ভুলচুক হলে সেটা ঠিক করার কোনও উপায় নেই তানুবাই গোভিলকরের। এই যে তিনি হাতে করে নকশদার কাঁথা নিঁখুতভাবে সেলাই করছেন, একচুল গড়বড় হওয়ার জো নেই কোথাও! একটু এদিক-ওদিক হলেই সব শেষ, ৯৭,৮০০টি সেলাইয়ের ফোঁড় খুলে আবার শুরু করতে হবে গোড়া থেকে!

"একটিবারের জন্যও যদি ভুল করে বসেন, তাহলে সে ভাকল [কাঁথা] আর ঠিক করা যাবে না," তাঁর কারিগরি যে কতটা নিখুঁত, ৭৪ বছরের রোগাসোগা এই মানুষটি সেটাই বোঝাচ্ছিলেন। অথচ ভাকল বুনতে গিয়ে একটিবারের জন্য হাত ফসকেছে, এমন কোনও মহিলার কথা মনেই করতে পারলেন না তানুবাই। "একডা শিকলা কি চুক হোৎ নহি [একবার হাত পেকে গেলে আর ভুলচুক হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না]," একমুখ হাসি নিয়ে জানালেন তিনি।

তবে নিজে থেকে তিনি কিন্তু এই গাণিতিক সূক্ষ্মতার জগতে পা রাখেননি। জীবন এবং রুজিরুটির তাগিদ তাঁকে বাধ্য করেছে হাতে সূচ-সুতো তুলে নিতে। "পোটানে শিকাভলা মালা [দারিদ্র শিখিয়েছে আমায়]," বলতে বলতে ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে ফিরে গেলেন তিনি, সেই যখন ১৫ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গেল তাঁর।

"ইস্কুলে পড়ার বয়স, অথচ পেন-পেন্সিলের বদলে হাতে একখান কাস্তে আর ছুঁচ। এটাই ভাবছেন তো যে ইস্কুলে গেলে কী আর এ জন্মে এসব শিখতে-টিখতে পারতাম?" স্পষ্ট সওয়াল তানুবাইয়ের। লোকে অবশ্য আদর করে তাঁকে 'আজি' (ঠাম্মা) বলেই ডাকে।

PHOTO • Sanket Jain

ভাকল বুনতে বসেছেন তানুবাই গোভিলকর, আদর করে সবাই তাঁকে আজি (ঠাম্মা) বলে ডাকে। কাঁথার দেহে ফুটে ওঠা সেলাইয়ের প্রত্যেকটি ফোঁড়ে লেখা আছে তাঁর দক্ষতার পরিচয়

PHOTO • Sanket Jain

শাড়ি থেকে কেটে নেওয়া ছোটো ছোটো টুকরো দিয়ে ঠিগল সেলাই করতে অপার সূক্ষ্মতার প্রয়োজন। উপরের পরতে সেগুলি একে একে বসিয়ে দেন তানুবাই, তৈরি হয় রঙচঙে একটি মানানসই নকশা। 'খুব ছোটো ভুলচুক হলেও ভাকলের গুণমান ও মেয়াদ, দুটোই কেঁচে যাবে'

আজি এবং তাঁর (প্রয়াত) স্বামী দুজনেই মারাঠা জাতির মানুষ। পেশায় খেতমজুর হওয়ায় নুন আনতে পান্তা তো ফুরোতই, এমনকি শীতকালে একটা ভাকল কিনে গায়ে দেওয়াটাও বাবুয়ানি ছিল তাঁদের কাছে। "তখনকার দিনে পাতি একটা কাঁথা কেনারও সাধ্যটুকুও ছিল না," স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি, "মেয়েরা তাই পুরানো শাড়ি-টাড়ি কেটে নিজেরাই ভাকল বুনে নিত।" অতএব সারাটাদিন অন্যের খেতে ঘাম ঝরানোর পর বাড়ি ফিরে শুরু হত নকশাদার কাঁথা সেলাইয়ের পালা।

তানুবাইয়ের কথায়: "শেতৎ খুরপা ঘেউঁ ভাঙ্গালেলা বারা, পান হা ধান্দা নাকো [এমন কাজের চেয়ে কাস্তে দিয়ে খেত-খামারে আগাছা উপড়ানোর কাজও ঢের ভালো]।" তার কারণ: একেকটা ভাকল বুনতে ১২০ দিন ধরে ৬০০ ঘণ্টা ছুঁচ চালাতে হয় সুক্ষ্মভাবে। থেকে থেকে হানা দেয় পিঠব্যথা আর চোখজ্বালা, সুতরাং ছুঁচের দরবারে জীবনপাত করার চেয়ে কাস্তে-হাঁসুলি চালানো যে সত্যিই হাজারগুণে ভালো, একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।

ঠিক এই কারণেই মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার জাম্ভালি গ্রামে ৪,৯৬৩ জন মানুষের বাস হওয়া সত্ত্বেও ভাকল বানানোর কাজে তানুবাই ছাড়া আর কারোরই দেখা মেলে না।

*****

ভাকল তৈরির প্রথম ধাপ: শাড়িগুলো গুছিয়ে রাখা, স্থানীয় মারাঠি জবানে যার নাম 'লেভা'। একটা ভাকল বুনতে কটা শাড়ি লাগবে সেটা নির্ভর করছে কারিগরের উপর। হাতে কতটা সময় আছে, মহিলারা সাধারণত সেটার ভিত্তিতেই স্থির করেন শাড়ির সংখ্যা। তানুবাই এখন যে ভাকলটা বুনছেন, নয়খানা সুতি বা নৌভরি (নয় গজ বহর যার) শাড়ি লাগবে সেটার জন্য।

শুরুতে একখান শাড়ি সমান সমান দুটো ভাগ করে মেঝেতে বিছিয়ে রাখেন, তার উপর একভাঁজ করা শাড়ি চাপান দুটো। সর্বসাকুল্যে আটটি শাড়ির চারটে পরত। এরপর আলগা অস্থায়ী সেলাইয়ের সাহায্যে জুড়ে দ্যান নয়খানা পরত, যাতে বুনিয়াদটা বেশ মজবুত হয়। "ভাকলের আসল সেলাই-ফোঁড়াই শুরু হলে এই [অস্থায়ী] সেলাইগুলো একে একে বাদ পড়ে যায়," বুঝিয়ে বললেন তিনি।

PHOTO • Sanket Jain
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিক: ভাকল বানাতে পুরানো শাড়ি লাগে, তবে সেগুলো মাপমাফিক কাটতে কিন্তু আজি কোনও ফিতে ব্যবহার করেন না; হাতের আন্দাজেই কাটাকুটি হয়ে যায় তাঁর। ডানদিকে: কাঁচি দিয়ে দুভাগ করা হয় শাড়ি, তারপর একে একে নয় পরত শাড়ি চাপে, যার নাম 'লেভা'

PHOTO • Sanket Jain

ভাকল বানাতে আজিকে সাহায্য করেন তাঁর নাতবৌ অশ্বিনী বিরাঞ্জে (বাঁদিকে)

দ্বিতীয় ধাপে খানকতক শাড়ি ছোটো ছোটো করে কেটে ঠিগল তৈরি করেন আজি। এবার পালা একে একে সেগুলি উপরের পরতে বসিয়ে রঙচঙে একটি মানানসই নকশা তৈরি করার। "এর জন্য আগে থেকে আঁকাজোকা বা চিন্তাভাবনা করার কোনও দরকার নেই," বললেন তিনি, "ঠিগলগুলো তোলো, আর সেলাই করে বসাও, ব্যাস।'

বাইরের পাড় থেকে এবার শুরু হয় ছুঁচের কাজ। সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম তাঁর সেলাইয়ের ফোঁড়গুলি একেকটা ৫ মিলিমিটারের বেশি নয় বটে, তবে সুতোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলে ভাকলের ওজন, বুনতে থাকা হাতে ভর করে ক্লান্তি। একটা কাঁথা বানাতে একাধিক ছুঁচ ও ৩০ নাটাই সাদা সুতির সুতো লাগে, অর্থাৎ ১৫০ মিটার (আনুমানিক ৪৯২ ফুট)। এই নাটাইগুলো কিনতে জাম্ভালি থেকে ১২ কিলোমিটার দূর ইচলকরঞ্জি শহরে যেতে হয় তাঁকে, একেকটার দাম পড়ে ১০ টাকা। "আগে ১০ টাকার সুতো দিয়েই একটা ভাকল হয়ে যেত, আর আজকে সেটা বাড়তে বাড়তে ৩০০ টাকায় এসে ঠেকেছে," আলগোছা একটু নালিশের সুর ছিল তাঁর কণ্ঠে।

সেলাইয়ের শেষ ফোঁড়টির আগে তিনি সযত্নে একটুকরো ভাকরি রেখে দেন ভাকলের পটে (পেটে) – কাঁথার দয়ায় শরীর গরম থাকবে, এ যেন তারই প্রতিদান। তানুবাইয়ের কথায়: "ত্যালা পান পোট আহে কী রে বালা [ভাকলেরও তো একখান উদর আছে রে বাচ্চা]।"

সব শেষে ভাকলের চার কোনায় ত্রিকোণ আকৃতির চারটে কাপড়ের টুকরো বসিয়ে দেওয়া হয়, এটি যে শুধু এখানকার কাঁথাশিল্পের একটি বৈশিষ্ট্য তা নয়, বিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও এই টুকরোগুলোর – কাঁথাটা বেজায় ভারি তো, এগুলো থাকলে তোলা-পাড়া করতে সুবিধা হয়। ৯টা শাড়ি, ২১৬ ঠিগল আর সেলাইয়ের ৯৭,৮০০টা ফোঁড় মিলিয়ে একেকটা ভাকলের ওজন দাঁড়ায় ৭ কিলো পর্যন্ত।

PHOTO • Sanket Jain
PHOTO • Sanket Jain

একেকটা কাঁথার পিছনে একাধিক ছুঁচ এবং সাদা গুলিসুতোর প্রায় ৩০টি করে নাটাই খরচা হয় তানুবাইয়ের

PHOTO • Sanket Jain
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: বাইরের পাড় থেকে শুরু হয় সূচের কাজ, যাতে ভাকলটি শক্তপোক্ত হয়। ডানদিকে: সেলাইয়ের শেষ ফোঁড়টির আগে তিনি সযত্নে একটুকরো ভাখরি রেখে দেন ভাকলের ভিতর – কাঁথার দয়ায় শরীর গরম থাকবে, এ যেন তারই প্রতিদান

সদ্য বানানো ভাকলটি দেখিয়ে আজি বললেন, "এই দেখুন, চার মাসের খাটনি মাত্তর দুই মাসে নামিয়ে দিয়েছি।" সূচিশিল্পের এই ৬.৮ ফুট বাই ৬.৫ ফুটের নমুনাটিকে অপার্থিব বললেও কম বলা হয়। বড়োছেলের পাকাবাড়ির বাইরে বসেছিলেন তানুবাই, সিমেন্টে বাঁধানো এই বারান্দাটিই তাঁর রোজকার কর্মক্ষেত্র। বহুযুগের সাধনার ফল হয়ে চারিদিকে ফুটে আছে রজনীগন্ধা, কুলিয়াস (কোলেয়ুস, একধরনের পাতাবাহার), হরেক কিসিমের গাছ-গাছড়া। একদা এই মেঝেটায় তিনি গোবরের ছড়া দিতেন হররোজ। শতসহস্র ঘণ্টা ধরে, অগুনতি ছিটকাপড় গেঁথে যে ভাকলগুলি বানিয়েছেন এতদিন, তার প্রথম সাক্ষী এই মেঝেটিই।

"একটা ভাকল কাচতে নিদেনপক্ষে চারজন তো লাগেই। এতটাই ভারি," বলে উঠলেন আজি। আরও একটা জিনিস জানা গেল তাঁর থেকে, বছরের তিনটে দিন নাকি এই কাঁথাগুলো ধোওয়া হয়: দশহরা, নভ্যাচি পুনম (সংক্রান্তির পরে প্রথম পূর্ণিমা) এবং গ্রামের বাৎসরিক মেলার দিন। "বেছে বেছে এই দিনগুলোই যে কেন তা বলতে পারব না, এটাই আমাদের পরম্পরা।"

সারাজীবনে ৩০টিরও অধিক ভাকল বুনেছেন এই মানুষটি, সূচিশিল্পের সূক্ষ্মতম এই কারিগরির পিছনে বয়ে গেছে প্রায় ১৮,০০০ ঘণ্টা। অথচ এটা তাঁর মূল পেশা নয়। দশকের পর দশক ধরে খেতমজুরির কাজ করেছেন তানুবাই, দিন গেলে ১০ ঘণ্টার হাড়ভাঙা খাটুনি ছিল তাঁর দারিদ্রের হলফনামা।

ওঁর মেয়ে সিন্ধু বিরাঞ্জের জবানে: "এত্ত খাটাখাটনি করা সত্ত্বেও একফোঁটা ক্লান্তি দেখিনে তাঁর শরীরে। একটুখানি ফাঁকা সময় পেলেই ভাকল বুনতে বসে যান।" আজ অবধি এ শিল্পকলায় হাতেখড়ি নেননি সিন্ধু। "গোটা জিন্দেগি চেষ্টা করলেও মায়ের জায়গায় পৌঁছতে পারব না আমরা। এই যে এখনও অবধি তাঁকে কাজ করতে দেখতে পাচ্ছি, এটাই যে পরম সৌভাগ্যি," পাশ থেকে ফুট কাটলেন বড়ো বৌমা লতা।

PHOTO • Sanket Jain

তানুবাইয়ের দাবি, উনি নাকি ঘুমন্ত অবস্থাতেও ছুঁচে সুতো পরিয়ে ফেলতে পারেন

PHOTO • Sanket Jain
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: নিঁখুতপানা এ ছুঁচ-সুতোর কাজে অচিরেই টনটন করতে থাকে হাত, কাঁধ, সবকিছু। 'হাতদুটা তো ইস্পাতের মতো হয়ে গেছে, ছুঁচ ধরতে আর কষ্ট হয় নাকো।' ডানদিকে: প্রত্যেকটি ফোঁড়ের মাঝে সমান সমান ফারাক, একেকটার দৈর্ঘ্য ৫ মিলিমিটার। ভাকলের পরতগুলো একে অপরের এঁটে থাকে এই সেলাইয়ের জন্য, ফোঁড়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলে কাঁথার ওজনটাও

তবে সিন্ধুর বৌমা অশ্বিনী যেমন দর্জির কাজ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তেমন ভাকল বানাতেও পটু। "আমি কিন্তু যন্ত্র দিয়েই কাঁথা বানাই। পুরনো কায়দায় বানাতে গেলে অনেক সময় লাগে, অত ধৈর্য্য আমার নেই," জানালেন তিনি। যেটা চেপে গেলেন সেটা হচ্ছে কাজটি করতে গিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি, পিঠব্যথা, চোখজ্বালা এবং আঙুলের ডগায় কালসিটে পড়ে যাওয়ার কথা।

এসবে বিশেষ পাত্তা দিতে নারাজ তানুবাই, হাসতে হাসতে বললেন: "ওসব আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। এই যে হাতদুটো দেখছেন? এগুলো ইস্পাতের, ছুঁচ-টুচে থোড়াই না ব্যথা লাগে আর?" কাজে ব্যাঘাত ঘটলে সুচারু কায়দায় ছুঁচগুলো বিনুনিতে গুঁজে রাখেন এই মানুষটি। "ছুঁচ তুলে রাখার এর চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর হয় না," ঠোঁট থেকে হাসিটা যেন মুছতেই চাইছিল না তাঁর।

নতুন প্রজন্ম কেন আর এই শিল্পে হাত পাকাতে চায় না এটা জিজ্ঞেস করতেই মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলেন: "চিন্ধ্যা ফাডাইলা কোন ইয়েনার? কিতি পগার দেনার? [শাড়িগুলো কাটাছেঁড়া করতে আসবেটা কে শুনি? তাও যদি ধরুন কেউ আসে, তাদের কতই বা আর মজুরি দেবেন?]"

অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা আজকাল বাজার থেকে সস্তার যন্ত্রনির্মিত কাঁথা কিনেই খুশি, বুঝিয়ে বললেন আজি: "দুঃখটা কোথায় জানেন? হাতেনাতে ভাকল বানাতে পারে, এমন মেয়েমানুষের সংখ্যা আজ হাতে গোনা। তাও বা যারা এই কারিগরির কদর করে, তারাও মেশিন দিয়ে সেলাই করিয়ে নেয়। আদতে যে কারণে ভাকল বানানো হত, সেটাই পাল্টে গেছে আজ, তবে কী জানেন? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই তো বদলায়।" আরও একটা জিনিসের উপর আলোকপাত করলেন তিনি, মহিলারা ইদানিং পুরোনো কাপড়ের বদলে নতুন শাড়ি দিয়েই কাঁথা বানাতে চান।

PHOTO • Sanket Jain
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: ঠিগলগুলো সেলাই করার আগে হাত দিয়েই মাপ নেওয়ার কাজ সেরে নেন তানুবাই। ডানদিকে: সারা জীবনে ৩০টিরও অধিক ভাকল বুনেছেন এই মানুষটি, সূচিশিল্পের সূক্ষ্মতম এই কারিগরির পিছনে বয়ে গেছে প্রায় ১৮,০০০ ঘণ্টা

সেলাইয়ের জগতে দুটি হাতের জোরেই লাখে লাখে ফোঁড় তোলা রয়েছে যাঁর নামে, সেই শিল্পীটি কিন্তু সময় থাকতে নাইক (ভাল নামটা মনে করতে পারলেন না আজি) নামে এক বন্ধুস্থানীয় পড়শির উপদেশ কানে তোলেননি বলে আজও আফসোস করে মরেন। "দর্জির কাজ শেখার জন্য বারবার বলত আমায়," স্মৃতি হাতড়ে বললেন, "যদি শিখে নিতাম গো, আজ আমার জীবন এক্কেবারে অন্য ছাঁদের হত।" তবে হ্যাঁ, পিঠভাঙা মেহনত করতে হয় বলে এই শিল্পের প্রতি তাঁর ভালোবাসায় টান পড়েছে, এমনটা আবার ভাববেন না যেন!

মজার বিষয়, তানুবাই কিন্তু আজ অবধি একটা ভাকলও বিক্রি করেননি। "কশালা রে মি ভিকু ভাকল, বালা [ওহে খোকা, কেনই বা আমি বেচব]? এসব আর কত টাকা দিয়েই বা লোকে কিনবে?"

*****

ভাকল বানানোর কোনও বাঁধাধরা সময় নেই বটে, তবে চাষবাসের যে আর্থসামাজিক ঋতুচক্র, তার ছন্দের সঙ্গে খানিকটা হলেও নাড়ির যোগ ছিল তার। ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের ভিতর মাঠেঘাটে যখন কাজ কম থাকে, ঠিক তখনই ছুঁচ-সুতো হাতে তুলে নেন মহিলারা। তানুবাইয়ের জবানে: "মনালা ইয়েইল তেহ্বা করায়চঁ [যখন ইচ্ছে হত তখন করতাম]।"

সে আজ বহুযুগ আগেকার কথা, তখন কোলাপুরের গান্ধীংলাজ তালুকের নৌকুড় গ্রামে থাকতেন তিনি। ষাটের দশকের শেষ অবধি প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চলেছিল কাঁথা বানানোর পরম্পরা। মহারাষ্ট্রের অন্যান্য এলাকায় ভাকলের অপর নাম 'গোধডী'। আজি বলে উঠলেন: "আগে আগে ভাকল বোনার কাজে হাত লাগাতে পড়শিদের ডেকে নিত মহিলারা, সারাদিন কাজ করলে তিন আনা [এ প্রকারের প্রাক-মেট্রিক মুদ্রার একক] মিলত।" ওঁর মতে জনা চারেক মহিলা যদি একটানা কাজ করে, তাহলে একেকটা ভাকল বানাতে দুমাসের বেশি লাগার কথা নয়।

PHOTO • Sanket Jain

বুনতে বুনতে ক্রমশই ওজনদার হয়ে ওঠে কাঁথাগুলো, তাই সেলাইয়ের শেষের দিকে ফোঁড়গুলো সবচেয়ে কঠিন

তখনকার দিনে শাড়ির দামও বেশ চড়া ছিল, মনে পড়ে তাঁর। একখান সুতির শাড়ির দাম ছিল ৮ টাকা, আর সেটা বাহারি হলে তো আর কথাই নেই, দামটা একলাফে ১৬ হয়ে যেত। হ্যাঁ, রাজকীয় ব্যাপারই বটে, বিশেষ করে যখন এক কিলো মুসুর ডালের দাম ছিল ১২ আনা আর সারাটাদিন খেত-খামারে ঘাম ঝরিয়ে ৬ আনা মজুরি পেতেন আজি। এখানে বলে রাখা ভাল যে ১৬ আনায় এক টাকা হত।

"বছরভর দুটো শাড়ি আর চারটে ঝম্পর (ব্লাউজ) কিনেই কাজ চালিয়ে দিতাম।" শাড়ি বস্তুটি যে কতটা দুষ্প্রাপ্য ছিল তা বোঝাই যাচ্ছে, ফলত ভাকলগুলো বেশ টেকসই না হলে চলত না। তাঁর বানানো কাঁথাগুলো কম করে ৩০ বছর তো টেকেই, সগর্বে জানালেন তানুবাই। বছরের পর বছর কঠোর সাধনায় এ শিল্পের মিহিস্য মিহি কায়দায় হাত না পাকালে এমনটা করা সত্যিই অসম্ভব।

ভালোমন্দ মিশিয়ে কাটছিল দিন, কিন্তু ১৯৭২-৭৩ সালে এসে উপস্থিত হয় ভয়াবহ এক খরা, নাভিশ্বাস উঠে যায় ২০০ লাখ মানুষের (মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় ৫৭ শতাংশ), গোভিলকর পরিবার বাধ্য হয় নৌকুড়ের পাট চুকিয়ে ৯০ কিমি দূর কোলাপুরের শিরোল তালুকের জাম্ভালি গ্রামে চলে আসতে। "ওইরকম একটা রাক্ষুসে খরার কথা মনে রাখাটাও পাপ। বলে বোঝাতে পারব না কতটা ভয়ঙ্কর ছিল। দিনের পর দিন পেটে কিল মেরে ঘুমিয়েছি," বলতে গিয়ে চোখদুটি ছলছলিয়ে উঠল আজির।

"জাম্ভালিতে কিছু কাজের খোঁজ পেয়েছিল নৌকুড়ের এক বাসিন্দা। বেশি মাথা না খাটিয়ে গোটা গাঁটাই উঠে চলে এল," মনে করে বললেন তিনি। পরিযানের আগে রাস্তাঘাট বানানো আর পাথর ভাঙার কাজ করতেন তাঁর প্রয়াত স্বামী ধানাজি, মজুরির দায়ে নৌকুড় থেকে ১৬০ কিমি পথ ঠেঙিয়ে গোয়াও গেছেন কয়েকবার।

খরাত্রাণ প্রকল্পের আওতায় জাম্ভালিতে রাস্তা বানানোর কাজ শুরু করে সরকার, আজি সহ জনা চল্লিশেক মজুরি শ্রমিকের কাজে লেগে পড়েন। তানুবাইয়ের কথায়: "দিন গেলে ১২ ঘণ্টা খাটতে হত, মজুরি মোটে দেড় টাকা।" ঠিক এই সময় ওঁদের ডেকে পাঠান জাম্ভালির মোড়ল মহাশয়। ১৬ একরের একটা খামার ছিল তাঁর, সেখানে কাজ করলে দৈনিক ৩ টাকা মিলবে। ব্যাস, খেতমজুরির কাজে লেগে পড়েন তানুবাই। আনাজের মধ্যে চিনেবাদাম, জোয়ার, গম, ধান, এবং ফলের মধ্যে সবেদা, আম, আঙুর, বেদানা এবং আতা চাষ করতেন তিনি।

PHOTO • Sanket Jain
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: শেষবারের মতো চলছে আজির কাঁচি, প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে ভাকলখানা। ডানদিকে: ডান কাঁধে দু-দুবার অস্ত্রোপচার হয়েছে, যন্ত্রণা তাঁর নিত্যকার সাথী, তা সত্ত্বেও একটানা কাঁথা বানিয়ে চলেছেন তানুবাই

খেতমজুরির কাজে তিনটে দশক পার করে শেষে ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে সে জীবনে ইতি টানেন আজি। ততদিনে অবশ্য মজুরি বেড়ে দৈনিক ১৬০ টাকা হয়েছিল, তবে সেটা পাওয়ার জন্য ১০ ঘণ্টা করে খাটতে হত প্রতিদিন। "কোন্দাচা ধোন্ডা খাল্লা পান মুলানা কঢি মাগা থেওলো নহি [খাবারের বদলে ভুষি খেতাম, যাতে আমাদের বাচ্চাকাচ্চারা কষ্ট না পায়]," এভাবেই তাঁর যুগ যুগান্তরের দারিদ্র ভরা মেহনতি জীবনের কথা তুলে ধরলেন আজি। তবে এ হেন মাজাভাঙা খাটুনি আর ত্যাগ কিন্তু জলে যায়নি শেষমেশ। আজ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র প্রভাকর একটি সারের দোকান চালান পাশের শহর জয়সিংহপুরে, এবং জাম্ভালি গাঁয়েই একটি ব্যাংকে কাজ করেন ছোটো ছেলে বাপুসো।

কাজ ছাড়ার পর খুব বেশিদিন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেননি আজি, কদিন পরেই বিরক্ত হয়ে যান, তাই আবারও শুরু হয় খেতমজুরির পালা। তারপর, বছর তিনেক আগে বাড়িতে আছাড় খেয়ে মারাত্মক একটা চোট পান তিনি, চিরতরে শেষ হয়ে যায় মজুরি খাটার গল্প। "ছয়মাস পড়েছিলাম হাসপাতালে, ডান কাঁধটায় দু-দুটো অপারেশন করাতে হয়েছে, তা সত্ত্বেও ব্যথাটা পিছু ছাড়ছে না," বুঝিয়ে বললেন তানুবাই। তবে হ্যাঁ, এতকিছুর পরেও কিন্তু নাতি সম্পত বিরাঞ্জের জন্য একখান ভাকল বানাতে ছাড়েননি।

কাঁধের যন্ত্রণাটাকে পাত্তা না দিয়ে সকাল ৮টা বাজতে না বাজতেই বসে যান ছুঁচ-সুতো নিয়ে, সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে তাঁর শিল্পকর্ম, মাঝে কেবল বাঁদর তাড়াতে ওঠেন দু-একবার। বাইরে ভুট্টা শুকোতে দেওয়া আছে, ব্যাটাদের না ভাগালে চেটেপুটে সব সাফ করে দেবে যে! আজির জবানে: "হনুমানগুলোর সঙ্গে ভুট্টা ভাগাভাগি করে নিতে আমার কোনও আপত্তি নেই, তবে রুদ্রটা (ওঁর নাতি) যে বড্ডো ভালোবাসে মকাইদানা খেতে।" এই যে সূচিশিল্পের প্রতি তাঁর অপার আবেগ, দুই বৌমা না থাকলে এটা হয়ত ধরে রাখতে পারতেন না: "ওরা না থাকলে ঘরকন্নার কাজ সামলাতেই দিন বেরিয়ে যেত।"

৭৪ বছর বয়সেও ছুঁচ বাগিয়ে ভোজবাজী দেখান আজি, সেলাইয়ের একটা ফোঁড়ও এদিক-ওদিক হয় না কখনও। বয়েস বাড়ছে তো কী হয়েছে? দক্ষতায় ভাঁটা পড়েনি একরত্তি। "ত্যাত কায় বিসরণার, বালা? ত্যাত কায় বিদ্যা আহে? [ভোলার মতো আর আছেই বা কী এতে? এসব করতে থোড়াই না কোনও বিদ্যেবুদ্ধি লাগে?]" কণ্ঠভরা বিনয় নিয়ে সওয়াল করলেন তিনি।

তবে সব্বার জন্য একখান উপদেশ আছে তাঁর: "সে যেমনই চড়াই-উৎরাই আসুক না কেন জীবনে, নেহমি প্রামাণিক রাহাভা [সত্যের সাথে বেঁচে থাকো]।" একটা ভাকল ধরে রাখতে যেমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সেলাইয়ের প্রয়োজন, তাঁর পরিবারটিকে বেঁধে রাখতে ঠিক তেমনভাবেই আজি লড়ে গেছেন জীবনভর। "পুর্ণ আয়ুষ্য মি শিওয়ত গেলে [সারাটা জীবন কেটে গেল সেলাই করে]।"

PHOTO • Sanket Jain

নিত্য ১২ ঘণ্টা খেটে দুই মাসের মধ্যেই এই কাঁথাটি বানিয়ে ফেলেছেন তানুবাই

PHOTO • Sanket Jain

৬.৮ ফুট বাই ৬.৫ ফুটের এই ভাকলটির ওজন ৭ কিলো, এটি বানাতে লেগেছে ৯টি শাড়ি, ২১৬খানা ঠিগল ও সেলাইয়ের ৯৭,৮০০টি ফোঁড়

মৃণালিনী মুখার্জি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় লিখিত সংকেত জৈনের এই প্রতিবেদনটি গ্রামীণ কারিগরদের ঘিরে সৃষ্ট একটি সিরিজের অংশবিশেষ।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Reporter : Sanket Jain

Sanket Jain is a journalist based in Kolhapur, Maharashtra. He is a 2022 PARI Senior Fellow and a 2019 PARI Fellow.

Other stories by Sanket Jain
Editor : Sangeeta Menon

Sangeeta Menon is a Mumbai-based writer, editor and communications consultant.

Other stories by Sangeeta Menon
Photo Editor : Binaifer Bharucha

Binaifer Bharucha is a freelance photographer based in Mumbai, and Photo Editor at the People's Archive of Rural India.

Other stories by Binaifer Bharucha
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra