ছোটবেলায় সবচাইতে মজা হত মায়ের কাছে 'রাজা সুপাড়কান্নো'-র গল্পটা শুনতে। গুজরাতি এই লোককথাটি এমন এক রাজাকে নিয়ে, যার কানদুটো নাকি হাতির মতো। পরে অবশ্য এই লোককাহিনীটির বেশ অনেকগুলোই সংস্করণ শুনেছি নানা মুখে। বাচ্চাদের জন্য একটা ছোটগল্পের সংকলন লিখেছিলেন গিজুভাই বাধেকা, সেটাতেও এই কাহিনীর একটি বর্ণন রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোককথা জড়ো করে সেগুলিকে নিজের মতো করে এই বইটিতে সাজিয়ে নিয়েছেন বাধেকা, যেমন গ্রিসের রাজা মাইদাস ও তার গাধার মতো কানের গল্পখানা। হয়তো বা সুপাড়কান্নোর কাহিনীটা ওই গল্পের আদলেই তৈরি, কে জানে!

গল্পটা খানিক এরকম: হঠাৎই একদিন জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলে এক রাজা। ক্লান্ত, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য, খিদের জ্বালা আর সহ্য না করতে পেরে একটা চড়ুই পাখির ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলে সে। ব্যাস, ওমনি নেমে আসে অভিশাপ, তার কানদুটো হাতির মতো হয়ে যায়। রাজপ্রাসাদে ফিরে আসার পর থেকে লজ্জায় সে এই ব্যাপারটা কাউকে বলতে পারে না। হরেক রকম পাগড়ি, মুকুট আর ওড়নার তলায় ঢেকে রাখতে শুরু করে কুলোপানা কানদুটো। কিন্তু বাধ সাধে তার উত্তরোত্তর বেড়ে চলা চুলদাড়ির জটাজুট, তাই একদিন সে বাধ্য হয় নাপিতকে ডেকে পাঠাতে।

রাজার কান দেখে তো নাপিত বাবাজির আক্কেল গুড়ুম। একে তো এমন হাতিমামার মতো কানের লজ্জা, তার উপর ভয়, পাছে তার প্রজাদের কাছে ফাঁস হয়ে যায় অভিশাপের আসল কারণটা, তাই রাজা বেশ গুরুগম্ভীর শাসানি দিয়ে রাখে নাপিতকে — কাউকে বলেছো তো মুণ্ডু ঘ্যাচাং! কিন্তু হায়, বকবক না করে নাপিত যায় কোথায়? তার কাজটাই সেরকম কিনা। তাই এতবড় কথা সে আর চেপে না রাখতে পেরে শেষটায় জঙ্গলে গিয়ে একটা গাছের সামনে সবটা পেট থেকে বার করে দেয় হুড়হুড় করে।

তারপর একদিন এক কাঠুরে সেই জঙ্গলে যায়, কাটবি তো কাট সেই গাছটাকেই সে সামনে পায় কাটার জন্য। কুড়ুলের কোপে রাজার গোপন কথাটা গান হয়ে বেরিয়ে আসে। এই মন্ত্রপূত কাঠ এমন এক কারিগরকে বেচে দেয় সেই কাঠুরে যে ঢাক-ঢোল এসব বানাতো। ওস্তাদ তো সেটা দিয়ে একটা জয়ঢাক বানিয়েই খালাস, কিন্তু ঢাকে কাঠি পড়লেই বেরিয়ে আসতে থাকে সেই গানটা। শেষমেশ বিপদে পড়ে এক গোবেচারা ঢাকি যে কিনা রাস্তায় রাস্তায় এই ঢাকটি বাজিয়ে ফিরছিল। ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে তাকে রাজার কাছে টেনে নিয়ে যায় প্রভুভক্ত পেয়াদার দল... যতদূর মনে পড়ে গল্পটা আরও বেশ খানিকটা লম্বা ছিল, তবে শেষে রাজা একদিন বুঝতে পারে যে, রাজ্যে পাখিদের জন্য একটা অভয়ারণ্য না বানিয়ে দিলে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কোনওদিনই হবে না।

প্রতিষ্ঠা পান্ডিয়ার কণ্ঠে মূল কবিতাটি গুজরাতি ভাষায় শুনুন

প্রতিষ্ঠা পান্ডিয়া কণ্ঠে কবিতাটির ইংরেজি সংস্করণটি শুনুন

রাজা হাত্তিমাতিমতিম

"রাজা হাত্তিমাতিমতিম,
রাজার সনাতনী ড্রিম,
রাজার কুলোর মতো কান,
রাজা মানুষ মেরে খান!"

চোপ্ চোপ্ চোপরাও! মাথা কেটে জুড়ে নাও!
কুনকি সে রাজা তার হাতিমামা কান...
বলেছো কি মরবে, হাওয়া বুঝে সরবে,
চুপিচুপি আড়ি পাতে রাজা ভগবান।

"রাজা হাত্তিমাতিমতিম,
রাজার সনাতনী ড্রিম,
রাজার জাম্বো দুটি কান,
রাজা মানুষ মেরে খান!"

কোথা সে শালিক ছানা? নেই তার আনাগোনা,
যুগীর যুগান্তরে খুঁটে খাওয়া পাখনা...
কথা বলা অপরাধ, গোপনে পেতেছে ফাঁদ
নারায়ণী রাজা মোর, থাক্ তবে থাক্ না!
রণে বনে যন্তরে, ঝুপসি তেপান্তরে,
মুখরা দিনের বাসা আগুনের গন্ধ —
আঁটকুড়ি মালিকের, আকলাখি শালিকের
পালকে মেঘের খেলা এক্কেরে বন্ধ।
হায় রে চড়ুই টুনি, কুনকি সে রাজা শুনি
পরিয়েছে হাতকড়া ফতোয়া খেলায় —
উড়কি বেলার নবী, বন্ধ বন্ধ সবই,
ভারত ভারত মা গো বিদায় বিদায়!

প্রশ্ন? সে থাক্ তবে, ডানাকাটা বাস্তবে,
বেহায়া শ্লোগান শেষে এঁটো ষড়যন্ত্র...
"কেক নহে, চাহি ব্রেড, ভেঙে ফ্যালো ব্যারিকেড"
কুনকি সে রাজা তার কানকাটা মন্ত্র।
জ্বলছে হাজার পাখি, আকাশ বলেছে ডাকি
"রক্তে ভাসিয়া গেছে রাজার দু'হাত।"
দমকে দমকে তারই আঁশটানি বল্লরী
বলিল, "সাক্ষী আমি, দুখের কিরাত।
শোনো শোনো পেতে ধান, বুলবুলি কলতান
কুনকি সে রাজা তার পেটের ভিতর...
বাঁকা হাতে ওঠে ঘি, লোকে বলে কত কী,
হয়েছে রাজার নাকি ভালুকের জ্বর।
দুচোখে কুলুপ এঁটে, মগজে আধার সেঁটে
মন-কি-বাতের সুরে ভক্ত মহান —
মানতে না চাইলে, যাই কোথা ভাই রে?
খ্যামটা সে রাজা তার কুলোপানা কান।"

"রাজা হাত্তিমাতিমতিম,
রাজার সনাতনী ড্রিম,
রাজার জাম্বো দুটি কান,
রাজা মানুষ মেরে খান!"

এ হেন পুণ্যভুঁয়ে ফিরিবো জন্ম লয়ে
গরিবের দাম যেথা চিরকালই সস্তা —
খিদে খিদে হাসি তার, দাঁড়িচাচা হাঁড়ি কার?
চাঁড়ালীর পেট কেটে দেবতার নাস্তা।
শুনিয়া ধরিলে হাঁফ সে কথা শোনাও পাপ,
আত্মা আহাম্মকি তুলিবে পটল...
খামোখা রন্ধ্র খুঁজে ডুবিসনে মুখ বুঁজে,
থাকিলে দেওয়াল সেথা ধরিবে ফাটল।
যাস কোথা? কেন যাস? সত্য খুঁজিতে চাস?
বাঁদিকে তাকিয়ে দ্যাখ নামকাটা গ্রাম...
আল্লাহ্, মারাং, শিবে, আলোনা হাজার জিভে
আঙারে আঙারে ঝরে আলতাসি ঘাম।
লাশকাটা দরবারে, ক্ষ্যামা দে, ছুটিস না রে,
বেকার গুনিস কেন আগাছার জান?
আয়লা বা আম্ফানে, এ কথা সবাই জানে
দামড়া সে রাজা তার হাতিমামা কান।

"রাজা হাত্তিমাতিমতিম,
রাজার সনাতনী ড্রিম,
রাজার কুলোর মতো কান,
রাজা মানুষ মেরে খান।"

আষাঢ়ে সোনার খাঁচা, মরতে মরতে বাঁচা,
বনপোড়া শালিকেরা হয়েছে যে জব্দ —
আজাদি আতান্তরে, ওদিকে তাকাস না রে,
শুনিস না কান পেতে ত্রিশূলের শব্দ।
জংধরা নিরবধি, তাও বা তাকাস যদি,
ভুলেও এসব কথা লিখিস না কাব্যে...
রক্তে গেরুয়া ছাপ, মহারাজা মাই-বাপ,
ভাবিস না লাশকাটা কোনদিনও থামবে।
আঁঝলা মাটির কোনে এইটা রাখিস মনে
হাত্তিমাতিম মোরা পিশাচের গান...
"মিত্রোঁ" বলার পরে মানুষ শিকার করে
হাভাতে সে রাজা তার কুলোপানা কান।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Pratishtha Pandya

Pratishtha Pandya is a Senior Editor at PARI where she leads PARI's creative writing section. She is also a member of the PARIBhasha team and translates and edits stories in Gujarati. Pratishtha is a published poet working in Gujarati and English.

Other stories by Pratishtha Pandya
Illustration : Labani Jangi

Labani Jangi is a 2020 PARI Fellow, and a self-taught painter based in West Bengal's Nadia district. She is working towards a PhD on labour migrations at the Centre for Studies in Social Sciences, Kolkata.

Other stories by Labani Jangi
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra