১৯৫৬ সালের দশেরার দিন ডঃ আম্বেদকর জনসমক্ষে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেন। গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্টের জন্য এই যুগান্তকারী ঘটনাটির কথা এবং বুদ্ধের গৃহত্যাগের কাহি নি গানের মাধ্যমে তুলে ধরলেন রাধাবাই বোরহাডে ও ওয়ালহাবাই তাখনকর

"বাবাসাহেব আম্বেদকরের জীবনকথা আর বৌদ্ধশাস্ত্রে আমার খুব আগ্রহ," বললেন রাধাবাই। বহু বছর কৃষিশ্রমিকের কাজ করেছেন তিনি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে যখন তাঁর সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়, তখন রাধাবাই একটা ছোট্ট মুদিখানা চালাচ্ছেন।

আমরা বীড জেলার মাজালগাঁও গ্রামে সেই সকল গায়ক-গীতিকারদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম যাঁরা জাঁতা পেষাইয়ের গীতি সংকলন গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রকল্পের ডেটাবেসে তাঁদের বিভিন্ন ওভি প্রদান করেছিলেন প্রায় দুই দশক আগে। (পড়ুন: মাজালগাঁওয়ের গান, মহৌয়ের স্মৃতি ।) রাধাবাই আগে গ্রামের দলিত পাড়া ভীম নগরের বাসিন্দা ছিলেন, তবে আমরা দেখা করতে যাওয়ার কয়েকমাস আগেই স্বামীর মৃত্যুর পর কাছেই মাজালগাঁও তালুকের সাভারগাঁওয়ে চলে যান তাঁর ননদের কাছে।

গৃহস্থালির যাবতীয় দায়িত্ব সামলানো, পেশায় গৃহিণী ওয়ালহাবাই তাখনকর আমাদের বলছিলেন, "বাবাসাহেব আম্বেদকরের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমার ভাই দলিত সমাজের কল্যাণের জন্য নিজের জীবন অর্পণ করেছে..."

রাধাবাইয়ের স্বামীর "খুব একটা আগ্রহ ছিল না এই সবে," তবে, "তিনি আমাকে ভ্রমণে উৎসাহ দেন। আমি ঔরঙ্গাবাদ গিয়েছিলাম অজন্তা আর ইলোরার (বৌদ্ধ) ভাস্কর্য দেখতে। বাবাসাহেবের জন্মস্থান মহৌ আর নাগপুরে তাঁর দীক্ষাভূমিতেও গিয়েছিলাম।"

প্রত্যেক বছর দশেরা উৎসবের শেষে বিজয়াদশমীর দিন সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষজন পাড়ি দেন নাগপুরের দীক্ষাভূমির পথে। এই উৎসব নবরাত্রির শেষে দশম দিনটিকে চিহ্নিত করে যেদিন অশুভের উপর শুভশক্তির জয় স্থাপিত হয়েছিল, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী দুর্গার শূলে মহিষাসুরের মৃত্যু হয়। মহাভারত অনুযায়ী এদিন অর্জুনের হাতে কৌরবদের পরাজয় ঘটে। আবার রামায়ণ অনুযায়ী এই দিন রামের হাতে রাবণের মৃত্যু হয়।

People gathering at Dikshabhumi
PHOTO • Sudarshan Sakharkar

প্রতি বছর দশেরার দিন হাজার হাজার দলিত মানুষজন পাড়ি দেন নাগপুরের দীক্ষাভূমির পথে। তাঁরা স্মরণ করেন সেই মহান দিনটিকে যেদিন ডঃ আম্বেদকর হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধম্মে দী ক্ষা নিয়েছিলেন । এই দিনটি আর্থসামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাক্ষী, সুবিচার ও সাম্যের একটি প্রতীকী জয়ধ্বনি

তবে মনগড়া কোনও কাল্পনিক যুদ্ধ নয়, বরং ভারতের ইতিহাসে অন্যতম একটি মাইলফলকের স্মরণে দলিত মানুষজন নাগপুরে সমবেত হন। এই নাগপুরেই ১৯৫৬ সালের ১৪ই অক্টোবর বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং তাঁর সঙ্গে লাখে লাখে মানুষ বৌদ্ধধম্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। দলিত সমাজ এই দিনটিকে মনে রেখেছে হিন্দুধর্মের অকথ্য বর্ণবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে ডঃ আম্বেদকরের যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে।

অ্যানাইলেশন অফ কাস্ট (১৯৩৬) গ্রন্থে বাবাসাহেব বলেছেন যে, " (হিন্দু) শাস্ত্রের দ্বারা অনুমোদিত বেশ কিছু ধর্মীয় সংস্কারের ফলাফলই আদতে জাতপাত।"

এই জাতীয় কুসংস্কারের নাগপাশ ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: "এই শাস্ত্রগুলিকে মানুষ কীভাবে মননে ধরেছে সেটাই মূল কথা। বুদ্ধ যে অবস্থানটি নিয়েছিলেন সেটা আমাদের দেখতেই হবে। দেখতে হবে সেই অবস্থানটি যেটি গুরু নানক নিয়েছিলেন। শাস্ত্রগুলিকে শুধু পরিত্যাগ করলেই চলবে না, জীবন থেকে এসব শাস্ত্রের প্রভুত্বকেও মুছে ফেলতে হবে, যেমনটা করেছিলেন বুদ্ধ ও নানক। সবাইকে বুকে এই সাহসটা রাখতেই হবে যাতে তারা হিন্দুদের সরাসরি বলতে পারে যে তাদের ধর্মে অশুভ অযৌক্তিক অমানবিক কী কী উপাদান রয়েছে – সেই সনাতন ধর্ম যেটি তাদের মধ্যে বর্ণবাদের মতো অমানবিক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। আপনারা পারবেন তো সেই সাহসটুকু দেখাতে?"

সংগ্রাম ও ত্যাগের গাথা

রাধাবাই বোরহাডে এবং ওয়ালহাবাই তাখনকর সাতটি ওভি গেয়েছেন গৌতম বুদ্ধ ও ডঃ আম্বেদকরের জীবন বিষয়ে। প্রথম দুটি গানে আমরা পাই রাজপ্রাসাদ, ধনসম্পত্তি ও ভোগবিলাসের জীবন ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের কথা। প্রথম ওভিটিতে রাধাবাই গেয়েছেন গৌতমের কথা যে তার পিতা শুদ্ধোদনের খেতে সোনার লাঙল ফেলে রেখে অরণ্যাভিমুখী হয়েছে। দ্বিতীয় ওভিতে বুদ্ধের মাতা মায়াবতীর দুঃখ প্রকাশ পেয়েছে, দুঃখের কারণ মায়াবতীর পুত্র নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করেছে।

PHOTO • Samyukta Shastri

বাড়ির দেওয়ালে বুদ্ধ ও বাবাসাহেবের ছবি থেকে তাঁদের প্রাতি রাধাবাই বোরহাডের তাঁর অসীম শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়

৩-৭ নং গানে আমরা শুনতে পাই ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর এবং বর্ণবাদী বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের কাহিনি। তৃতীয় ওভিটিতে রাধাবাই ভীমের জয়গান গাইছেন, তিনি বৌদ্ধধম্মকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন। আলো যেমন করে শুষে নেয় আঁধারকে, তার সঙ্গে তিনি তুলনা করেছেন হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে জাতপাতের বিষ ধুয়ে ফেলার পর্বটিকে। দৃশ্যকল্পে জ্যোৎস্না রাতে চন্দ্রালোকে আলোকিত হয়ে উঠছে তাঁর আঙিনা।

চতুর্থ ওভিতে দুজনের গলায় ফুটে উঠছে এক অদ্ভুত দৃশ্য। আয়না জড়ানো একটি সাঁজোয়া গাড়ি এসেছে, কিন্তু নির্ভীক ভীম প্রতীকী নিশান উড়িয়ে দিচ্ছেন। এই ওভিটিতে একটি অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থ আছে: সাঁজোয়া গাড়িটি বাবাসাহেবের মূল্যবোধ ও সাহসিকতার প্রতীক, যেটা তাঁর লড়াইয়ের মূল আধার। রূপকে বর্ণিত এই মূল্যবোধের আছে সেই অসীম সাহস ও শক্তি যা দিয়ে মানবিকতাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। সাঁজোয়া গাড়িতে লাগানো আয়নাটিও একটি প্রতীক, যা দিয়ে হিন্দুসমাজ তার নিজের মধ্যে জাতিবিদ্বেষী বীভৎসতা দেখতে পাবে। কিন্তু ভীম – ডঃ আম্বেদকর – কাউকে ভয় পান না। তিনি বুদ্ধি, পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার জোরে উড়িয়ে দেন মানবধর্মের বিজয়ধ্বজা। দুনিয়ায় কারও ক্ষমতা নেই তাঁকে মনুষ্যত্বের এই সংগ্রামে হারানোর – এটাই এই ওভিটির অন্তর্নিহিত বার্তা।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং বর্ণবাদের প্রাচীর ভেঙে ফেলা – এই চিন্তাধারাটিকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যায় পরের তিনটি দোহা। পঞ্চম ওভিতে দেখতে পাই যে একটি কামানগাড়ির লাগাম বলদের পিঠে লাগানো এবং ভীমরাওয়ের শ্বশুরমশাই একজন ব্রাহ্মণ। ভীমরাওয়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সবিতার জন্ম হয়েছিল একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে – এই দোহার ইঙ্গিত তারই দিকে।

রাধাবাই বোরহাডে এবং ওয়ালহাবাই তাখনকর ষষ্ঠ ও সপ্তম ওভি দুটি উৎসর্গ করেছেন সবিতা আম্বেদকরের প্রতি – গানে ফুটে উঠেছে সবিতার কোঁকড়া চুল এবং সেই চুলের বেণীতে বাঁধা ফিতের গল্প। নিজের ব্রাহ্মণ্যবর্ণের সমাজের মানুষদের ছেড়ে সবিতা বিয়ে করেছিলেন তাঁর প্রেমে মগ্ন দলিত ভীমরাওকে। বাবাসাহেব তাঁকে বিবাহের পর সসম্মানে নিয়ে যান নিজের কর্মক্ষেত্র দিল্লিতে।

সামগ্রিকভাবে এই দোহাগুলিতে উঠে এসেছে বর্ণাশ্রমের মতো নির্মম ব্যবস্থা এবং তার প্রতিবাদে সাম্যের দাবি। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে শোষিত নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ ওভির মর্মে মর্মে তাই মুখর হয়েছে।

ওগো মেয়ে, পথ চেয়ে, গল্প পাগল, শুদ্ধোদনের মাঠে সোনার লাঙল।
খোকা তার অবেলার গৌতমী হায়, ইটের প্রাসাদ ছেড়ে বনমালে ধায়।

মায়াবতী মাতা ওই দুয়োরানি আজ, গর্ভে বাঁধিয়াছিল ধম্ম সিরাজ।
ওগো মেয়ে, প্রেম চেয়ে, ছেড়ে গেছে ওই, বুদ্ধ বিশাখি তার কালচে আলোয়।

ওগো মেয়ে, রাত নিয়ে, উঠোনের চাঁদ জোছনে জাতক সাজে অমার নিষাদ।
আঙিনা ভারতী মম ভীমের ছোঁয়ায় মরাগাঙে তথাগত ধম্ম সাজায়।

আয়না জড়ানো চাকা, সাঁজোয়া সিপাই, ভীমবাবা বলে শোনো ভয় কোন নাই।
বুদ্ধ একলা নহে বুদ্ধ হাজার, ভীমেই ভারত গাঁথি, নিশান সবার।

বেহায়া কামানগাড়ি গরুর লাগাম ছাড়ি, ওই আসে, আসে ওই, ঝাঁঝরা বিদূর –
বামুন সে হল মোর ভীমের শ্বশুর।

শোনো গো বামুন মেয়ে, ফুলকি ফিতের চেয়ে খোঁপায় জড়ায়ে রেখো আলোনা কাপড়।
বাসিয়া তোমায় ভাল, মুছিয়া জাতের কালো, ভীমবাবা দিল্লিতে বাঁধিল বাসর।

শোনো গো বামুন বালা, কোঁকড়া চুলের ডালা ঝরায়ে খিদের কাঁখে হইয়ো মানুষ।

ছাড়িয়া বামুন পাড়া, ভীমেই ভারত জোড়া, সিঁদুরে মেঘের জ্বালা বুঝেছে ফানুস।


PHOTO • Samyukta Shastri

গায়িকাদ্বয় : রাধাবাই বোরহাডে এবং ওয়ালহাবাই তাখনকর

গ্রাম : মাজালগাঁও

জনপদ : ভীম নগর

তালুক : মাজালগাঁও

জেলা : বীড

পেশা : রাধাবাই বোরহাডে পেশায় ছিলেন কৃষিশ্রমিক, এখন একটি ছোট্ট মুদিখানা চালান। ওয়াল্হাবাই তাখনকর সংসারের দায়িত্বে থাকা গৃহিণী।

জাতি : নব বৌদ্ধ

তারিখ: ১৯৯৬ সালের ২রা এপ্রিল এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল। আলোকচিত্রগুলি নেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের ২রা এপ্রিলে।

পোস্টার: জ্যোতি শিনোলি

অনুবাদ : জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

নমিতা ওয়াইকার লেখক, অনুবাদক এবং পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া, পারির নির্বাহী সম্পাদক। ২০১৮ সালে তাঁর ‘দ্য লং মার্চ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে।

Other stories by নমিতা ওয়াইকার
PARI GSP Team

পারি গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্ট টিম: আশা ওগালে (অনুবাদ); বার্নার্ড বেল (ডিজিটাইজেশন, ডেটাবেস নির্মাণ, রূপায়ণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ); জিতেন্দ্র মেইদ (প্রতিলিপি এবং অনুবাদ সহায়ক); নমিতা ওয়াইকার (প্রকল্প প্রধান এবং কিউরেশন); রজনী খলাদকর (ডেটা এন্ট্রি)

Other stories by PARI GSP Team
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার (পারি) ভারতীয় ভাষাবিভাগ পারিভাষার কন্টেন্ট ম্যানেজার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল উত্তীর্ণ জশুয়া একজন বহুভাষিক কবি তথা অনুবাদক, শিল্প সমালোচক এবং সমাজকর্মী।

Other stories by Joshua Bodhinetra