পুণের শিরুর তালুকের দুই গায়িকার জাঁতাপেষাইয়ের এই ১৩টি গানের মধ্যে দিয়ে মনের ভেতর গোচর হয়ে ওঠে সীতার বনবাস ও স্বজন-হারানোর বিষাদ

চিবাইলে সুপারি যে শান্তিটা পাই , বঁধুয়া রামের নামে ক্লান্তি হারাই ,
'
রাম রাম ' বলি আমি গেরস্থ ক্ষণে , আত্মা আমার ভাসে সুখের কূজনে।

রামকে নিয়ে এই ওভিটি গেয়েছেন শিরুর তালুকের সাভিন্দানে গ্রামের বাসিন্দা রত্নাবাই পড়বাল। হৃদয়ে রামের ছবি নিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত ধীর চিত্তে হাজারটা সমস্যা পার করে যান। রামায়ণ ঘিরে রচিত ১৩টি ওভির এই গুচ্ছে ভক্তিমূলক যে তিনটি দোহা রয়েছে, এটি তার মধ্যে অন্যতম।

সোনুবাই মোটে ও রত্নাবাইয়ের যুগলবন্দির মধ্যে দিয়ে একে একে ফুটে উঠতে লাগল মহাকাব্যের দৃশ্যগুলি – একটিতে গোচর হয় রথে চেপে বাজারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আদর করে রামের কপাল থেকে ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছেন সীতা।

এর পরের অংশে আমাদের লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে যাচ্ছেন রত্নাবাই। সেখানে বানরসেনার সঙ্গে যুদ্ধে নেমে প্রাণ হারিয়েছেন ইন্দ্রজিৎ এবং রামের কাছে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর লিখিত প্রমাণ দাবি করছেন সুলোচনা। মেঘনাদের কাটা মুণ্ডু উঠোন জুড়ে গড়াগড়ি খাওয়া সত্ত্বেও সেটা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছেন না তিনি। যুদ্ধ মাত্রেই বিবদমান দুটি পক্ষেরই যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, অমোঘ সে সত্যিটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে এই দৃশ্যটি।

গানে গানে সীতার অরণ্যযাত্রার কথা শোনাতে লাগলেন সোনুবাই, জানালেন কেমন করে তাঁর কপালে কুঙ্কু (সিঁদুর) লেপ্টে একাকার। নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও সীতার কপালে জুটেছে বনবাস – ছেড়ে যাওয়া প্রিয়জন, ফেলে আসা প্রেম, একাকীত্ব, সব মিলিয়ে শারীরিক ও নৈতিক এই যৌথ যন্ত্রণাটাই যেন একমাত্র পাওনা তাঁর। রামের ছলছলে চোখ বিদায় জানাচ্ছে সীতাকে, ওদিকে তাঁর এ দুঃখকষ্টের জন্য রাবণকেই দোষী সাব্যস্ত করছেন গায়িকা।

"In such a forest, Sita, how could you sleep?" the singer asks
PHOTO • Antara Raman

গায়িকা জিজ্ঞেস করছেন: 'এমন গহন বনে বল দেখি সই, কী করে ঘুমায় সীতা একাকিনী ওই?'

জঙ্গলে নির্বাসিতা জানকী নিজের শাড়ি দিয়ে তাঁবু খাটিয়েছেন, ধরিত্রীই পালঙ্ক তাঁর, বালিশ হয়েছে এক টুকরো পাথর। এমন দুখের দিনে বনকুল ও বাবলা গাছই যেন তাঁর সই। ফাটা-ফাটা বাকল জড়ানো এই কাঁটাদার গাছগুলি সাধারণত বনভূমির এক্কেবারে গা-ঘেঁষে গজায়, এবং গ্রামীণ মহিলারা গানে-ছড়ায় নিজেদের পরিস্থিতির রূপক হিসেবে ব্যবহার করেন তাদের। ফুটে ওঠে সমাজের পটভূমিকায় নারীর অসম অবস্থান, ফুটে ওঠে সেই প্রতিকূলতা যার সঙ্গে আমরণ যুঝতে হয় তাঁদের।

রামায়ণের পুনর্কথনের মুখবন্ধে সি. রাজগোপালাচারি লিখেছেন: "সীতার যন্ত্রণা মোটেও রামায়ণের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না। আজও আমাদের মহিলাদের জীবন সেই দুঃখেরই হলফনামা।" অগ্নিপরীক্ষার দ্বারা সারা বিশ্বের সামনে নিজের সতীত্ব প্রমাণ করার পরেও সীতা নির্বাসিত হচ্ছেন অরণ্য মাঝে, রাজগোপালাচারির মতে এর থেকে স্পষ্টত উঠে আসে, "আমাদের সমাজে নারীর অনন্ত বিষাদ যা আদতে নির্বাক।"

রামায়ণ অনুযায়ী পঞ্চবটী অরণ্যে ১৪টা বছর বনবাসে কাটিয়েছিলেন সীতা, রাম ও লক্ষ্মণ। অনেকের মতে এটি অধুনা মহারাষ্ট্রের নাসিকের কাছে অবস্থিত। আজ গায়িকার কল্পনায় উত্তরাকাণ্ডে বর্ণিত সীতার একক বনযাপনের কথা ফুটে উঠেছে ছন্দে ছন্দে। যমজ দুই সন্তান লহু ও অঙ্কুসের (লব-কুশ) জন্য ঘুমপাড়ানি গান গাইছেন সীতা। "ছাড়িয়া পঞ্চবটি আইল রে ছোঁড়া দুটি" লাইনটিতে বর্ণিত রয়েছে এদেরই কথা।

শেষের তিনটি ওভিতে ফুটে উঠেছে সীতা ও রামের সন্তানের প্রতি ভক্তি ও বাৎসল্য। গায়িকারা বলছেন কেমন করে গোধূলি বেলায় লব-কুশ স্নান করতে আসে গোদাবরী নদীর পবিত্রতম স্থান রামকুণ্ডের তীরে। হিন্দুদের অটুট বিশ্বাস যে অযোধ্যা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে এই স্থানেই স্নান করতে আসতেন রামচন্দ্র।

পুরাণ বর্ণিত পুরুষোত্তম রামের পাদপদ্মে আরাধনার পাশাপাশি তাঁর দুর্ব্যবহারের প্রতি অবলীলায় প্রশ্নবান নিক্ষেপ করছেন রত্নাবাই পড়বাল এবং সোনুবাই মোটে। শুধু সীতা নন, সুলোচনার কষ্ট ও প্রণয়ের কথাও তুলে ধরছেন তাঁরা, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন যে যুদ্ধাভিমুখে ধাবিত বিবদমান দুই পক্ষেরই মহিলাদের কপালে আজীবন জ্বালা-যন্ত্রণা বই আর কিছুই জোটে না – তা সে পৌরাণিক পটভূমি হোক বা বাস্তব জীবনের মাটি।

রত্নাবাই পড়বাল ও সোনুবাই মোটের কণ্ঠে ওভিগুলি শুনুন


রাম বলি রাম আমার গলায় মন্ত্র-তাবিজ বান্ধা তার,
কেউ জানে না গলায় আমার দুলছে রামের চন্দ্রহার।

সে জন বড়ই সুজন বঁধু, পথ চলে মোর সঙ্গে যে,
বানাইলা রাম হিয়ার মাঝে একচালা ঘর বাংলো সে।

চিবাইলা সুপারি যে শান্তিটা পাই, বঁধুয়া রামের নামে ক্লান্তি হারাই,
'রাম রাম' বলি আমি গেরস্থ ক্ষণে, আত্মা আমার ভাসে সুখের কূজনে।

হায় রে জমেছে ঘাম রামের মাথায়, সে ঘাম মুছিলা সীতা খুঁটের ডগায়,
যেমনে বাজার দিয়া ছোটে রথখানি, "নজর কে দেয় শুনি?" বলে ওঠে বনি।

ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরে, দুখী রঘুবীর, সে ঘাম মুছিলা সীতা, বড়োই অথির,
"বলো দেখি রামরায় প্রিয়সখা মোর, কে দেয় কে দেয় শুনি বেজেড়া* নজর?"

* * *

মারা গেছে মেঘনাদ, মাথাখানি তার, উঠানে গড়ায় দেখো এপার ওপার,
সাবিত্রী সুলোচনা মানিতে না চায়, কাগজে লিখিয়া দিবে মোর রামরায়।

বনবাসে চলে বধু, সীমন্ত তার, কুঙ্কু সিঁদুর ঘেঁটে হ'ল একাকার,
দূর থেকে দেখে তারে রাজা রঘুবীর, আঁখির আগল ভেঙে হইলা অথির।

বনবাসে চলে বধু, গাভী কাটে পথ,
কে দায় কে দায় নিবে? রাবণ আপদ!

কাঁটা কাঁটা শির বাবলা সখীর, কাঁদিতেছে কোন জন?
শিয়াকুলে তার মন্দ রাজার মান ভাঙে কোজাগর।

এমন আরণ্যকে লোরি কেবা গায়, ঘুমপাড়ানির সুরে বনানী জাগায়?
কহে সীতা, "লব-কুশ, দুই ছানা মোর, কুঁকড়ে ঘুমায় দেখো হিয়ার ভিতর।"

গহীন বনানী ঘন, পাথুরে বালিশ,
কেমনে ঘুমায় সীতা না করে নালিশ?

রুখাশুখা জঙ্গলে আলতাসি ওই
টাঙায়ে শাড়ির তাঁবু জানকী ঘুমোয়।

*  *  *

জানকী রানির পাটে, রামকুণ্ডের ঘাটে, জানো কি কাহার তরে চড়িলা আবির?
ছাড়িয়া পঞ্চবটী আইল রে ছোঁড়া দুটি, চকিত গাহন তরে হইলা অধীর।

জানকী রানির সুখে, রামকুণ্ডের বুকে, জানো কি কাহার তরে চড়িলা সুপারি?
সন্ধে নামিলা হায়, লব-কুশ দুই ভাই, আসিছে সিনান** তরে সাত-তাড়াতাড়ি।

ভেজা ভেজা ধুতি দুই, ভাঁজ করে রাখা হুই রামকুণ্ডের তীরে সাঁঝলা বেলায়,
লহু আর অঙ্কুস, মন করে উসখুস, দেখো রে পরাণ সুখে ডুবকি লাগায়।

* বেজেড়া: বিদঘুটে (বাঁকুড়া জেলার কথ্য ভাষা)
** সিনান: স্নান (বাঁকুড়া জেলার কথ্য ভাষা)


Performer/Singer: Sonubai Mote

Village: Savindane

Taluka: Shirur

District: Pune

Occupation: Farmer and homemaker

Caste: Maratha
PHOTO • Samyukta Shastri

পরিবেশিকা/গায়িকা : সোনুবাই মোটে

গ্রাম : সাভিন্দানে

তালুক : শিরুর

জেলা : পুণে

পেশা : চাষি ও গৃহিণী

জাতি : মারাঠা


পরিবেশিকা/গায়িকা : রত্নাবাই পড়বাল

গ্রাম : সাভিন্দানে

তালুক : শিরুর

জেলা : পুণে

পেশা : চাষি ও গৃহিণী

জাতি : মারাঠা

তারিখ : ১৯৯৫ সালের ১৩ই ডিসেম্বর এই গানগুলি প্রথমবার রেকর্ড করা হয়েছিল

পোস্টার: উর্জা

হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ'র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Namita Waikar is a writer, translator and Managing Editor at the People's Archive of Rural India. She is the author of the novel 'The Long March', published in 2018.

Other stories by Namita Waikar
PARI GSP Team

PARI Grindmill Songs Project Team: Asha Ogale (translation); Bernard Bel (digitisation, database design, development and maintenance); Jitendra Maid (transcription, translation assistance); Namita Waikar (project lead and curation); Rajani Khaladkar (data entry).

Other stories by PARI GSP Team
Illustration : Antara Raman

Antara Raman is an illustrator and website designer with an interest in social processes and mythological imagery. A graduate of the Srishti Institute of Art, Design and Technology, Bengaluru, she believes that the world of storytelling and illustration are symbiotic.

Other stories by Antara Raman
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra