গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে হরেক কিসিমের গাড়িঘোড়া পাওয়া যায় বটে, কিন্তু এর জুড়ি মেলা সত্যিই ভার। লরিটা ফাঁকা হোক কিংবা মালপত্র খালাস করে ফেরার পথে, এই বাহনের জোরে চালক কিন্তু দিব্যি খানিক উপরি রোজগার করে নিতে পারেন। যে কেউ চড়তে পারে, আপনিও পারেন বইকি! তবে হাটবারের শেষে কাতারে কাতারে মানুষ যখন বাড়ি ফেরার জন্য গুঁতোগুঁতি করেন, তখন সেই ভিড়ের ফাঁক গলে এ গাড়িতে ঠাঁই পাওয়া সত্যিই কঠিন। তাছাড়া পেলেও যে শেষ অবধি চড়তে পারবেন, সেটাও হলফ করা বলা যায় না। সে  ধ্যাধধেড়ে গোবিন্দপুরই হোক, কিংবা পাণ্ডববর্জিত কোনও নাম-না-জানা গ্রাম, ভারতের যে প্রান্তেই যান না কেন, দেখবেন যে প্রতিটা লরির চালকের মধ্যেই বসত করে এক ট্যাক্সি-ড্রাইভারও! এক মিনিটের জন্যও যদি গাড়ির মালিকের নজর সরে, তক্ষুনি চালক মহাশয় ভোঁকাট্টা হয়ে যান উপরি টু-পাইসের ধান্দায়। তবে হ্যাঁ, ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলির জনজীবনে সারথির ভূমিকায় অবতীর্ণ হাওয়া এই মানুষেরা অপরিহার্য। গাড়িঘোড়ার নামগন্ধও যেখানে নেই, সেখানে দেবদূতের মতো দেখা দেন তাঁরা – একটুখানি ভাড়া গুনতে হয়, এই যা!

কোরাপুট, ওড়িশা। হাইওয়ের কাছেই একটা গ্রাম, আঁধার নামার আগেই বাড়ি ফেরার তাড়া। এ হেন অবস্থায় ঠিক কতজন যে হাঁচড়-পাঁচড় করে লরিতে উঠেছিলেন, সেটা ঠিক ঠাহর করতে পারিনি। ড্রাইভার বাবাজির হিসেব কিন্তু পাক্কা ছিল, পাইপয়সা হিসেব করে ভাড়া নিয়েছেন যে তিনি। কিন্তু নাহ্, তাঁর হিসেবটাও যে ষোল আনা ঠিক এটা বলা যাবে না, কারণ সবাই যে সমান ভাড়া দিয়েছেন তা নয়। উপরন্তু ভারি মালপত্র কিংবা ছাগল-মুরগি নিয়ে গেলে তার আবার ভাড়া আলাদা। অন্যদিকে আপনি যদি চালকের চেনাজানা কেউ কিংবা বয়স্ক মানুষ হন, তাহলে ভাড়ায় খানিক ছাড় পেলেও পেতে পারেন। হাইওয়ে ধরে চলতে চলতে তিনি যাত্রীদের তাঁদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে নামিয়ে দেন। তারপর সেখান থেকে তাঁরা হন্তদন্ত হয়ে মাঠঘাট জলাজঙ্গল পেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন। সঙ্গী হয় ক্রমশ জমাট বাঁধা অন্ধকার।

বেশিরভাগ যাত্রীর বাড়িই হাইওয়ে থেকে বহু যোজন দূরে, তাঁদের প্রায় সব্বাই ৩০ কিলোমিটার ঠেঙিয়ে হাটে গিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে কোরাপুটে লরিতে চেপে ২০ কিলোমিটার যেতে দু-পাঁচটাকার বেশি লাগত না। তবে হ্যাঁ, একেক জন চালক যেমন একেক রকম ভাড়া চাইতেন, তেমনই রাস্তাঘাট কতটা খারাপ, বাড়ি পৌঁছনোর জন্য আপনি কতখানি মরিয়া এবং সর্বোপরি চালক ও যাত্রীর মধ্যে দরদাম করার ব্যাপারে কে কতটা তুখোড় – এসবের উপর নির্ভর করতো ভাড়া। তবে এভাবে যাতায়াত করার ব্যাপারে আমার মুশকিলটা ছিল অন্য একটা ব্যাপারে। আমি যে ড্রাইভারের কেবিনের বদলে লরির পিছনে হাটুরে মানুষের সঙ্গেই চড়তে চাই, কিংবা নিদেনপক্ষে চালকের কেবিনের মাথায়, এটা বোঝাতে বোঝাতেই হাড়ে দুব্বোঘাস গজিয়ে যেত। অথচ, এভাবেই যে আমি হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছি!

PHOTO • P. Sainath

আমার দাবি শুনে তো চালক বাবাজি তাজ্জব বনে গেলেন, আসলে তিনি অত্যন্ত সরল সাদাসিধা মানুষ ছিলেন কিনা। "আমার কাছে কিন্তু হেব্বি একটা ইস্টিরিও আছে স্যার, ক্যাসেট প্লেয়ার আছে তো কেবিনে, মজাসে গানটান শুনতে শুনতে যেতে পারবেন," আমতা আমতা করছিলেন তিনি। আর সত্যিই তাঁর কাছে পাইরেটেড গানের দারুণ সব সংগ্রহ ছিল বটে। কেবিনে বসে যে আমি কখনও পাড়ি দিইনি তা নয়, অবশ্যই গেছি, এবং বেশ আরাম করেই গেছি। তবে এখানে আমার লক্ষ্যটা ছিল অন্য। এই যে কাতারে কাতারে গ্রামবাসী লরিতে চেপে ফিরছেন, হাটে তাঁদের কার কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা জানাটাই তো আমার কাজ। তাই চালকের কাছে পিড়াপিড়ি করলাম, বললাম যে দিনের আলো নিভে যাওয়ার আগে অন্তত দু-একটা ফটো তুলতেই হবে। হাটুরে মানুষজনের সঙ্গে আলাপ জমানোটাও তো দরকার। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলেন তিনি। শহুরে এই বাবুটা কেন এমন গাধার মতো ভিড়ের মাঝে গুঁতোগুঁতি করতে চান, এ ব্যাপারে তাঁর ধন্দ যেন কাটতেই চাইছিল না।

ব্যাপারটা হজম না হলেও আমাকে লরির পিছনে উঠতে তিনি অবশ্য সাহায্য করেছিলেন। আমায় টেনে তোলার জন্য সহযাত্রীদের হাজারটা হাত এগিয়ে এসেছিল। ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত সেই যে হাট-ফেরত মানুষের দল, তাঁরাও সাদাসিধা অমায়িক মানুষজন। মুরগি, ছাগল, বাছুরগুলোও যেন মুখিয়ে ছিল আলাপ জমাবে বলে। বেশ জমিয়ে আড্ডা হল সেদিন, যদিও চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়ার আগে গুটিকয়েক ফটো তুলেই ক্ষান্ত দিতে হয়েছিল!

১৯৯৫ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর , ‘ দ্য হিন্দু বিজনেসলাইন ' পত্রিকায় এই প্রতিবেদনটির একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra