি

PHOTO • Sanskriti Talwar
PHOTO • Sanskriti Talwar

বাঁদিকে: আমন সিং বলছেন এই লাল পাগড়িই তাঁর পরিচয়। ‘এইটা না পরি তবে লোকে বুঝবে কী করে যে কান সাফাইওয়ালা যাচ্ছে?’ ডানদিকে: অবশেষে এক খদ্দের পেয়েছেন আমন, অম্বা সিনেমায় দুপুরের শো দেখতে এসেছিলেন তিনি

১৬ বছর বয়সে বাবা বিজয় সিংয়ের কাছে কান সাফ করার বিদ্যায় হাতেখড়ি আমনের। হরিয়ানার রেওয়ারি জেলার রামপুরনিবাসী তাঁর পরিবারে এটা খানদানি কাম (পারিবারিক পেশা)। আমন কাজ শুরু করেছিলেন পরিবারের সদস্যদের কান পরিষ্কার দিয়েই। “প্রথম ছয় মাস আমরা সিলাই আর চিমটি দিয়ে বাড়ির লোকের কান পরিষ্কার করি। যখন দেখা যায় ঠিকঠাক কাজ হচ্ছে, কোনও আঘাত বা ব্যথা লাগছে না কারও, তবেই আমরা কাজ করতে বাড়ির বাইরে বেরোই,” জানাচ্ছেন তিনি।

তাঁর পরিবারে আমন তৃতীয় প্রজন্মের কান সাফাইওয়ালা। স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করলে জানালেন কখনও যাওয়া হয়নি, নিজেকে বললেন আঙ্গুঠা ছাপ (নিরক্ষর)। “প্যায়সা বড়ি চিজ নেহি হ্যায়। কিসি কা কান খরাব নেহি হোনা চাহিয়ে [টাকাটা বড়ো কথা নয়, কারও কান যেন না নষ্ট হয়],” যোগ করেন তিনি।

পরিবারের বাইরে তাঁর প্রথম খদ্দের ছিলেন হরিয়ানার গুরগাঁওয়ের মানুষ, সে সব দিল্লি আসার আগে। আমন জানাচ্ছেন, সাফাই-প্রতি ৫০ টাকা করে এক একদিনে ৫০০-৭০০ টাকা আয় হয়ে যেত তাঁর। “এখন দিনে টেনেটুনে ২০০ টাকা হয়।”

দিল্লির ড. মুখার্জী নগরের বাড়ি থেকে ঘিঞ্জি ট্র্যাফিক পেরিয়ে চার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের উপর অম্বা সিনেমায় আসেন তিনি। সেখানে পৌঁছে ভিড়ের মধ্যে চোখ বুলিয়ে সম্ভাব্য খদ্দেরের খোঁজ করেন, বিশেষ করে সকালের শো দেখতে আসা জনতার মধ্যে। জানালেন, তাঁর লাল পাগড়িটি হল কান সাফাইওয়ালার নিশান। “এইটা না পরলে লোকে বুঝবে কী করে যে কান সাফাইওয়ালা যাচ্ছে?”

PHOTO • Sanskriti Talwar
PHOTO • Sanskriti Talwar

বাঁদিকে: রোজ সকালে দিল্লির ড. মুখার্জী নগরের বান্দা বাহাদুর মার্গ ডিপোর নিকটবর্তী তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের উপর অম্বা সিনেমায় পৌঁছান তিনি। ডানদিকে: দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী কমলা নগর মার্কেটের অলিগলি ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন আমন

অম্বা সিনেমায় প্রায় ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকার পর মিনিট দশেকের দূরত্বে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ ক্যাম্পাস লাগোয়া কমলা নগর মার্কেটের গলিতে ঢুকে পড়েন আমন। পড়ুয়া, ব্যস্ত দোকানদার, আর কাজের অপেক্ষায় ঘুরে বেড়ানো দিনমজুরের ভিড়ে মার্কেট গিজগিজ করছে। আমনের কাছে এরা সবাই সম্ভাব্য খদ্দের, তাই তিনি জিজ্ঞেস করে বেড়ান, “ভাইয়া, কান সাফ করায়েঙ্গে? বস দেখ লেনে দিজিয়ে [দাদা, কান সাফ করবেন? একবার শুধু দেখে নিতে দিন]।”

সবাই ফিরিয়ে দেয় তাঁকে।

পৌনে ১২টা বেজে গেছে, দ্বিতীয় শোয়ের সময় হল, অতএব অম্বা সিনেমায় ফেরত যাওয়াই মনস্থ করেন তিনি। সেখানেই অবশেষে একজন খদ্দের পাওয়া গেল।

*****

অতিমারির সময় যখন কাজকর্ম একদম কমে গেছিল, আমন রসুন বেচতে শুরু করেন। “সকাল ৭:৩০-এর মধ্যে কাছের মান্ডিতে পৌঁছে যেতাম, পুরো এক হাজার টাকার কিংবা ৩৫-৪০ টাকা কিলোদরে রসুন কিনে ৫০ টাকা কিলোদরে বেচতাম। দিনে মোটামুটি ২৫০-৩০০ টাকা জমে যেত,” বলছেন আমন।

কিন্তু এখন আমনের আর রসুন বেচায় ফেরত যাওয়ার ইচ্ছে নয়, কারণ তাঁর কথায় ওটা বড়ো খাটনির কাজ, “রোজ সকালে মান্ডি যেতাম, রসুন কিনে, বাড়ি বয়ে আনতাম, সেগুলোকে ধুতাম। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা বেজে যেত।” কান সাফাইয়ের কাজে সন্ধে ৬টার মধ্যে বাড়ি ফিরে যান তিনি।

PHOTO • Sanskriti Talwar
PHOTO • Sanskriti Talwar

নিজের সরঞ্জাম দিয়ে খদ্দেরের কান সাফ করছেন আমন

পাঁচ বছর আগে দিল্লি আসার পর ড. মুখার্জী নগরের বান্দা বাহাদুর মার্গ ডিপোর কাছে ৩,৫০০ টাকা ভাড়ায় একটা ঘর নিয়েছিলেন আমন। স্ত্রী হীনা সিং, ৩১, এবং তিনজন ১০ বছরের কম বয়সি পুত্রসন্তান নেগি, দক্ষ, এবং সুহানকে নিয়ে সেখানেই এখনও থাকেন তিনি। বড়ো দুই ছেলে সরকারি স্কুলে পড়ে। তাদের বাবার আশা, গ্র্যাজুয়েট হলে সেলস্‌ম্যানের কাজ পাবে ছেলেরা, আর কান সাফাই করতে হবে না, কারণ “ইস কাম মে কোই ভ্যালু নেহি হ্যায়। না আদমি কি, না কাম কি। ইনকাম ভি নেহি হ্যায় [এই কাজে কোনও সম্মান নেই, কাজেরও না মানুষেরও না]।”

“কমলা নগর মার্কেটের গলিতে সব শ্রেণির মানুষ আসে। আমি যখন ওদের জিজ্ঞেস করি [তাঁরা কান সাফ করতে চান কিনা], সবাই বলে কোভিড হয়ে যাবে। তারপর বলে দরকার হলে ডাক্তারের কাছে যাবে,” বলছেন আমন।

“আমি আর কী বলব? আমি বলি, আচ্ছা, না হয় করিও না কান সাফাই।”

*****

২০২২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির আজাদপুরে বাইকে ধাক্কা মারে আমনকে। মুখে আর দুই হাতে আঘাত লেগেছিল। ডানহাতের বুড়ো আঙুলে জোর চোট লেগেছিল, এই কারণে কান সাফ করার কাজ খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

ভাগ্যক্রমে, আঘাতের ওষুধে কাজ হয়েছে। এখনও মাঝে মাঝে কান সাফাই করেন, তবে আরেকটু স্থায়ী উপার্জনের খোঁজে আজকাল দিল্লির নানা অনুষ্ঠানে ঢোল বাজাতে শুরু করেছেন, প্রতি খেপে ৫০০ টাকা নেন। এক মাস আগে এক শিশুকন্যা এসেছে আমন ও হীনার কোলে। জানালেন, পরিবারের ভরনপোষণের জন্য আরও খানিক কাজের খোঁজে আছেন।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Sanskriti Talwar

সংস্কৃতি তলওয়ার নয়া দিল্লি-ভিত্তিক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং ২০২৩ সালের পারি-এমএমএফ ফেলোশিপ প্রাপক রিপোর্টার।

Other stories by Sanskriti Talwar
Editor : Vishaka George

বিশাখা জর্জ পারি’র বরিষ্ঠ সম্পাদক। জীবিকা এবং পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করেন। পারি’র সোশ্যাল মিডিয়া কার্যকলাপ সামলানোর পাশাপাশি বিশাখা পারি-র প্রতিবেদনগুলি শ্রেণিকক্ষে পৌঁছানো এবং শিক্ষার্থীদের নিজেদের চারপাশের নানা সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষা বিভাগে কাজ করেন।

Other stories by বিশাখা জর্জ
Translator : Dyuti Mukherjee

দ্যুতি মুখার্জী কলকাতা নিবাসী অনুবাদক এবং প্রকাশনা ক্ষেত্রে কর্মরত একজন পেশাদার কর্মী।

Other stories by Dyuti Mukherjee